![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্যান্ডেল টাতে সেলাই একটু বেশিই হয়েগেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ডান পায়ের ফিতে টা ছিড়ে যাওয়াতে ঠিক মত হাটতে পারছিনা। বাম পা ঠিক মত ফেলে ডান পা টা স্যান্ডেল এর সাথে ঘসে কিছুটা ছেচড়িয়ে আনতে হচ্ছে। কেউ হাটা ভালো ভাবে খেয়াল করলে মনে হবে খোড়াচ্ছি আর আরো ভালো ভাবে খেয়াল করলে বুঝবে আমার স্যান্ডেল ছেড়া। যা হোক বেশ কায়দা করে হেটে স্টেশন ঘর টা ঘেষে বসে থাকা মুচি র দোকানের সামনে এসে পরেছি। কিন্তু মুচি র কাছে যেতে পারছি না। কিছুটা লজ্জা করছে। শেষ বার যখন সেলাই করে নেই তখন সে বলেছিল
- বাবু , এ স্যান্ডেল আমি এই শেষ বার সেলাই করছি। আর পারব না।
স্যান্ডেল কেনার টাকা চাইলে বাবা দেবেন। কিন্তু এই সেদিন এক জোড়া হারিয়েছি খেলতে গিয়ে। এ পুরোনো টা দিয়ে চালাচ্ছি। বাবা কে ভয় পাই ত খুব , তিনি যখন প্রশ্ন করবেন নতুন জোড়ার কথা তখন আমার ঘাম ছুটে যাবে। তাই এখন আর সেলাই করা ছাড়া কোন গতি নেই।
আমি কয়েকবার মুচির দোকানের সামনে দিয়ে হেটে এপাশ থেকে ওপাশে গেলাম আবার ঘুরে স্টেশন ঘরের দিকে আসলাম। মুচি মানে রাম লাল নিচু হয়ে দু পায়ের ফাকে একটা স্যান্ডেল রেখে সেলাই করছিল। চশমা চোখে , সাদা চুল গুলোর মাঝে কয়েকটি কালো চুল যেন তার বয়স কে কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। গায়ে একটা শার্ট , সেটার রং একসময় সাদা ছিল সেটা অনুমান করা যায়। মুখ ক্লিন শেভ করা তাই মুখে বয়সের বলি রেখা গুলো স্পষ্ট ই বুঝা যায়। চ্যাপ্টা মুখে বেশ খাড়া নাক বেয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝড়ছে। কয়েক বার কপাল থেকে বেয়ে পরা ঘাম বৃদ্ধাংগুলি দিয়ে ঝেড়ে ফেলল। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। মনে হচ্ছে দেখে ফেলেছেন আমাকে। হ্যাঁ , দেখেছেন তিনি। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকিয়ে ডাকলেন ,
- বাবু , এই দিকে আসেন।
আমিও ভালোভাবে হাটার ভান করে তার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বললাম ,
- আদাব , কাকা।
উনি ওনার জিনিস পত্র রাখার কাঠের বাক্স টা গামছা দিয়ে ঝেড়ে বললেন ,
- বসেন বাবু।
আমি ইতস্তত করে বসে বললাম, - কাকু , স্যান্ডেল টা সেলাই করা লাগত।
উনি ওনার কাজ করতে করতেই বললেন ,
- স্যান্ডেল সেলাই করা লাগবে তা দোকানের সামনে দিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন ক্যান?
আমি উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলাম। দোকানের সামনে দিয়ে রিকশা যাওয়া আসা করছে। টুংটাং শব্দে বেল বাজিয়ে। আমি ওনার দিকে না তাকিয়ে রিকশা গুলো দেখছি। যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। রাম লাল কাকু ওনার হাতের কাজ শেষ করে বললেন ,
- দেন দেখি আপনার স্যান্ডেল টা।
আমি পা থেকে স্যান্ডেল টা হাতে নিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে দিলাম। আমি যখনই এভাবে তার দিকে জুতা বা স্যান্ডেল এগিয়ে দিয়েছি প্রতিবারই তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আজও তাকিয়ে রইলেন। এমন চাহুনি আমাকে অস্বস্তি তে ফেলে দেয়। আমি আবার রিকশার দিকে মনোযোগ দেই। স্যান্ডেল হাতে নিয়ে উনি দেখে পাশ থেকে একটি চামড়ার টুকরা বের করলেন। সেটা কেটে নিয়ে আমার স্যান্ডেল এর কাজ শুরু করলেন। কাজ করতে করতেই বললেন ,
- তা , বাবু , আপনার খবর ভাল?
আম উত্তর দিলাম ,
- এইত চলছে ভালই।
উনি বললেন ,
- বাড়ি যান না কতদিন?
তখন আমি হস্টেল এ থেকে পড়াশোনা করি। রংপুর এর পীরগাছা নামক এক থানায়। উনি এটা জানেন। আমি উত্তর দিলাম ,
- প্রায় দুই মাস হচ্ছে। তবে মা এসেছিল দেখতে , গত শুক্র বারে।
উনি শুনে উচ্ছ্বসিত হলেন। বললেন ,
- কেমন আছে মা?
- হ্যা , ভালই আছে। ট্রেনে উঠিয়ে দিতে আসছিলাম বিকালে, তখন আপনার দোকান বন্ধ ছিল।
উনি , দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ,
- বয়স ত আর কম হল না বাবু। শুক্র বারে সকালে আসি আর জুম্মার পরই চলে যাই। একটু ছেলে মেয়েদের সাথে খাওয়া দাওয়া করি। দুপুর বেলাটা একটু ঘুমাই।
তার কথা শুনে আমি চুপ হয়ে থাকি। বাড়ির শুক্রবার এর দিন দিন গুলোর কথা মনে পরে। সকাল বেলা পড়াশুনা শেষ করে বাবার সাথে খেতে বসতাম। সব দিনই যদিও উনি সাথে নিয়েই খেতেন তারপরও শুক্রবার টা একটু আলাদা ছিল। মা বাড়িতে থাকত। কিছু ভালমন্দ রান্না হত। খাওয়া শেষ করে বাবা চেম্বার এ চলেগেলেই বই খাতা ফেলে দৌড় , মাঠে বা অন্যকোন যায়গায়। খেলা হত ইচ্ছে মত। আবার জুম্মা র নামাজ এর আজান হওয়ার আগেই বাড়িতে এসে গোসল সারতে হত। বাবা এক সাথে মসজিদে নিয়ে যেতেন। আবার নামাজ শেষ করে বাসায় এসে মা বাবা বোনের সাথে একসাথে দুপুর এর খাবার খাওয়া। এর পর শুয়ে শুয়ে ৩টা বাজার অপেক্ষা করা সিনেমা দেখার জন্য। কখনো লোডশেডিং হলে মনে হত যে জীবন টাই মাটি , আর রাতে কাথা বা লেপ মুড়ি দিয়ে ভয়ে ভয়ে আরব্য রজনীর আলিফ লায়লা বা আকবর দি গ্রেট দেখা। প্রায়ই লোডশেডিং হত। হয়ত শুরু হতেহতেই কারেন্ট চলে গেল আবার আসল যখন তখন শেষ হয়ে নাম দেখাচ্ছে। তখন মনের অবস্থা কেমন হত তা আসলে বুঝানো যাবে না। এমন ভাবতে ভাবতে আমি আর রাম লাল কাকার কথা শুনছিলাম না। উনি একটু জোরেই বললেন ,
- কি বাবু যাবেন না?
আমি থতমত খেয়ে বললাম ,
- কোথায়?
উনি আবার শুরু করলেন,
- মেয়ে টার বিয়ে আগামী বৃহস্পতিবার , যদি যেতেন!
বলেই উনি কেমন যেন অপরাধী র মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।
আমি বললাম ,
- আরে কাকু , এ ত সুখবর , অবশ্যই যাব।
এ কথা শুনে ওনার মুখটা কেমন যেন খুশি খুশি হয়ে উঠল। বলল,
- বাবু , চিন্তা করবেন না , আমরা যাই খাই , আপনার জন্য আলাদা ব্যাবস্থা থাকবে।
আমি হেসে মাথা নাড়লাম। উনি বলেই চললেন,
- আপনার বন্ধু দের সাথে নিয়ে আইসেন , কোন সমস্যা নাই। গরিব হলেও দু মুঠো অন্ন আপনাদের খাওয়াতে পারব।
আমি বললাম ,
- ধুর কাকা , কি যে বলেন না।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
- কাকু , কাকি মোয়া আর নারকেলের নাড়ু বানাবে না?
উনি বললেন ,
- অবশ্যই বানাবে বাবু। আপনার জন্য আলাদা করে রাখতে বলব।
আমি খুশি হয়ে বললাম ,
- মনে থাকে যেন কাকু?
উনি হাসতে হাসতে মাথা নাড়লেন।
আমার স্যান্ডেল টা সেলাই হয়ে গেলে তা নিয়ে , তার কাছথেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম আমার হস্টেল এ। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় ঘুর ঘুর করছিল। রাম লাল কাকু বললেন আমার বন্ধুদের নিয়ে যেতে কিন্তু ওদের কে বলব কিভাবে? একজন মুচি দাওয়াত করেছে আমাকে সেটা ওরা নেবেই বা কিভাবে? অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। শেষমেষ একাই যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিলাম। এর পরও চিন্তা কমল না। রাম লাল কাকুর মেয়ের বিয়েতে কি উপহার দেয়া যায় সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। কারও সাথে শেয়ার করব সে উপায়ও নেই।
রাম লাল কাকুর সাথে আমার পরিচয় হয়ে প্রায় মাস তিনেক আগে জুতা রং করতে গিয়ে। ওনার বয়স আর ব্যাক্তিত্বে এমন কিছু ছিল যা তে একটা শ্রদ্ধার ভাব চলে আসে। তার মানে এই না যে অন্য মুচিদের অশ্রদ্ধা করি। কিন্তু ওনার সাথে পরিচয় এর আগ পর্যন্ত তাদের প্রতি আলাদা কোন চিন্তা আসেনি। সমাজের স্বাভাবিক রীতি তে তাদের কে দেখতাম। তাতে কেউ বয়সে বড় হলেও তাদের কে কাকু বা অন্য কিছু বলে সম্বোধন করা যায় এটা মাথায় আসেনি। ওনার কাছে জুতা কালি করতে গিয়ে দেখি উনি পত্রিকা পরছেন মনোযোগ দিয়ে। আমার জুতাটি এগিয়ে দিলে , পত্রিকাটি পাশে সরিয়ে রেখে জুতাটি হাতে নিলেন। কালি করার আগে জুতা পরিষ্কার করতে করতে বললেন ,
- বাবু , আপনারা ত শিক্ষিত মানুষ , বলেন ত এই যে আমেরিকা ইরাকে এসে হামলা করল এইটা কি ঠিক হইল?
আমি কিছুক্ষন বুঝে পেলাম না কি উত্তর দেব। তখন এ আলোচনা সব চেয়ে বেশি আলোচিত ছিল। আমি কিছুটা ভেবে বললাম ,
- আমরা ঠিক বেঠিক বুঝে কি করব বলেন? আমেরিকা ত আমাদের ঠিক বেঠিক বুঝে কাজ করে না।
উনি কাজ করতে করতেই মাথা নাড়লেন ,
- কথা আপনি ঠিকই বলছেন। কিন্তু এর মাঝেও কথা আছে। এই যে আমেরিকা বোম মারছে , সেগুলা কি খালি সাদ্দাম এর গায়ে পরছে? ছোট ছোট ছাওয়াল গুলার গুলি খাওয়া বা হাত পা উড়ে যাওয়া ছবি গুলান দেখলে চোখ ফাইটা কান্দন আসে।
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। একজন মুচি যে সারাদিন তার জীবিকা নিয়ে পরের স্যান্ডেল ঘসে চলে তারও কত সুন্দর একটা মন আছে , চিন্তার জগত আছে। আমি তখন শুধু বললাম
-কাকু , দুনিয়া টা খুবই আজিব যায়গা। কি হয় বুঝা মুশকিল।
উনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন ,
- বাবু মন টাই হইল আসল। মানুষ রে মানুষ না চিনলে কে চিনবে বলেন?
ওনার কথায় কিছু একটা ছিল। তাইত মানুষ কে কি গরু ছাগল বুঝবে? হঠাৎ করেই মনে হল কথাটা উনি অন্য অর্থে বলেছেন। আশপাশের অবস্থা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় একজন মুচি হিসেবে সে সারা জীবন কতটা হেয় হয়েছেন আমাদের মত ভদ্র মানুষের কাছে। অনেকে নিজের চেষ্টায় সমাজে অবস্থান করে নিতে পারে কিন্তু মুচি সারা জীবন মুচিই থাকে। কখন ভদ্র মানুষ গালি হিসেবে তাদের পেশা কে ব্যাবহার করে। অথচ তারা সত ভাবে কষ্ট করে জীবিকা চালাচ্ছে। আচ্ছা তাদের সমাজে কি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বলে কাউকে গালি দেয়?
এসব কথা ভাবতেই রাম লাল কাকু র দোকান এর সামনের দোকান থেকে হাক আসল ,
- আরে এ রাম লাল, পেপার কি মুখস্ত করবি না কি?
এ কথার সাথে আশেপাশের কয়েক দোকান এর মানুষ একটু হাসাহাসি করল তাকে নিয়ে। যারা তাকে এভাবে ডাকছে তাদের বয়স রাম লাল নামক মানুষ টির অর্ধেক হবে হয়ত।
উনি হাক শুনে তারাতারি করে পত্রিকা টি ভাজ করতে শুরু করল। আমি ওনার কাছ থেকে পত্রিকা টি নিয়ে বললাম
-আপনি বসেন , আমি দিয়ে আসি।
উনি আমার কথা শুনে শুধু আমার হাতে পেপার দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন আমার ও এর থেকে বেশি কিছু করার নেই। সমাজের সামনে বিদ্রোহী হয়ে দাড়াব সে সাহস কৈ?
এভাবেই তার সাথে আমার পরিচয়।
বৃহস্পতিবার বিকালে তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য বিকালে তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হলাম একাকি। স্টেশন হয়েই যেতে হবে। কিন্তু তার দোকানের সামনে গিয়ে দেখি সে তখনও কাজ করছে। আমি মনে মনে ভয় পেলাম কাহিনী কি? যার মেয়ের বিয়ে সে এখনো কাজ করছে! কিছুটা ভয়ে ভয়ে তার সামনে দাড়ালাম। উনি আমাকে দেখেই বললেন ,
- ওহ , বাবু আপনি আসছেন? একটু বসেন। হাতের কাজ টা সেরেই উঠব।
আমি তখনো ঠিক বুঝছি না। বসতে বসতে বললাম ,
- আপনি এখনো কাজ করছেন?
উনি হাসলেন। উত্তরে বললেন ,
- বাবু লগ্ন মাঝ রাতে। বাড়িতে লোকজন আছে। ভাবলাম কয়টা টাকা কামাই হলে আগায়া যায়। জামাই রে একটা সাইকেল দেয়ার কথা, কিনছিও , কিন্তু তারপরও ত বিয়ের খরচ আছে।
আমার সামনে অনেক গুলো অবাক করা জিনিস। জীবনের অনেক বাস্তবতা দেখলেও এ বাস্তবতা ভিন্ন। ওনাকে বলতে যাচ্ছিলাম যে জামাই কি করে? কিন্তু বলতে প
©somewhere in net ltd.