নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি মাসউদুর রহমান, আব্বা আম্মা ডাকেন রাজন নামে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পারফর্মিং আর্টস-এর শিক্ষক। ফিল্মমেকিং, অভিনয়, পাবলিক স্পিকিং, প্যান্টোমাইম- এইসব বিষয় পড়াই। এর আগে স্কুলে মাস্টারি করতাম। শিক্ষকতা আমার খুব ভালোবাসার কাজ।

মাসউদুর রহমান রাজন

একজন মানুষ, শিক্ষক ও সবার আমি ছাত্র তবে সব শিক্ষকের পড়া আমি শিখি না।

মাসউদুর রহমান রাজন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দাসবালিকার শৈশব (শেষ কিস্তি)

২১ শে মে, ২০২১ রাত ১০:২৫

লিন্ডা ব্রেন্ট, অনুবাদ: মাসউদুর রহমান রাজন



প্রথম কিস্তি পড়তে এই লিংকে ক্লিক করুন:দাসবালিকার শৈশব, ১ম কিস্তি

এই মহতি মাতামহীর কাছে অনেকগুলো কারণেই আমি ঋণী- আমি এবং আমার ভাই উইলি বিস্কুট, কেক এবং অন্যান্য সব খাবারের অবশিষ্টাংশের ভাগ পেতাম, যে সব তিনি বিক্রির জন্য বানাতেন। আর শিশু হিসেবে যে সব প্রতিবন্ধকতায় আমরা আটকে যেতাম, তখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ সহায়তার জন্যও আমরা তার কাছে ঋণী।

আমার শৈশবের শুরুর দিনগুলো এমনই ব্যতিক্রমধর্মী সৌভাগ্যময় ছিলো। যখন আমার বয়স ৬, আমার মা মারা গেলেন। আর তখনই, প্রথমবারের মতো, চারপাশের মানুষের কথাবার্তা থেকে, আমি জানতে পারলাম যে, আমি একটা দাস। আমার মায়ের মালকিন ছিলেন আমার নানীর মালকিনের মেয়ে। আবার তিনি ছিলেন আমার মায়ের দুধবোনও। তারা দু’জনেই আমার নানীর বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়ে উঠেন। সত্যি বলতে কি, আমার মাকে মাত্র তিন মাস বয়সে বুকের দুধ ছাড়ানো হয়েছিলো, যাতে আমার নানীর মালকিনের মেয়ে যথেষ্ট পরিমাণ দুধ পেতে পারে। শৈশবে, তারা দুইজনে একই সাথে খেলাধুলা করেছে, এবং তাদের পরিণত বয়সে, আমার মা তার সাদা দুধবোনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত দাসী ছিলেন। তার মৃত্যুশয্যায়, তার মালকিন তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তার সন্তানেরা কোন কিছুর জন্য ভোগান্তির শিকার হবে না। তার মালকিন তার জীবদ্দশায় সেই প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। ওরা সবাই আমার মৃত মায়ের সম্পর্কে সহৃদয়ে কথা বলছিলো, যে কিনা নামকাওয়াস্তে একজন দাসী ছিলো, কিন্তু সত্যিই সে মহৎ এবং স্ত্রীসুলভ প্রকৃতির মানুষ ছিলো। আমি তার জন্য অনেক দুঃখ করেছিলাম, কিন্তু আমার শিশুমন এই ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলো যে, এখন কে আমার এবং আমার ছোট ভাইয়ের দেখাশোনা করবে। আমাকে বলা হলো- এখন থেকে আমার মায়ের মালকিনের ঘরই হবে আমার ঘর; আর আমিও এ জায়গাটিকে অত্যন্ত সুখের জায়গা হিসেবে পেলাম। কোন শ্রমসাধ্য বা অস্বস্তিকর কাজ আমার উপর চাপিয়ে দেয়া হতো না। আমার মালকিন আমার প্রতি এতই দয়ালু ছিলেন যে, তার নির্দেশগুলো পালন করতে পারলেই আমি সব সময় খুশি হতাম এবং যতক্ষণ পর্যন্ত আমার অল্প বয়স সায় দিতো, ততক্ষণ তার জন্য খাটতে পারলে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করতাম। আমি তার পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম, মনোযোগ দিয়ে সেলাই করতাম, আমার হৃদয়টা থাকতো সব ধরণের উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত, যেভাবে একটি স্বাধীন সাদা চামড়ার শিশুর থাকতো। যখন তার মনে হতো, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তিনি আমাকে দৌড়ঝাপ করার জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিতেন। নির্ধারিত সীমার মধ্যে আমি যতদূর যেতে পারতাম, আমি তার জন্য বেরি ফল অথবা তার ঘর সাজানোর জন্য ফুল খুঁজে নিয়ে আসতাম। সে দিনগুলো ছিলো বড়ই সুখের- এতই সুখের যা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। দাসশিশুটির আগামি দিনের কোন দুর্ভাবনাই ছিলো না। কিন্তু অবশেষে সেই দুর্বিপাকের সময়টি এলো, যা অত্যন্ত নিশ্চিতভাবেই প্রত্যেক ঐ মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে, দাস হওয়ার জন্যই যার জন্ম হয়েছে।

আমার বয়স যখন বারোর কাছাকাছি, আমার এই অতি দয়ালু মালকিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং মারা গেলেন। যেমনটি আমি দেখেছিলাম, দেখতে দেখতে তার গাল দু’টি ফ্যাঁকাশে হয়ে গেলো, আর চোখ দু’টি ক্রমশ নিষ্প্রাণ হয়ে যাচ্ছিলো, কতটা কাকুতি মিনতির সাথে মনে মনে আমি তার বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনা করেছিলাম! আমি তাকে ভালোবাসতাম, কারণ তিনি আমার কাছে একদম একজন মায়ের মতোই ছিলেন। আমার প্রার্থনার কোন সাড়া মিলেনি। তিনি মারা গেলেন, এবং ওরা তাকে চার্চের সমাধিক্ষেত্রে কবর দিয়ে আসলো, যেখানে, দিনের পর দিন, আমার অশ্রু তার কবরকে সিক্ত করেছিল।

আমাকে আমার নানীর সাথে সপ্তাহখানেক থাকবার জন্য পাঠানো হয়েছিলো। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার মতো যথেষ্ট বয়স আমার তখন হয়েছিলো; আর বার বার আমি নিজের কাছে জানতে চাইছিলাম ওরা আমাকে নিয়ে কী করবে। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, যিনি চলে গেছেন তার মতো এত দয়ালু কোন মালকিন আমি আর কখনোই পাবো না। তিনি আমার মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তার সন্তানেরা কোন কিছুর জন্য কখনোই ভোগান্তির শিকার হবে না, আর যখন আমি এ কথা মনে করি, এবং আমার প্রতি তার মমত্ববোধের অসংখ্য প্রমাণ আমি মনে করতে পারি, তখন মনের ভেতরে একটা ভরসা পাই যে, তিনি হয়তো আমাকে মুক্ত করে গেছেন। আমার বন্ধুরাও একরকম নিশ্চিত ছিলো যে, ব্যাপারটা এমনই ঘটবে। তারা ভেবেছিলো, তিনি তো অবশ্যই এ কাজটা করবেন, আমার মায়ের ভালোবাসা ও বিশ্বস্ত সেবার জন্য। কিন্তু, হায়! আমরা সবাই জানি যে, একজন বিশ্বস্ত দাসের স্মৃতি তার সন্তানদের নিলামের মঞ্চে উঠা থেকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

এভাবে শঙ্কাময় ক’টা দিন যাওয়ার পর, আমার মালকিনের উইল সবাইকে পড়ে শোনানো হলো, আর আমরা জানতে পারলাম যে, তিনি আমাকে দান করে গেছেন তার বোনের মেয়ের কাছে, যে ছিলো একটা পাঁচ বছর বয়সের শিশু। এভাবেই আমাদের সব আশা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। আমার মালকিন আমাকে ঈশ্বরের বাণী থেকে অনেক উপদেশ শিক্ষা দিয়েছিলেন: “তোমার প্রতিবেশিকে তোমার ভালোবাসা উচিৎ, তোমার নিজের মতোই।” “তুমি মানুষের সাথে তাই করো, যেমনটা তুমি মানুষের কাছ থেকে আশা করো।” কিন্তু আমি তো ছিলাম তার দাসী, এবং আমার মনে হয়, তিনি আমাকে তার প্রতিবেশি মনে করেন নি। আমি মন থেকে চেষ্টা করবো- আমার স্মৃতি থেকে এই মহাভুলটি মুছে ফেলতে। একটা শিশু হিসেবে আমার মালকিনকে আমি ভালোবেসেছিলাম; এবং তার সাথে কাটানো সুখের দিনগুলোর দিকে পেছন ফিরে তাকিয়ে, আমি আমার প্রতি তার এই অবিচারের ব্যাপারটি কিছুটা কম বেদনা নিয়ে ভাবার চেষ্টা করি। যখন আমি তার সাথে ছিলাম, তিনি আমাকে পড়তে ও বানান করতে শিখিয়েছিলেন; আর এই বিশেষ সুবিধাটির জন্য, যা একজন দাসের ঘটে কদাচিৎ জোটে, আমি তার স্মৃতির প্রতি আশীর্বাদ জানাই।

অল্প কয়টি দাসই তার ছিলো; তার মৃত্যুতে তারা সবাই তার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেলো। তাদের মধ্যে পাঁচজন ছিলো আমার নানীর সন্তান, এবং ঐ একই দুধ তারা ভাগ করে খেয়েছিলো, যা খেয়ে আমার মালকিনের মায়ের সব সন্তানেরাও বেড়ে উঠেছিলো। মালিকদের জন্য আমার নানীর এই দীর্ঘ এবং বিশ্বস্ত সেবা সত্ত্বেও, তার সন্তানদের কেউই নিলামের মঞ্চে উঠা থেকে বাঁচতে পারেনি। ঈশ্বরের প্রাণধারী এই যন্ত্রগুলো, তাদের মালিকদের দৃষ্টিতে, তারা যে তুলা চাষ করে অথবা যে ঘোড়া তারা পালন করে, তার চাইতে বেশি কিছু ছিলো না।

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে মে, ২০২১ রাত ১১:০৫

রাজীব নুর বলেছেন: বড় মর্মান্তিক কাহিনী।

২১ শে মে, ২০২১ রাত ১১:৪৪

মাসউদুর রহমান রাজন বলেছেন: রাজীব ভাই, বইটার পরের চ্যাপ্টারগুলা আরো বেশি মর্মান্তিক।

২| ২১ শে মে, ২০২১ রাত ১১:১৭

শেরজা তপন বলেছেন: অনুবাদ ভাল হয়েছে! সব দাসের কাহিনী- সম্ভবত এমন মর্মান্তিক!!!

২১ শে মে, ২০২১ রাত ১১:৪৫

মাসউদুর রহমান রাজন বলেছেন: তপন ভাই, অনুবাদ ভালো হইছে জেনে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

৩| ২২ শে মে, ২০২১ রাত ১২:৫২

সাহাদাত উদরাজী বলেছেন: ভাল মালকিন হলে কিছুটা জীবন সুন্দর হত। দাস প্রথা একটা ভয়াবহ ব্যাপার ছিল, তবে এখনো মোড়কে এমন আছে।

২২ শে মে, ২০২১ বিকাল ৩:৫৪

মাসউদুর রহমান রাজন বলেছেন: মালকিন ভালো আর মন্দ কী। দাস তো দাসই।

৪| ২২ শে মে, ২০২১ দুপুর ২:২১

আমি রানা বলেছেন: দাস প্রথা এখনো আছে?

২২ শে মে, ২০২১ বিকাল ৩:৫৫

মাসউদুর রহমান রাজন বলেছেন: এই যে আমরা মাসে মাসে বেতন নিয়া মাসকাবারি দাসত্ব করি।

৫| ২৪ শে মে, ২০২১ বিকাল ৪:৪৮

কল্পদ্রুম বলেছেন: আরো চ্যাপ্টার আছে মনে হচ্ছে।

২৫ শে মে, ২০২১ রাত ১২:২৮

মাসউদুর রহমান রাজন বলেছেন: বইটা অনেক বড়, এটা শুধু তার শৈশবের অংশটুকু।

৬| ২৫ শে মে, ২০২১ দুপুর ২:৪৭

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন:
হায়রে দাস জীবন!! মৃত্যু ছাড়া মুক্তি নেই।

২৫ শে মে, ২০২১ বিকাল ৩:৩৬

মাসউদুর রহমান রাজন বলেছেন: তখনকার অবস্থাটা এমনই ছিল। তাই অনেক দাসই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিল। এরপর দাসেরা যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে সেজন্য এরা অনেক অভিনব কষ্টদায়ক উপায়ও বের করেছিল।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.