নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মাসউদুর রহমান, আব্বা আম্মা ডাকেন রাজন নামে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পারফর্মিং আর্টস-এর শিক্ষক। ফিল্মমেকিং, অভিনয়, পাবলিক স্পিকিং, প্যান্টোমাইম- এইসব বিষয় পড়াই। এর আগে স্কুলে মাস্টারি করতাম। শিক্ষকতা আমার খুব ভালোবাসার কাজ।

মাসউদুর রহমান রাজন

একজন মানুষ, শিক্ষক ও সবার আমি ছাত্র তবে সব শিক্ষকের পড়া আমি শিখি না।

মাসউদুর রহমান রাজন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলায় দুর্ভিক্ষ: যেভাবে ব্রিটিশরা নিজেদের ফায়দার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য গণহত্যার ব্যবস্থা করেছিলো

১১ ই মে, ২০২১ সকাল ১১:১৯

রাখি চক্রবর্তী
অনুবাদ: মাসউদুর রহমান রাজন



“ভারতীয়দের আমি ঘৃণা করি। এরা হলো জন্তু জানোয়ারের গোষ্ঠী যাদের জন্তু জানোয়ারের মতো একটা ধর্ম আছে। এই দুর্ভিক্ষ হয়েছে তাদের নিজেদের খরগোশের মতো বাচ্চা জন্ম দেয়ার ভুলের কারণে।”
-উইনস্টন চার্চিল
ব্রিটিশদের ছিল একটি নির্মম অর্থনৈতিক এজেন্ডা যা তারা ভারতে প্রয়োগ করার জন্য নিয়ে আসে এবং তাতে স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য বিন্দুমাত্র সহানুভূতির জায়গাও ছিল না। ব্রিটিশরাজের অধীনে ভারত অসংখ্য দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছে। তবে সবচেয়ে খারাপ আঘাতটি এসেছিল বাংলার উপরে। এর প্রথমটি হয়েছিল ১৭৭০ সালে, যার পরে আরো মারাত্মক দুর্ভিক্ষ হয় একাধারে ১৭৮৩, ১৮৬৬, ১৮৭৩, ১৮৯২, ১৮৯৭ সালে আর সবশেষ ১৯৪৩-৪৪-এ। ইতিপূর্বে, যখনই কোন দুর্ভিক্ষ এ অঞ্চলে আঘাত হানতো, এ দেশীয় শাসকেরা বড় ধরনের ক্ষতি ঠেকাতে খুব দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নিতেন। ব্রিটিশদের আগমনের পরে, বেশিরভাগ দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল ঠিক সময়ে বৃষ্টি না হওয়া, যার সাথে যুক্ত ছিল নিজেদের অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ব্রিটিশদের দ্বারা এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণ। এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতিকে পুষিয়ে নেয়ার জন্য তারা তেমন কিছুই করেনি। যদিও কিছু করে থাকে, তা হলো- দুর্ভিক্ষের ফলে কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার কারণে তাদের বিরক্ত হওয়ার কাজটি।
এসব দুর্ভিক্ষের প্রথমটি সংঘটিত হয়েছিল ১৭৭০ সালে এবং এর ফলাফল ভয়ানক নির্মম। এমন একটা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রাথমিক আলামতগুলো অবশ্য ১৭৬৯ সাল থেকেই দেখা দিচ্ছিলো আর এই দুর্ভিক্ষ স্থায়ী হয়েছিল ১৭৭৩ সাল পর্যন্ত। প্রায় ১০ মিলিয়ন লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিলো এই দুর্ভিক্ষ যে সংখ্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কারারুদ্ধ ইহুদিদের চেয়েও কয়েক মিলিয়ন বেশি। এ দুর্ভিক্ষ বাংলার এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো। জন ফিস্ক্, তার বই “The Unseen World”-এ লিখেছেন, “১৭৭০-এর বাংলার দুর্ভিক্ষ ছিলো চতুর্দশ শতাব্দীতে গোটা ইউরোপকে কাঁপিয়ে দেয়া Black Plague-এর চাইতে বেশি ভয়াবহ।” মুঘল শাসনামলে, কৃষকদেরকে তাদের মোট কৃষিফলনের ১০-১৫ শতাংশ রাজস্ব হিসেবে দিতে হতো। এই পরিমাণ একই সাথে শাসকগোষ্ঠির জন্য একটি সুবিধাজনক কোষাগার নিশ্চিত করতো এবং পাশাপাশি বিরূপ আবহাওয়ার কারণে পরবর্তী ফলনে যে কোন সমস্যা মোকাবেলায় কৃষকদের জন্য নিরাপত্তার জাল হিসেবে কাজ করতো। ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে এলাহাবাদ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো এবং তৎকালীন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের কাজটি গ্রহণ করলো। রাতারাতি এই রাজস্ব, ব্রিটিশরা যাতে কোন প্রকারের বিদ্রোহ না হয় সে জন্য একে কর না বলে রাজস্ব হিসেবে আখ্যায়িত করতে বাধ্য করলো, তা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেল। কৃষকরা এটা বুঝতেও পারলো না যে, তাদের টাকা হাতবদল হচ্ছে। এই অর্থ জমা হচ্ছে সম্রাটের কোষাগারে, তখনও এই বিশ্বাস নিয়েই তারা সেই রাজস্ব আদায় করেছিল।
ফসলের আংশিক ক্ষতি ভারতের কৃষক-জীবনের একটা নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। তাই এই উদ্বৃত্ত মজুত, যা রাজস্ব আদায়ের পরে কৃষকের ঘরে জমা থাকতো, তা ছিলো তাদের জীবনধারনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ক্রমবর্ধমান করারোপের ফলে, এই উদ্বৃত্ত মজুতে খুব দ্রুত ঘাটতি হতে লাগলো। ১৭৬৮ সালে যখন ফসল উৎপাদনে এমন আংশিক ক্ষতি হলো, সেই নিরাপত্তার জালটি তখন আর সক্রিয় ছিলো না। ১৭৬৯ সালে তেমন কোন বৃষ্টিই হলো না এবং এরই মধ্যে তীব্র খরার সমূহ আলামত দৃশ্যমান হতে শুরু করলো। দুর্ভিক্ষ প্রধানত সংঘটিত হলো পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে, পাশাপাশি উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড এবং বাংলাদেশও আক্রান্ত হলো। অবশ্যই বাংলায় এর আঘাতের পরিমাণ ছিল সর্বাধিক। এ অঞ্চলের বীরভূম এবং মুর্শিদাবাদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। হাজার হাজার মানুষ এসব অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছিল অন্নসংস্থানের আশায়, পরবর্তীতে অনাহারে মৃত্যুকেই তাদের বরণ করে নিতে হয়েছিলো। হাজার হাজার একর চাষযোগ্য জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। বিপুল পরিমাণ এলাকা জনমানবহীন হয়ে পড়লো। বিহারের তিরহুত, চম্পারান ও বেত্তিয়াহও একইভাবে আক্রান্ত হয়েছিল।
এর আগে, যখনই কোন দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা দেখা দিতো, ভারতীয় শাসকেরা সকল ধরনের কর ক্ষমা করে দিতেন এবং ক্ষতিপূরণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, যেমন পানি সেচের ব্যবস্থা করা। এসব করা হতো যাতে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকেরা যতটা সম্ভব এ দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে। ঊপনিবেশিক শাসকেরা দুর্ভিক্ষ সম্পর্কিত যে কোন ধরনের পূর্বাভাসকেই উপেক্ষা করে যাচ্ছিলো, যদিও মানুষের অনাহারে থাকার শুরু হয়েছিল ১৭৭০-এর শুরু থেকেই। এরপর মানুষ মারা যেতে শুরু করলো ১৭৭১ থেকে। সেই বছর কোম্পানি ভূমিকর বাড়িয়ে দিলো শতকরা ৬০ শতাংশ যাতে করে অনেক কৃষকের মৃত্যুর ফলে হওয়া ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়। অল্প কৃষক তাই ফসল উৎপাদনও কম, সঙ্গত কারণে রাজস্বের পরিমাণও কম। এভাবে যারা তখনো দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করেনি তাদেরকে দ্বিগুণ কর আদায় করতে হয়েছে যাতে এই রঙ্গ চলাকালীন ব্রিটিশ কোষাগার কোন ধরনের ক্ষতিস্বীকার না করে।
মুঘল শাসকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পর, ব্রিটিশরা সমগ্র ভারতে যে সব অর্থকরী ফসলের চাষ হবে সে সবের উপর কিছু নির্দেশনামা জারি করলো। এগুলো তারা বিদেশে রপ্তানি করার অভিপ্রায় করলো। এভাবে যে সকল কৃষকেরা সচরাচর ধান এবং সবজি উৎপাদন করতেন তাদেরকে বাধ্য করা হলো নীল, আফিম এবং এ ধরনের আরো সব পন্য উৎপাদন করতে যেগুলোর বাজার মূল্য তাদের কাছে উঁচু কিন্তু খাদ্যের অভাবে অনাহারে কাটানো এ জনগোষ্ঠীর জন্য তা কোন কাজেই আসবে না। দুর্ভিক্ষের জন্য খাদ্যশস্যের কোন মজুতই রাখা হয়নি। খরার যে প্রাকৃতিক কারণগুলো ছিলো সেগুলো নিতান্তই মামুলি ব্যাপার ছিল। সর্বব্যাপি এই ভয়াবহ ক্ষতিকর পরিণতির মূল কারণ ছিল মুনাফার প্রতি একদেশদর্শী মনোভাব। আক্রান্তদের জন্য কোন ধরনের সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বরং, উপরে যেমন বলা হয়েছে, রাজস্বের ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য করের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও মজার ব্যাপার হলো যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৭৭১ সালের মুনাফা ছিলো ১৭৬৮ সালের মুনাফার চেয়ে বেশি।


যদিও বাংলার অনাহারি জনসাধারণ তখনো এসব ব্যাপারে অবগত ছিলো না, তথাপি এটি ছিলো একরাশ দুর্ভিক্ষের প্রথমটি, যেগুলো সংঘটিত হয়েছিল নিছক অতিরিক্ত মুনাফার অভিপ্রায়ের কারণে, যা গ্রামাঞ্চলগুলোকে ছন্নছাড়া করে দিয়েছিলো। যদিও এই সব হত্যাকা- ছিলো ভয়াবহ, তবে ১৭৭১-এর পরে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিলো ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ যখন তিন মিলিয়ন লোক মারা যায় আর বাকিরা বেঁচে থাকার জন্য ঘাস আর মরা মানুষের মাংসকে অবলম্বন করেছিল।
উইনস্টন চার্চিল, মহান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যিনি পুরো ইউরোপকে হিটলারের মতো একটা দৈত্যের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, তিনি চলমান এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে, যা বাংলার জনগণকে গিলে খাচ্ছিলো, ভয়ংকর নির্বিকার মনোভাব প্রদর্শন করলেন। তিনি হঠাৎ করেই দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য প্রেরিত খাদ্য ও চিকিৎসা সেবার চালান পাঠিয়ে দিলেন ইউরোপে অবস্থান করা সৈনিকদের জন্য যাদের কাছে তখন এসব পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিলো। যখন তাকে এ ব্যাপারে অনুরোধ করা হলো, তিনি বললেন, “দুর্ভিক্ষ থাক আর না থাক, ভারতীয়রা খরগোশের মতোই বাচ্চা জন্ম দিতেই থাকবে।” দিল্লী সরকার তার কাছে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতির একটি বিভীষিকাময় ছবি এঁকে এবং মৃতের সংখ্যা জানিয়ে টেলিগ্রাম করেছিল। তার উত্তর ছিলো মাত্র, “তাহলে এখনো গান্ধী মারা যায়নি কেন?”

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.