![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভবঘুরে জীবনের ইতি টানা আমার পক্ষে কখনো সম্ভব হয়ে উঠেনি। জীবনের প্রায় অর্ধেকেরও বেশী সময় এভাবে পার করে দিয়েও কোন পরিবর্তন হয়নি। বৈধভাবে আমার কখনো বিদেশ যাওয়া হয়নি। যদিও একযুগ পূর্বে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বন্ধু রাস্ট্রের আগরতলা যাওয়ার সুভাগ্য হয়েছিল। সেখানে প্রায় ৩দিন ভয় ও শঙ্কা নিয়ে কাটিয়ে পরবর্তীতে নিজ বাড়ীতে ফিরে আসি। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি সংযুক্ত আরব আমিরাত গমনের প্রবল ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমি অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় সে বারের মতো বিদেশের মাটিতে পা রাখা সম্ভব হলোনা।
সংযুক্ত আরব আমিরাত, যা আমাদের দেশের মানুষের নিকট দুবাই হিসাবে অধিক পরিচিত। শব্দটি ছোট হওয়ায় দুবাই হিসাবে পরিচয় দিতে বা লিখতে খুব সহজ। দুবাই যাওয়ার ক্ষেত্রে যিনি আমাকে খুবই উৎসাহ দিয়েছেন তিনি হচ্ছেন আমার বন্ধু ইউসুফ আনসারী। দীর্ঘদিন যাবত তিনি আমাকে দুবাই নেওয়ার জন্য অনেক আগ্রহ দেখিয়ে আসছিলেন। পরিশেষে আমিও যাওয়ার জন্য রাজি হলাম। আমার একটি শর্ত ছিল যে, আমি ডিসেম্বর মাস ব্যতীত আদালত প্রাঙ্গণ ছেড়ে বিদেশ যেতে পারবোনা। আমার জন্য যদি কোন ব্যবস্থা করতে হয় তাহলে ডিসেম্বর মাসেই করতে হবে। তিনি আমার কথায় রাজি হলেন কিন্তু বিধি বাম; নভেম্বর মাসে তিনি আমাকে জানালেন যে, নভেম্বর মাসেই আমাকে যাবতীয় কাজ রেখে দুবাই এর উদ্দেশ্যে যেতে হবে। অগত্যা আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমাকে ২০১১ সালের নভেম্বর মাসের ১৬ তারিখের মধ্যেই দুবাই পৌছতে হবে, না হলে ভিসা বাতিল হয়ে যাবে এবং আরো জানানো হলো যে, এবার ভিসা বাতিল হলে পুণরায় দুবাই যাওয়া সম্ভব হবেনা। নভেম্বর মাসে এমনিতেই কোর্টের কাজ বেশী থাকে, অন্যদিকে ডিসেম্বর মাস বন্ধ থাকার কারণে নভেম্বর মাসের আয়ের কিছুটা ডিসেম্বর মাসের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে হয়। এ মূহুর্তে আমার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল খুবই কঠিন। তারপরও স্বপ্নের শহর দেখার জন্য আমার মন উতালা হয়ে উঠল। আমার চিকিৎসক স্ত্রীর সাথে বিষয়টি শেয়ার করতে চাইলে সে কোনভাবেই মানতে রাজি নয়। অগত্যা তাকে না জানিয়েই আমি সবকিছু গুছিয়ে টিকিটের জন্য বুকিং দিলাম। আমার স্ত্রী আমার পাসপোর্ট লুকিয়ে ফেলবে এই ভয়ে আমি তাকে জানানোর পূর্বেই আমার পাসপোর্টটি লুকিয়ে ফেললাম। অবশেষে পেশাগত কাজকর্ম বিশ্বস্ত বন্ধুদের উপর দায়িত্ব দিয়ে ১৪ নভেম্বর বাসা হইতে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার প্রাক্কালে স্ত্রীর কর্মস্থলে গিয়ে ঢাকা যাওয়ার কথা বলে বিদায় নিলাম।
ঢাকা পৌঁছেই আমি জানলাম যে, ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬ টায় বিমান ছাড়বে, কিন্তু ইব্রাহীম ভাই জানালেন যে, ৬ টার পরিবর্তে ৪ টায় বিমান ছাড়বে। তাই ১৫ তারিখে ১২টার মধ্যেই আমাকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌছুতে হবে। তাই ছোট ভাই লিটনের গাড়ি করে বিমান বন্দর পৌঁছলাম। লিটনের কাজ থাকায় আমাকে বিমান বন্দরে নামিয়ে দিয়েই সে চলে গেলে আমি ভেতরে চলে যাই। ইউনাইটেড এয়ার ওয়েজের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগে জানতে পারি যে, বিমান পরদিন সকাল ৭টায় ছাড়বে। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। ১৬ তারিখের মধ্যে আমাকে দুবাই পৌছুতে হবে। ঐদিন ও যদি ফ্লাইট মিস হয় তাহলে আমার ভিসা বাতিল হয়ে যাবে। স্বপ্নের দু্বাই শহর আর দেখা হবেনা। অগত্যা লিটনকে পুণরায় ডেকে এনে তার গাড়ী করে এমিরাটস এয়ারলাইনস এর জন্য বুকিং দিয়ে রাখি। যাতে অন্য বিমানে হলেও দুবাই যাওয়া যায়। ১৬ নভেম্বর রাত ৩টায় ঘুম থেকে উঠে লিটন কে জাগিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রাওয়ানা হই। বিমান বন্দরে পৌছা মাত্রই আমি ভেতরে প্রবেশ করে সিডিউল ঠিক আছে কিনা জেনে নেই। সিডিউল ঠিক আছে জেনে আশ্বস্ত হয়ে লিটনকে বিদায় দিয়ে বোডিং পাস এর জন্য অপেক্ষা করি। বোর্ডিং পাস পেয়ে ইমিগ্রেশন এর ভেতরে প্রবেশ করি। ইমিগ্রেশনের লম্বা লাইন হওয়ায় লাইন ভেঙ্গে অন্য লাইনে গেলাম। অনেক কষ্ট করে যখন ইমেগ্রেশন অফিসারের নিকট গেলাম, তখনি আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন জর্জরিত করতে লাগলো। অন্য একজন অফিসার দিয়ে আমাকে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নিকট পাঠানো হলো। তিনি আমার পাসপোর্ট দেখে আমাকে পুনরায় ঐ অফিসারের নিকট পাঠালেন যেন আমাকে ভেতরে যেতে দেওয়া হয়। উর্দ্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশমত আমাকে ইমিগ্রেশন পার হতে দেওয়া হলো। কি কারণে আমাকে আটকানো হয়েছে তাহা আমি তৌহিদ সাহেবের নিকট থেকে জানতে পেরেছি। কারণ দুবাই গিয়ে নাকি অনেকে আসতে চায়না এবং আমার পাসপোর্টে অন্য কোন দেশের সীল না থাকায় আমি ফিরে আসবো কিনা এ বিষয়ে কর্মকর্তা সন্দিহান ছিল। বিমানে উঠার পূর্ব মূহুর্তে তৌহিদ সাহেবের সাথে পরিচয় হলো। তিনি ফেনীর সন্তান, বিদেশ ভ্রমনে তার প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। পরিচয়ের পর তিনি আমাকে আটকানোর বিষয়টি অফিসারের নিকট থেকে জেনেছেন বলে আমাকে জানান। সকাল ৭টার সময়ে আমরা বিমানে উঠি। বিমানে চড়ার আগেই তৌহিদ সাহেবের সাথে মোটামুটি আমার সখ্যতা হয়ে গেছে। কিন্তু আমার ও তাহার সীট একই সাথে না পড়ায় আমি যেন একা হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার পার্শ্বের সীটের ভদ্রলোককে তৌহিদ সাহেবের সীটে স্থানান্তর করে তাকে আমার পার্শ্বে নিয়ে আসি।
বিমান ছাড়ার পূর্ব মুহুর্তে পূলকিত হয়ে যাই। বিমান প্রমীলা বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিতে থাকেন। বিমান ছাড়ার পর আকাশে উঠার সময়ে নিজেকে খুবই গর্বিত মনে হয়েছে। বিমানে বসে তৌহিদ সাহেবের সাথে প্রচুর আলাপচারিতায় সময় কাটতে থাকে। বিমান প্রমীলাদের আতিথেয়তা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণে অনেক ভালোই সময় কেটেছে। পরিশেষে বিমান থেকে বলা হলো যে, কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা দুবাই আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করছি। তৌহিদ সাহেবের নিকট দুবাই এর একটি সীম ছিল। তিনি তাহা খুলে মোবাইলে ঢুকিয়ে আত্মীয়ের সাথে বিমান থেকেই কথা বললেন। আমিও সুযোগের হাতছাড়া করলাম না। বন্ধু ইউসুফ আনসারীকে ফোন করে আমার অবস্থানের কথা জানালাম। তিনি অনেক আগেই বিমান বন্দরে অপেক্ষা করছেন জেনে অনেকটা আশ্বস্ত হলাম। দুবাই বিমান বন্দরে বিমান অবতরণের পর চারিদিকে তাকিয়ে খুবই অবাক লেগেছে। এত সুন্দর শহর হতে পারে? আমার বিশ্বাস হচ্ছিলনা। ইমিগ্রেশনের পুর্বে আমাকে চক্ষু পরীক্ষা দিতে হলো। চক্ষু পরীক্ষা দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হতে হবে এবং আমাকে কি কি প্রশ্ন করা হবে তার উত্তর তৌহিদ সাহেব আমাকে নির্দেশনা দিয়ে বাইরে চলে যান। আমি ইমিগ্রেশন পার হয়ে বাইরে চলে এসে দেখি বন্ধু ইউসুফ আনসারী, তৌহিদ ও তার আত্মীয় আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছেন। আমাকে পাওয়ার পর কুশল বিনিময় করে আমরা টেক্সি নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। আমাদের গন্তব্যের পুর্বেই তৌহিদ সাহেবেরা নেমে গেলেন। আমি ও বন্ধু আনসারী দুবাই এর ‘সুউক নায়েফ’ নেমে তার কর্মস্থলে গেলাম। আনসারী একটি ঘড়ির দোকান এর দায়িত্বে আছেন। তার সহকর্মী মাহমুদ মিশরীয় নাগরিক। মাহমুদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি ‘সুউক নায়েফ’ মসজিদে জোহরের নামাজ পড়ার জন্য যাই। আমি মসজিদে ঢোকার পূর্বে জুতা খুলে জুতা ভেতরে নিতে গিয়ে দেখি, আমার চেয়ে আরো অনেক বেশী দামী জুতা বাইরে পড়ে আছে, তাই আমি জুতা ভেতরে না নিয়া বাইরে রেখে দেই। জোহরের নামাজ পড়াকালে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও বাইরে এসে জুতা সঠিক স্থানে দেখতে পাই। নামাজ পড়ার পর আমি আনসারীর দোকানে এলে তিনি আমাকে নিয়ে বাসায় চলে আসেন। খাওয়া দাওয়া সেরে আমি কিছুটা বিশ্রাম নেই।
দুপুর গড়িয়ে যখন বিকাল হতে লাগল, তখন আমার আর বিশ্রাম নিতে মন চাইলনা। আমি বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে ইউসুফ ভাই আমাকে আরো শুয়ে থাকতে বলেন। কিন্তু আমি কিছুতেই আর শুয়ে থাকতে চাইলাম না। অগত্যা তিনি আমাকে নিয়ে তার দোকানের দিকে রাওনা হন। দোকানে যাওয়ার পর আমাকে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে বলেন। পাশাপাশি তিনি আমাকে তার মোবাইল থেকে খুলে একটি সীম দেন। যাতে তিনি আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন। আমি সীমটি আমার মোবাইলে ঢুকিয়ে তখনকার জন্য বেরিয়ে যাই। যে এলাকায় আমি ঘুরতে বেরিয়েছি তা ‘দেরাহ দুবাই’ নামে পরিচিত। বিশেষ করে বিভিন্ন দোকান পাট ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এ এলাকায় অবস্থিত। এখানকার লোকজন আরবী, উর্দু ও হিন্দি ভাষায় কথা বলে। ইংরেজির প্রচলন ও রয়েছে। হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষার প্রচলন থাকায় আমাকে একা বেরুতে কোন সমস্যা হবেনা ভেবে ইউসুফ ভাই আমাকে একাই দেখার জন্য ছেড়ে দেন। আমি সারা বিকাল শহরের অলি-গলিতে হাটাহাটি করি। সেখানকার ‘গোল্ডেন সুউক’ বা স্বর্ণ মার্কেট খুবই বিখ্যাত। আমি স্বর্ণ মার্কেট সহ অনেক মার্কেট ঘুরে দেখি। অলিতে গলিতে বিভিন্ন ধরণের লোক দেখি। বোরখা পরা মহিলা যেমন দেখেছি তেমনি হাফ প্যান্ট পরাও দেখেছি। কোন কিছু কেনার মত বা মূল্য জিজ্ঞেস করার মত সাহস আমার ছিলনা। কারণ প্রতিটি জিনিসের দাম গায়ে লিখা আছে। বাংলাদেশী টাকায় যখন হিসাব করে দেখি তখন খুবই অবিশ্বাস্য লাগে। যেমন একটি শার্টের গায়ে মুল্য লিখা আছে ৩৫০ দিরহাম, যা আমাদের দেশীয় টাকায় ৭ হাজার টাকা থেকেও বেশী। আমি এশার নামাজ পড়ে আস্তে আস্তে ইউসুফ ভাইয়ের দোকানে আসার চেষ্টা করি। কিন্তু তা আর পারলাম কই? প্রতিটি রাস্তাই একই রকম লাগে। কোন রিক্সা নেই তবে শহরে প্রচুর টেক্সি ক্যাব আছে। যাতে সর্ব নিম্ন ভাড়া ১০ দিরহাম বা দু’শ টাকা। এক বা আধা কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দেওয়ার জন্য দু’শ টাকা দিয়ে দেবো তা ভাবতে কষ্ট লাগছিল। রাস্তায় অনেক পাকিস্থানী আছে, তাদেরকে পোশাক দেখলেই চেনা যায়। তাদেরকে জিজ্ঞেস করে ও মোবাইল ফোনের সুবাদে অনেক কস্টে ইউসুফ ভাইয়ের নিকট পৌঁছি। ইউসুফ ভাই খুবই ব্যস্ত লোক, তাছাড়া যারা দোকানে চাকুরী করেন তাদের কোন ছুটি নেই। বছরে একদিনও নয়। যা আমাদের দেশে কল্পনাও করা যায়না। মার্কেটের হলি ডে বলতে কিছুই নেই। মার্কেটের কোন দোকান ইচ্ছে করলে কেউ বন্ধ রাখতে পারেনা। নির্দিষ্ট সময়ের পরে কোন দোকান খুললে বা কোন দোকান বন্ধ রাখলে নগর কর্তৃপক্ষ অনেক টাকা জরিমানা করে দেয়। তাছাড়া মালিকের খড়গ তো আছেই। এ কারণে কোন দোকান বন্ধ থাকেনা। দোকান বন্ধ করার পর ইউসুফ ভাই সহ আমি বাসায় চলে আসি। বাসা শহরের ভেতরেই। হোটেল ক্যালিফোনিয়ার পার্শ্বের বিল্ডিং। ৬ তলা বাসার ৩ তলায় ইউসুফ ভাইয়েরা থাকে। বাসায় অনেকের সাথে আমার পরিচয় হয়। ইউসুফ ভাই ব্যতীত আর সকলেই ভারতীয়। তারা ভারতের কেরালা রাজ্যের অধিবাসী। যারা মালওয়ারী হিসাবেও পরিচিত। সালাম নামে ইউসুফ ভাইয়ের এক অন্তরঙ্গ বন্ধু রয়েছে। সে খুবই হাসিখুশী থাকে। সালাম ইউসুফ ভাইকে কেরালার ভাষা শেখায়, ইউসুফ ভাই সালাম কে বাংলা শেখায়। কিন্তু ইউসুফ ভাই সালামকে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা শেখানোর কারণে সালাম যখন বাংলা বলার চেষ্টা করে তখন তা শুনে না হেসে পারা যায়না। সালাম যতবারই আমার সাথে বাংলার কোন শব্দ উচ্চারণ করেছে তখনই আমি বা অপর বাঙ্গালীরা হেসেছি। ইউসুফ ভাই সালামকে নোয়াখালীর অনেক গালিও শিখিয়েছে। ইউসুফ ভাইদের বাসায় সবাই বিবাহিত ব্যাচেলর। একটি খাটের উপর সিড়িতে উঠে আরেকজন থাকে। বাসা ভাড়া অনেক বেশী। ইউসুফ ভাইয়ের কাছে জেনেছি একটি সিটের ভাড়া ৫০০ দিরহাম, বাংলাদেশী টাকায় ১০ হাজার টাকার উপরে। রাতে খাওয়ার পর আমরা সবাই শুয়ে পড়ি।
১৭ তারিখ সকাল বেলা আমি ঘুম থেকে ৫ টায় জোগে যাই। বাংলাদেশে থাকাবস্থায় আমি খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠার চেষ্টা করতাম। সেখানেও আমি ভোরে উঠে যাই। কিন্তু কেউ ঘুম থেকে উঠছেনা। যাওয়ার পূর্বেই আমার জেঠাত বোনের ছেলে দিদার এর মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করেছিলাম। আমি সকালে ফোন দেওয়ায় সে আমাকে আবুধাবী যেতে বলল। আমি ইউসুফ ভাইকে বললাম আমাকে আবুধাবীর বাসে উঠিয়ে দিতে। ইউসুফ ভাই আমাকে আবুধাবীর প্রাইভেট কারে উঠিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন কিন্তু তা সম্ভব হলোনা। পাকিস্থানী ও আফগানী কিছু লোক গাড়ী কিনে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে গোপনভাবে ভাড়ার গাড়ি চালায়। ঐ সকল গাড়িতে আমাকে পাঠাতে চাইলে আমি যেতে রাজি হলামনা। অগত্যা আমাকে বাসের উদ্দেশ্যে যেতে হলো। আবুধাবীর বাস ‘দেরাহ দুবাই’ থেকে ছাড়েনা। আবুধাবীর বাসের জন্য ‘বাহার দুবাই’ যেতে হবে। ‘বাহার’ বা ‘বার’ মানে সাগর। বার দুবাই যেতে হলে একটি নদী পার হতে হয়। নদীটি আরব সাগর হতে কৃত্রিম ভাবে তৈরী করা হয়েছে। নদীর দু’পাশে অট্রালিকা ভবন দেখতে খুবই মনোরম লাগছিল। যেখানে ইঞ্জিন চালিত নৌকা থামলো তা ‘আবরার’ নামে পরিচিত। নদীর পাশ দিয়ে যে রাস্তা বয়ে গেছে তা খুবই পরিস্কার। নদীর কূল বেয়ে মানুষ কে জিজ্ঞেস করে আমি হাটতে হাটতে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। বাসের টিকিট কেটে বাসে চড়ে আবুধাবীর দিকে রাওনা হলাম। আমার পাশে যে ভদ্রলোক বসা ছিলেন তিনি নেপালী। আমি ভেবেছিলাম তিনি ফিলিপিনো তাই অনেকক্ষণ কোন আলাপ হয়নি। আমি রাস্তার দুপার্শ্বের বিল্ডিং গুলো দেখছিলাম। দুবাই আধুনিক বিশ্বের শহর গুলোর মধ্যে অন্যতম। সুউচ্চ অট্টালিকা, নিমাণ শৈলী আমাকে খুব মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে শেখ যায়েদ রোডের দু’পার্শ্বের ভবন গুলো ভুলবার মত নয়। হাজার হাজার বিল্ডিং একই নক্সা অনুসারে তৈরী। শেখ যায়েদ রোড খুবই প্রশস্ত। মাঝখানে আইল্যান্ড ছাড়াও একদিকে ৬টি লেইন রয়েছে। অর্থাৎ ৬টি গাড়ি একসঙ্গে একই দিকে চলতে পারে। প্রতিটি লেইনের গতি নির্ধারণ করা আছে। সর্ব ডান পার্শ্বের লাইনে পুলিশ বা এম্বুলেন্স চলবে। একই লাইনে ওভার টেক করা যাবেনা। ওভার টেক করতে হলে লাইন পরিবর্তন করে গাড়ির গতি বাড়াতে হয়। যাওয়ার পথে বুর্জ আল আরব, জুমায়রা বীচের ৭ স্টার হোটেল সহ অপরাপর নির্মান শৈলী, মরুদ্যান, ইন্টারনেট সিটি, শেখ যায়েদ মসজিদ চোখে পড়ে। নেপালী ভদ্রলোক আমাকে সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। প্রায় দু ঘন্টা পাড়ি দিয়ে আমি আবুধাবীতে পৌছালাম। আবুধাবী সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী। আমি আবুধাবী এসে বাসস্ট্যান্ডে দীদার এর জন্য অপেক্ষা করছি। প্রায় আধ ঘন্টা পর দীদার এসে আমাকে অভিবাদন জানালো। আমি ও দীদার হাটতে হাটতে ‘মদিনা জায়েদ’ মার্কেটের নিকট আসি। এখানে এসে আমি জোহরের নামাজ পড়ি। জোহরের নামাজ পড়ার পর একটি বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে আমরা লাঞ্চ সেরে নেই। ইতোমধ্যে দীদার আমার পার্শ্ববর্তী গ্রামের ছেলে সুমন কে টেলিফোন করে আমার আসার খবর জানিয়ে দেয়। সুমন এসে আমাদের সাথে যোগ দেয়। সুমনের বাসা শহরের মধ্যে হওয়ায় দীদার আমার ব্যাগটি সুমনের বাসায় রেখে আসে। সুমন ও দীদার আমাকে বিভিন্ন স্পট সমুহ দেখাতে থাকে কিন্তু তা ধারণ করার জন্য ক্যামেরা না থাকায় সমস্যায় পড়ে যাই। পরে আমরা মদিনা যায়েদ মার্কেটে গিয়ে একটি ক্যামরা কিনে ছবি উঠাতে থাকি। অফিস শেষ হওয়ার পর আমাদের সাথে যোগ দেয় হাশেম, রাজু, আফসার। হাশেম আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু। রাজু আমার মায়ের সম্পর্কের আত্মীয়, আফসার রাজুর ভগ্নীপতি। আমি দীদারের মামা হওয়ায় সকলেই আমাকে মামা হিসাবে সম্বোধন করা শুরু করে। তারা অত্যন্ত আগ্রহে আমাকে পার্ক, কর্ণিশ (আবুধাবী বীচের কূল), আবুধাবী মল সহ বিভিন্ন প্রসিদ্ধ স্থানে নিয়ে যায়। রাতে আমরা সবাই একসাথে ডিনার সেরে হাশেম ও আফসার ব্যতীত সবাই সুমনের বাসায় চলে যাই। সুমনের বাসায় ফেনীর অনেক সঙ্গী রয়েছে। তারা আমাকে পেয়ে খুবই খুশী। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ি।
১৮ নভেম্বর, শুক্রবার ঘুম থেকে একটু আগেই জেগেছি। নাস্তা খাওয়ার জন্য আমরা আটজন হোটেলে যাওয়ার পথে পাঠানি রুটি নিতে যাই। সবাই আমার সাথে গল্প করা কালে একজনকে ৮টি রুটি কেনার জন্য পাঠান ভদ্রলোকের নিকট পাঠানো হয়। দোকানী একজনের জন্য ২টি রুটি দিতে রাজি হয়। পরে আমাদের দল থেকে আরো একজন আমাদেরকে দেখিয়ে ৪ টি করে ৮টি রুটি কিনতে চাইলে দোকানী কোনভাবেই আমাদের নিকট পরবর্তীতে একটি রুটিও বিক্রি করতে রাজি হয়নি। পাঠানরা যা বুঝে তাদেরকে আর বোঝানো যায়না। আমরা কোন রকম সকালের নাস্তা সেরে বিদায় নেই। আমার তীব্র আকাঙ্খা এশিয়ার বিখ্যাত শেখ যায়েদ মসজিদ দেখার জন্য। তাই তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে ট্যাক্সি ক্যাবে উঠলাম। প্রায় বেলা ১০ ঘটিকার সময় আমরা শেখ যায়েদ মসজিদের আঙ্গিনায় পৌঁছালাম। খুবই অপুর্ব দৃশ্য। আমার জীবনে কখনো এত সুন্দর মসজিদ দেখা হয়নি। মসজিদের বারান্দায় আয়তন অনেক বড়। একদিকে খলিফা শেখ যায়েদ এর কবর রয়েছে। সারাক্ষণ সেখান থেকে কুরআন তেলাওয়াত শোনা যাচ্ছিল। শেখ যায়েদ এর কবর সমাধির ছবি তোলা ‘মামনুহ’ বা নিষেধ হওয়ায় আমরা শুধুমাত্র বাইরে থেকে দেখে মসজিদের দিকে চলে এলাম। মসজিদের বারান্দায় দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন পর্যটক দেখা গেছে। মসজিদের বারান্দায় তারা হাঁটতে কোন বাধা নেই। বিদেশী মহিলাদের মসজিদের ভেতরে ঢুকতে হলে বোরখা পরে ঢুকতে হয়। সেজন্য মসজিদের বাইরে তাদের জন্য বোরখা রাখা আছে। আমরা মসজিদের অজুখানায় গিয়ে অজু করলাম। অজুখানায় পানির ফোয়ারা ও চলন্ত সিঁড়ি রয়েছে। বেলা ১২ ঘটিকার সময় মসজিদের মুল গেইট খোলায় আমরা মসজিদের ভেতর ঢুকলাম। মসজিদের বাতি, কার্পেট, নক্সা ও নির্মান শৈলী আধুনিক স্থাপত্য কলার এক অপুর্ব নিদর্শন। জুমার নামাজের খুতবার পূর্বে ইমাম সাহেব কোরান তেলাওয়াত করলেন। আমার খুবই আশ্চার্য লেগেছে যে, ইমাম সাহেবের মুখে দাঁড়ি নেই। পরে জানতে পারলাম তিনি নাকি মিশরীয়। আমরা প্রথম কাতারে নামাজের জন্য জায়গা পেয়েছি। মসজিদটি শহরের একপ্রান্তে হলেও অনেক দুর-দুরান্ত থেকে নামাজ আদায় করার জন্য মুসল্লীরা আসেন। নামাজ শেষে আমরা হাশেম এর বাসার দিকে যাওয়ার জন্য টেক্সিতে উঠি। হাশেম আমাদেরকে দুপুরের লাঞ্চের জন্য আগেই দাওয়াত করেছিল। হাশেমের বাসায় গিয়ে তার ভাই ও রুম মেটের সাথে পরিচয় হলো। হাশেমের বড় ভাই খুবই ভাল রান্না করতে পারেন। আমরা লাঞ্চ সেরে দেরী না করে আবুধাবী বিচের দিকে রাওয়া হলাম। আবুধাবী বীচ খুবই প্রসিদ্ধ। বীচে ঢুকতে হলে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে হাফপ্যান্ট বা সুইমিং পোষাক পরা বাধ্যতামূলক। আমাদের সাথে সুইমিং পোষাক না থাকায় রাজু মামাকে চারটি প্যান্ট নিয়ে বীচে আসতে বলা হলো। রাজু মামার সময় জ্ঞান বেশী। অর্থাৎ এক ঘন্টার কথা বলে তিন ঘন্টা সময় নেয়। সেজন্য গুরুত্ব দেওয়ার জন্য আমাকে ফোন করতে হলো। তারপরও রাজু মামার জন্য আমাদেরকে পৌঁছার পর আরো একঘন্টা অপেক্ষা করতে হলো। আবুধাবী বীচের পরিবেশ অত্যন্ত সুন্দর। সেখানে সাগর থেকে উঠার পর সুন্দরভাবে গোসলের ব্যবস্থা রয়েছে। রাজু আসার পর আমরা সুইমিং পোষাক পড়ে আরব সাগরে ডুব দেওয়ার জন্য সাগরে নামলাম। সেখানে অনেক ইউরোপিয়ান পুরুষ মহিলা দেখে প্রথমে থমকে গিয়েছিলাম। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে জড়তা কমে গেছে। সন্ধা পর্যন্ত আমরা বীচে থেকে গোসল সেরে মার্কেটে অনেকক্ষণ ঘুরাফেরা করে ডিনার সারলাম। গত কয়েকদিন যাবত অনেকে ফোন করছে আমার সাথে দেখা করার জন্য। আজ তারা সবাই হোটেল মার্কিউরি এর সামনে অপেক্ষা করছে। তাদের সাথে সেখানে দেখা করলাম। দীদার আমাকে তার বাসায় নেওয়ার জন্য ইতোপূর্বে ব্যর্থ হয়েছে। আজ যেভাবেই হোক আমাকে তার বাসায় নিবেই। কিন্তু সুমন ও হাশেম চাচ্ছে আমি তাদের বাসায় যাই। দীদারের আকুতিকে আমি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারিছিলামনা। দিদার সবাইকে বুঝিয়ে ইয়াসিনসহ আমাকে তার বাসায় নেওয়ার জন্য ট্যাক্সিতে উঠালো। দীদারের বাসা আবুধাবী শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দুরে প্রত্যন্ত এলাকায়। সারাদিন ঘোরাঘুরির পর খুবই ক্লান্ত লাগছিল। ঘন্টা খানেক পর আমরা প্রায় রাত ১১ টার দিকে দীদারের বাসার দ্বারপ্রান্তে নামলাম। এরপর মুহুর্তের ঘটনা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। এটি ছিল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল এরিয়া এবং সংরক্ষিত এলাকা। সিকিউরিটি কোনভাবেই আমাকে পাশ ছাড়া ভেতরে ঢুকতে দিতে রাজি নয়। দীদার এতকষ্ট করে তিন বন্ধুকে অনুরোধ করে আমাকে তার কাছে নিয়ে এসেছে অথচ সিকিউরিটি ঢুকতে দিচ্ছেনা বিষয়টি তার কাছে খুবই অপমানজনক মনে হয়েছে। দীদার যে কি কস্ট পেয়েছিল তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ অনুভব করতে পারেনি। দীদার লজ্জায় আমাকে চোখ দেখাতে পারছিলনা, তার চোখের পানি গড়িয়ে পরছে লজ্জায় । তার অবস্থা দেখে আমিও চোখের পানি সামলাতে পারছিলামনা। আমি গেইট থেকে রাস্তায় চলে আসি কিন্তু ৭০ কিলোমিটার পথ এতরাতে পাড়ি দেয়া সহজ নয়। ইয়াসিন আমাকে টানাটানি করছিল তার সাথে যাওয়ার জন্য আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলামনা। আমি অনেক দুর পর্যন্ত সিকিউরিটি ও দীদারের ঝগড়া শুনছিলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পর একটি ট্যাক্সি পাওয়া গেলে আমি ট্যাক্সিতে উঠে যাই। ট্যাক্সিতে উঠে দীদারকে ফোন করার চেষ্টা করি কিন্তু মোবাইলের চার্জ না থাকায় তাও করা যাচ্ছেনা। বিপদের অন্ত নেই। একদিকে অপরিচিত জায়গা, কারো সাথে কোন যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা; নিজেকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছিল। ট্যাক্সির ড্রাইভারের মোবাইলে আমার মোবাইলের সীমটি ঢুকিয়ে কথা বলার চেস্টা করছিলাম, কিন্তু সে আরবী ভাষী। সে ইংরেজি ও হিন্দি কিছুই বুঝেনা। ইশারা করে ও ব্যর্থ হলাম। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর এক ভারতীয় উঠলে তার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে আমার সিমটি ঢুকিয়ে সুমন ও হাশেম কে বাসষ্ট্যান্ডে থাকতে বললাম এবং আমার মোবাইলে চার্জ নেই তাও জানিয়ে দিলাম। দীদারও তাদের কাছে ফোন করেছে, কিন্তু আমার সাথে যে তাদের যোগাযোগ হয়েছে তা দীদারকে জানায়নি ফলে দীদার আরো কষ্ট পায়। অবশেষে অনেক কষ্টে তাদেরকে পেয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়ে সে রাতের মতো হাশেমের বাসায় রাত কাটালাম।
১৯ নভেম্বর সকাল বেলা হাশেমের বড়ভাই সহ তাদের কর্মস্থলে আসি। আমরা যাওয়ার আগেই হোটেল মার্কিউরির সামনে সুমন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল, সে আমাকে আল আইন যাওয়ার বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে সে তার গন্তব্যে চলে যায়।
আল আইনের বাসে উঠে আমি আবুধাবী শহরের অনেক অট্টালিকা দেখতে থাকি। ইতোমধ্যে জানতে পারি যে, আমার বোনের ভাসুরের ছেলে মীরু ও দীদারের ছোটভাই পলাশ আল আইনে চাকুরী করে। আমি মীরুকে ফোন করা মাত্রই সে বাসস্ট্যান্ডে আমার জন্য অপেক্ষা করবে বলে আশ্বস্ত করে। আমি ও নিজেকে নিরাপদ মনে করতে থাকি। আমার পার্শ্বের সীটে একজন আফগানী বসে ছিলেন। তিনি সম্ভবত হকারের কাজ করেন। তার সাথে অনেক অন্তরঙ্গ আলাপ হয়। তিনি আমাকে আফগানিস্থানের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কথা অকপটে জানিয়ে দেন এবং আফগানিস্থান দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আল আইন যাওয়ার পথে ইউ.এ.ই সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কার্যক্রম চোখে পড়ে। মরুভূমিতে পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ইন্ড্রাস্ট্রিজ নির্মান খুবই প্রশংসনীয়। ‘আল আইন’ নামার পর মীরু আমার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। মীরুর সাথে অভিবাদন সেরে আমরা গাড়িতে উঠি। মীরু ঐ এলাকায় ড্রাইভিং এর চাকুরী করায় সকল রাস্তা-ঘাট তার চেনা। সে সহজেই আমাকে বিভিন্ন জায়গা চেনাতে পারছে। আল আইন হল একটি আধুনিক গ্রীন সিটি। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আল আইন অত্যন্ত সুন্দর। সেখানে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আমরা প্রথমে উটের খামার দেখার জন্য যাই। আমি কখনো উটের বিচরণ দেখিনি। পল্লী এলাকায় উটের অনেক খামার রয়েছে। উটের খামারে যারা কাজ করে তাদের বেশীর ভাগ সুদানের নাগরিক। আমি ও মীরু একটি উটের খামারে ঢুকলাম। উটের খামার দেখাশুনার দায়িত্বে যিনি রয়েছেন তিনি সুদানী। তিনি আমাদেরকে ঘুরে ঘুরে তার খামারটি দেখালেন এবং আমাদের সাথে ছবি তুললেন। এরপর আমরা আল-আইনের একটি সুপার মার্কেটে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি কথা না বললেই নয়। সেখানকার টয়লেট গুলো খুবই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। সেটা মসজিদ, মার্কেট, হোটেল, বাসস্ট্যান্ড বা রেস্তোঁরা যেখানেই হোক না কেন সব জায়গার বাথরুম গুলো খুবই পরিস্কার। সাবান ও টিস্যু সব টয়লেটে অনায়াসে পাওয়া যায় এবং আমাদের দেশের মতো বাথরুম ব্যবহারে কোন ধরণের টাকা ব্যয় করতে হয়না। সেখানে সকল ক্ষেত্রেই বেসরকারী ব্যবস্থাপনার চেয়ে সরকারী ব্যবস্থাপনা বেশী কার্যকর। মার্কেটের দৃশ্যাবলী দেখার পর আমরা পুণরায় গাড়ীতে উঠলাম ‘যাবল হাফিজ’ এর উদ্দেশ্যে। যাবল হাফিজ হচ্ছে ওমান সীমান্তের একটি পাহাড়। যার উচ্চতা সমতল ভূমি হতে প্রায় ৬ হাজার ফুট উপরে। পাহাড়ের চুড়া থেকে সুউচ্চ বিল্ডিং গুলো অনেক ছোট বলে মনে হয়। আমরা গাড়িতে করে যাবল হাফিজে উঠার সময়ে ওখানকার খলিফার একটি সুন্দর বাড়ী দেখলাম। একসময়ে যাবল হাফিজে মানুষ উঠতে পারতোনা। বর্তমানে উঠার জন্য হাজার কোটি দিরহাম ব্যয়ে সুন্দর রাস্তা করা হয়েছে। উক্ত রাস্তা ধরে আমরা প্রথমে খলিফার সুরম্য ভিলায় দাঁড়ালাম। সেখানকার সিকিউরিটি নেপালী। তিনি আমাদের কে ছবি উঠাতে দিলেন। কিন্তু ভেতরে ঢোকার অনুমতি না থাকায় বাইরে থেকে দেখতে বললেন। এরপর আমরা আরো উপরে উঠে আরো একটি সুন্দর অট্টালিকা দেখলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম সেটা হোটেল মারকিউরি, পাঁচতারা মানের হোটেল। এত উপরে হোটেল হতে পারে তা কল্পনাও করা যায়না। হোটেল মারকিউরি পার হয়ে অবশেষে বেলা ৩.০০ ঘটিকায় আমরা যাবল হাফিজের একেবারে উপরে উঠে গাড়ি থামালাম। সুর্য ডোবার পূর্ব মূহুর্তে সেখানে গেলে নাকি খুব মনোরম লাগে। এক তামিল গাইড আমাদেরকে জানালেন। প্রখর রোদের কারনে আমরা প্রায় ৩০ মিনিট যাবত সেখানে অবস্থান করলাম। যাবল হাফিজ থেকে আমরা নীচে নেমে কৃত্রিম ঝর্ণায় কৃত্রিম নদীর খরশ্রোত, নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে লাগলাম। সেখানে অনেক গুলো পিকনিক স্পট রয়েছে। অনেক দেশী-বিদেশী সেখানে মরুদ্যানের ছায়ায় গল্প করছে। আমার ভাগ্নে দীদারের ছোট ভাই পলাশ আমাদেরকে ফোন করল। আমরা যাবল হাফিজ থেকে নীচে নামছি বলায় সে আমাদেরকে জানাল যে, সে আশপাশের কোন এক হোটেলে চাকুরী করে। আমরা অনেক খুঁজে তাকে বের করলাম। ‘হোটেল সাহারা’ নামীয় চাইনিজ হোটেলে সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে পেয়ে সে অনেক খুশী হলো। দুপুর বেলায় হোটেলে অনেক ভীড়। তারপরও সে আমাদেরকে বসিয়ে কথা বলল। হোটেলের ম্যানেজারকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তিনি মরক্কোর নাগরিক। এরপর “মুদির” বা তত্বাবধায়ক এর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল যে, আমার মামা বাংলাদেশ হতে বেড়াতে এসেছে। ভদ্র মহিলার বাংলাদেশ সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণা ছিল বলা যায়। বাংলাদেশের মানুষ এ দেশে বেড়াতে আসে তিনি প্রথম শুনলেন। অনেকক্ষণ খাওয়া হয়নি তাই পলাশ আমাদেরকে খেতে বললেও হোটেলের খাদ্যের মূল্য তালিকা দেখে আমি খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। আমাদের জন্য যে খাওয়ার অর্ডার দেওয়া হয়েছে হিসাব কষে দেখলাম যার মূল্য দাঁড়ায় ৩৫০ দিরহাম। যা বাংলাদশী টাকায় ৭০০০ টাকার উপরে। পলাশ আমাকে জোর করে খেতে বসালো। আমরাও ভাল করে খেয়ে বিল দিতে চাইলে পলাশ কোনভাবেই রাজি হয়নি। পরিশেষে পলাশ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আল আইন চিড়িয়াখানার দিকে যাত্রা করলাম। পলাশ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময়ে আমার খুবই কষ্ট লেগেছে। সে আমাদেরকে বিল দিতে দেয়নি, যদি হোটেলের বিলগুলো তাকে পরিশোধ করতে হয়, তাহলে হয়তো তাকে ১ মাসের বেতন গচ্চা দিতে হবে। চিড়িয়াখানার কিছু আগে আমরা কৃত্রিম লেকে মাছের বিচরণ দেখতে পেলাম। মরুভূমির বুকে মাছের চাষ কিভাবে সম্ভব? সেটি শুধুমাত্র শেখ যায়েদের গড়া দেশ আরব আমিরাতেই।
আমরা লেকের পাশ ঘেষে একসময়ে চিড়িয়াখানায় পৌঁছুলাম। চিড়িয়াখানা খুবই বড়। ভেতরে গাড়ীর ব্যবস্থা আছে। আমরা গাড়ি না নিয়ে হেঁটে হেঁটে চিড়িয়াখানার পশু পাখি দেখলাম। বিভিন্ন প্রজাতির জিরাপ, কুকুর, সাপ, কুমির দেখলাম। কুমির সংরক্ষণ ব্যবস্থা খুবই সুন্দর। আমাদের আর কুমিরের দুরত্ব ছিল মাত্র ৩ ইঞ্চি। পানির ভেতর পূরু কাঁচ দিয়ে পানি আলাদা করে রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। কাচের একদিকে দর্শনার্থী অপর দিকে কুমির। চিড়িয়াখানায় মাঝে মাঝে কৃত্রিমভাবে কুয়াশা ছিটানো কারণে পরিবেশ ঠান্ডা থাকে। আমরা আসরের নামাজ চিড়িয়াখানার মসজিদে পড়ে আবুধাবী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রাওনা দিলাম। আবুধাবী বিশ্ববিদ্যালয়, আল আইনের প্রসিদ্ধ ঘড়ি, পার্লামেন্ট ভবন সহ দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে মীরু আমাকে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে এলো। মীরুকে বিদায় দিয়ে আমি আবুধাবীর উদ্দেশ্যে বাসে উঠে আবুধাবীর দিকে রাওনা হলাম। আমি বাসে চড়ে আবুধাবীতে নামার পর রাজু মামা আমাকে বাসস্ট্যান্ড থেকে ‘মদিনা যায়েদ’ মার্কেটের কাছে নিয়ে এলো। সেখানে সুমন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ পর দীদার প্রায় ৩০ টি পানীয় নিয়ে আফসার মামাসহ হাজির। আমাকে জোর করে ৫টি পানীয় নিতে হলো। আমরা সবাই অনেকক্ষণ গল্প করলাম। রাজু মামার ভগ্নিপতি আফসার মামা আমাদের সবাইকে ডিনার করাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু আমরা কেউ ডিনার করতে রাজি হলামনা। দুইটি লেবানিজ আস্ত মুরগীর রোস্ট ও রুটি নিয়ে আমরা আবুধাবীর কর্নিশে গল্প করে রাত কাটাতে থাকি। দীদারের নিকটাত্মীয় হোন্ডায় একঘন্টা ঘুরে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। সে রাত আমরা আর ঘুমাইনি। সেটি ছিল আবুধাবীর শেষ রাত, রাতের বেলা আবুধাবী কেমন তা খুব ভাল করেই দেখছিলাম। রাত ৩.৩০ টার সময় নাইট ক্লাব হতে ইউরোপিয়ানরা বেরিয়ে যাচ্ছে। ভোর ৫ টার দিকে সুমনের বাসায় গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেই।
২০ নভেম্বর, রবিবার সকাল ৯টার সময় দীদার আমাকে দুবাই এর বাসে তুলে দিয়ে শেষ বারের মত অস্বাভাবিক অবস্থায় বিদায় জানায়। আমিও বাসে উঠে শেষ বারের মতো স্বপ্নের শহর আবুধাবীকে অনেক কষ্টে বিদায় জানিয়ে চলন্ত বাসে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম থেকে জেগে দেখি সবাই নেমে যাচ্ছে। আমি ভাবছিলাম এখানে বুঝি বিরতি নিচ্ছে। আমি আমার পাশের ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম “বাস এখানে কতক্ষণ থামবে”? সে আশ্চর্য হয়ে আমি কোথায় যাবো জিজ্ঞেস করল। আমি আমার গন্তব্যের কথা জানালে সে জানাল যে, আমি দুবাই পৌছে গেছি। দুবাইয়ের রাস্তা এত সুন্দর ও মসৃণ যে, আমরা দু’শ কিলোমিটার খুব অল্প সময়ে ঘুমের মধ্যে পাড়ি দিলাম। আবরার নামক স্থান হতে আমি নৌকায় নদী পার হয়ে ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সারলাম। সেদিন সন্ধ্যায় শারজাহ স্টেডিয়ামে পাকিস্থান ও শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট ম্যাচ ছিল। আমার খুবই ইচ্ছা সরাসরি ক্রিকেট খেলা দেখবো। ইউসুফ ভাই থেকে অনুমতি নিয়ে শারজাহ যাওয়ার জন্য বাসে চড়লাম। রাজু মামা আমাকে জানাল যে, আমাদের দেশীয় ছেলে আওয়ামীলীগার হুমায়ুন আমাকে সহযোগিতা করবে। আমি শারজাহ বাসষ্ট্যান্ডে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর হুমায়ুন আমাকে গাড়িতে করে শারজাহ শহর ঘুরিয়ে বাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকায় নিয়ে যায়। হুমায়ুন আমাকে জানাল যে, সে বেকার, এখানে অনেকেই আছে কোন কাজ পাচ্ছেনা। খুবই কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। আমার খুব মায়া হলো। তবে সান্তনা ব্যতীত আমার পক্ষে কোন কিছুই করা সম্ভব হচ্ছিলনা। হুমায়ুন ও দুই বন্ধুসহ আমরা শারজাহ স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে যাই। ক্রিকেট প্রেমী পাকিস্থানীরা যে এতবেশী ক্রিকেট পাগল তা আমার কখনো জানা ছিলনা। অনেকে আছেন শুধুমাত্র পাকিস্থান থেকে খেলা দেখতে এসেছেন আবার চলে যাবেন। অনেক নিম্ন আয়ের পাকিস্থানী দেখেছি যারা ১ সপ্তাহের আয় দিয়ে ১টি ম্যাচ দেখছে। আমাদের দেশে তা কল্পনাও করা যায়না। খেলা শেষ হতে সাড়ে বারটা বেজে যাওয়ায় হুমায়ুন আমাকে দুবাই আসতে না দিয়ে তার বাসায় নিয়ে গেল।
পরদিন ২১ নভেম্বর সকাল ৮ ঘটিকার সময় আমি হুমায়ুনের বাসা ছেড়ে হেটে হেটে শারজাহ শহরের বিখ্যাত স্পোর্টস শপ গুলো দেখি। অবশেষে পথ হারিয়ে ট্যাক্সি ক্যাবে চলে বাসষ্ট্যান্ডে এসে পুণরায় দুবাই চলে আসি। আমার ভায়রা মোস্তফা সাহেবের একমাত্র মেয়ে নিশিতা স্বামী আলমগীর সহ ফুজিরা প্রদেশে থাকে। আলমগীর আমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে আসছে। আমি শারজাহ গিয়েছি জেনে সে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শারজাহ চলে আসে। ততক্ষণে আমি দুবাই পৌছে গেছি জেনে গাড়ি চালিয়ে দুবাই চলে আসে। কিন্তু দুবাই তার খুব বেশী পরিচিত না হওয়ায় আমাকে পেতে তার খুব বেগ পেতে হয়েছে। সে যেখানে আসতে বলে আমি সেখানে যেতে যেতে গাড়ি থামাতে না পারার কারণে ঐ স্থানে সে থাকতে পারেনা। এভাবে অনেকক্ষণ পর আমি তাকে খুঁজে পাই। তার কালো রঙের গাড়িতে চড়ে আমরা ফুজারা শহরের উদ্দেশ্যে রাওনা করি। ফুজারা দুবাই থেকে অনেক দুরে। শারজাহ, আজমান পাড়ি দিয়ে আমরা বিকাল ৫ ঘটিকার সময় ফুজারা আলমগীরের বাসায় পৌছি। নিশি আমাকে দেখে খুবই খুশী। আমরা ভাত খেয়ে নিশি সহ অনেকক্ষণ গল্প করলাম। নিশি ও আলমগীরসহ আমরা বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরেছি। ফুজারা শহরের বিখ্যাত ফোয়ারা খুব সুন্দর লেগেছে। রাতে হোটের তাজমহলে ডিনার করে বাসায় চলে আসি।
২২ নভেম্বর ঘুমথেকে উঠতে একটু দেরী হয়। আমি উঠার আগেই আলমগীর অফিসে চলে যায়। আমি নাস্তা সেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। আলমগীর ১২ টার সময়ে অফিস থেকে চলে আসে। নিশি ও আলমগীরসহ আমরা ঘুরতে বেরিয়ে যাই। ফুজিরা বীচের পাশ ঘেষে আমরা একটি প্রাচীন মসজিদ দেখার জন্য যাই। মসজিদ টি অনেক প্রাচীন। মসজিদের পাশে একটি ঘর আছে তাও প্রাচীন। হয়তো কোন ধর্মপ্রচারক এখানে সাগর পাড়ি দিয়ে এখানে এসে মসজিদ নির্মান করে। আমরা আসার পর রাশিয়ান ৫০ জন নারী পুরুষ মসজিদটি দেখতে আসে। মসজিদ দেখা শেষ হলে আমি ও আলমগীর ফুজিরা বীচে গোসল করি। নিশি তার মেয়ে সহ উপরে থাকে। সেখানেই পার্কে আমরা বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া খাবার দিয়ে লাঞ্চ সেরে নেই। ফুজিরা আরবের এক অমূল্য সম্পদ। সেখানকার পাহাড়গুলো পাথরে ভরা। ফুজিরার লেকের পাশ বেয়ে আমরা গাড়িতে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছি। ওমান সীমান্তের মাঠের উটগুলো সবারই নজর কাড়ে। শারজাহ-কালবাহ সড়কের পাথরের পাহাড়ের নীচ দিয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার ট্যানেলের কথা কখনোই ভোলা যাবেনা। লেকের পাশ ঘেষে অনেকক্ষণ পাড়ি দিয়ে আমরা শহরের পার্শ্বে লেকের পাড়ে পৌঁছে গেলাম। বাসায় যেতে আমার ভাল লাগছিলনা বিধায় আমি আপাততঃ তাদের থেকে বিদায় নিয়ে প্রায় দু’ঘন্টা লেকের ধারে বসে রইলাম। তাদের সাথে কথা হয়েছিল যে, আমি ফোন করলে আলমগীর এসে আমাকে নিয়ে যাবে।
লেকের পার্শ্বে একটি মেলা বসছিল সেখানে বিভিন্ন ধরণের জিনিস পাওয়া যায়। তাই আমি সময় কাটানোর জন্য মেলার স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। হঠাৎ করে দেখতে পেলাম যে, একটি ছেলে সুর করে গান করছে। “সোনা বন্ধু আমারে দেওয়ানা বানাইল”। গানটি শুনে আমার খুব হাসি পেলে ছেলেটি আমাকে হাসার কারণ জিজ্ঞেস করে। আমি বাংলা গান শুনে হাসছি বলায় সে আমার বাড়ী জিজ্ঞস করে। আমি ‘ফেনী’ বলায় সে আমাকে ইকবালের গেস্ট কিনা জানতে চায়। আমি ইকবাল চিনিনা বললে সে ইকবালকে তার স্টলে ডেকে আনে। ইকবালের সাথে পরিচয়ের পরে সে আমাকে তার স্টলে নিয়ে যায়। তার বাড়ী ছাগলাইয়ার মুহুরীগঞ্জ এলাকায় এবং আমাদের মুহুরী মহিউদ্দীনের বন্ধু বলে পরিচয় দেয়। এত সৌহার্দপূর্ণ ও আন্তরিক ছেলে আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। সে এবং পরবর্তীতে ইসমাইল আমার জন্য যা করেছে তার বর্ণনা দিলে তাদেরকে ছোট করা হবে। তাদের আন্তরিকতা মনে রাখার মতো। ইকবালের নিকট হইতে বিদায় নিয়ে আমি আলমগীরসহ ইকবালের উপহার সামগ্রী ও খাবার নিয়ে বাসায় চলে আসি।
২৩ নভেম্বর সকাল ৮ ঘটিকার আলমগীর আমাকে গাড়ীতে করে দুবাইয়ের বাসে উঠিয়ে দেয়। আমি বাসে করে দুবাই এসে বন্ধু ইউসুফ আনসারীর বাসায় লাঞ্চ করি। লাঞ্চ সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর ইসমাইল নামে এক ভদ্রলোকের ফোন আসে। সে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমার বন্ধু এডভোকেট শাহজাহান সাজু ফোন করে ইসমাইলকে আমাকে দুবাই দেখানোর জন্য বলায় ইসমাইল তার কর্তব্য পালনের জন্য ফোন করেছে। আমি বাসা থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ মার্কেটের মধ্যে ঘোরাঘুরি করি। এতদিন কোন জিনিসের কিনতে যে জড়তাও ভয় ছিল তা অনেকখানি কেটে গেছে। ইউসুফ ভাই আমাকে আশ্বস্থ করল যে, এখানে কেনার সময় বাংলাদেশী টাকার হিসাব করলে কোন জিনিষ কেনা যাবেনা। আমরা দিরহামে আয় করি ও দিরহামে খরচ করি। সুতরাং এ বিষয়ে চিন্তা করবেননা। টাকার প্রয়োজন হলে আমি ধার দেবো। সেদিনের মতো মার্কেটের অবস্থা বুঝে নিলাম। ইতোমধ্যে ইসমাইল তার বন্ধু স্বপনকে নিয়ে আমার জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছে। আমি এসে ইসমাইলের গাড়িতে উঠলাম। সে প্রথমেই আমাকে গাড়িতে করে নদীর নীচ দিয়ে তৈরী করা ট্যানেলের ভেতর দিয়ে আমাকে হাজী আমিন সাহেবের দোকানে নিয়ে গেল। হাজী আমিন সাহেব দেশের কথা জিজ্ঞেস করলেন। অনেকক্ষণ সময় কাটানোর পর সেদিনের মতো ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় পৌছে দিয়ে ইসমাইল বিদায় নিল।
২৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার আমি ইউসুফ ভাইয়ের দোকানে এসে মিশরীয় মাহমুদের সাথে তাদের দেশের অবস্থা নিয়ে কথা বললাম। রাজু মামার সাথে আমার কথা ছিল যে, ২৫ নভেম্বর আমাকে দুবাই শহর দেখাবে। তার সিডিউল মতো সে ২৪ তারিখ বিকাল ৫ টায় পৌঁছাবে। বেলা ১২ টার সময় ইসমাইল, স্বপন ও আমি বেরিয়ে পড়লাম। আমরা শহরের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে লাগলাম। মুক্তিযোদ্ধা কাজী আবুল বশর এর সাথে তার অফিসে দেখা হলো। আজ বিকালে তিনি আমাদের জন্য রান্না করবেন বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। দুপুর ১ টায় আমরা গাড়ি পার্কিং করে বিখ্যাত জুমিরিয়া বীচের কাছে গেলাম। ভেতরে ঢোকার লোভ সামলাতে পারছিলামনা। গেইট দিয়ে ৫ দিরহামের টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। কাউন্টারের যিনি বসে আছেন তিনি বাংলাদেশী। ইসমাইল আমার পরিচয় দেয়াতে তিনি টিকিটের কোন বিনিময় নেয়নি। জুমিরিয়া বীচের পার্কে আমরা ছবি উঠালাম। পার্ক পার হলে আরেকটি গেইট সুইমিং ড্রেস পরে পার হতে হয়। আমার সুইমিং ড্রেস ছিল। কিন্তু ইসমাইল ও স্বপনের তা ছিলনা। ইসমাইল কোন রকম ব্যবস্থা করতে পারলেও বেচারা স্বপন ব্যবস্থা করতে পারেনি। সে কোনমতে পরনের প্যান্ট খুলে হাঁটুর উপরে উঠালেও সিকিউরিটি কোনভাবেই তাকে ভেতরে যেতে দেয়নি। পরে সে মাটিতে বসে আমাদের জিনিষ গুলো পাহারা দেয়া ছাড়া উপায় ছিলনা। জুমিরিয়া বীচে ছবি উঠানো নিষিদ্ধ থাকায় আমরা ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করিনি। পরে দেখতে পেলাম যে, সাদা চামড়ার ভদ্রলোকেরা ছবি উঠাচ্ছে। আমরা কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাথরুমে এসে গোসল করে দুবাই মলের দিকে ছুটলাম। দুবাই মল সুপ্রসিদ্ধ মার্কেট। আয়তনের দিক দিয়ে এতবড় মার্কেট আমার কখনো দেখা হয়নি। তিনটি ফ্লোর গাড়ি পার্কিং এর জন্য রাখা আছে। গাড়ি রেখে পুণরায় খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টকর। আমরা গাড়ি পাকিং করে দুবাই মলে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখছি। এতই ব্যয় বহুল যে, সাধারণের কেনার সাধ্যের বাইরে। মলের সামনের দিকে সুবিশাল লেক, সুউচ্চ ইমারত দেখতে অবিশ্বাস্য লাগে। পাশেই ১৬৫ তলা বিল্ডিং ‘বুর্জ খলিফা’। দুর থেকে ছবি উঠাতে গেলে মানুষের ছবি উঠেনা, আবার কাছ থেকে ছবি উঠাতে গেলে বিল্ডিং এর ছবি উঠেনা। ‘দুবাই মল’ থেকে গাড়ী নিয়ে বেরুতে অনেকক্ষণ সময় লেগে যায়। পুর্বের সিডিউল মতো রাজুমামা আবুধাবী হতে দুবাই এসে পৌঁচেছে। আমরা রাতের বেলা দুবাই শহর দেখছি। কিন্তু শেখ যায়েদ রোডে ঢুকে বামদিকে মোড় নিয়ে গতি পরিবর্তন করা দুস্কর। আমরা যেতে যেতে দুবাই মেরিনা পর্যন্ত চলে এসেছি। কিন্তু রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। পরিশেষে ব্যর্থ হয়ে বীচ বল খেলা দেখতে ঢুকে পড়লাম। এদিকে রাজুমামা ফোন করতে করতে বিরক্ত। আমরা শুধু সময় দিয়েই যাচ্ছি। বীচ বল খেলা দেখে বেরিয়ে কোনভাবেই রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরিশেষে প্রায় ৩ ঘন্টা পর তাকে আমরা খুঁজে পেয়েছি। রাত ১০টার দিকে ইউসুফ ভাই সহ মুক্তিযোদ্ধা লিডার কাজী আবুল বাশারের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। তিনি আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনালেন। সেখান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চড়ে আমরা দুবাই শহর চষে বেরিয়েছি। ইসমাইল ভাল গাড়ি চালাতে জানে বিধায় আমাদের কোন বেগ পেতে হয়নি। সে রাত আমরা ঘুমাইনি। পরদিন ২৫ নভেম্বর সকাল ৮টায় আমাকে ও রাজু মামাকে ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় নামিয়ে দিয়ে ইসমাইল চলে যায়।
২৫ নভেম্বর ইউসুফ ভাই ও রাজুমামা সহ কেনা কাটায় বেরিয়ে পড়ি। শুধুমাত্র আজই ইউসুফ ভাই আমাকে সময় দেবেন বলে জানিয়েছেন। দুপুরে লাঞ্চের জন্য হাজী আমিন সাহেব বিখ্যাত ‘দরবার’ হোটেলে আমাদেরকে দাওয়াত দেন। আমরা সবাই জুমার নামাজের পর সেখানে পৌঁছি। অনেকক্ষণ দেশের ও বিদেশের গল্পের ফাঁকে খাবার এসে যায়। যা অর্ডার দেয়া হয়েছিল কারো কারসাজিতে তা পাল্টে গিয়েছিল যা মাথায় বাজ পড়ার অবস্থা। কিন্তু ইসমাইল ও মুক্তিযোদ্ধা কাজী সাহেবকে আমাদের সন্দেহ হয়েছিল। দুপুরের লাঞ্চ সেরে আমরা হাজী আমিন ও লিডার কাজী বাশার কে ধন্যবাদ জানিয়ে জুমিরিয়া বীচ হোটেলের সামনে অনেকক্ষণ সময় ব্যয় করি। হোটেলের নাম ‘বুর্জ আল আরব’। হোটেল টি ৭ তারা মানের হোটেল। হোটেলে হেলিকপ্টার নামতে পারে। হোটেল লবির ভেতরের প্রবেশ মুল্য ২০৫ দিরহাম বিধায় আমরা ভেতরে যা্ইনি। বাইরে থেকে ঘুরে দেখা শেষ করে ইউসুফ ভাইয়ের দোকানে চলে আসি। রাতে ইসমাইলের বাসায় দাওয়াত কিন্তু রান্নার দায়িত্ব লিডার কাজী আবুল বাশার সাহেবের কাছেই রইল। আমরা সবাই মিলে ইসমাইলের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করলাম। ডিনার সেরে রাজু মামা, ইসমাইল, ইউসুফ ভাই ও আমি সারারাত ঘুরলাম। কিছুক্ষণ পর ইউসুফ ভাই আমাদের থেকে কোন এক সময়ে কেটে পড়ে। আমি অনেক রাতে বাসায় ফিরি। ইসমাইল রাজু মামাকে আবুধাবীর বাসে উঠানোর জন্য নিয়ে যায়। রাজু মামার সাথে টেলিফোনে কথা হলেও আর দেখা হয়নি।
২৬ নভেম্বর আমি একা বেরিয়ে পড়ি। ইউসুফ ভাই আমাকে মেট্রো ট্রেনে চড়ার পরামর্শ দেন। ইউসুফ আনসারীর ‘নোল কার্ড’ আমাকে দিলেন এবং স্টেশানে গিয়ে ২০ দিরহাম রিচার্জ করে দিলেন। মেট্রো ট্রেন এক আধুনিক নিদর্শন। চালক বিহীন সম্পূর্ণ কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। দুবাই শহরের নীচ দিয়ে ট্রেন লাইন গিয়েছে। নোল কার্ড স্পর্শ না করে স্টেশানে প্রবেশ করা ও বের হওয়া যায়না। স্পর্শের সাথে সাথেই টাকা কেটে যায়। আমি মেট্রো ট্রেন চড়ে ইন্টারনেট সিটি গিয়েছি। প্রায় দু’ঘন্টা ট্রেনে ঘুরে পুণরায় ইউসুফ ভাইয়ের নিকট চলে আসি। সেদিন বিকালে একটি মোবাইল কেনার জন্য ইউসুফ ভাইয়ের বন্ধু দোকানে যাই। তিনি ভারতীয় মালওয়ারী। দোকানে না থাকায় দোকানের বাংলাদেশী কর্মচারীকে তার মোবাইল নাম্বার জিজ্ঞেস করাতে সে কোনভাবেই দিতে রাজি নয়। আমার তখন ইসমাইল ও ইকবালের আন্তরিকতা ও চট্টগ্রামের বাঙালী লোকটির কর্কশ ব্যবহার তুলনা করতে ইচ্ছে করল। সন্ধ্যায় আমি ও ইসমাইল কেনাকাটায় বেরিয়ে পড়লাম। অনেকক্ষণ কেনাকাটা করে ইউসুফ ভাইয়ের কাছে ডিনারের আতিথ্য গ্রহণ করলাম। সেদিন সালাম আমাদের সাথে ছিল। সে শুধু খাচ্ছিল, আর ইউসুফ ভাইয়ের শেখানো বাংলা বাক্য বলছিল “কোন সমস্যা নাই” । আমরা বিদায় নিয়ে ইউসুফ ভাইয়ের বাসায় চলে এলাম।
২৭ নভেম্বর সকালে ঘুম থেকে উঠে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ রাতেই আমার ফ্লাইট। খুব খারাপ লাগছিল। সত্যি কথা বলতে কি দুবাই ছেড়ে আমার আসতে ইচ্ছে হচ্ছিলনা। এখানকার পরিবেশ, পরিচ্ছন্নতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আতিথেয়তা কখনো ভুলবার নয়। ইউসুফ ভাই সহ ছোটখাট কেনা কাটার কাজ দুপুরের আগেই সেরে ফেললাম। লাঞ্চ করে আমাদের ব্যাগ গোছাতে লাগলাম। ইউসুফ ভাই লাগেজ গোছাতে খুবই পটু। তিনি সবকিছু গুছিয়ে দিলেন। রাতের খাবার খেতে ইচ্ছে করছিলনা। ইন্ডিয়ান সালাম আমাকে তাদের দেশীয় রীতিতে মাংস নারিকেল দিয়ে রেধে খাওয়াল। এরপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। ইসমাইল ও স্বপন গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। ইউসুফ ভাই সহ এয়ারপোর্টে গেলাম। বিমান রাত দু’টায় ছাড়ার কথা ছিল কিন্তু ২ ঘন্টা দেরী হবে বিধায় ইউসুফ ভাইকে এয়ারপোর্ট রেখে আমরা শেষবারের মতো দুবাই দেখার জন্য পুণরায় বেরিয়ে পড়লাম। দুবাই এয়ারপোর্টের বিভিন্ন টার্মিনাল সমুহ দেখলাম। স্বপন, ইসমাইল সহ শেষ বারের মতো স্মৃতির ছবি উঠালাম। ইউসুফ ভাইয়ের ফোন আসাতে পুণরায় এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা করলাম। ইসমাইল গাড়ি পার্কিং করে আমাকে বিদায় দিতে আসলে শেষবারের মতো সবাইকে বিদায় জানালাম। আমি কি পারবো আমার স্বপ্নের দেশ দুবাই এর সেই স্মৃতি মুছে ফেলতে? কখনো নয়। স্মৃতি বার বার রোমন্থিত হবে স্বপ্নের শহর দুবাইকে ঘিরে। গুডবাই দুবাই, আলবিদা।
২| ৩১ শে মে, ২০১২ রাত ১১:৩৬
আহমাদ জাদীদ বলেছেন: ভালোই লিখেছেন.........তবে একটু জায়গা বাদ দিয়ে দিয়ে লিখলে ভালো করতেন......শুভকামনা থাকল......হ্যাপি ব্লগিং......
৩| ০২ রা জুন, ২০১২ সকাল ১০:৫০
উদাসীন চৌধুরী বলেছেন: ধন্যবাদ, মন্তব্য করার জন্য।
৪| ০৪ ঠা জুন, ২০১২ রাত ১০:৫০
উদাসীন চৌধুরী বলেছেন: মডারেটর মহোদয়গণ, আমার প্রতীক্ষার প্রহর কখন শেষ হবে?
৫| ২২ শে জুলাই, ২০১২ রাত ১১:২৫
উদাসীন চৌধুরী বলেছেন: মডারেটর মহোদয়গণকে ধন্যবাদ। আমাকে প্রথম পৃষ্ঠায় লিখার সুযোগ দেয়ার জন্য।
©somewhere in net ltd.
১|
১৪ ই মে, ২০১২ রাত ১০:৪০
উদাসীন চৌধুরী বলেছেন: লিখাটি বড়, আমার লিখাটি কেমন হয়েছে মন্তব্য করবেন কি?