নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মোঃ জাহিদ হাসান

Z@hid

Z@hid › বিস্তারিত পোস্টঃ

বদিউলের একাত্তর

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:০৭

এখনো ভোর হয় নি।ভোরের পাখিদের কলকাকলিতে নিঝুম রাতের নৈশব্দতা ভাঙতে আরম্ভ করেছে কেবল। কাশ্মীরী চাদর ভেদ করে অল্প-স্বল্প শীতল বাতাস গায়ে কাপুনি ধরিয়ে দিয়ে শীতের জানান দিয়ে যাচ্ছে। আসলে কি, এই বুনো জংগলে আকাশে মেঘের ভেতর দিয়ে জায়গায় জায়গায় সূর্যের আলোর ক্ষীণ রেখাগুলোকে যেন প্রাগৈতিহাসিক, আদিম ও স্বর্গীয় বলে মনে হয়। সূর্য উঠতে শুরু করেছে। ছোট্ট লাজুক মেয়ে যেভাবে ঘরের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে তাকায় সূর্যও সেভাবে প্রথমে উঁকি দেয়। এরপর পুরোপুরি দেখা দিতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না। খুব দ্রুতই একেবারে ঝুপ করে সূর্য করে উঠে যায়। শুরু হয় নতুন একটি দিনের। শুরু হয় নতুন পথচলা।
আমাদের গল্পের নায়ক মোঃ বদিউল আলম। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে থার্ড হওয়া তুখোড় ছাত্র। বুয়েটে ’৬৭ ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র। থাকত শেরে বাংলা হলে-৪০২ নং রুমে। এখন এসব তার কিছুই মনে পড়ে না। শুধু মনে পড়ে সিভিল বিল্ডিং এর সৌম্য-শান্ত চেহারাখানি। একসময় যার প্রতিটা ইটকে সে ভালবাসত। ভালবাসত সিভিল আর ই এম ই বিল্ডিং এর মাঝে রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে। ভালবাসত ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা দিতে। ভালবাসত হাফ ওয়ালে বসে সকালে প্রথম চায়ে চুমুক দিতে। আর ভালবাসত অনুপমাকে। যুদ্ধ সব কেড়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে। সব সব। এখন সবকিছু সাদা কালো ছবি মনে হয় শুধু।
নৌকার ছইয়ের উপর বসে নিজের কথা ভাবতে থাকে সে। একাত্তরে যুদ্ধের শুরুতেই তার বাবা-মায়ের মারা যাওয়ার খবর আসে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে যায় বাড়িতে। কারও লাশ খুঁজে পায় না সে। শুধু সাত বছরের ভাইটার রক্তাক্ত শরীরখানা সাদা বিছানার উপর পড়ে থাকতে দেখে ডুকরে কেদে উঠে। পরে শুনেছিল তার বাবা মসজিদের ইমাম সাহেব একদল মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছিল এই খবর পেয়ে রাজাকাররা এসে প্রথমে তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। বাড়ির সামনের কাঠাল গাছটার সাথে বেঁধে রেখে পরপর চারটা গুলি করে মারে। বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাবার সময় বাবার পা জড়িয়ে ছিল তার অন্তঃসত্ত্বা মা। তার তলপেটে বুট দিয়ে লাথি মারতে মারতে একসাথে দুইজনকে পাশবিক উল্লাসে হত্যা করে পাকিস্তানি মিলিটারীরা। ওর ছোটবোন আছিয়া সেবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিত। কোমল চেহারা- বড় বড় চোখ করে তাকাত। বুনো জন্তুগুলো তাকেও ধরে নিয়ে যায়। কোন খবর পাওয়া যায় নি তার। বোনের পরিণতি চিন্তা করে শিউরে উঠে সে। কিচ্ছু ভাবতে পারে না। জগত আচ্ছন্ন হয়ে আসে তার কাছে। ভাইয়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ কোলে নিয়ে রক্ত মাখা জামা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে, “ভাইরে, আমি মানুষটা ভীতু হইতে পারি, কিন্তু নপুংসক কাপুরুষ না। যে শূয়োরের বাচ্চাগুলো তোর চোখ বন্ধ করে দিয়েছে তাদের অন্তত একটাকে দোজখে না পাঠায়ে আমি ঘরে ফিরছি না। আমি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিব”।
দোজখে সে একটাকে পাঠায় নি এবং বদিউল ছেলেটা মোটেও ভীতু না। অত্যন্ত সাহসী এবং তড়িৎকর্মা কমান্ডার। এখন পর্যন্ত আঠারোটি যুদ্ধে সফল নেতৃত্ব দিয়ে সে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে চলেছে। এপ্রিলের দিকে তার দলের সদস্য ছিল ৩০ জন। এখন কমতে কমতে ১৮ জনে এসে ঠেকেছে। এই কয়জন নিয়েই সে রওনা হয়েছে নদীপথে। আজকে ভোরে সূর্য উঠার সাথে সাথেই রওনা হয় তারা। নেত্রকোণা জেলার দূর্গাপুর সুসং আদর্শ বিদ্যানিকেতনে মিলিটারীদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প রয়েছে। সোমেশ্বরী নদী দিয়ে রাতের মধ্যে তারা পৌঁছাবে সুসং দূর্গাপুর বাজারে। এরপর রাত গভীর হলে শুরু হবে রক্ত, শব্দ আর আগুনের খেলা।
বদিউলের দিনগুলো খারাপ যাচ্ছিল না। সবই ছিল- বন্ধু, প্রেম, আড্ডা। ক্লাস শুরু হওয়ার বেশ কয়দিন পরের একটা ঘটনা। ফার্স্ট বেঞ্চের কোণায় বসা একটা মেয়ে কি কারণে বা অকারণে ডান দিক দিয়ে পিছনে ফিরে বদিউলের সাথে চোখাচুখি হয়েছিল। বদিউল মুহূর্তের জন্য কেন জানি বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। ওর মনে হয়েছিল এরকম একটা নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে একটা ক্লাস কেন একটানা কয়েকটা দিন পার করে দেওয়া যায়। অনুপমার কাছেও মনে হয়েছিল এই লাজুক মুখচোরা ছেলেটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? এইতো তারপর কথা, পরিচয়, ল্যাব গ্রুপে একসাথে কাজ করা, হাফ ওয়ালের আড্ডায় সঙ্গী হওয়া, বিকালে ফুলার রোড হয়ে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া, ফেরার পথে শহীদ মিনারের সামনে বড় কড়াই গাছটার নিচে মুনির ভাইয়ের বিখ্যাত চটপটি খাওয়া। অনুপামা জলের মত শান্ত, রাণীর মত গম্ভীর আবার কখনো কিশোরীর মত উচ্ছল, ঝর্ণার মত চঞ্চল। সে যখন হাসত, হাসতে হাসতে প্রায়ই বদিউলের বুকে পড়ে যেত। বদিউলের মনে হত এই কিন্নর হাসি দেখার জন্যই তার পৃথিবীতে আসা সার্থক হয়েছে। আর কিছু চাই না। এরই মাঝে দুইটি বসন্ত, চব্বিশটি পূর্ণিমা কেটে গেছে। সময়ের পরিক্রমায় কখন যে তারা একজন আরেকজনের সাথে মিশে গেছে, কখন যে তারা একে অপরকে ভালবেসে ফেলেছে তা এখন প্রত্মতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু দেশের এই উত্তাল অবস্থা যে তাদের শান্ত প্রেমের মাঝে কিছুটা উত্তাপ ঢেলে দেয় নি তা না। থার্ড ইয়ারে উঠার পর থেকেই মোটামুটি বদিউল মিটিং, মিছিল, আন্দোলন এসবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। অনুপমাও ঠিকমত ক্লাসে আসতে পারত না। দেখা হতো অনেক দিন পরপর। একদিন অনুপমা এসে বিষন্ন মুখে জানায়, বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছে। ছেলে আর্মির লেফট্যানেন্ট। তুমি কিছু কর। বদিউল কিছু বলতে পারে না। অসহায়ের মত বসে থাকে। এররপরও এক-দুইবার দেখা হয়েছিল ওদের মধ্যে। কিন্তু কথা হয় নি এই বিষয়ে। অনুপমা হয়তো কাঙালের মত সুকান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর শোনার আশায়। নির্বোধ পুরুষ হয়তো নারীর অব্যক্ত আকুতি বুঝতে পারত না কিংবা দেশমাতা কর্তব্যপরায়ণ ব্যস্ত দেশপ্রেমিককে বাধ্য করেছিল নারীর প্রতি প্রেমকে দেশের প্রতি প্রেমে রুপান্তরিত করতে। কিন্তু “সময়” নিজেই যে ব্যস্ত, তাকে ব্যস্ততা দেখানো চলে না। সে আপন মনের মত ঘটনার পর ঘটনা বুনতে থাকে। সে যখন বাড়ি চলে এসেছিল অনুপমার সাথে শেষ কথাটুকু পর্যন্ত হয় নি। কি খবর আর জানা হয় নি। বেঁচে আছে কি নেই সেই খবরও আর নেওয়া হয় নি।
বদি অনুপমার কথা ভাবতে থাকে। তার মনের ভিতর অনুপমাকে লেখা শত শত চিঠি খামে বন্দী হতে থাকে। চিঠির সম্বোধন শুরু হয় ‘প্রিয় অনু’ দিয়ে। সে চিঠি আর পাঠানো হয়ে উঠে না কখনো। বদিউল আলম কল্পনা করে, একসময় যুদ্ধের দামামা থামবে। তার জীবন আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। আবার অনুপমা তার বুকে মাথা রেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে। অনুপমাকে নিয়ে তার ছোট্ট সুখের সংসার থাকবে। সেখানে কখনো গুলির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যাবে না। মৃত্যুভয়ে ইঁদুরের মত লুকিয়ে থাকতে হবে না। রক্তদৃশ্য দেখে আঁতকে উঠবে না। প্রিয়জন হারানোর দুঃখে কেউ হাহাজারি করবে না। তাদের একটা ছোট্ট সুন্দর বাচ্চা থাকবে। বদিউল ঠিক করেছে তাকে একটা পতাকা কিনে দিবে। সে ছোট্ট হাতে নাড়াতে থাকবে বাংলাদেশের পতাকা। উফফ কি সুন্দর দৃশ্য! এই দৃশ্যে হয়ত তার নিজের জীবনে কখনো দেখবে কি না তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে হাজারো বদিউল-অনুপমার কোলে একেকটা শিশুর কপালে বাংলাদেশের পতাকা বাঁধা থাকবে, হাতে পতাকা নাড়বে-বাংলাদেশের পতাকা-স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা-এই দৃশ্য দেখার জন্যই তো যুদ্ধ করছে।
ভাবনার এই পর্যায়ে ছেদ পড়ে। হটাত গোলাগুলির শব্দে তার ধ্যান ভাঙ্গে। মিলিটারীরা তাদের উপস্থিতির কথা বুঝতে পারে। পাক মিলিটারী তাদের উপর অতর্কিতে গোলাবর্ষণ শুরু করে। দিনের বেলা নৌকা নিয়ে আসা খুবই ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ঠিক কী হচ্ছে বুঝে উঠার আগেই তারা তাদের নৌকাটা ডুবিয়ে দেয় চতুর মিলিটারীরা। সহযোদ্ধা যারা ছিল অনেকেই শহীদ হোন। যারা বেঁচে ছিলেন তাদের কেউ কেউ সাঁতরে পার হোন। মাত্র সাত জন আহত অবস্থায় ধরা পড়েন মিলিটারীদের হাতে। বদিউলের ডান হাতের একটু উপরে বুলেট বিঁধেছে। সে আচ্ছন্ন হয়ে ডুবে যেতে থাকে। শেষ মুহূর্তে শুধু দেখতে পায় পানিতে তাদের নৌকার আগুনের লেলিহান শিখার প্রতিবিম্ব পড়েছে। সে “মাগো” বলে একবার ডাক দিয়ে পানিতে তলিয়ে যেতে থাকে।
যখন তার জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করে মিলিটারী ক্যাম্পের টর্চার সেলে। ইন্টারোগেশন অফিসার তাকে সহযোদ্ধাদের নাম বলতে বলে। একটা একটা করে আঙ্গুল থেঁতলে দেওয়া হতে থাকে। কিন্তু বদিউল অটল। সে কিছুতেই তাদের নাম মুখে আনবে না। এক পর্যায়ে ইন্টারোগেশন অফিসার তাকে প্রস্তাব দেয়, “তুম বহুত নাফরমান আদমি হ্যায়। তুম মুক্তিবাহিনীকা নাম বাতা দো। ম্যা তুমকো ছোড় দুঙ্গা”। বদিউল এক দলা থুতু ছিটিয়ে দেয় তার মুখে। অফিসার ভদ্রলোক শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে মুখ মুছেন। এরপর কষে লাথি দেয় বদিউলের বুক বরাবর। বদিউল উলটে পড়ে। অফিসার নিস্পৃহ ভঙ্গিতে নির্দেশ দেয়, “ Shoot him”. বদিউলকে পিছনে হাত বেঁধে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। সে কখনো অনুপমাকে বলতে পারেনি, সে তাকে ভালবাসে। এখন গুলির মুখের সামনে বসে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, “আমি তোমাকে ভালবাসি, অনু”। সেই চীৎকার ছাপিয়ে উঠে পরপর কয়েকটা গুলির শব্দ।

উৎসর্গঃ
এই লেখায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটা সময়কে ধারণ করার কিঞ্চিত চেষ্টা করা হয়েছে। মোঃ বদিউল আলম স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন শহীদ বুয়েটিয়ান। যুদ্ধ চলাকালে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তার নাম এখনও বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ার সামনে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ বুয়েটিয়ানদের স্মৃতিস্তম্ভের সবার প্রথমে চোখে পড়ে। এই লেখাটি মহান শহীদ বদিউল আলমকে উৎসর্গ করা হলো।

মোঃ জাহিদ হাসান

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৩

কানিজ ফাতেমা বলেছেন: মহান শহীদ বদিউল আলমকে হৃদয়ের গভীরতম শ্রদ্ধা নিবেদন ।
শুভ কামনা রইল ।

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৪৮

Z@hid বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.