![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ধর্ম যার যার, মানবতা অধিকার
লোকসঙ্গীতের কোন স্বরলিপি নেই, নেই কোন বাধ্যবাধকতা। সব লোকই লোকগীতি গাইতে পারে নিজের ইচ্ছেমতো। এই গানে উঠে আসে প্রকৃতি, মানুষের ভালবাসা, দুঃখ বেদনা ইত্যাদি। আচার-অনুষ্ঠান উৎসব সব কিছুই রয়েছে লোকগানে। সাধারণের জীবনচিত্র উঠে আসা এই সঙ্গীতে নির্দিষ্ট কোন সীমারেখা না থাকলেও একটা সীমিত কাঠামো এই সঙ্গীতকে আবদ্ধ করে রেখেছে। অঞ্চল ভেদে একটা নিজস্বতা আছে এই সঙ্গীতের। আঞ্চলিকতাকে লোকগীতির প্রাণ বলা হয়ে থাকে। বৈশিষ্ট্যে ভরপুর এই সঙ্গীতের মাধ্যমেই একসময় আবহমান বাংলার মানুষের যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ও অগ্রসর চিন্তা-চেতনার বহির্প্রকাশ ঘটেছিল।
প্রথমদিকেই সাধারণ মানুষ লোকগীতিকে নিজেদের করে নিয়েছিল। ত্রিশের দশকে সংগ্রামের কৌশল হিসেবে এই সঙ্গীত রাজপথে, গ্রামেগঞ্জে মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। আর এই সঙ্গীতকে মানুষের মুক্তির সোপান রচনায় কাজে লাগাতে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। বাংলার লোকজগানকে তিনি শুধু জাতীয়ভাবেই সমাদৃত করেননি, ছড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বলোকে। কণ্ঠজাদুতে লোকসঙ্গীতের যাত্রাপথকে সুদৃঢ় করার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে লোকগীতির সম্রাট অভিধায় আখ্যায়িত করা হয়।
জন্ম ও শৈশব
নির্মলেন্দু চৌধুরী ১৯২১ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে উঠেছেন পিত্রালয়ে, জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী গ্রামে। পিতা স্বর্গীয় নলিনীনাথ চৌধুরী ও মাতা স্নেহলতা চৌধুরী। পিতা-মাতা তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মা স্নেহলতা সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি নির্মলেন্দু চৌধুরীকে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার অভিপ্রায়ে গানের তালিম দেন। প্রায় প্রতিদিনই ছেলেকে রেওয়াজ করাতেন তিনি। বাবা যোগাতেন উৎসাহ। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিপক্ক হতে থাকেন নির্মলেন্দু। সঙ্গীতের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে বাড়িতে একজন সঙ্গীত শিক্ষক রাখা হয়। শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আসার পর নির্মলেন্দু নিজেকে শাণিত করে তোলেন।
নির্মলেন্দু চৌধুরী বেহেলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এর পর চলে আসেন সিলেটে। সিলেট নগরীর লামাবাজারে তাঁদের নিজস্ব বাসা ছিল। সে সুবাদে তিনি রসময় মেমোরিয়েল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন এমসি কলেজে। সিলেটে অবস্থানকালীন সময়ে সুরসাগর প্রাণেশ চন্দ্র দাশের কাছে তালিম নেন তিনি। এ সময় রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত হন তিনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয় প্রতিবাদের গান।
যেভাবে লোকগানে
ম্যাট্রিক পাস করে নির্মলেন্দু রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কৃষকফ্রন্টে তিনি কাজ করতেন। রাজনৈতিক কারণে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয় তাঁকে। একদিন দলীয় কাজে খাসিয়া পাহাড়ঘেঁষা একটি গ্রাম অতিক্রম করার সময় দেখলেন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সন্তান কামনায় সারাদিন হাতে জ্বলন্ত প্রদীপ রেখে নারীরা দিগন্তে সেগুলো নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে আর গাইছে গান। আশ্চর্য এক গান। সূর্যব্রতী মেয়েদের সেই গানে নির্মলেন্দু জীবনের পরমার্থ খুঁজে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন- এই গান, এই লোকসঙ্গীত মানুষের কামনা-বাসনার সঙ্গী, যার প্রকাশভঙ্গি অকৃত্রিম। মানুষের হৃদয়রাজ্যে পৌঁছানোর চাবিকাঠি পাওয়া যাবে এই গানেই।
এর পর থেকেই তিনি লোকগানে অনুরক্ত হলেন। নিজ মনের অনুরণের সঙ্গে যুক্ত হলো রাগ-অনুরাগ। গাইলেন নির্মলেন্দু। খাসিয়া ও গারো পাহাড়ের গান, ভাটিয়ালি-সারি-জারি, বাউল, ঝুমুর আরও কত কী। যতই গেয়ে যান ততই যেন তৃষ্ণা বাড়ে। আর গানের প্রতি গভীর ভালবাসাই তাঁকে লোকগানের সম্রাটের আসনে অধিষ্ঠিত করে। তাঁর দরাজগলা জয় করে লক্ষ কোটি মানুষের মন। তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে নির্মলেন্দু বললে তাঁর নামের সঙ্গে আর কোন বিশেষণ যুক্ত করতে হতো না। এক নামেই সবাই চিনতো তাঁকে।
নতুন ধারার সূচনা
নির্মলেন্দু লোকসঙ্গীত ও গণসঙ্গীতের মধ্যে একটা সীমারেখা টেনে এনেছেন। তিনি সহজ সরল লোকসঙ্গীতে নিজস্ব একটি গায়ন পদ্ধতি জুড়ে দিয়েছিলেন, যার ফলে তাঁর গাওয়া গানগুলো মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেতো। অনেক গানে সংযোজন করেছেন বিজাতীয় সুরের মিশ্রণ। মূলত নিজের মতো করে গাইতে পছন্দ করতেন। কাউকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেননি কখনও। তিনি ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন লোকসঙ্গীতে মানুষের আবেগের গান। আবেগ অনুভূতিটাই এখানে বড়। বিশ্লেষকরা বলে থাকেন দরদ বা নিজের আবেগ অনুভূতিকে গানের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়াই ছিল নির্মলেন্দুর সাফল্যের চাবিকাঠি।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন, মধ্যমণি নির্মলেন্দু
চল্লিশের দশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছিল সংস্কৃতি আন্দোলনের মাধ্যমে। কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলনকে বেগবান করতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল মানুষের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি। আর সেজন্য দলীয় ও দলসমর্থনকারী সংস্কৃতিসেবীদের বেছে নেয়া হয়। বিকশিত হয় গণনাট্য আন্দোলন ও প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতি আন্দোলন। সমগ্র ভারতবর্ষে গড়ে ওঠে গণনাট্য সংঘের শাখাÑপ্রশাখা। দিনে দিনে এই সংঘ স্বাধীনতাকামীদের প্রতিবাদের প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়। সুরমা উপত্যকায় এই আন্দোলন বেগবান করতে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন প্রখ্যাত কবি, সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই কমিউনিস্ট নেতা অসংখ্য গণসঙ্গীত রচনা করেন লোকগীতির আদলে। যা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে সহায়ক হয়। তাঁর লেখা গানগুলো পরিবেশন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। গণনাট্য সংঘ সিলেটের মধ্যমণিতে পরিণত হন তিনি। তাঁর সুরের জাদুতে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে কৃষক-কামার-কুমার-জেলেসহ মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষজন।
এ প্রসঙ্গে বিপ্লবী হেনা দাস তাঁর আত্মজীবনী ‘চার পুরুষের কাহিনী’তে লিখেছেন,‘...সিলেটের গণনাট্য আন্দোলনে আমরা একজন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পীকে পেয়েছিলাম। তিনি হলেন উপমহাদেশখ্যাত পল্লীসঙ্গীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী। হেমাঙ্গদার নেতৃত্বে গঠিত সুরমা উপত্যকা কালচারাল স্কোয়াডের কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যমণি ছিল নির্মল।...একক গান পরিবেশনে তাঁর জুড়ি ছিল না। মাঠে-ময়দানে হাজার হাজার শ্রোতাকে নির্মল মাতিয়ে তুলত তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের সুর ও ঝঙ্কারে, তাদের অন্তরের গভীরে পৌঁছে দিত প্রতিটি গানের মর্মবাণীকে।’
শেকড়েই সঙ্গীত
নির্মলেন্দুর পিতৃভূমি বেহেলীকে লোকসঙ্গীত চর্চার অনন্য স্থান বললে ভুল হবে না। কারণ গ্রামের শান্ত পরিবেশ সঙ্গীত চর্চায় শুধু সহায়কই ছিল না, এই গ্রামের অবস্থানকারীরাও ছিলেন সঙ্গীত পিপাসু। সঙ্গীতের প্রতি তাদের অগাদ ভালবাসা ছিল। শুধু লোকগীতিই নয়, গণসঙ্গীতের প্রতিও গ্রামের লোকজন ছিল দুর্বল। সংস্কৃতি চর্চায় অগ্রসর ও বিভিন্ন কর্মকা-ে নারীদের সম্পৃক্ততা এই গ্রামের আবহকে দিয়েছিল ভিন্নমাত্রা।
গ্রামের সঙ্গীত চর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল নির্মলেন্দুদের বাড়ি। নির্মলেন্দুদের পরিবারের প্রায় সব সদস্যই সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই গলা ছিল গান গাওয়ার উপযোগী। চার পুরুষের কাহিনীতে হেনা দাস উল্লেখ করেছেন,‘....নির্মলেন্দুর বাড়ি ছিল লোকসঙ্গীতের প্রাণকেন্দ্র। প্রতিদিন সেখানে বসত গানের আসর। ওরা ভাইবোন সবাই তাঁদের সুরেলা কণ্ঠ ও প্রতিভা দিয়ে লোকসঙ্গীতের ভুবনকেই আলোকিত করে তুলেছিল। আর সেই সঙ্গীত ভুবনের রাজা ছিল নির্মল নিজে। তবে নির্মল যে কেবলমাত্র তাঁর প্রতিভার সাহায্যে এই রাজ্যকে জয় করে নিয়েছিল তা নয়, এ ব্যাপারে তাঁর মা ছিলেন প্রেরণা ও শক্তি। তাঁর ছিল চমৎকার সঙ্গীতের এক দরাজকণ্ঠ আর ছিল অফুরন্ত লোকসঙ্গীতের ভা-ার। একাই গান গেয়ে মাতিয়ে তুলতে পারতেন আসর। আর যখন ছেলেমেয়েদের নিয়ে একসঙ্গে গান ধরতেন, তখন সত্যিই সেই সম্মিলিত কণ্ঠের সুরের মূর্ছনায় মনে হতো ঘরের পরিবেশ পাল্টে গিয়ে যেন আমরা খোলা আকাশের নিচে উন্মুক্ত প্রান্তরে প্রকৃতির কোলে বসে মাটি, নদী, হাওড়, ক্ষেত, খামার ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাচ্ছি।’
ওপার বাংলায়, বিশ্বলোকে
তাঁর বিরুদ্ধে তখন হুলিয়া জারী করা হয়েছে। যে কোন সময় গ্রেফতার হতে পারেনÑ এই শঙ্কা থেকেই নির্মল অপার বাংলায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন। বৈরী পরিবেশের কারণে ধনীর দুলাল হওয়া সত্ত্বেও নির্মলেন্দু তখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। সিলেটে এলেন, বন্ধু-বান্ধবরা সিদ্ধান্ত নেন; শহরে নাটক করে এ থেকে অর্জিত সমুদয় টাকা তুলে দেয়া হবে তাঁর হাতে। তা নিয়েই ভারতে পাড়ি জমাবেন নির্মলেন্দু। শহরে ‘দুই পুরুষ’ নাটকের আয়োজন করা হলো, এ থেকে অর্জিত অর্থ পৌঁছে দেয়া হলো নির্মলেন্দুর কাছে। নন্দরানী চা বাগান হয়ে ওপার বাংলায় পাড়ি জমালেন এপার বাংলার লোকসঙ্গীতের উজ্জ্বল এই নক্ষত্র।
কলকাতায় গিয়ে রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। শুরু হয় সংগ্রামী জীবনের আরেক অধ্যায়। পূর্ব পরিচিতরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। ১৯৫৫ সালে কলকাতা শহরে অনুষ্ঠিত বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনে নির্মলেন্দু অংশগ্রহণ করে ‘শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত’ পরিবেশন করেন। তবে এর আগেও বেশ কয়েকটি আসরে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেন তিনি। কিন্তু এ অনুষ্ঠানে নতুনভাবে নির্মলেন্দুকে চিনল কলকাতাবাসী। এ দিন তিনি একে একে পরিবেশন করেন নৌকা বাইচের গানÑ সোনার বান্দাইল নাও, ভাওয়াইয়াÑ প্রেম জানে না রসিক কালাচান, হাসন রাজারÑ লোকে বলে, বলেরে, টানা ভাটিয়ালী ‘মইষ রাখ মইষাল বন্ধুরে’ নাচের গানÑ সোহাগ চান বদনে ধ্বনী, ধামাইলÑ আমি কি হেরিলাম জলের ঘাটে গিয়া প্রভৃতি। নির্মলের গানে মুগ্ধ হলেন স্রোতারা। সুনাম ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এ বছরই শান্তিনিকেতনে গিয়ে সঙ্গীত পরিবেশনের আমন্ত্রণ জানানো হল তাঁকে। শান্তিনিকেতনের সবাই মুগ্ধ হলো তাঁর সুর শৈলীতে। শুরু হয় নতুন এক নির্মলেন্দুর পথচলা। নানান অনুষ্ঠান থেকে আমন্ত্রণ আসতে থাকে। সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তিনি। দরাজ কণ্ঠে গান ধরা মাত্রই অনুষ্ঠানস্থল পরিপূর্ণ হয়ে যায় কানায় কানায়। চৌরাস্তার মোড়ে অনুষ্ঠান হলে ট্রাফিক জ্যাম এড়ানো যায় না।
জনপ্রিয়তা যখন এই পর্যায়ে তখন নির্মলেন্দুকে রাষ্ট্রীয় সফরে নেয়ার জন্য মনোনীত করা হয়। এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণমূলক ‘নির্মল হৃদয়’ নিবন্ধে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন- ‘একদিন মন্ত্রী অনিলকুমার চন্দের চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেন- ‘অভিতাভ, আমি ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক দল নিয়ে যাচ্ছি পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়া। রানী (চন্দ) লিখেছে, একটি ছেলে নাকি শান্তিনিকেতনে এসে দারুন গান গেয়ে গেছে। তুমি চেন তাঁকে? চেনা থাকলে নামটা জানাও, আমি পঁচিশে বৈশাখ কলকাতা যাচ্ছি। ৪৮ চৌরঙ্গি রোডে সকাল বেলা আমার সঙ্গে ওকে দেখা করতে বল।’
চিঠি পড়েই বুঝলাম, অনিলদা নির্মলের কথা বলছেন। ওকে খবরটা দিতেই বুকে জড়িয়ে ধরল। ১৯৫৩ সালের ৮ মে সকালে নির্মলকে নিয়ে অনিলদার কাছে গেলাম। গান শুনে অনিলদা নির্মলকে বুকে টেনে নিলেন। নির্মল ছোট ভাই শিবুকে দোহার হিসেবে নিয়ে পূর্ব ইউরোপের পথে চলে গেল দিল্লী। হাওড়া স্টেশনে তাঁকে তুলে দিলাম।
ওই সাংস্কৃতিক দলে ছিলেন বিলায়েত খাঁ, সিতারা, শান্তা প্রসাদ, দ্বিজেন মুখার্জী এবং আরও নামজাদা সব গাইয়ে বাজিয়ে। বিদেশ রওনা হওয়ার মুখে দিল্লীতে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে নির্মল সবাইকে ছাড়িয়ে গেল। অনিল দা তাঁকে নিয়ে গেলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে। নেহেরু আলাদা আবার গান শুনে হুকুম দিলেন বিদেশের কোন মান্য অতিথি দিল্লীতে এলে এই গাইয়েকে যেন বিনোদনের জন্য ডাকা হয়। বছরের পর বছর এই হুকুম বহাল ছিল। আইজেনহাওয়ার এসেছেন, ডাকো নির্মল চৌধুরীকে। কুইন এলিজাবেথ এসেছেন, ডাকো-নির্মল চৌধুরীকে। ভরোশিলভ একনক্রমা- যিনিই আসুন, রাজ দরবারে সভা গায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরী। এ সব খবর কাগজে একটু একটু করে বেরোয় আর কলকাতার আসরে নির্মলের কদর বাড়ে। বলশয় থিয়েটারে স্বয়ং ক্রুশ্চেক প্রথমসারিতে বসে সাধুবাদ জানান, বেলগ্রেডে মার্শাল টিটো তাঁকে প্রশংসা করতে ছুটে আসেন।’
১৯৫৫ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারশ বিশ্ব যুব উৎসবে আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো অংশ নিয়ে প্রথমস্থান অর্জন করে স্বর্ণপদক লাভ জিতে সবাইকে চমকে দেন তিনি। তাঁর আগে কোন বাঙালীর এ ধরনের পদক পাওয়ার নজির নেই। এরপর জীবদ্দশায় অনেকটা ধারাবাহিকভাবেই অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন তিনি।
বিদেশ সফর
ইউরোপের এমন কোন দেশ নেই যেখানে নির্মলেন্দু যাননি এবং গান করেননি। শুধু ইউরোপই নয় আমেরিকাসহ অন্যান্য মহাদেশেও তাঁর অবাদ বিচরণ ছিল। জীবদ্দশায় এশিয়ার শ্রেষ্ঠ লোকগীতি গায়কের সম্মান অর্জন করেছিলেন তিনি।
বিদেশে রাষ্ট্রীয় ডেলিগেশনে যেতে হলেই নির্মলেন্দু চৌধুরীর ডাক পড়ত। চীনে ভারতের প্রথম সাংস্কৃতিক ডেলিগেশনে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। এরপর ভারতের সরকারী সফরে অসংখ্যবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ সোভিয়েট রাশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া চেকোশ্লাভাকিয়া, হাঙ্গেরী, বুলগেরীয়া, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, পোল্যান্ড জাপান প্রভৃতি। এ সব দেশে বাংলার লোকগান পরিবেশন করেছেন তিনি। তবে সবচেয়ে বেশি সফর করেছেন ইংল্যান্ড। প্রায় প্রতিবছরই সেখানে যেতে হতো তাঁকে। যুক্তরাজ্যে যাওয়ার পেছনে অন্য একটি কারণ ছিল- সেটি হচ্ছে তৎকালীন সময়ে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালীদের মধ্যে ৯০ ভাগই ছিলেন সিলেট অঞ্চলের বাসিন্দা। তাদের অনেকের সঙ্গেই নির্মলেন্দুর পরিচয় ছিল, ছিল সখ্যতা। বাল্যবন্ধুদেরও অনেকেই ছিলেন সেখানে। তাদের আমন্ত্রণ কখনও ফেলতে পারেননি এই লোকশিল্পী। আর যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালীরাও তাঁকে পেয়ে হয়েছে আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত।
পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী
বর্ণাঢ্য ও পরিপূর্ণ জীবনের অধিকারী ছিলেন নির্মলেন্দু চৌধুরী। জীবদ্দশায় শতাধিক গানের রেকর্ড বের হয়েছে তাঁর। অধিকাংশই গানের সুর তিনি নিজেই করেছেন। বের হওয়া রেকর্ডের মধ্যে একাধিক লং প্লে রয়েছে। উল্লেখযোগ্য দুটি লং প্লে হচ্ছে-মালুয়া গীতিনাট্য এবং চাঁদ সাগর গীতিনাট্য। তন্মধ্যে মালুয়া গীতিনাট্য ষাটের দশকে ভারতে আলোড়ন তুলেছিল। ময়মনসিংহের এই গীতিনাট্যে ৫০ জন শিল্পী অংশগ্রহণ করেছিলেন। মালুয়ার গানগুলো সুর করেছেন তিনি নিজেই। আর মনসামঙ্গল থেকে করেছেন আলোচিত চাঁদ সদাগর।
সিলেটের হারিয়ে যাওয়া লোকসঙ্গীতকে ধরে রাখার তাগিদ থেকেই তিনি এ অঞ্চলের অসংখ্য লোকগান রেকর্ড করেন। ভারতে অবস্থান করলেও মাতৃভূমির প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালবাসা।
১৯৬৯ সনে জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে অধ্যাপনায় যোগ দেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি জবধফবৎ রহ সঁংরপ ছিলেন। জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠা করেন লোকভারতী। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর প্রায় ৬ হাজার ছাত্রছাত্রী ছিল।
যুবক বয়সে সুরমাভেলী ফুটবল দলের কৃতী খেলোয়াড় ছিলেন, এ ছাড়াও শিকারে ছিলেন দক্ষ। সুযোগ পেলেই শিকার করতেন। ছাত্র আন্দোলনে একজন চৌকস ছাত্রনেতা, কৃষাণ সম্মেলনে ছিলেন পার্টির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল ক্যাডার।
বহুমুখী প্রতিভার সম্মেলন
নির্মলেন্দুর চরিত্রে বহুমুখী প্রতিভার সম্মেলন ঘটেছিল। শুধু গান গাওয়া, সুর করা, অভিনয় এবং প্রযোজনার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি তিনি। বইও লিখেছেন। ‘এপার বাংলা ওপার বাংলার গান’-নামের দুই বাংলার লোকসঙ্গীত ও গণসঙ্গীতের সংগ্রহ নিয়ে লেখা বইটি প্রয়াত আলাউদ্দিনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি।
শুধু লোকগানেই সীমাবদ্ধ ছিল না নির্মলেন্দু চৌধুরীর প্রতিভা। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অভিনেতা। তাঁর অভিনয় শৈলী ছিল মনোমুগ্ধকর, ব্যতিক্রমী ও নিখুঁত। তিনি অভিনয়কে কখনও অভিনয় হিসেবে নেননি। চরিত্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে উপলব্ধি করে তারই বহির্প্রকাশ করেছেন ক্যামেরার সামনে। তাই তাঁর অভিনীত প্রতিটি চরিত্রই ছিল জীবন্ত। জীবনের কাছাকাছি তিনি নিয়ে গেছেন অভিনয়কে।
পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্তের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত থিয়েটার ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারী’ ‘ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে তাঁর অনবদ্য অভিনয় এখনও জনমনে স্বীকৃত।
সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন। ভারতের প্রখ্যাত পরিচালক রাজেন তরফদারেরর ‘গঙ্গা’, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাঞ্চন মালা’, ‘নতুন ফসল’, ‘ডাকাতের হাতে’ ইত্যাদি সিনেমায় তাঁর অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘ডাকাতের হাতে’ ছবিতে তিনি অত্যাচারী জমিদারের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক মাতিয়ে ছিলেন। অথচ ব্যক্তি জীবনে জমিদার বংশের হয়েও তিনি ছিলেন নিরহঙ্কারী। কোন কিছুর প্রতি লোভ ছিল না তাঁর।
শেষ কথা
নির্মলেন্দু শোষিত বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। তিনি তাঁর নীতি আদর্শে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন অবিচল। সঙ্গীত তাঁকে যশ-খ্যাতি সবকিছু দিয়েছে। কিন্তু তিনি কখনও সঙ্গীতকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেননি। যাঁরা তাঁকে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাদের ডাকেই সাড়া দিয়েছেন। যে সংগঠনগুলো অসহায় মানুষের জন্য সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করত তাদের কাছ থেকে তিনি কোন ধরনের সম্মানী গ্রহণ করতেন না।
নির্মলেন্দু চৌধুরী একজন সমাজসেবীও ছিলেন। অসংখ্য দরিদ্র মানুষকে তিনি অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করেছেন। দাঁড়িয়েছেন নির্যাতিতদের পাশে। অন্যায় তিনি সহ্য করতে পারতেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদে তিনি সব সময়ই ছিলেন সোচ্চার। সুরের মূর্ছনায় আচ্ছন্ন শ্রোতাদের কাঁদিয়ে ১৯৮১ সালের ১৮ এপ্রিল তিনি চিরবিদায় নেন। চিতার কাঠে পুড়ে তাঁর নশ্বর দেহ। শেষকৃত্যানুষ্ঠান তাঁর দেহের সমাপ্তি ঘটায় কিন্তু নিজ সুর সঞ্জিবনীতে নির্মলেন্দু আজও বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন যতদিন থাকবে লোকগান।
তথ্য উৎস্য দৈনিক জনকন্ঠ ১৮ এপ্রিল ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ, লেখক : অপূর্ব শর্মা ।
©somewhere in net ltd.