![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একজন অত্যন্ত সাধারণ মানুষ। খুব ছোটবেলা থেকে জীবন সংগ্রাম করছি। শ্রেণীহীন শোষনহীন যৌক্তিক সভ্যতার স্বপ্ন দেখি এখনো। একমাত্র দারিদ্রতাই আমার অহংকার। প্রকৃতিকে ভালোবাসি,নিজের মত করে। দেশকে ভালোবাসি মায়ের মত। আর তাই মনে হয়, দূর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ,লুটেরা আমলা-কর্মচারী এবং অতিলোভী ভেজাল ব্যবসায়ী,এই ত্রি-রত্নের হাতে জিম্মি হয়ে আছে প্রিয় ৫৫ হাজার ১ শত ২৬ বর্গমাইল।
তুমি ছিলে তখন তরুণ চিকিৎসক । তুমি গণতন্ত্রের পুঁজারী । জীবন দিয়ে সেটি তুমি প্রমাণ করেছো । তোমার স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির উল্টো দিকে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ। নির্মাণশৈলী আর ভাবগাম্ভীর্য দুটোই এর আছে। পথের ধারে অল্প জায়গা নিয়ে করা স্মৃতিস্তম্ভটি শুধু তোমার স্মৃতি নয়, বরং বর্তমান প্রজন্মের প্রেরণার অনন্ত উৎস। আপোসের বিরুদ্ধে অনন্য সাধারণ প্রতিবাদ।
আজ তোমার মৃত্যূ দিবসে এখানেই অনেকেই ছুটে যাবেন কিন্ত আমি যাবো না,ডা:মিলন । আমার সে সাহস নেই । বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা ফুলে ফুলে বেদি ভরিয়ে দেবেন।
আজ তোমার স্মুতিস্তম্ভটির ধোয়ামোছার কাজ চলছে। প্রতিবছর তাই হয়। কিন্তু বছরের বাকি দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের ক্যাম্পাসে নির্মিত স্মৃতিস্তাম্ভটি পড়ে থাকে অযত্ন-অবহেলায়। স্মৃতিস্তম্ভটিকে ঘিরে থাকা লোহার শেকলটি নেই। এর ভেতরে অবাধে প্রবেশ করছে পথশিশুরা। নিজের মতো করে খেলাধুলা করছে। তারা ইতিহাস জানে না। জানারও সুযোগ নেই। একইভাবে না জানার সুযোগ নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। কিন্তু এর পরও তাঁদের একটি বড় অংশ উদাসীন। স্মৃতিস্তম্ভটিকে পার্কের বেঞ্চের মতো ব্যবহার করে তারা। দল বেঁধ আড্ডা দেয়। সর্বশেষ ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এমন দৃশ্য দেখেছি ।
আজ তোমার স্মৃতিস্তম্ভটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে থাকে আবর্জনার স্তুপ। দুই পাশের গাছ থেকে হেলে পড়া ডালে এর শরীর ঢাকা থাকে। সামনের জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে অলস সময় পার করে প্রাইভেট কার, রিকশা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা। ফলে তোমার স্মৃতিসত্মম্ভটি চোখের সীমানায় আসে না বললেই চলে। স্থাপত্যটির কাছে গিয়ে একবার তাকালে পরিষ্কার হয়, এর "রক্ষনাবেক্ষন" বলতে কিছু নেই। শ্বেতপাথরের সিঁড়িগুলোতে কয়েকস্তর ধুলো জমে আছে। একই রকম ধুলোয় ঢাকা একটি পাথরের গায়ে খোদাই করা আছে আবেগঘন শব্দগুচ্ছের ওপর হাতে লেখা " নিঝুম স্থাপত্য আজ মিলনের প্রতিবাদী মুখ"। আর পাশের স্মৃতিফলকটি এখন বলা চলে পরিত্যক্ত। ভঙ্গুর অবস্থায় এটি কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে। খুব কাছে চোখ নিতে পারলে দৃশ্যমান হয়। ফুঁ দিয়ে ধুলো সরাতে পারলে পাঠোদ্ধার করা যায়। এতে লেখা আছে "এই রাজপথ সিক্ত হয়েছে "শহীদ ডাক্তার শামসুল আলম মিলনের রক্তে"। বেদনার বোধ জাগা স্মৃতিফলকটি উন্মোচন করেছিলো তোমারই কন্যা "শ্যামা "। অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিয়ে এক সময় কাজগুলো করা হয়েছিল। কিন্তু এখন বদলে গেছে সব। ইতিহাস যেন উল্টো পথে পা বাড়িয়েছে।
অথচ খুব আগের কথা নয়। ১৯৮২ সালে ক্ষমতার দখল নেন জেনারেল এরশাদ। এ স্বৈরশাসকের পায়ে পিষ্ট হতে থাকে গণতন্ত্র। এর প্রতিবাদও ছিল তীব্র। গণতন্ত্রের দাবিতে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেন জাফর,দীপালী সাহা, জেহাদ, তাজুল, জয়নাল, নূর হোসেনসহ আরও অনেকে। এর ধারাবাহিকতায় আসে নব্বই। দীর্ঘ নয় বছরের ক্ষোভ বঞ্চনা রূপ নেয় গণআন্দোলনে।
তুমি তখন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক। এরশাদ সরকারের স্বাস্থ্যনীতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করেছো । বিএমএ'র আন্দোলনের নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলে তুমি । তাই সরকারের রোষানলে পড়তে হয় তোমাকে। তোমাকে চাকরির্চ্যূৎ করা হয়। চিকিৎসকসমাজের আন্দোলনের মুখে সরকার সে আদেশ বাতিল করে। তবে হয়রানি চলছিল। এরই একপর্যায়ে ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর এরশাদের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা তোমাকে পিছন থেকে গুলি ছোড়ে।
মনে পড়ে আমি তখন কয়েকজন ছাত্র নেতা সহ মধুর ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে টি.এস.সির দিকে আসছিলাম । হটাৎ গুলির শব্দ পাই । গুলি তো অনেক সময় ধরে চলছিলো তাই চমকাই নাই । এরাশাদ সরকারের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা তখন কার্জন হল ও শহীদুল্লা হলে অবস্থান নিয়ে দোয়েল চত্বর এলাকা থেকে গুলি করছিলো । আমাদের সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতা কর্মীরা টি.এস.সি এলাকায় অবস্থান নিয়েছিলো । সামনে এগিয়ে দেখি তুমি গুলিবিদ্ধ ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রতিবাদের রক্তে ভেসে যায়। আর সে রক্ত আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। গণআন্দোলন রূপ নেয় গণঅভু্যত্থানে। সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তোমার মুত্যূর পরই সরকার কারফিউ জারি করে । আমি শাহবাগ পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে সাংবাদিকতার আইডি দেখিয়ে কারফিউ পাস জোগার করি । তোমার মৃত্যুতে আন্দোলন আরো বেগবান হয় । মাত্র কয়েকদিন পর ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় এরশাদ । গণতন্ত্র ফেরে দেশ। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হওয়া সকলের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানায় জাতি। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে ততই ইতিহাসটির সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। আর তাই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে স্বৈরাচার এরশাদ। অন্য দলে স্বৈরাচারের প্রধানমন্ত্রী ব্যরিস্টার মওদুদ। তোমার প্রিয় দল জাসদ ও হাত মিলিয়েছে মহাজোটে সেই বিশ্ব বেহায়া এরশাদের সাথে । রাজনীতির এ হাওয়াই যেন লেগেছে তোমার স্মৃতিসত্মম্ভে। আর তাই ধুলোয় মলিন থাকে প্রতিবাদী মুখ। সম্মান করার পরিবর্তে অমর্যাদা করা হয় তোমার বীর এর স্মৃতিস্তম্ভকে। বিপস্নবী চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়। অথচ কেউ দেখার নেই। বলার নেই কারও কিছু। শুধু আছে আনুষ্ঠানিকতা। নিয়ম রক্ষার নিয়ম। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? ঘৃণ্য এ সংস্কৃতি থেকে দেশ কবে মুক্ত হবে? মিলন দিবসে আজ এ প্রশ্ন সচেতন মহলের।
আমি যাবোনা তোমার স্মৃতি স্তম্ভে । কারন আমার লজ্ঝা করে । কি সাহস নিয়ে দাড়াবো তোমার স্মৃতিস্তম্ভের সামনে ? যদি তোমার কন্যা "শ্যামা "র মুখোমুখি হই ? আমি জানতাম ৯০ এর আন্দোলনে বা এরশাদের পতনে আমাদের রাষ্ট্রের শেণী চরিত্র পরিবর্তন হবে না । আমি জানতাম যে আমাদের ১ দফার আন্দোলনের দাবীর দ্বন্দটা ছিলো ক্ষমতাসীন স্বৈরাচারের সাথে ক্ষমতাচূৎ এবং ক্ষমতা বর্হিভূত স্বৈরাচারের দ্বন্দ । এই দ্বন্দের অবসান হলেও রাষ্ট্রের শেনীচিরত্র পরিবর্তন হয়না । আমি জানি তুমি সহ সকল প্রগতিশীলরাই জানতো,তারপরও আমরা আন্দোলনে ছিলাম । ১০ অক্টোবর,৯০ সচিবালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত "জেহাদ" এর লাশ নিয়ে আমরা ছাত্ররা যে শফৎ নিয়ে ছিলাম যে, এরশাদের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরবো না । আমরা আমাদের কথা রেখেছিলাম। আমরা ঘরে ফিরে এসেছি । কিন্ত তোমার আর ঘরে ফেরা হয়নি, তুমি চলে গেলে না ফেরার ভুবনে । তোমার দলটিও আজ ক্ষমতাসীনদের সাথে আছে । তোমার দলের সেদিনের সাধারন সম্পাদক এখন মন্ত্রীত্বের আসনে বসেছেন । তোমার সহযোদ্ধা,যিনি তোমারই সাথে রিকাসায় ছিলেন তিনিও সংসদ সদস্য ছিলেন । কিন্ত তোমার রক্তের সাথে আমরা প্রতারনা করেছি । তাই সাহস পাইনা তোমার স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাড়াতে ।
আমাদের ক্ষমা করে দিও শহীদ ডা: মিলন ।
©somewhere in net ltd.