নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মেঘ বলেছে চৈত্রে যাব

মেঘ বলেছে চৈত্রে যাব › বিস্তারিত পোস্টঃ

অবেলায়

২৬ শে জুলাই, ২০১৩ ভোর ৪:৩৫

এই যুগে যেখানে প্রায় ছেলে মেয়েই নিজেরা নিজেদের পাত্রপাত্রি পছন্দ করে বিয়ে করে, সেখানে নিধি ও করিম বিয়ের ৫ দিন আগেও কেউ কাউকে চিনত না। পারিবারিক ভাবেই তাঁদের বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে। দুজনেই আবার বিয়ের আগে প্রেম ও করে নি। বিয়ের আগের প্রেমটাকে দুইজনের কাছেই জঘন্য বলে মনে হত। তবে তাঁরা যে প্রেমে পড়তে চায় নি, এমনও না। প্রথম দেখায় দুইজনেরই অনেককেই ভালো লেগেছিল। কিন্তু সেই ভালো লাগাটাকে প্রশ্রয় দেয় নি তাঁরা। একটা ছেলে একটা মেয়ে প্রেম করবে, যাঁর ভবিষ্যৎ থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে, এমন সম্পর্কের কোন মানেই হয় না। খামোখা সময় নষ্ট, মা বাবার মনে কষ্ট, পড়াশোনার ক্ষতি ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন তাঁরা অনেক সুখেই আছে। বিয়ের আগের তুলে রাখা প্রেম বিয়ের পরে করছে। চুটিয়ে করছে প্রেম। এইটাকে প্রেম বলে কিনা তাঁরা জানেনা। হতে পারে মহব্বত, হতে পারে ভালোবাসা। সবতো একই কথা।

প্রেমিক প্রেমিকার মতই কখনো ভালোবাসা, কখনো খুনসুটি, কখনো বা তুচ্ছ কারনে ঝগড়া, ছুটিরদিন ঘুরতে যাওয়া, করিমের কাছে নিধির এটা ওটা চাওয়া, ভীড়ের মধ্যে করিমের হাতকে নিধির শক্ত করে ধরে রাখা, এভাবেই চলছে তাঁদের সংসার। জোছনা রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোৎস্নাস্নান করে দুজন। একজন আরেকজনকে গান শোনায়। এ একটা গান গাইলে ও একটা গায়। আবার দুজনেই একসাথে গান গায়। মাঝে মাঝে করিমকে নিধি সন্দেহ করে। এত সুন্দর গান গায়, আবৃতি করে, চোখে আবার মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে। এমন ভাবুক প্রকৃতির ছেলে প্রেম করে নি, তাঁর বিশ্বাস হয় না। না না করিম তো মিথ্যে বলে না। দূর শুধু শুধুই তাকে সন্দেহ করি।

করিমও নিধিকে সন্দেহ করে। এমন সুন্দরী মেয়ে প্রেম করেনি তাঁর বিশ্বাস হয় না। কয়টা ছেলের সাথে প্রেম করেছে ও। ছেলে গুলো কি আমার চাইতেও স্মার্ট? না, না এসব কি ভাবছি। ও এমন হতেই পারে না। ও শুধুই আমার। আমার নিধি। আমার সম্পদ।

অবেচেতন মনে চিন্তা করা এই বিষয় গুলো নিজেরা আবার একে অপরকে বলে। দুইজনেই হাসে আবার দুইজনেই মন খারাপ করে। দুইজনেই একসাথেই বলে, তুমি কি আমায় অবিশ্বাস কর, সন্দেহ কর?

আবার চুপ করে থাকে দুইজন।

একদিন করিম নিধিকে বলেছিল, ভালোবাসায় কখনো অবিশ্বাস শব্দটা থাকা উচিৎ না। ভালোবাসার মানুষের জন্যে শুধুই ভালোবাসামিশ্রিত একটা মন থাকলেই হয়। সেখানে বিশ্বাসের আগে কখোনোই অ আসা উচিৎ নয়। তবে সন্দেহ প্রবণ হওয়া ভালো। তুমি আমায় সন্দেহ কর বলেই আমি বুঝতে পারি তুমি আমায় কতটা ভালোবাসো। আমাকে হারানোর তোমার কতটা ভয়! তোমার পুরো হৃদয় জুড়ে আমাকে কিভাবে রেখছ তা বুঝতে পারি।

কথা গুলো নিধির অনেক ভালো লেগেছিল। এমন স্বামী পেয়ে সে নিজেকে অনেক ভাগ্যবতি ভাবে।



কার্সরটাকে এইদিক সেইদিক করছে নিধি।

কোন গানটা শুনবে বুঝতে পারছে না। বিষাদের গান শুনবে নাকি নিটোল প্রেমের গান শুনবে বুঝতে পারছে না। মনটা এমনিতেই তাঁর ভীষন খারাপ হয়ে আছে। করিমের সাথে ঝগড়া হয়েছে তাঁর। সেলটাকে আছাড় মেরেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে করিম। করিমের এই একটা স্বভাব। স্বভাবটা কিছুটা ভালো আবার কিছুটা খারাপ। নিধির সাথে ঝগড়া হলেই সে কিছু একটা ভেঙে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পরে আবার আপনি থেকে এসেই নিধিকে সরি বলে। নিধির বিশ্বাস আজও করিম আপনি থেকে এসেই তাকে সরি বলবে। জড়িয়ে ধরতে চাইবে। সে অভিমান করে মুখ গোমড়া করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে থাকবে। আর মনে মনে খুশি হবে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাঁদের চোখাচোখি হবে। মুখে ভেংচি কেটে সে আবার অন্য দিকে মুখ করে বসবে। এরপর করিম এসে তাঁর খোলা চুলের গন্ধ নিবে। তারপর গাইতে থাকবে, তোমার চুলের গন্ধে কখন, লুকায়ে আসিলো লোভি আমার মন।

করিমকে ধাক্কা দিয়ে সে বলবে, হইছে, আর ফ্লার্ট করতে হবে না।



কার্সরটা গিয়ে মিফতাহ জামানের ফোল্ডারে ঢুকল।

শুধু তোমাকে এলবামের ৭ নাম্বার ট্র‍্যাকটা প্লে করল সে।

এই গানটা নিধি এবং করিম দুইজনেরই অনেক পছন্দের একটি গান। দুইজনেই আবার অনেক সুন্দর করে গানটা গাইতে পারে। মাঝে মাঝে দুইজনেই একসাথে গানটা গায়। নিধি স্থায়ী ধরলে করিম অন্তরা থেকে শুরু করে। এভাবে দুইজনের গলায় গানটি মিশে যায়।

ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে নিধি বারান্দায় চলে গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখল সে। সন্ধ্যা হয়ে এল প্রায়। দিনের আলো কেমন যেন আঁধারের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে। ভাবতেই তাঁর অবাক লাগে। জানালার গ্রিল ধরে দাড়ালো সে। মৃদু বাতাস এসে তাঁর খোলা চুলে মিশে যেতে চাইছে। গানের শুরুটা তাঁর কানে ভেসে আসল।

"তুমি এসেছিলে আমারি পাশে,

ভালোবাসবে বলে

তুমি এসেছিলে, আমারি পাশে

ভালোবাসবে বলে।

বুঝতে পারিনি আমি

বুঝতে দাওনি তুমি

বুঝতে পারিনি আমি

বুঝতে দাওনি তুমি।

নীরবে চেয়েছিলে

আমার চোখের পানে।

বুঝি নি আমি, বুঝি নি আমি,

বুঝি নি আমি, বুঝি নি আমি। "

তাঁর মনের ভিতর কেমন জানি একটা নাড়া দিয়ে উঠল। চোখ দুটো ছলছল করতে লাগল। একটা ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকালো সে। আকাশের মধ্যে আজ কেমন জানি একটা আলো আঁধারি খেলা বুঝা যাচ্ছে। সাদা কালো মেঘ গুলো এইদিক ওদিক ছোটাছোটি করছে। মনে হচ্ছে আকাশে মেলা বসেছে। মেঘের মেলা। মেলা আবার তারা বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। মেঘের ভীড়ে তারা গুলো একবার আড়াল হয় আবার দেখা যায়। সবকিছু চাপিয়ে যে জিনিসটা নিধিকে অবাক করল, তা হল আকাশে আজ গোল একটা চাঁদও দেখা যাচ্ছে। নিধির বুকটা হু হু করে উঠল। বুকটা কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা বলে মনে হলে। যেন কিসের একটা অভাব। সেই অভাবটাকে আরও তাঁতিয়ে দিল শুণ্যতার চাদর।



নাহ! পাশের বাসায় তো আলো দেখা যাচ্ছে। রাস্তাও ল্যাম্প পোস্টে বাতি জ্বলছে। তার মানে বিদ্যুৎ যায় নি। কিন্তু গানটা বন্ধ হয়ে গেলো কেন? নিধি রূমে যাওয়ার জন্যে পিছন ফিরতেই দেখল করিম তাঁর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। কখন এসে দাঁড়ালো সে টেরই পায় নি। কিছু বুঝে উঠার আগে করিম গানটার পরের অংশটুকু গাওয়া শুরু করল।

" যখন তুমি গান গেয়েছিলে,

আপন করে মোরে ডেকেছিলে।

আমি তখন কোন নেশার টানে,

তোমায় ফেলে অনেক দূরে।

আমি তখন কোন নেশার টানে,

তোমায় ফেলে অনেক দূরে।

তুমি শুধু হেসেছিলে,

সব ব্যথা আড়াল করে।

তুমি শুধু হেসেছিলে,

সব ব্যথা আড়াল করে।

বুঝি নি আমি, বুঝি নি আমি,

বুঝি নি আমি, বুঝি নি আমি।"

গানের এই অংশটা নিধির খুব পছন্দের। করিমের ভরাট কন্ঠে গানের এই অংশটুকে বেশি ভালো লাগে তাঁর। নিধির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। বুঝতে পারছে যে চোখে হাল্কা পানি চলে এসেছে। করিম হাতজোড় করে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। নিধি কিছু না বলে ফ্লোরে বসে পড়ল। আর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে গাইতে লাগল,

" এখন আমি একা বসে

আমায় রেখে তুমি গেছ চলে।

এখন আমি একা বসে,

আমায় ফেলে তুমি গেছ চলে।

কোথায় আজ হারালে তুমি,

কোথায় আজ হারালে তুমি।

আগে তোমায় কেন..…

বুঝি নি আমি, বুঝি নি আমি,

বুঝি নি আমি, বুঝি নি আমি।"

সমস্বরেই দুজনে গেয়ে উঠল,

বুঝি নি আমি, বুঝি নি আমি,

বুঝি নি আমি, বুঝি নি আমি।



করিম জানে নিধিকে গান শুনালেই রাগ কমে যাবে। বাসায় ঢুকেই " অবেলায়" গানটা শুনেই তাঁর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গিয়েছিল। তাই সে গানটা বন্ধ করে দিয়েছিল।

দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। দুজনের দৃষ্টি ই আকাশের দিকে। মেঘ জোছনার লুকোচুরি খেলায় হারিয়ে গেল দুজন। আর আবেগী জোছনায় ভেসে গেল দুটো স্বত্তা।

করিম নিধির দিকে তাকিয়ে আছে। নিধির দৃষ্টি এখনো অসীমের মাঝে। তাঁর চুলগুলো বাতাসের সাথে ঢেউ তুলে উড়ছে। জোছনার মৃদু আলোয় তাঁর মুখবয়বে একটা নিষ্পাপ আভা পড়েছে। এমন সুন্দর লাগছে যে সে অপলকেই চেয়ে আছে তাঁর দিকে। আর ভাবছে, এত সুন্দর বউয়ের সাথে কিভাবে আমি রাগ করি। আমি কি মানুষ?!

নিধির দিক থেকে চোখ না সরিয়েই করিম রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লার " উল্টো ঘুড়ি" কবিতার কয়েকটা চরণ আবৃত্তি করতে লাগল,

" এতো সহজেই ভালোবেসে ফেলি কেন!

বুঝি না আমার রক্তে কি আছে নেশা -



দেবদারু-চুলে উদাসী বাতাস মেখে

স্বপ্নের চোখে অনিদ্রা লিখি আমি,

কোন বেদনার বেনোজলে ভাসি সারাটা স্নিগ্ধ রাত?"

এতক্ষণে করিমের দিকে তাকালো নিধি। করিমের ঠোঁটে হাত দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিল। আর আবৃত্তি করতে লাগল,

" সহজেই আমি ভালোবেসে ফেলি,

সহজেই ভুলিনা কিছু -

না-বলা কথা তন্ত্রে তনুতে পুড়ি,

যেন লাল ঘুড়ি একটু বাতাস পেয়ে

উড়াই নিজেকে আকাশের পাশাপাশি।"

দুজনেই একসাথে বলল, এতো সহজেই ভালোবেসে ফ্যালো কেন?

নিঃশ্বাস দুরুত্বে থেকেই একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। দেরি না করেই নিধিকে বাহুডোরে বন্দি করে নিল করিম।

জোছনার আলোয় ভেসে গেলো, এক হয়ে গেলো দুটি প্রাণ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.