নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাগরী (উপন্যাস: পর্ব- ছয়)

২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:৩১

ছয়

পূর্ব-দিগন্ত রক্তিমরূপ ধারণ করেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো দিগন্তের বৃক্ষরাজির আড়াল থেকে উঁকি দেবে সূর্য। চম্পানগরীর বৃক্ষতল কিংবা গৃহের আড়াল-আবডালের আবছায়া আঁধার ক্রমশ উবে যাচ্ছে। কোনো কোনো গৃহ থেকে ভেসে আসছে সামগীতের সমধুর সুর। নগরীর প্রান্তে দরিদ্র শুদ্রদের গৃহে আবদ্ধ কুক্কুট প্রভাত বরণের ধ্বনি তুলছে। নগরীর পথে দু-চারজন মানুষ হেঁটে চলেছে গঙ্গার দিকে; কারো শূন্যহাত, কারো হাতে-মাথায় জলের মুটকি কিংবা কলসি। নগরীর অধিকাংশ মানুষই হয়তো এখন আড়মোড়া ভাঙছে, শীঘ্রই শয্যা ত্যাগ করে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়বে।

গিরিকা ও তার আত্মজা শবরী এবং গিরিকার আশ্রিত কন্যা উমা ও সুলোচনাকে দুটো শিবিকায় বয়ে নিয়ে নগরীর পথ দিয়ে বেহারারা ছুটে চলেছে গঙ্গার তরণীঘাটের দিকে। পিছনে গরুর গাড়িতে তাদের কিছুদিনের খাদ্যদ্রব্য, নিত্য ব্যবহার্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মোট সাজিয়ে চলেছে ভৃত্যরা, পণ্যদ্রব্যের মোট তরণীতে পৌঁছে দিয়ে তারা ফিরে আসবে। কেবল দুজন নারী ভৃত্য তাদের সঙ্গে যাবে রন্ধন এবং আনুষঙ্গিক কর্ম করার জন্য। গিরিকা এবং তিন কন্যার জন্য সব রকম আরাম আয়েসের বন্দোবস্তই করে দিয়েছেন রাজা লোমপাদের অমাত্যগণ।

দুটো শিবিকার প্রথমটাতে আরোহন করেছে শবরী এবং উমা, আর দ্বিতীয়টায় গিরিকা এবং সুলোচনা। উমা আর সুলোচনা গিরিকার যোনিজাত কন্যা না হলেও বালিকা বয়স থেকেই তিনি ওদেরকে কন্যাস্নেহে লালন-পালন করছেন। নৃত্য-গীত শিখিয়েছেন, সাজসজ্জা ও নানা রকম কেশবিন্যাস শিখিয়েছেন; নাগরকে দেখে কিভাবে চঞ্চুতে হাস্যপুষ্প প্রস্ফুটিত করতে হয়, কিভাবে নাগরকে তুষ্ট করতে হয় তা শিখিয়েছেন, কামকলার বিভিন্ন আসন সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন, মোটকথা গণিকাবৃত্তির যতো রকম বিদ্যা, সব তিনি ওদেরকে শিখিয়েছেন। উমা এবং সুলোচনার মতো আরো নয়জন পালিত কন্যা আছে তার, যারা সকলেই চম্পানগরীর পুরুষদের মনোরঞ্জন করে থাকে।

দুর্যোগ বিষয়ক অমাত্য অন্নদামঙ্গল গণিকালয় থেকে ফিরে যাবার পর শবরী-উমারা এই ভেবে স্বস্তিতে ছিল, যে তাদের আর মুনিকুমারকে আনতে যেতে হবে না আর মহর্ষি বিভাণ্ডকের রোষানলে পড়ে অযুত বৎসর পাথর কিংবা নিষ্ফল বৃক্ষ হয়েও থাকতে হবে না; এ যাত্রায় অন্তত তারা বেঁচে গেল! কিন্তু অন্নদামঙ্গলের হাত থেকে রেহাই পেলেও তারা যে নিজেদের জন্মদাত্রী-পালনকর্ত্রী গিরিকার হাত থেকে রেহাই পাবে না, সেটা তারা ক্ষুণাক্ষরেও ভাবে নি। গিরিকা গত পরশু গৃহে ফেরার পথে তার পূর্বপরিচিত দেবিকা নামের এক গণিকার মুখে অন্নদামঙ্গলের গণিকা সন্ধানের খবরটা প্রথম শোনেন আর স্বস্তিবোধ করেন এই জন্য যে দেবিকাদের গণিকালয়ের কোনো গণিকাই অন্নদামঙ্গলের প্রস্তাবে রাজি হয় নি। গিরিকা দেবিকার মুখে কেবল কড়ি আর সুবর্ণ অলংকারের কথা শুনেছিলেন, তার টানেই তিনি দ্বিগুণ গতিতে গৃহে ফিরে এসেছিলেন। আর ফিরে এসে কন্যাদের মুখে যখন শুনলেন অন্নদামঙ্গল এখানেও এসেছিলেন এবং মুনিকুমারকে হরণ করার পুরস্কার স্বরূপ প্রচুর কড়ি, সুবর্ণ অলংকার, মণিরত্ন, সুরম্য বাসগৃহ আর রাজনটীর সম্মান প্রদানের আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু কন্যারা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে; তখন যেন তার মাথায় বজ্রাঘাত হলো! কন্যাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য তিনি তাদেরকে ভীষণ তিরস্কার করলেন। পারলে তখনই তিনি ছুটে যেতেন রাজবাড়ীতে, কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় তাকে অপেক্ষা করতে হয় পরদিন সকালের জন্য। সারারাত তিনি দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারেন নি এই ভেবে যে যদি অন্য কোনো গণিকা এই প্রস্তাবে এরই মধ্যে রাজি হয়! কন্যাদেরকে তিনি কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেই ক্ষান্ত হন নি, সঙ্গে এটাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, এই আকালের দিনে দেবী লক্ষ্মী-ই পাঠিয়েছিলেন অমাত্য অন্নদামঙ্গলকে আর অর্বাচীনের মতো লক্ষ্মীর দান তারা পায়ে ঠেলে দিয়েছে, কিন্তু ভাগ্যে থাকলে লক্ষ্মীর দান তিনি হস্তগত করবেনই! আর তখনই তিনি মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করার জন্য উমা, সুলোচনা এবং নিজকন্যা শবরীকে নির্বাচন করে ফেলেন। তিন কন্যার কোনো কথা কিংবা অনুরোধেই গিরিকা কর্ণপাত করেন নি। পুরস্কারের মূল্য ছাড়াও তিনি কন্যাদের বুঝিয়েছেন যে, কোনোক্রমে তারা যদি মুনিকুমারকে হরণ করে নিয়ে আসতে পারেন তবে কেবল চম্পানগরীতে নয়, অঙ্গরাজ্য তো বটেই এমনকি আশপাশের অনেক রাজ্যেও তাদের নামে হইচই পড়ে যাবে! এমনিতেই গত সমন উৎসবে শবরী অঙ্গরাজ্যের শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী নির্বাচিত হওয়ায় তাদের গণিকালয় বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে, আর এবার মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে হরণ করে আনতে পারলে অঙ্গরাজ্যের মানুষ এক নামে চিনবে তাদের গণিকালয়, ধনী বণিকেরা পিপীলিকার ন্যায় লাইন দিয়ে ছুটে আসবে তাদের গণিকালয়ে, কাড়ি কাড়ি কড়ি আর উপহার আসবে গৃহে। নির্বোধ ব্যতিত কে আর এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করে! সুতরাং তার নিজের বিচারে বুদ্ধিমতীর মতোই তিনি সুযোগটি গ্রহণ করেছেন, দেবী লক্ষ্মীর সাধা ধন পায়ে ঠেলেন নি!

শবরী, উমা আর সুলোচনা; তিনজনই সপ্তদশ-অষ্টাদশ বর্ষীয়া রূপবতী কন্যা। তিনজনের কেউই আজকের পূর্বে শিবিকায় আরোহণ করে নি। করবে কী করে, তারা যখন পাপড়ি মেলে সুবাস ছড়াতে শুরু করেছে তার আগে থেকেই অঙ্গরাজ্যে অনাবৃষ্টি, আর তার ফলে দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের প্রভাবে বাবুদের বিলাস-ব্যসন লঘু হওয়ায় গণিকাদের বিলাস-ব্যসনও কমেছে। আগে কতো বাবু প্রিয় গণিকাকে নিয়ে শিবিকারোহণে কিংবা নৌকাযোগে বিহারে যেতেন, দুর্ভিক্ষ বাবুদের সেই বিলাসিতাটুকু কেড়ে নিয়েছে! তাছাড়া অনেক ধনী বাবু-ই এই আকাল আর রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে বাঁচতে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভিন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। যারা বড়ো বড়ো বাণিজ্য তরণী নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে বাণিজ্য করে বেড়ায়, তারা পরিবার পরিজন সঙ্গে নিয়েই বাণিজ্যে গেছে। ফলে উঠতি গণিকারা বড়োদের মুখে সু-দিনের সেই অতুল আহার-বিহারের গল্প শোনে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে!

তিন কন্যাকে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিয়ে আসায় গিরিকার ওপরে রাগ হলেও এখন দুলকি চালে চলতে থাকা শিবিকার ভেতরে বসে তিনজনই বেশ পুলক অনুভব করছে। বিশেষত শবরী আর উমা, তারা দুজন একই শিবিকায় আরোহণ করায় নিজেদের মধ্যে নানারকম কথা বলছে, রসিকতা করছে।

গিরিকা শিবিকায় অনেক চড়েছেন। যৌবনে তার কয়েকজন ধনী বাবু ছিল, যারা তাকে শিবিকা পাঠিয়ে নিয়ে যেতেন নিজেদের বাগানবাড়িতে, আবার শিবিকায় করেই পৌঁছে দিতেন। গিরিকা সেইসব সুখ আর বৈভবের দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন সুলোচনাকে, ‘জানিস লো, শতানন্দ বাবু আমাকে কী ভাল-ই না বাসতেন, নিজের পত্নীর চেয়েও বেশি! তার দয়াতেই তো আমি জীবনে প্রথম শিবিকায় আরোহণ করি।’

‘শতানন্দ বাবু কে গো মাসিমা?’ সুলোচনার কৌতুহলী প্রশ্ন।

‘শতানন্দ বাবু আমার সত্যিকারের নাগর ছিলেন। কেবল নাগর তো নয় লো, তার চেয়েও বেশি কিছু; পতির মতোন! আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো ছিলেন, কিন্তু তার স্বভাব ছিল একেবারে ছোকরাদের মতোন! কতো জায়গায় বিহারে নিয়ে গেছেন আমাকে, ভূ-মণ্ডলের কতো কী যে দেখেছি তার আশির্বাদে, তা বলে শেষ করা যাবে না। মনও ছিল তার, কাড়ি কাড়ি কড়ি এনে ফেলতেন আমার পায়ের কাছে। তিনি-ই তো নগরীতে আমার বাড়িখানা বানিয়ে দিয়েছিলেন। সে-সব দিনের কথা ভাবলে এখনও বুকের ভেতরটায় শর বেঁধা পাখির মতোন ছটফটায়! জীবনে এই একজন মানুষকে আমি ভালবেসেছিলাম অন্তর দিয়ে। জীবনে আমার সঙ্গে কোনোদিন চালাকি করেন নি, কখনো একটা মিথ্যে কথা বলেন নি; আমিও তার সঙ্গে ছেনালি করি নি কখনো, নিজের পতির মতো সেবাযত্ন করেছি। জানিস লো, মাতাল হয়ে প্রায়ই আমার পা জড়িয়ে ধরে বলতেন, “এ জনমে হলো না গিরি, পরজন্মে আমি যেন তোমাকে সহধর্মিনী হিসেবে পাই! তোমার গর্ভে যেন আমার পঞ্চ পুত্রের জন্ম দিতে পারি।” তখন কী যে ভাল লাগতো আমার তা তোকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারবো না, মনে হতো সার্থক জনম আমার, ধন্যি গণিকার জীবন!’

বলতে বলতে গিরিকার চোখ ছলছল করে উঠলো, উড়নি দিয়ে চোখ মুছে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘যখনই কোনো প্রয়োজনে বলেছি যে কোথাও যাবো, পরদিনই সদরদ্বারে শিবিকা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে বেহারারা। কিন্তু খুব বেশিদিন তাকে সেবা-যত্ন করতে পারি নি, মাত্র বছর চারেক। মা গঙ্গা আমায় বঞ্চিত করলেন, এক রাতের কালবৈশাখী ঝড়ের সময় মা গঙ্গা তাকে গ্রাস করলেন তরণীসমেত।’

গিরিকার জীবনের সুবর্ণ অতীতের কথা শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সুলোচনা, তার মনও স্বপ্ন বুনছে শতানন্দ বাবুর মতো একজন নাগরের আশায়! আহা, তারও যদি অমন একজন নাগর থাকতো, তাহলে তো তাকে দিনের পর দিন গিরিকা মাসিমা’র অধীনস্থ হয়ে বাবুদের মনোরঞ্জন করতে হতো না, দেহ বিকিকিনির কড়ির ভাগ দিতে হতো না, তারও একটা বাড়ি হতো, সেও নানা জায়গায় বিহারে গিয়ে নাগরের মনোরঞ্জন করতে পারতো, ইচ্ছে মতো শিবিকারোহণে বাইরে যেতে পারতো! মনে মনে শিবের কাছে মিনতি করলো সুলোচনা, ‘হে মহেশ্বর, মিলিয়ে দাও, অমন একজন নাগর আমার জীবনেও মিলিয়ে দাও তুমি।’

আচমকা সামনের শিবিকা থেকে হাওয়ায় ভেসে উমার অট্টহাসি কানে আসতেই অতীতের স্মৃতিকাতরতা ভুলে সচেতন হয়ে কান খাড়া করলেন গিরিকা। শিবিকার কপাট দিয়ে গলা বাড়িয়ে ধমকের সুরে বললেন, ‘কী হলো লো? বেশি রঙ্গ উপচে পড়ে তো জায়গা মতো পাঠিয়ে দেব, চিপে রঙ্গ বের করে দেবে!’

সঙ্গে সঙ্গে হাসি মিলিয়ে গেল। নগরীর পথ চলতি দু-চারজন মানুষ সন্দেহের চোখে শিবিকার দিকে তাকাতে লাগলো এই ভেবে যে, রোজ সকালেই তো শিবিকা নয়তো ডুলিতে চড়ে কতো বনেদী বাড়ির নারীরা গঙ্গাস্নান করতে যায়, কিন্তু কেউ তো এমন শব্দ করে হাসে না, জোরে কথাও বলে না তারা! তবে কারা এরা? ভিন রাজ্যের লাজ-লজ্জাহীন কোনো নারী না কি গণিকা? উমা এখন মুখের মধ্যে উড়নি ঢুকিয়ে হাসছে। শবরী ফিসফিস করে বললো, ‘থাম উমা, নয়তো আবার ধমক খাবি।’

উমা তবু হাসতেই লাগলো। উমা সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতি, কিন্তু জোরে শব্দ করে বড্ড বেশি হাসে। ও যেন একা হাসে না; চারপাশের মানুষ, বৃক্ষলতা, গৃহপালিত পশু-পাখি, ঘটি-বাটি, বাতাস সকলকে নিয়েই হাসে! দিনের মধ্যে বিশবার হাসে তো শতবার গিরিকার ধমক খায়। এমনকি ঘরে নাগর থাকলে তখনও জোরে জোরে হাসে, হেসে গড়িয়ে পড়ে বিছানায় কিংবা নাগরের শরীরে। তবে ওর এই হাসি নাগররা খুব পছন্দ করে। তারা ওকে হাসানোর জন্য ইচ্ছে করে ওর শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় সুড়সুড়ি দেয়, অশ্লীল কৌতুক বলে শরীরে চিমটি কাটে! তারপর নাগর তার কাজ সেরে চলে গেলে গিরিকা ওকে ধমকান, ‘এতো রস কিসের লো মাগি তোর? রোজ রোজ এতো এতো রস খসিয়ে দিয়ে যায়, তবু রসে টইটম্বুর!’

তবে উমার এই হাসির জন্যই গিরিকা ওকে নিয়ে এসেছেন; যেহেতু ওর এই হাসি নাগররা পছন্দ করে, মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গও পছন্দ করতে পারে এই চিন্তা করে।

উমার এখনকার হাসির কারণ পিছনের একজন বেহারাকে নিয়ে শবরীর রসিকতা। শবরী শিবিকার কপাটের কাছে মুখ নিয়ে বাইরে দৃষ্টি বুলাচ্ছিল, মুখ আরেকটু বাড়াতেই হঠাৎ কষ্টি পাথরে খোদাই করা মূর্তির মতো বেহারার দিকে দৃষ্টি পড়ায় সে কিছুটা চমকে মাথা পুনরায় কপাটের ভেতরে নিয়ে এসেছে। বেহারার লম্বা দেহাতি উদোম কালো শরীর, শরীরের বিন্দু বিন্দু ঘাম একত্র হয়ে দরদর করে গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকে। মাথার তৈলাক্ত কাঁচা-পাকা লম্বা কেশ পিছনে খোঁপা বাঁধা। নাক কিছুটা বোঁচা কিন্তু নাসারন্ধ্র অস্বাভাবিক রকমের বড়ো। চোখ দুটো লাল। পরনে নেংটি, উদোম শরীর ভরা কাঁচা-পাকা মোটাজাতের লোম। কপালের বাম দিকে এবং বাম গালে প্রায় দু-আঙুল আর বুকের ডান দিকে অন্তত পাঁচ-ছয় আঙুল লম্বা দুটো কাটা দাগ। দেখে বোঝা যায় দাগ দুটো খুব বেশি দিনের পুরনো নয়। হয়তো কোথাও কোনো দস্যুদলের কবলে পড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ খেয়েছিল। বেহারারা শিবিকা নিয়ে প্রায়ই দস্যুর কবলে পড়ে এরকম কোপ খায়, কেউ কেউ মারাও যায়।

উমা চমকানোর কারণ জিজ্ঞেস করতেই শবরী ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছে, ‘বেহারাটাকে দেখলে কেমন ভয় লাগে!’

উমাও মুখ বাড়িয়েছিল কপাটের বাইরে, মুহূর্তের জন্য উমার চোখে চোখ পড়েছিল বেহারার। যেন পাথরের মুখে বসানো পাথরের চোখ! এতো যে ওজন বয়ে চলেছে কাঁধে তবু মুখে কোনো কষ্ট বা ক্লান্তির চি‎হ্নমাত্র নেই, আবার হাসিও নেই। একজন সন্দরী গণিকার চোখে চোখ পড়লো তবু তার চোখ-মুখের ভাষার কোনো পরিবর্তন নেই! যেন নিথর চোখ, নির্বাক মুখ! উমা মাথা ভেতরে এনে বলেছে, ‘আমি রাতের অন্ধকারে একে একা দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাব!’

শবরী বলেছে, ‘সখি, ওকে তুই নাগর করে নে, দিনে তুই ওর শিবিকায় আরোহণ করবি আর রাতে ও তোর কায়ায় আরোহণ করবে!’
এই রসিকতাতেই আচমকা শব্দ করে হেসে উঠেছিল উমা। ধমক খেয়ে এখনো হেসে চলেছে মুখে উড়নির প্রান্ত ঢুকিয়ে। একেবারে তুচ্ছ কারণেও এমনি করে হাসে সে।

বেহারারা এখন নগরীর প্রান্তে গঙ্গাপারের পথ ধরে শিবিকা বয়ে নিয়ে চলেছে তরণীঘাটের দিকে। গঙ্গার ধারে দারুণ বাতাস বইছে। ভোরবেলার এই বাতাসটা শরীরের জন্য যেন অমৃত, গঙ্গার বক্ষের মায়া নিয়ে এসে শরীর শীতল করে দেয়। তারপর তো সারাটা দিন সূর্য তেতে থাকে। মানুষ, বৃক্ষ-লতা, পশুপাখির রস যেন নিঙড়ে নেয়; আর বাতাস তো নয় যেন সূর্যদেবের তপ্ত নিশ্বাস! বেহারারা সামনে থেকে আসা অপর একটি শিবিকাকে পথ করে দিতে কিছুটা বায়ে সরে গেল। শবরী আর উমা কপাটের কাছে মুখ নিয়ে দেখলো, শিবিকা থেকে জল চুইয়ে পড়ছে পথে। শিবিকার সামনে-পিছনে কয়েকজন রক্ষী আর ভৃত্য। হয়তো কোনো ধনী বণিক অথবা রাজবাড়ির কোনো নারী গঙ্গা স্নান সেরে গেলেন।

ভোরবেলায় কেউ গঙ্গাপারে প্রাতঃভ্রমণ করতে আসে, কেউ শরীরচর্চা কিংবা কুস্তির চর্চা করতে আসে, কেউ স্নান করতে আসে, আবার কেউবা আসে সারা দিনের পানীয় জল সংগ্রহ করতে। অঙ্গরাজ্যকে লোভ দেখিয়ে গঙ্গাদ্বারের পাহাড়ি অঞ্চল এবং উজানের দিকের রাজ্যগুলির বৃষ্টির জল গঙ্গা বয়ে নিয়ে চলেছে ভাটির বঙ্গ-ম্লেচ্ছদেশের দিকে। এখন অবশ্য গঙ্গার বুকের দু-দিকে জেগেছে বালুচর। জল নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় মানুষকে কোথাও কম আবার কোথাও অনেকটা বালুচর পেরিয়ে জলের কাছে যেতে হয়। শুধু তো রাজধানী চম্পানগরী নয়, অনেক দূরের জন্মন্ থেকেও মানুষ জল সংগ্রহ করতে আসে কলসি কিংবা মুটকি নিয়ে। অন্ধকার থাকতেই তারা রওনা করে, নিজেরা স্নান করে জল ভরা কলসি কিংবা মুটকি মাথায় বয়ে নিয়ে গৃহে ফিরে যায় রোদ তেতে উঠবার আগেই। সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটেই গঙ্গাস্নান করতে আসে। কিন্তু বণিক কিংবা অন্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী-পুরুষেরা আসে শিবিকা অথবা ডুলিতে আরোহণ করে। আর আরো দূরে যাদের নিবাস, যেখানে জলের কোনো ব্যবস্থাই নেই, নদী-খাল সব শুকিয়ে গেছে; তারা চম্পানগরীতে এবং নগরীর বাইরে গঙ্গা এবং চম্পা নদীর পারের বিভিন্ন জন্মনের বৃক্ষতলায় অস্থায়ী নিবাস গড়েছে।

বেহারারা এখন বাঁধা রাস্তা ছেড়ে বালুচরে নেমে ঘাটের দিকে এগোচ্ছে, জল নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ঘাটও এখন কিছুটা দূরে সরে এসেছে। বেহারাদের পা ডুবে যাচ্ছে শুষ্ক বালিতে, কমে গেছে শিবিকার গতি। কর্মব্যস্ত তরণীঘাট, ঘাটে অপেক্ষমাণ ছোট-বড়ো অনেক তরণী, কোনো কোনো তরণী থেকে ভৃত্যরা পণ্যসামগ্রী বয়ে নিয়ে গরু কিংবা মহিষের গাড়িতে সাজাচ্ছে। সুজ্জিত একটি তরণীর কাছে এসে বেহারারা শিবিকা নামিয়ে একদিকে সরে দাঁড়ালো। তাদের গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরছে, কিন্তু ক্লান্ত দেখাচ্ছে না মোটেও। একবারে তারা অনেক পথ পাড়ি দিতে সক্ষম, তাই হয়তো এতো অল্প পথ তাদেরকে ক্লান্ত করতে পারে নি।

প্রথমে শিবিকা থেকে নামলেন গিরিকা, তারপর সুলোচনা। তাদের নামতে দেখে অন্য শিবিকা থেকে নামলো শবরী আর উমা। গিরিকা ভেবেছিলেন নেমে উমাকে আচ্ছা মতো একটা ধমক দেবেন, ধমক না দিলে ছুড়িকে বাগে রাখা যায় না। কিন্তু নেমে তরণীর দিকে দৃষ্টি পড়তেই বিপুল আনন্দে তিনি সে-কথা ভুলে গেলেন। এতো বড়ো তরণী! বহু বৎসর তিনি এতো বড়ো তরণীতে আরোহণ করেন না। আর নানা রঙের পুষ্প, সবুজ লতা-পাতা দিয়ে কী সুন্দর করে সাজানো-গোছানো, যেন কোনো ঋষির ভাসমান আশ্রম! তরণীর ওপর ভিন্ন ভিন্ন বয়সের পাঁচজন দাঁড়ি দাঁড়িয়ে-বসে তাদের দিকে চেয়ে আছে। তরণীর আকার অনুপাতে দাঁড়ির সংখ্যা নিতান্তই কম, এটি আসলে রাজবাড়ীর প্রমোদতরণী। তরণীতে ভিড় কমানোর জন্যই দাঁড়ি কম রাখা হয়েছে। রাজবাড়ী থেকে যারা প্রমোদ ভ্রমণে বের হয়, তাদের কোনো তাড়া থাকে না, তরণী ধীর গতি চলে।

গিরিকার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ চোখ-ই যেখানে কপালে ওঠার যোগার, সেখানে অন্যদের মুখ তো একেবারে হাঁ! শবরী, সুলোচনা আর উমাও বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তরণীর দিকে। সুসজ্জিত তরণী দেখে তিনকন্যা যেন ভুলেই গেছে মহর্ষি বিভাণ্ডকের অভিশাপের ভয়! সুলোচনা তো আনন্দের আতিশয্যে বলেই ফেললো, ‘মাসিমা, আমরা এই তরণীতে যাবো?’

গিরিকা হাস্যমুখে বললেন, ‘হ্যাঁ লো, হ্যাঁ, অঙ্গরাজের কন্যার পতি আনতে যাচ্ছি, যে- সে তরণীতে গেলে কী চলে!’

ভৃত্যরা অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল, গিরিকার দৃষ্টি তাদের দিকে পড়তেই তিনি এমন আন্তরিকভাবে তাদেরকে তরণীতে দ্রব্যসামগ্রী তোলার নির্দেশ দিলেন যেন তারা দীর্ঘদিন ধরে গিরিকার গৃহে কাজ করছে, তারপর তিনি লম্বা ঘোমটায় মুখমণ্ডল আবৃত করা রাঁধুনী ভৃত্য দুজনকে বললেন, ‘তোমরাও উঠে পড়ো, রন্ধনের দ্রব্যসামগ্রী রন্ধনশালাতেই গুছিয়ে রেখো।’

রাঁধুনী আর ভৃত্যরা দ্রব্যসামগ্রীর মোট নিয়ে তরণীতে উঠলো, তাদের পিছন পিছন গিরিকা এবং তিনকন্যা। তরণীর দুটি তলা-ওপর তলায় দুটি কক্ষ; আর নিচতলায় রন্ধনশালা, স্নানাগার, শৌচাগার এবং দাঁড়িদের বিশ্রামের জন্য ছোট একটি কক্ষ। রাঁধুনীদের নিদ্রার জন্য আলাদা কোনো গৃহ, রন্ধনশালার মেঝে-ই তাদের শয্যাস্থান। তরণীর নিচতলার ছাদ অতিশয় নিচু, সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না, মাথা নিচু করে কোমর বেঁকিয়ে চলাফেরা করতে হয়। কিন্তু ওপরতলা তা নয়, ওপরতলার ছাদ বেশ উঁচুতে, দিব্যি হাঁটাচলা করা যায়।

গিরিকা তাদের নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রীর মোট এবং তোরঙ্গগুলো তরণীর ওপরতলার কক্ষে রাখার নির্দেশ দিলেন। তিনি শবরীকে নিজের কক্ষে থাকার আদেশ করলেও শবরী উমার সঙ্গে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করলো। গিরিকা তার আত্মজার ওপর একটু বিরক্ত হলেও ওর ইচ্ছে পূরণ করলেন। সুলোচনাকে তিনি নিজের কক্ষে নিলেন, সুলোচনা এমনিতেও তার ছায়ার মতোন। শবরী এবং উমা অন্য কক্ষে প্রবেশ করলো। ভৃত্যরা দ্রব্যসামগ্রী তুলে দিয়ে গিরিকার অনুমতি নিয়ে তাকে করজোরে প্রণাম করে তরণী থেকে নিচে নেমে গেল, বেহারারা শিবিকা তুলে আগেই রাজবাড়ীর পথ ধরেছে। গিরিকা সুলোচনাকে সঙ্গে নিয়ে জিনিসপত্রের মোট খুলতে লাগলেন। একজন দাঁড়ি কক্ষের বাইরের সরু গলিতে দাঁড়িয়ে বেষ্টনের আড়াল থেকে বললো, ‘নমস্কার ভগিনী, আজ্ঞা করলে মা গঙ্গার নামে যাত্রা আরম্ভ করি।’

আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকায় দাঁড়ির কথা শুনলেও মুখ দেখতে পেলেন না গিরিকা, উঠে কপাটের বাইরে গিয়ে দাঁড়ির মুখে দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘কী নাম তোমার ভ্রাতা?’

মাঝারি উচ্চতার, সুঠাম অঙ্গের শ্যামবর্ণ প্রৌঢ় নত দৃষ্টিতে বললেন ‘আঙ্গে, রঘু।’
‘রঘু, ঝড়-বাতাস উঠলে একটু সামলে চ’লো ভ্রাতা, প্রয়োজনে তরণী কূলে ভিড়িও। আমাদের অতো তাড়া নেই। মা গঙ্গার নাম স্মরণ করে এবার যাত্রা আরম্ভ করো।’
‘আজ্ঞে ভগিনী, নমস্কার।’

রঘু চলে গেলে গিরিকা করজোড় কপালে ঠেকিয়ে পূর্বদিকে মা গঙ্গার উদ্দেশে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে শেষে স্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘গঙ্গা…গঙ্গা…রক্ষা ক’রো মা আমার, রক্ষা ক’রো।’

রঘুর হাঁক শোনা গেল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তরণী দুলে উঠে চলতে শুরু করলো। গিরিকা নিজের কক্ষে প্রবেশ করতে গিয়েও করলেন না, পাশের কক্ষে প্রবেশ করে শবরী আর উমাকে বসে গল্প করতে দেখে বললেন, ‘বসে আছিস কেন তোরা? জিনিষপত্তরগুলো বের কর, কক্ষটা গুছিয়ে একবারে স্নান করে এসে বোস।’
‘এই তো গুছাচ্ছি মাসিমা, একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।’ বললো উমা।

‘বিশ্রামের অনেক সময় পাবি, দেখবি বসে থাকতে থাকতে পায়ে রস জমে যাবে। আমি যাই, আমাদের কক্ষটা গুছিয়ে নিই।’
বলেই শবরীর দিকে একবার গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেলেন গিরিকা। নিজের ঘরে এসে কাঠের তোরঙ্গ খুলে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছদ এবং জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে রাখতে লাগলেন। তাকে সাহায্য করতে হাত লাগালো সুলোচনা। হাত দিয়ে কাজ করলেও গিরিকা মনে মনে ভাবতে লাগলেন শবরীর কথা। তার নিজের গর্ভজাত কন্যা, তবু মাঝে মাঝে বড়ো অচেনা লাগে ওকে! মা হয়েও তিনি যেন ওর মনের অতল খুঁজে পান না! ভেবেছিলেন নিজের কন্যার সঙ্গে এক ঘরে থাকবেন, অথচ কন্যা তাকে ছেড়ে বেছে নিলো সখিকে। কেন লো, মায়ের চেয়ে কি সখি আপন? ও কেন যে তাকে এড়িয়ে চলতে চায়, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না গিরিকা। তিনি সবাইকে শাসনে রাখেন, তা অতোগুলো ঋতুমতী কন্যাকে নিয়ে গণিকালয় চালাতে গেলে একটু কড়া ধাতের হতে হয় বৈকি। নইলে কন্যারা কাঁধে পাড়া দিয়ে চলে, মান্য করে না; নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে, গণিকালয়ের শৃঙ্খলা থাকে না। তাছাড়া গণিকালয় হলো মধু ভরা মৌচাক! একটু কড়া আর মুখরা স্বভাবের না হলে মধুর লোভে বাইরের বাঁজপাখিও ছোঁ মারে!

তবে তিনি যে শুধু শাসন করেন তা তো নয়, ভালও তো বাসেন ওদের! সময় সময় কন্যাদের কাছে বসিয়ে চুলে তেল দিয়ে মাথা আঁচড়ে দেন, নিজে তদারকি করে ভৃত্যদের দিয়ে কুঙ্কুম-চন্দনের প্রসাধনী তৈরি করান ওদের জন্য, ওদের শরীর যাতে ভাল থাকে সে-জন্য যথাসাধ্য ভাল খাবারের আয়োজন করেন। তিনি না হয় একটু শাসন করেন, আর তার মা তো কন্যাদের মারতেন! নিজের মেয়ে বলে তাকেও রেহাই দিতেন না। চুলের মুঠি ধরে থাপড়ে গাল রক্তবর্ণ করে দিতেন। আর নিজের কন্যা শবরীকে তো তিনি বলতে গেলে শাসনই করেন না। নিজের অপছন্দ হলেও ওর ইচ্ছা পূরণ করেন। সখিদের সঙ্গে কী সুন্দর হাসি-ঠাট্টা করে, অথচ তার সাথে কথা বলার সময় তাকায় যোগিনীর মতো!

কন্যার জেদ দেখে সময় সময় তার নিজের গা নিজে খাঁমচে মাংস ছিঁড়তে ইচ্ছে করে! এবারই কী রাজি করাতে কম ধকল গেল! তবু কী রাজি হয়েছে? তিনি খিস্তিখেউড় করে জোর করলেন বলেই না এলো! বড্ড জেদ, রেগে গোঁজ হয়ে আছে ভেতরে ভেতরে। সকলের সঙ্গে হেসে কথা বললেও তিনি সামনে গেলেই গম্ভীর হয়ে থাকছে। একে তো জেদি, তায় বিষয়বুদ্ধিও নেই। কোনো নাগরকে অপছন্দ হলে একবার যদি বলে তাকে শয্যায় তুলবো না, তো পায়ের কাছে লক্ষ কড়ি ছড়ালেও তাকে আর নিজের কক্ষে ঢুকতে দেবে না। বলে অমুকের গায়ে ভারী দুর্গন্ধ, তমুকের শরীরের সুচের মতো লোমে শরীর ছড়ে যায়! আরে বাপু, জলে নেমে কাপড় বাঁচানোর ভয় করলে কী চলে! এসব তো একটু সইতেই হবে, এসব সহ্য করলেই না কড়ি আসবে গৃহে! তার ভয় হয়, এইসব কারণে শেষ বয়সে কন্যাকে আবার ভিক্ষের থালা হাতে নিয়ে রাস্তায় নামতে হয় কি-না!

গিরিকার নিজের শরীরে ব্রা‏‏হ্মণের রক্ত, তার মাতার এক ব্রা‏‏হ্মণ নাগর ছিল, তারই ঔরসে জন্ম গিরিকার। কিন্তু ব্রা‏হ্মণ রক্ত হলে কী হবে তিনি স্বভাবটি পেয়েছেন একেবারে ক্ষত্রিয়ের মতো দাপুটে। আর তার কন্যা ক্ষত্রিয়ের ঔরসে জন্মালেও স্বভাবে কেমন ঋষিপত্নীর মতো! অথচ ওকে একটু কড়া ধাতের না হলে চলবে কেমন করে? তার অবর্তমানে তো ওকেই সামলাতে হবে গণিকালয়। তার তো আর কোনো কন্যা নেই, ওই একমাত্র উত্তরসুরি। দু-দুটো সন্তান তার মরেছে, একটা কন্যা আরেকটা পুত্র। কন্যা জন্মেই মরেছিল না কি মরেই জন্মেছিল তা বোঝাও যায় নি, আর পুত্র মরেছে তেরো বছর বয়সে। পুত্রের মৃত্যুশোক আজও তার বুকে বাসা বেঁধে আছে। পথে-ঘাটে চলার সময় ওই বয়সের কিশোর দেখলেই তার মৃত পুত্রের মুখটি ভেসে ওঠে চোখের সামনে, দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে বুক থেকে! আহা, পুত্র!
সুলোচনা কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় উড়নির ঘোমটায় মুখমণ্ডল ঢেকে একজন রাঁধুনী এসে কপাটের বাইরে দাঁড়িয়ে বললো, ‘মাতা, এখন কী কী রন্ধন করবো?’

গিরিকা হাতের কাজ থামিয়ে মেঝেতে বসে শবরীর চিন্তায় ডুবে থেকে রাঁধুনীর কথা খেয়াল করলেন না। সেটা লক্ষ্য করে শয্যার ওপর পরিচ্ছদগুলো ভাঁজ করতে করতে সুলোচনা বললো, ‘মাসিমা…।’
সম্বিত ফিরে পেয়ে গিরিকা সুলোচনাকে বললেন, ‘কী যেন বলছিলি?’
‘কী ভাবছো তুমি?’
‘কই, কিছু না।’

কপাটের দিকে আঙুল দিয়ে সুলোচনা বললো, ‘ওই যে রাঁধুনী জিজ্ঞেস করছে এখন কী রন্ধন হবে।’
গিরিকা ঘুরে বসে তাকালেন রাঁধুনীর দিকে। দাসীর মাথার লম্বা ঘোমটা দেখে বললেন, ‘তোমাকে তো দেখতেই পাচ্ছিনে বাপু, কথা বলবো কী করে! খোলো দেখি ঘোমটাখানা।’

রাঁধুনী কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে ঘোমটা মাথার ওপরে টেনে দিলো, তার বছর ত্রিশের শ্যামবর্ণ গোল মুখের দিকে তাকিয়ে গিরিকা বললেন, ‘এমন সুন্দর মুখখানা ঢেকে রেখেছো কেন মা! ঢেকে রাখলে না তুমি ভূ-মণ্ডল দেখতে পাও, না ভূ-মণ্ডল তোমায় দেখতে পায়! কী নাম তোমার?’

গিরিকার কথায় রাঁধুনী খানিকটা লজ্জা পেলেও ভাল লাগছে তার। কেননা আদেশের ভৃত্য তারা, তারা জানে যে ত্রিবর্ণের সেবা করার জন্যই ভগবান তাদেরকে ভূ-মণ্ডলে পাঠিয়েছেন। তাই ত্রিবর্ণ তাদের সবরকম সেবা গ্রহণ করবে, আবার গালমন্দও করবে, এমনকি মারবেও! জেনেছে ত্রিবর্ণ তাদেরকে পায়ে ডললেও নীরবে সহ্য করাতেই তাদের পূণ্যি! তাই শরীর নিঙড়ে তারা ত্রিবর্ণের সেবা করে, কখনো কারো কাছে ভাল ব্যবহারের আশা করে না। এখন গিরিকার আত্মীয়সম ব্যবহারে সে তার ভাললাগার অনুভূতি ঠোঁটে ছড়িয়ে বললো, ‘আজ্ঞে, আমার নাম উলুপী।’

‘বেশ নাম! তা বলো দেখি উলুপী কী কী রন্ধনদ্রব্য পাঠিয়েছে?’
‘কয়েক পদের মৎস্য, কুক্কুট, পাঁঠার মাংস, ডাল, আটা, বিভিন্ন রকম আনাজ।’
‘বেশ, তাহলে কোনো ছোট মৎস্য, পাঁঠার মাংস, সবজী আর ডাল রন্ধন করো। দাঁড়িরা সবাই পাঁঠার মাংস ভোজন করে কি-না জিজ্ঞেস করে নিও।’
‘আজ্ঞে, তাদের আর আমাদের জন্য আলাদা রন্ধন হবে।’

‘ওমা, সে কী কথা! একসঙ্গে যাচ্ছি সবাই, তোমাদের আর দাঁড়িদের জন্য আবার আলাদা রন্ধনের ব্যবস্থা কেন?’
‘আজ্ঞে, সেটাই নিয়ম। রাজবাড়ির কর্তা কিংবা অতিথিদের জন্য রন্ধন করা খাদ্যসামগ্রী আমাদের ভোজন করা অনুচিত।’

‘এখন তো রাজবাড়ীর কর্তারা নেই, আমাদের ক্ষেত্রে ওসব রাজ আচার মেনে চলার কোনো প্রয়োজন নেই উলুপী, আলাদা রন্ধনের ঝামেলা করার কোনো দরকার নেই। একসঙ্গেই সকলের জন্য রন্ধন ক’রো। আর রঘুকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে ব’লো।’
‘আজ্ঞে, আপনার যা আজ্ঞা মাতা। নমস্কার।’ চলে গেল উলুপী।

গিরিকার এই এক আশ্চর্য ক্ষমতা, তিনি সবাইকেই খুব সহজে আপন করে নিতে পারেন। তিনি তার কন্যাদের শিখিয়েছেন যে গণিকাদের আহারে যেমনি বাছবিচার করতে নেই, তেমনি শয্যাতেও জাতপাতের বিচার করতে নেই। কোথায় রাগের সরা খুলে ফোঁস করতে হয় আর কোথায় স্নেহের কোমল পাত্র উন্মুক্ত করতে হয় তা তিনি ভালো জানেন। গোঁয়ার ষাঁড়ের মাথায় হাত বুলিয়েও তিনি সহজে কার্যসিদ্ধি করতে পারেন! তার মুখের মিষ্ট কথায় মুগ্ধ হয়ে কন্যাদের কাছে আসা এক যুবক নাগর প্রায়-ই বলে, ‘মাসী গো, তোমার বয়স কম হলে সত্যিই আমি তোমায় বিবাহ করে সংসার পাততাম!’

সুলোচনা অনেকক্ষণ যাবৎ নিজের ভেতরে আটকে রাখা কৌতুহলী প্রশ্নটা উগড়ে দিলো, ‘আচ্ছা মাসিমা, তুমি কোথায় কোথায় জলবিহারে গিয়েছ?’

গিরিকিা তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, ‘কতো জায়গায় গিয়েছি তার কী ঠিক আছে! সব জায়গার নাম স্মরণেও নেই। তবে মনে আছে একবার এক বেনেবাবু বাণিজ্যে যাবার সময় আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে তিনমাস নদীবক্ষে ছিলাম। সেই মগধদেশ, কোশল, প্রয়াগ ঘুরিয়ে আরো অনেক দূরের মৎস্য আর মধুপুরী রাজ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। কী আশ্চর্য সেইসব রাজ্য, আর মানুষের কতো বিচিত্র জীবনযাপন। সেই জলবিহার থেকে ফিরে আমার আর ঘরে মন টিকতো না, মনে হতো আবার যাই, আরো দূর দেশে যাই, যে-ই দেশ আর দেশের মানুষ দেখি নি কোনোদিন। তারপর আরো কয়েকবার গিয়েছিলাম। কিন্তু ঘরে ফিরলেই মনটা আবার উড়ু উড়ু করতো, মনে হতো বেশ তো ছিলাম, আবার এক জায়গায় ঘানিচিপা হয়ে মরতে এলাম! মন একেবারে বাহিরমুখী হয়ে পড়েছিল, আমার মাতা তা বুঝতে পেরে আমার পায়ে শিকল পড়িয়েছিলেন। মাতা ভেবেছিলেন ঘন ঘন বিহারে গেলে আমি যদি আর না ফিরি, যদি সেইসব দেশের নাগরদের সঙ্গে ভেগে যাই তো বৃদ্ধকালে তাকে দেখবে কে!’

কিছুক্ষণ পর রঘু এসে কপাটের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমায় ডেকেছেন ভগিনী?’

তাম্বূলপাত্র থেকে একটা তাম্বূল সবে মুখে দিয়েছেন গিরিকা, জিভের ডগা দিয়ে মুখের ডানপাশের মাড়িতে তাম্বূল ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘উলুপী বলছিল আমাদের আর তোমাদের জন্য নাকি আলাদা রন্ধন ব্যবস্থা?’
‘আজ্ঞে ভগিনী, সেটাই নিয়ম।’

‘রাখো ভ্রাতা তোমার নিয়ম। তোমরা আমার ভ্রাতা-পুত্রসম, আমরা যা আহার করি তোমরাও তাই করবে। আমি উলুপীকে বলে দিয়েছি ওরা সকলের জন্য একসঙ্গেই রন্ধন করবে।’
‘ভগিনী, রাজবাড়ির কর্তারা শুনলে রাগ করতে পারেন।’
‘তোমরা কেউ না বললেই তো হলো, আমরা তো আর বলতে যাচ্ছি নে।’
‘আজ্ঞে, আপনার যা আদেশ। আপনার মতো মানুষ হয় না ভগিনী।’
‘ঠিক আছে যাও; আর শোনো, কখনো কিছু প্রয়োজন হলে চাইতে লজ্জা ক’রো না ভ্রাতা। আমরা রাজপুরীর রাজরাজেশ্বরী-রাজনন্দিনী নয় গো ভ্রাতা, আমরা নাগরী। আমাদের কাছে ছোট-বড়ো, জাত-বেজাত সবাই সমান, সকলেই আমাদের পরমাত্মীয়। নিজের ভগিনী মনে করে যখন যা প্রয়োজন চেয়ে নিও ভ্রাতা।’
‘নিশ্চয় ভগিনী, আপনার মঙ্গল হোক।’

রঘু চলে গেলে রন্ধনশালার উদ্দেশ্যে গিরিকা নিচে নামলেন।


(চলবে...)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১২:০৮

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর ইতিহাস।

অনুরোধ করবো এরপরের পর্ব গুলোতে সহায়ক গ্রন্থ গুলোর নাম দিয়ে দিবেন। তাহলে পাঠকের জন্য সুবিধা হয়।

২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ৯:২৮

মিশু মিলন বলেছেন: চার বছর আগে লেখা উপন্যাস, সব বইয়ের নাম এখন হয়তো মনেও নেই। তবু চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।

২| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:৫২

শুভ_ঢাকা বলেছেন: ক্লাসিক লেখা। তৎসহ বর্ণনা। এই লেখা প্রকৃত সময়কাল ও স্থান কোথায়।

মনে হয়েছিল এই লেখার সব শব্দের অর্থ আমার বোধগম্য না ও হতে পারে। কিন্তু সহজেই উৎরে গেলাম বলে।

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিকাল ৩:৫৭

মিশু মিলন বলেছেন: এই আখ্যান রামচন্দ্রের জন্মের কিছুকাল পূর্বের। স্থান বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের ভাগলপুর ও মুঙ্গের অঞ্চলের।

৩| ১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ রাত ১:৪০

ডঃ এম এ আলী বলেছেন:

ভাল লিখেছেন ।
পরের পর্ব দেখতে চল্লাম ।

১৮ ই অক্টোবর, ২০২০ সকাল ১১:৪০

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.