নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
আমি এসি ঘরে বসে সংবাদপত্রের খবর পড়ে কিংবা টিভির খবর দেখে, সেই খবরের সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে গল্প-উপন্যাস লিখি না। প্রত্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াই, জীবন ও জনপদ দেখি, যে জনপদ নিয়ে লিখি সেখানে বারবার গিয়ে সেখানকার মানুষের হৃদয় ও জনপদের হাওয়াটা বুঝতে চেষ্টা করি, জীবন ছেকে রসদ নিয়ে এসে তারপর লিখতে বসি। লক-ডাউনের আগে সুনামগঞ্জ গিয়েছিলাম উপন্যাসের তথ্য সংগ্রহের জন্য, একটা বাইসাইকেল ভাড়া নিয়ে চষে বেড়িয়েছি গ্রামের পর গ্রাম। মানুষের সাথে কথা বলে এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে আমি কি বাংলাদেশে আছি, নাকি এটা আফগানিস্তানের তালেবান শাসিত কোনো জনপদ? খুব সতর্কতার সাথে বেছে বেছে মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করেছি-আপনাদের এখানে বাউলগান হয়?
উত্তর পেয়েছি-‘না।’
‘কেন আপনারা গান-টান শোনেন না?’
‘না। হইতে দেয় না।’
‘কারা হইতে দেয় না?’
‘মাওলানারা।’
‘এদিকে ওয়াজ হয়?’
‘হা খুব। শীতকালে তো শুধু ওয়াজই হয়।’
বেশকিছু মানুষের কণ্ঠে এই একই কথা ধ্বনিত হয়েছে। এখানে গ্রামের পর গ্রামে গত দুই-তিন দশকে কোনো বাউল কিংবা শিল্পীর পা পড়েনি, সেখানে একতারা কিংবা দোতারার সুর বাজেনি। বাউলের জায়গা দখল করে নিয়েছে ওয়াজীরা। সেখানে তরুণরা ছোট ছোট হোটেলে কিংবা মুদি দোকানে ওয়াজ শোনে লাউড স্পিকারে, হাতের মোবাইলে ওয়াজ শোনে। চৈত্রের দুপুরের রোদে সাইকেল চালিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাঝে মাঝে আমার কান্না পেত-আহারে হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ, শাহ আব্দুল করিম, রামকানাই দাশ, সুষমা দাসের প্রাণের ভাটির জনপদ; যে জনপদের মাঠে-ঘাটে শোনা যেত বাউলের সুর, সেই জনপদের আজ এ কী দশা!
একবার ভাবুন, একটা জনপদের মানুষ বছরের পর বছর গান শোনে না, সিনেমা দ্যাখে না, বই পড়ে না, যাত্রা-নাটক দ্যাখে না, অনেকে টেলিভিশনও দ্যাখে না, কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে তারা নেই; উপরন্তু ওয়াজীদের উগ্র বয়ান তাদেরকে হিংস্র করে তুলেছে! এইসব মানুষেরা মানুষ খুন করবে না তো কারা করবে?
এই দশা শুধু সুনামগঞ্জের নয়, সারা বাংলাদেশের; সুনামগঞ্জ, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, সাতক্ষীরা, ফেনী, নোয়াখালী অঞ্চলে হয়ত একটু বেশি; কিন্তু বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র এখন এটাই, এটাই বর্তমানের প্রকৃত বাংলাদেশ। একবার স্কুল ছুটির সময় বাসে আসার পথে চট্টগ্রামের পটিয়ায় অসংখ্য হিজাব-বোরখা পরা ছাত্রীদের দেখে মনে হয়েছিল পটিয়া বুঝি বাংলাদেশে থেকে বিচ্ছিন্ন!
বাংলাদেশের সাংস্কৃতি বিপর্যয় ঘটে গেছে, আরো ঘটবে। আমি শাহ আরেফিনের আস্তানা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, বাংলার সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ে এই সুফিরাও কি কম ভূমিকা রেখেছে? তাইতো এইসব সুফিদের নামে আজ এতো কিছু হয়। যাদুকাটা নদীতে শাহ আরেফিনের নামে সেতু হচ্ছে। অনেক মডারেট মুসলিম ভাবে সুফিরা শান্তিবাদী ছিলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম প্রচার করেছেন। এরা হয় অজ্ঞ, নয়তো ধুরন্ধর। বেশিরভাগ সুফিই তো এসেছিল মুহাম্মদ ঘোরীর মতো যোদ্ধাদের সঙ্গে, তারা কেউ ভারতবর্ষের মানুষদের ধর্মান্তরে এবং লুটপাটে মদত দিয়েছে যোদ্ধাদের, কেউ কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধও করেছে। সিলেটের শাহজালাল, সুনামগঞ্জের শাহ আরেফিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া শাহ সৈয়দ আহাম্মদ গেছুদারাজ (রহ.) ওরফে শাহ পীর অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে, যুদ্ধজয় এবং লুটপাটের পর তারা শান্তিবাদী সেজেছেন। এরা কেবল জনপদের ধর্ম বদলাননি, বদলে দিয়েছেন বাঙালী মুসলমানের জীবনাচার, খাদ্যাভাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি। এদের হাতে বাংলার ব্যাপক সাংস্কৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে।
আগে বাউলরা গ্রামে গ্রামে গান করে বেড়াতেন, গান গেয়েই জীবিকা নির্বাহ করতেন, কিন্তু এখন আর তারা আগের মত বায়না পান না। কারণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জায়গা ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে আর সম্প্রসারিত হয়েছে ওয়াজের অপসংস্কৃতি। একসময় তৃণমুলে যারা গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন, গত দশ-পনের বছর যাবৎ তাদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়েছে, জীবিকার জন্য তাদেরকে অন্য পেশায় যুক্ত হতে হয়েছে।
তৃণমুলে এখনো যেসব বাউলশিল্পীরা আছেন, তারা মরমে মরে থাকেন, ভয়ে থাকেন যে কখন তাদের ওপর আক্রমণ হয়। প্রায়ই তাদের ওপর আক্রমণের কথা শোনা যায়, তাদের চুল-দাড়ি কেটে দেবার কথা শোনা যায়, তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেবার কথা শোনা যায়।
দেশের এই অবস্থার জন্য আমাদের আগের প্রজন্মের শহুরে সংস্কৃতিকর্মীরা অনেকটা দায়ী, তারা এইসব নিপীড়ন এবং পরিবর্তন আঁচ করলেও আমলে নেয়নি, কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানায়নি, সরকারের বিরুদ্ধে তাদের উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়নি, বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তারা সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাবার পরিবর্তে সরকারের লেজুড়বৃত্তি করেছে এবং নানান সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। এইসব নাগরিক ধুরন্ধর শিল্পীরা সরকারী অনুদান-পুরস্কারের পিছনে ছুটেছে, কালেভদ্রে তৃণমুলের কোনো শিল্পীকে ঢাকার মঞ্চে এনে তার শিল্পকলা প্রদর্শনের সুযোগ করে দিয়ে ভেবেছে, তোমার জীবন ধন্য করে দিয়েছি!
আচ্ছা ক’জন তৃণমুলের শিল্পী স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পদক পেয়েছে? তারা সত্যিকারের শিল্পী, রাজনীতি ঘেঁষা এবং রাজনীতিকের হাতের পুতুল নয় বলে তারা বঞ্চিত থাকে। নাগরিক শিল্পীরা নিজেদেরকে তৃণমুলের শিল্পীদের চেয়ে উঁচু শ্রেণির শিল্পী বলে বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করে থাকে।
প্রত্যন্ত গ্রামে গেলেও মসজিদের আজানে কানে তালা লেগে যায়, তারপরও হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে প্রত্যেক উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা করে সরকার, অথচ স্বাধীনতার এতো বছর পরেও উপজেলা পর্যায়ে শিল্পকলা একাডেমী গড়ে ওঠেনি, এসবের বিরুদ্ধে সরব হয় না নাগরিকশিল্পী নামক চাটুকারেরা। অথচ তৃণমুলের শিল্পী ও শিল্প না বাঁচলে, নগরেও যে একটা সময়ে শিল্পী ও শিল্প বাঁচবে না, এই বোধটি তাদের নেই। অপসংস্কৃতি তৃণমুল গ্রাস করার পর তাদের জিহ্বা বাড়িয়ে দেবে নগরের দিকে, কিন্তু তখন সময় ফুরিয়ে যাবে, বাঁচার উপায় থাকবে না।
সুনামগঞ্জে রণেশ ঠাকুরের বাড়ি কারা পুড়িয়ে দিয়েছে তা সকলেই জানে, তারপরও অধিকাংশ সংস্কৃতিকর্মী চুপ করে আছে, কেউ মুখ খুললেও গলাভরা ‘দুবৃত্ত’ শব্দটি ব্যবহার করছে। এই দুবৃত্ত কারা? যে লোকটি বলেছিল-‘আমি প্রেরিত হয়েছি মূর্তি এবং বাদ্যযন্ত্র ধ্বংস করার জন্য’; এরা তার অনুসারী- মুসলমান।
রণেশ ঠাকুর পালাও, যদি লড়াই করার নূন্যতম জায়গা থাকতো তাহলে বলতাম, ‘রণেশ ঠাকুর, দাঁড়াও, লড়াই করো।’ কিন্তু এটা লড়াই করার জায়গা নয়, রেফারি নিরপেক্ষ নয়; এখানে বাঁশি বাজবে সর্বদাই তোমার বিপক্ষে আর আহমদ শফি হুজুরদের পক্ষে। ফলে মাঠের খেলুড়েরা তোমার বাড়ি পোড়াবে, আখড়া পোড়াবে, এমনকি তোমাকে প্রাণেও মারবে। রণেশ ঠাকুর, তুমি তো বাউল মানুষ, অতো ইতিহাস পড়ো না, তোমায় একটা ঘটনা বলি শোনো- আরবে এক সময় ‘ওকাজের মেলা’ নামক একটা মেলা হত। সেই মেলায় সারা আরব থেকে কবি, সংগীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, যন্ত্রশিল্পীরা আসতেন, সাতদিন ভরে তারা তাদের কলানৈপুণ্য পদর্শণ করতেন। কবিতার প্রতিযোগিতায় যে কবিতাটি সেরা হতো, সেই কবিতাটি সোনালী পাতে লিখে কাবাঘরে ঝোলানো হতো। সেখানে এতোটাই সম্মানিত ছিলেন শিল্পী-কবিরা।
রণেশ ঠাকুর, সেই সোনালী পাতে লেখা কবিতা এখন কোথায়? কোথায় সেই বিখ্যাত ওকাজের মেলা? রণেশ ঠাকুর, কেবল তোমার ভাটি অঞ্চল নয়, সমগ্র বাংলাদেশের পরিণতি ওই ওকাজের মেলা’র মতোই হতে চলেছে। রণেশ ঠাকুর, তুমি পালাও, আরো দুঃসময় আসছে!
মে, ২০২০
১৯ শে মে, ২০২০ রাত ৮:১৫
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
২| ১৯ শে মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:০০
চাঁদগাজী বলেছেন:
ভালো, আপনি পর্যবেক্ষণ ও নিজে প্রেকটিক্যালী করে দেখে গল্প লেখেন, এটা ভালো! পরকীয়া নিয়ে একটা গল্প লিখিয়েন।
৩| ১৯ শে মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:২৩
নুরুলইসলা০৬০৪ বলেছেন: আর একটা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
৪| ১৯ শে মে, ২০২০ রাত ৮:৫৩
নেওয়াজ আলি বলেছেন: এই আমাদের মাতৃভূমি । কি ক্ষতি করেছে লোকটা যে ৪০ বছরের সাধনা এবং বসত ঘর পুড়ে দিতে হবে। জেলা এবং উপজেলায় শিল্পকলা একাডেমী ভবনের জন্য এখনো রাস্তায় বসে প্রতিবাদ করতে হয়।
২০ শে মে, ২০২০ রাত ২:৫১
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৯ শে মে, ২০২০ বিকাল ৫:৫০
রাজীব নুর বলেছেন: অত্যন্ত দুঃখজনক।