নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
পনের
অপরাহ্ণের সূর্যকিরণে তুষারাবৃত শুভ্র শৈল হিমালয় পর্বতশ্রেণি যেন লাস্যময়ীর ন্যায় হেসে ওঠে আর ক্ষণে ক্ষণে শুভ্র মেঘের আবরণ টেনে ঢেকে ফেলে সেই হাসি, আবার সরে যায় আবরণ, আবার ঢেকে যায় হাসি; দেখে বোধ হয় যেনবা মানব হৃদয়ের মতোই খেয়ালি ওই শুভ্র হিমালয় পর্বতশ্রেণি! মনে হয় যেন কত কাছে! কিন্তু দূরে, বহু দূরে, ওখানে যেতে হলে পেরোতে হয় অনেক রুক্ষ পাথুরে আর তুষারাবৃত পথ, বিপুল চড়াই-উৎরাই, সহ্য করতে হয় ব্যাপক ঠান্ডার কষ্ট। সেই পুরাকাল থেকে অনেক মুনি-ঋষি আর পরিব্রাজক হিমালয় পর্বতশ্রেণির সর্বোচ্চ চূড়ার সন্ধানে পর্বতশ্রেণিতে পা রেখেছেন, কেউ ফিরেছেন, কেউ ফেরেননি। যারা ফিরে এসেছেন, তারা নানারকম লৌকিক এবং অলৌকিক গল্প বলেছেন মানুষের কাছে। তবে তাদের প্রত্যেকের গল্পেই সাধারণত যে বিষয়টি পাওয়া যায় তা হলো- তুষারাবৃত পর্বতশ্রেণির উচ্চতার একটা পর্যায় পর্যন্ত যাবার পর সবাই খেই হারিয়ে ফেলে, কোনদিক দিয়ে যাবে বুঝতে পারে না, একটির পর একটি চূড়া, পর্বতশ্রেণির যেন শেষ নেই, যেন অনন্ত পর্বতশ্রেণি আর চারিদিকে শুভ্র তুষাররাশি! অনেকে পথ হারিয়ে ফেলে, পথ চিনে আর ফিরতে পারে না। অনেকে তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে কিংবা ক্ষুধায় আর ঠান্ডায় জর্জরিত হয়ে মারা যায়।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত পথিকদল গোধূলির পূর্বেই এক ঘন সবুজ উপত্যকায় শিবির ফেলেন। এই পথিক দলের নেতৃত্বে আছেন ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি বেণ; সঙ্গে আছেন তাঁর বাল্যসখা কুথান, সখা ও সমরবিদ সঞ্জয়, ক্ষত্রিয় যুবক উপল, ব্রাহ্মণ পুরোহিত সুবল এবং দুজন ঋষি কমল ও সুধন্য। সাতজনের এই দলটি স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন পাঁচদিন পূর্বে। দেবপতি ইন্দ্র তার পুত্রের বিবাহ উৎসবে নিমন্ত্রন করেছেন নৃপতি বেণকে, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেই সদলবলে প্রথমবারের মতো বেণের এই স্বর্গযাত্রা।
বিরাটাকৃতির এক কল্পতরু বৃক্ষের তলায় শিবির টাঙান নৃপতি বেণ এবং তার দল, নিকটেই পর্বতের অঙ্গে রয়েছে একটি ঝরনা, প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া সরু ঝিরি দিয়ে প্রবাহিত হয় ঝরনার জল, ঝিরিটি নেমে গেছে দক্ষিণের খাদের দিকে। এই সাতজনের মধ্যে কেবল প্রৌঢ় ঋষি কমল ইতোপূর্বে দু-বার স্বর্গে গিয়েছেন, বাকি সকলে এবারই প্রথম। বিতলের পণিদের তৈরি মোটা কাপড়ে তৈরি তিনটি শিবির টাঙান সকলে মিলে; একটিতে বেণ ও কুথান থাকবেন, বাকি দুটির একটিতে থাকবেন সঞ্জয় ও উপল, অন্যটিতে থাকবেন পুরোহিত এবং দুই ঋষি।
ঝরনা থেকে স্নান করে এসে সকলে আহারে বসেন, উপলের ওপর পরিবেশনের দায়িত্ব, সে সকলের আগে স্নান করে এসে পাথরের উনুন তৈরি করে পাত্রে প্রথমে রুটি সেঁকেছে, তারপর মাংস গরম করেছে। যাত্রাপথে আহারের জন্য পর্যাপ্ত রুটি, মাংস, ফল ইত্যদি খাদ্যদ্রব্য সঙ্গে এনেছেন তারা। এছাড়া স্বর্গযাত্রার পথে কদলী, বদ্রীসহ নানা প্রকার বৃক্ষে পর্যাপ্ত ফল পাওয়া যায়। ঋষি কমল শুধুমাত্র দুটি রুটি, এক টুকরো ছানা আর দুটি কদলী আহার করেন। বাকি সবাই পেট পুরে আহার করেন রুটি, মাংস, ছানা এবং কদলী। আহার শেষে হাত-মুখ ধুয়ে কেউ সবুজ ঘাসের উপর আরাম করে উপবেশন করেন, কেউবা চিৎ হয়ে শয়ন করেন। এক ঝাঁক ধবল বকের ন্যায় মেঘপুঞ্জ ভেসে এসে এমনভাবে আচ্ছাদিত করে সবাইকে যে একজন আরেকজনের মুখমণ্ডল ঝাপসা দেখতে পান। অভিজ্ঞ ঋষি কমল বলেন, ‘এমন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে থাকার সুবিধে এই যে দূর থেকে কোনো বন্যপ্রাণি দেখতে পায় না, ফলে আক্রমণও করে না।’
এই অঞ্চলে ভাল্লুক আর চিতাবাঘের উপদ্রব আছে। প্রায়শই পথিকদের ওপর আক্রমণ করে তারা। বহু ঋষি স্বর্গে যাওয়া-আসার পথে ভাল্লুক এবং চিতাবাঘের ভক্ষণে পরিণত হয়েছেন।
কুথান উপবেশন কিংবা শয়ন কোনোটাই করেন না, ধীর পায়ে হাঁটতে থাকেন উত্তর-পূর্বের দিকে। মেঘপুঞ্জ থাকে না বেশিক্ষণ, বাতাসে ভেসে যায় পশ্চিমের দিকে, চারিদিক আবার পরিচ্ছ্ন্ন হয়ে ওঠায় দেখা যায় সূর্য পশ্চিমের পাহাড়ের মাথা ছুঁই ছুঁই করছে, অল্পক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে যাবে। অপরাহ্ণের সূর্যের রক্তিম আলোয় উত্তর-পূর্বের তুষারাবৃত কয়েকটি শ্বেত পর্বতের চূড়া দেখে মনে হয় যেন সুবর্ণ শিরোভূষণ পরিহিত! এই উপত্যকা আশ্চর্য সুন্দর, প্রাণভরে সৌন্ধর্য অবলোকন করতে ইচ্ছে করে কুথানের। কিছুটা দূরে চলে আসায় ঋষি কমল হাঁক ছাড়েন কুথানের উদ্দেশে, ‘পুত্র, একা একা বেশি দূরে যেও না, ভাল্লুক কিংবা চিতাবাঘ আক্রমণ করতে পারে!’
কুথান ঘাড় ফিরিয়ে বলেন, ‘না, বেশি দূরে যাব না, এখানেই আছি।
উপত্যকার এমন ঘন সবুজ সৌন্ধর্য দেখে কুথানের একা হতে ইচ্ছে করে, একা একা অপরাহ্ণের সূর্যের আলোয় ওই সুবর্ণরাঙা শ্বেত পর্বত দেখতে ইচ্ছে করে মৌন হয়ে, তাই তিনি হাঁটতে হাঁটতে সরে পড়েন। শ্বেত পর্বতের দিকে তাকিয়ে কুথান মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, সর্বোচ্চ চূড়ায় না হোক, কোনো একদিন তিনি ওই শ্বেত পর্বতশ্রেণির যে-কোনো একটিতে পা রাখবেন, সম্ভব হলে এবারই। সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই শ্বেত পর্বতশ্রেণির মাথার ওপর দিয়ে প্রেয়সীর কপালের চন্দনের ফোঁটার ন্যায় চাঁদ ওঠে। চাঁদের আলোয় শ্বেত পর্বত সুবর্ণ থেকে ক্রমশ রূপালি রূপ ধারণ করতে থাকে। কুথানের মনে হয় যেন তিনি ইহজগতে নেই, কোনো অপার্থিব জগতে এসে পড়েছেন!
সন্ধ্যার পর কাঠ সাজিয়ে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করে উপল, সারারাত্রিই অগ্নি জ্বালিয়ে পালা করে একজনকে জেগে পাহাড়া দিতে হবে যাতে বন্যপ্রাণি এসে আক্রমণ না করে। সকলে শীতের ভারী পোশাক অঙ্গে চাপিয়ে অগ্নির চারপাশে গোল হয়ে বসে গল্প করতে থাকেন, প্রথমে কুথানের মুখে পাতালের অনার্যদের নগর সম্পর্কে গল্প শোনে সবাই, তারপর ঋষি কমল তার গুরুদেবের শ্বেতপর্বত অভিযানকালের অলৌকিক ক্ষমতার গল্প শোনান, ‘আমার পরম শ্রদ্ধেয় গুরুদেবের নাম অম্বরীষ, তিনি হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়ায় উপবেশন করে ধ্যান করবেন বলে মনস্থির করেছিলেন, তাই একদিন তিনি চারজন শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন হিমালয় পর্বতের সর্বোচ্চ চূড়ার উদ্দেশ্যে। সারাদিন তুষারাবৃত পাহাড়ী পথ হেঁটে সন্ধ্যায় কোথাও শিবির ফেলে রাত্রিযাপন করতেন তারা। হাড় হিম করা ঠান্ডা। সাধনার ফলে আমার গুরুদেব শূন্যে ভাসতে জানতেন, রাত্রির অনেকটা সময় তিনি শূন্যে ভেসে থাকতেন, নিদ্রা দিতেন খুব অল্প সময়! দিন কয়েক পর একজন গুরুদেবের শিষ্য অসুস্থ হয়ে মারা যান, তুষার খুড়ে গর্ত করে তাকে সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু গুরুদেব দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। তার একটাই লক্ষ্য ছিল- হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় ধ্যান করে সিদ্ধি লাভ করা। পথে তারা কিছুদূর অন্তর অন্তর তুষারের মধ্যে বেশ কিছু মৃতদেহ দেখতে পান, একদা যারা হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন, কেউ তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে, কেউবা প্রচণ্ড ঠান্ডা সইতে না পেরে প্রাণ হারান। গুরুদেব অবশিষ্ট তিনজন শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু একে একে তার বাকি তিন শিষ্যও অসুস্থ হন এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শিষ্যদের তুষারে সমাহিত করে গুরুদেব একাই তার যাত্রা অব্যাহত রাখেন। একদিন গোধুলিবেলায় গুরুদেব শিবিরের মধ্যে শূন্যে ভেসে ধ্যান করছেন, এমন সময় শিবিরের বাইরে থেকে কেউ একজন তার নাম ধরে ডাকেন, তিনি শূন্যে ভেসে বাইরে এসে দেখেন- বিশালদেহী এক পুরুষ দণ্ডায়মান, উপরের দিকে মাথা উঁচু করে তার মুখমণ্ডল দেখতে হয়! বিশাল সেই পুরুষের শরীর রক্ত-মাংসের নয়, শুভ্র তুষারের! গুরুদেব ভয় পেয়ে যান, তার ভীতসন্ত্রস্ত মুখ দেখে সেই বিশালদেহী অতিমানব বলেন, “ওরে অবোধ, আমাকে ধরা যায় না, আমাকে ছোঁয়া যায় না, কেবল দূর থেকে আমাকে অবলোকন করা যায়! আমাকে ছোঁয়ার আশা যে করে, তার মৃত্যু অবধারিত। আমাকে ছোঁয়ার নেশায় এযাবৎ বহু সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তুই গৃহে ফিরে যা, নইলে তোরও মৃত্যু অবধারিত। যা, ফিরে যা।’’ তারপর সেই তুষারমানব ভেঙে ভেঙে ক্রমশ মিশে যায় তুষাররাশিতে, আর তুষারমানবের নির্দেশ মতো আমার গুরুদেবও পরদিন প্রত্যুষে ফেরার পথ ধরেন।’
ঋষি কমলের গল্প শুনে কুথান শ্বেত পর্বতশ্রেণির দিকে তাকিয়ে থাকেন, একের পর পর্বতের চূড়া, ওইসব চূড়ার আড়ালেই কোথাও আছে হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া। হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আজ পর্যন্ত কেউ ফিরে এসে বলতে পারেননি যে তিনি হিমালয় পর্বতশ্রেণির সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেছেন। যারা হাল না ছেড়ে দুঃসাহস দেখিয়ে সর্বোচ্চ চূড়ার সন্ধানে একের পর এক চূড়া অতিক্রম করে উপরে উঠেছেন, তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। হয়ত তারা আরো উঁচুতে উঠার পর তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে কিংবা অতিরিক্ত ঠান্ডায় মৃত্যুরবণ করেন। আর যারা ফিরে আসেন, তারা নানারকম গল্প বলেন লোকালয়ে ফিরে, বহু কথা ভেসে বেড়ায় বসতি থেকে বসতিতে; কত যে লৌকিক-অলৌকিক গল্পের বুনন হয় তার কী ঠিক আছে!
পর্বতের পর পর্বত ডিঙিয়ে, অনেক নদী আর ছড়া পেরিয়ে সম্ভব্য দিনের দুই দিন পরে ইন্দ্রপুত্রের বিবাহের আগের দিন মধ্যাহ্নের পূর্বেই স্বর্গের প্রবেশ দ্বারে পৌঁছান বেণ এবং তাঁর দল, পথে ঋষি কমল অসুস্থবোধ করায় এই বিলম্ব। স্বর্গের প্রবেশদ্বারের অতন্দ্র প্রহরী যমরাজের কয়েকজন সৈন্য বেণ এবং তাঁর দলের পথ রোধ করে সামনে দাঁড়ান। আগত অতিথি দলকে দেখে যমরাজের প্রশিক্ষিত কুকুরের দল ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে, সৈন্যরা কুকুরদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। কুকুরগুলো কিছুটা শান্ত হয়ে বেণ এবং তাঁর দলের সবার পা শুকতে থাকে।
একজন সৈন্য জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনাদের নিবাস কোথায়? কেন এসেছেন? কার কাছে এসেছেন?’
ঋষি কমল বেণকে দেখিয়ে বলেন, ‘ইনি ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি- বেণ, দেবপতি ইন্দ্র তার পুত্রের বিবাহ উৎসবে নৃপতিকে নিমন্ত্রণ করেছেন, তিনি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছেন। আর আমরা নৃপতির সহচর।’
আরেকজন সৈন্য বলেন, ‘রসিকতা করছ নাকি মিথ্যে বলে স্বর্গে ঢুকতে চাইছ! ওর বেশভূষা দেখে তো ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি বলে মনে হচ্ছে না! কোথাকার দৈত্যপুরী না দানবপুরী থেকে তোমরা এসেছ তাই বলো।’
ঋষি কমল বিরক্ত হন, ‘দেখ, আমরা পথশ্রান্ত, রসিকতা করার সময় আমাদের নেই। আর মিথ্যেও আমরা বলছি না। তোমরা যমরাজকে ডাকো।’
শেষ বাক্যটি বেশ জোরে ধমকের সঙ্গে বলেন তিনি। প্রথম সৈন্য ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে চুপ করার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘চুপ, গুরু নিদ্রায় আছেন, এখন তার নিদ্রা ভাঙালে তোমাদের মাথা গুঁড়িয়ে দেবেন!’
‘ডাকো যমরাজকে নইলে আমি চিৎকার শুরু করব, অভিসম্পত করব!’ উচ্চকণ্ঠে বলেন ঋষি কমল। তারপর বেণের দিকে তাকিয়ে আবার বলেন, ‘সবগুলো সোম পান করে মাতাল হয়ে আছে!’
দ্বিতীয় সৈন্য বলেন, ‘অ্যাই….ই, পবিত্র সোমরসের নামে কটু কথা বলবে না বলে দিচ্ছি।’
উত্তপ্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে বেণ তাঁর কাঁধের ঝোলা খুলে এক টুকরো চামড়া বের করেন, তাতে বজ্রের চিহ্ন অঙ্কন করা। ইন্দ্রের পক্ষ থেকে বহির্ষ্মতীতে গিয়ে চিহ্নসমৃদ্ধ চামড়ার এই টুকরোটি তাঁর হাতে দিয়ে বিবাহের নিমন্ত্রণ করেছিলেন একজন দেবদূত। বেণ চামড়ার টুকরোটি প্রথম সৈন্যের দিকে বাড়িয়ে দিলে তিনি সেটা হাতে নিয়ে দেখেন, সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চায়ি করেন। তারপর প্রথম সৈন্য পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেন। অল্প দূরে একটা বড় পাথরের ওপাশে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা দীর্ঘদেহী যমরাজের কাছে গিয়ে দাঁড়ান। যমরাজ সোমরসের প্রভাবে নিদ্রায় অচেতন, অর্ধনিমীলিত তার দু-চোখ। মাথাভর্তি সোনালি আভাযুক্ত কালো কেশ আর মুখে একই বর্ণের লম্বা দাড়ি আর পুরু গোঁফ। কপালে রক্তচন্দনের বড় ফোঁটা। গলায় রুদ্রাক্ষ এবং নানারকম ফলের ডজনখানেক মালা, বাহুতে রুদ্রাক্ষের আর কব্জিতে রুদ্রাক্ষ ও বিভিন্ন ফলের মালা, পায়ে চামড়ার পাদুকা। পাগড়িটা পাশে পড়ে আছে। নিদ্রাকালে কখনোই তার চক্ষু সম্পূর্ণ নিমীলিত হয় না। শোনা যায় তিনি দিবারাত্রির যতক্ষণ জেগে থাকেন সোমরসের ঘোরে অতিবাহিত হয় তার সময়, চক্ষু থাকে রক্তিম বর্ণ। দেবপতি ইন্দ্রের নির্দেশ দেওয়া না থাকলে বাইরের কাউকে স্বর্গে প্রবেশ করতে দেন না তিনি বা তার অনুগত সৈন্যরা।
সৈন্য যমরাজের উদ্দেশে বলেন, ‘গরুদেব, গুরুদেব….।’
কয়েকবার ডাকার পর যমরাজ অর্ধনিমীলিত চোখেই বলেন, ‘বলে যা উল্লুক কোথাকার, আমি কানে কালা নাকি!’
‘ব্রহ্মাবর্ত থেকে মানুষ এসেছেন।’
‘কে এসেছেন? কেন এসেছেন?’
‘বলছেন তো ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি, সঙ্গে আরো কয়েকজন। দেবপতির প্রতীক আছে তাদের কাছে।’
ব্রহ্মাবর্তের নৃপতির কথা শুনে তিনি চোখ বড় করে তাকিয়ে ধমক দেন, ‘যা, সরে যা সামনে থেকে, নির্বোধ, আগে ডাকবিনে আমায়!’
সোমরসের নেশায় রক্তচক্ষু যমরাজ ধড়মর করে উঠে বসেন, কিছুটা টাল খাওয়া পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করেন প্রবেশদ্বারের দিকে। কাছে গিয়ে হাত জোড় করে বলেন, ‘নমস্কার নৃপতি, দেবলোকে আপনাকে স্বাগতম।’
বেণ প্রতি নমস্কার করলে যমরাজ বলেন, ‘যাত্রাপথে আপনাদের কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’
‘না, অসুবিধা তেমন কিছু নয়।’
‘আসুন আমার সঙ্গে, আপনাদের ইন্দ্রলোকে পৌঁছে দিচ্ছি।’
যমরাজ আগে আগে হাঁটতে শুরু করলে তার পিছু নেন বেণ এবং বাকিরা।
অপরাহ্ণে নিদ্রাভঙ্গ হয় বেণের। ভীষণ ক্লান্ত ছিলেন, ইন্দ্রলোকে পৌঁছনোর পর দেবপতি ইন্দ্রের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ সারেন, দেবপতি তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন তার গুহার অদূরে তিনটি ছোট গৃহে। স্নানাহার করে একটি গৃহের শয্যায় শয়ন করেন বেণ এবং কুথান। নিদ্রাভঙ্গ হওয়ায় কুথান শয্যা ত্যাগ করে বাইরে গেছেন। অনেকটা সময় নিন্দ্রা দেবার পর বেশ সতেজ অনুভব করেন কুথান। উঠে গৃহের বাইরে গিয়ে জলের পাত্র থেকে জল নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে উত্তরীয় দিয়ে জল মোছেন। তারপর ইন্দ্রের গুহার দিকে পা বাড়ান। গুহার বাইরে পাথরের ওপর উপবেশন করে গল্পে মত্ত ইন্দ্র, কুথান, ঋষি কমল এবং দেববৈদ্য অশ্বিনীকুমার দ্বয়। অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের চিকিৎসার খ্যাতি কেবল স্বর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; ব্রহ্মাবর্ত, অতল, বিতলসহ নানা স্থানে পৌঁছে গেছে। ঋষি কমলের শরীর এখনো পুরোপুরি ভালো হয়নি, অশ্বিনীকুমার দ্বয় তাকে দেখে সেবনের জন্য কিছু ঔষুধ দিয়েছেন।
বেণকে দেখে ইন্দ্র বলেন, ‘আসুন নৃপতি, উপবেশন করুন।’
অশ্বিনীকুমার দ্বয় উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলে বেণ প্রতি নমস্কার করেন। ইন্দ্র নৃপতির সঙ্গে অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের পরিচয় করিয়ে দিলে বেণ বলেন, ‘আপনাদের কথা অনেক শুনেছি। দিকে দিকে আপনাদের চিকিৎসার খ্যাতি শুনি শুধু, আজ সাক্ষাৎ পেয়ে ধন্য হলাম।’
অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের বড়জন বলেন, ‘যাঁর বীরত্ব আর সুশাসনের কথা এতদিন শুধু কানে শুনেছি, আজ আমাদের মাঝে তাঁকে পেয়ে আমরাও আনন্দিত!’
বেণ দুজনের সঙ্গে আলিঙ্গন করার পর পাথরের ওপর উপবেশন করেন। তাঁর নিকট থেকে ব্রহ্মাবর্তের খোঁজ-খবর নেন ইন্দ্র এবং অশ্বিনীকুমার দ্বয়। একজন কিশোরী বৈকালিক আহার নিয়ে আসে, ফল এবং ছানা। গল্প করতে করতে আহার করেন সকলে। আহার শেষে কুথান বলেন, ‘দেবপতি, স্বর্গের প্রাকৃতিক সৌন্ধর্য সত্যিই অপূর্ব! আমি মুগ্ধ হয়েছি।’
ইন্দ্র হেসে বলেন, ‘ব্রহ্মাবর্ত থেকে ঋষিগণ এলেও তাই বলেন।’
‘আমি এখন আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে চাই।’ তারপর বেণের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘সখা, তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ যাব। সূর্য ডুবতে এখনো বেশ দেরি আছে।’
ইন্দ্র বলেন, ‘বেশ, আপনারা তাহলে ভ্রমণ করে আসুন। রাত্রে নৃত্যগীতের আসরে দেখা হবে।’
বেণ আর কুথান ইন্দ্র এবং অশ্বিনীকুমার দ্বয়ের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে উত্তর-পশ্চিমদিকে হাঁটতে থাকেন। কিছুদূর অন্তর অন্তর পাথর গেঁথে তৈরি গৃহ, চালায় ছন, কোনো কোনো গৃহের সামনে নারী-পুরুষ সংসারের কর্মে ব্যস্ত, বাচ্চারা সব হইচই আর খেলাধুলায় মত্ত। কোথাওবা বসবাসের গুহার সামনে রোদ্রে পিঠ ঠেকিয়ে গাল-গল্পে নিবিষ্ট নারী-পুরুষ। দুজন অপরিচিত মানুষকে দেখে তাদের কেউ কেউ তাকায়, কেউ কেউ নিবাস জিজ্ঞেস করলে বেণ কিংবা কুথান উত্তর দেন। এখান থেকে শ্বেত পর্বতশ্রেণি খুব নিকটে, কুথান একদিন শ্বেত পর্বতে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করলে বেণও যাবেন বলে জানান। সবুজ উপত্যকা থেকে নেমে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে দুজন পৌঁছান স্বর্গের নদী অলকানন্দার পারে। স্বর্গের পানীয় জলের প্রধান উৎস অলকানন্দা নদী, যদিও প্রচুর ঝরনা আর ঝিরি রয়েছে এখানে, সরোবরও আছে বেশ কিছু। তবে অলকানন্দাকে কেন্দ্র করেই ব্রহ্মা একদিন এখানে বসতি গড়ে তোলেন। তারপর জনসংখ্যা যত বেড়েছে তত বিস্তৃত হয়েছে স্বর্গের পরিধি।
কুথান জলের কাছে গিয়ে বসে দু-হাতের আঁজলায় জল তুলে নিয়ে পান করেন, পারে দাঁড়িয়ে অলকানন্দার স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকেন বেণ। জল পান শেষে কুথান পরনের পরিচ্ছদে হাত মুছে বলেন, ‘বুঝলে সখা, মানুষ কেবল আমার বাইরেটা দেখতে পায়, ভেতরটা দেখতে পায় না। আমি যে দেবতাদের অনেক কাজের সমালোচনা করি, শাস্ত্রীয় বিধান আর যজ্ঞের বিরুদ্ধে কথা বলি, অন্ধভাবে দেবতাদের সকল নির্দেশ মেনে না নেবার কথা বলি; মানুষ কেবল সেটাই দেখে, আর ব্রাহ্মণরা এবং ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় কিছু মানুষ আমাকে ঘৃণা করে। কিন্তু ওরা যা দেখতে পায় না তা হলো-স্বর্গকে আমিও ভালোবাসি, স্বর্গ নিয়ে আমারও আবেগ আছে। এই স্বর্গভূমিতেই প্রোথিত আমার শিকড়, এই ভূমিতে আমার পূর্বপুরুষের পদচারণা ছিল। সুখে-দুঃখে, হাসি-আনন্দে এই ভূমিতেই নিঃশ্বেষ হয়েছে তাদের জীবন। বিশ্বাস করো সখা, স্বর্গভূমিতে পা দিয়ে, স্বর্গের বাতাস অঙ্গে মেখে আমার মনে হচ্ছে যেন, আমি আমার পূর্বপুরুষের শরীরের গন্ধ-স্পর্শ পাচ্ছি! এই যে আমি অলকানন্দার জল স্পর্শ করলাম, পান করলাম, মনে হলো আমার পূর্বপুরুষেরা আমার তৃষ্ণা মিটালেন। এখানে আসার পর আমার যে কী অনুভূতি হচ্ছে তা আমি তোমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না।’
চোখ ছলছল করে ওঠে কুথানের, বেণ কুথানের কাঁধে হাত রাখেন, ‘সখা, আমি তোমাকে বুঝি, অন্তত বোঝার চেষ্টা করি। তুমি গল্পকথক, একজন শিল্পী, অন্য পাঁচজন মানুষের চেয়ে তুমি পৃথক, তুমি যেভাবে ভাবো, সবাই সেভাবে ভাবতে পারে না, তাই সবাই তোমাকে বুঝতেও পারে না। কিন্তু ব্রহ্মাবর্তের একজন মানুষও যদি শেষ পর্যন্ত তোমার পাশে থাকে, জেনে রেখো সে- বেণ।’
‘তা আমি জানি সখা, তুমি আমার সখা বলেই অনেকে আমাকে ঘাঁটাতে সাহস করে না।’
‘তোমার মতাদর্শের প্রতি আমি সর্বদাই শ্রদ্ধাশীল, তোমার মতাদর্শ আমাকে ভাবায়।’
‘সখা, স্বর্গ আমাদের ব্রহ্মাবর্তবাসীর কাছে আবেগের স্থান, কিন্তু তার মানে এই নয় যে দেবগণ আমাদেরকে চিরকাল শাসন-শোষণ করবেন।’
‘দেবগণের শাসন-শোষণের বন্ধনে থাকতে আমারও ভালো লাগে না, শাস্ত্রীয় অনেক বিধানের সঙ্গে আমিও একমত হতে পারি না। কিন্তু আমি নৃপতি, আমার হাত-পা বাঁধা, তাই তুমি যেভাবে প্রতিবাদ করতে পারো, যে ভাষায় কথা বলতে পারো, আমি সব বুঝেও সেভাবে প্রতিবাদ করতে বা কথা বলতে পারি না। আমি এখন বিদ্রোহী হয়ে কোনো আইনের পরিবর্তন করতে চাইলে, নৃপতি হিসেবে টিকে থাকতে পারব না।’
‘তুমি শক্তি সঞ্চয় করো সখা, নইলে ব্রাহ্মণ আর মনুবাদী ঋষিরা তোমাকে অসহায় মোষ বানিয়ে সিংহের পরাক্রমে তোমার ঘাড়ে চেপে থাকবে!’
‘আমাকে একটু সময় দাও সখা। একদিন আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবোই।’
‘তুমি পারবে সখা, তোমার ওপর তোমার ওপর আমার সেই বিশ্বাস আছে। চলো সামনে এগোই।’ বলেন কুথান।
দুজনে কথা বলতে বলতে অলকানন্দার পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছান সুন্দর এক উদ্যানের কাছে, উদ্যান থেকে দুজন তরুণকে বের হতে দেখে কুথান তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এই উদ্যানের নাম কী, এটাই কি নন্দনকানন?’
একজন তরুণ উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, এটাই নন্দনকানন।’
তরুণ দুজন চলে গেলে বেণ আর কুথান নন্দনকাননে প্রবেশ করেন। বিচিত্র বর্ণের অজস্র পুষ্প আর নানা প্রকার ফলের বৃক্ষে শোভিত বিশাল উদ্যন। বৃক্ষশাখায় বিচিত্র সব পাখির কলকাকলি। একটি বৃক্ষে রক্তিমবর্ণের লম্বা পাপড়ীসমৃদ্ধ পুষ্প দেখে কুথান থমকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকেন।
বেণও দাঁড়িয়ে পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘অপূর্ব দেখতে এই পুষ্প!’
কুথান বলেন, ‘আমার বোধ হচ্ছে এটাই স্বর্গের বিখ্যাত পারিজাত পুষ্প।’
‘হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।’ আশপাশে তাকান বেণ, তারপর আবার বলেন, ‘কেউ থাকলে জিজ্ঞেস করা যেত।’
‘আমার মন বলছে, এটাই পারিজাত পুষ্প।’
‘একটা তুলে নেবে? কাউকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করা যাবে।’
‘অকারণে পুষ্প ছেঁড়া অনুচিত সখা। এখানে তেমন কেউ নেই যে উপহার দেওয়া যাবে।’
‘থাকবে না কেন, তুমি সরো আমি একটা তুলে নিই, রাত্রে ধরিত্রীর সবচেয়ে সুন্দর ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখবো।’
কুথান হাসেন, ‘সুরোত্তমার খোঁপায় নিশ্চয়!’
বেণও হেসে বলেন, ‘তুমি ছাড়া আমার মনের কথা এমনভাবে আর কে বুঝতে পারে সখা! সত্যি বলছি তোমায়, স্বর্গে আসবার পর থেকে সুরোত্তমাকে দেখার জন্য মনটা চঞ্চল হয়ে আছে। আজ রাত্রেই আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে করব।’
সন্ধ্যার পর থেকেই দেবপতি ইন্দ্রের গুহায় দেব-দেবী, অপ্সরা এবং গান্ধর্বদের আগমন ঘটতে থাকে। গুহার ভেতর-বাহির মশাল এবং প্রদীপের আলোয় আলোকিত। আগামীকাল ইন্দ্রপুত্রের বিবাহ, উৎসব শুরু হয়েছে গতকাল থেকেই, চলবে আরো কয়েকদিন। গুহার বাইরে পাথরের ওপর উপবেশন করে গল্প করতে থাকেন বেণ, কুথান, অশ্বিনীকুমার দ্বয় এবং অন্য কয়েকজন দেব-দেবী। নতুন বিশিষ্ট কোনো দেব-দেবী এলেই বেণ ও কুথানের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেন অশ্বিনীকুমার দ্বয়, কুশল বিনিময় শেষে দেব-দেবীরা প্রবেশ করেন গুহায়। বেণ উশখুশ করতে থাকেন সুরোত্তমার জন্য, কতো নারী এলেন কিন্তু তাদের মধ্যে সুরোত্তমা নেই, আবার মুখ ফুটে তিনি কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারেন না লজ্জায়। উত্তরীয়ের আড়ালে নন্দনকানন থেকে তুলে আনা পুষ্পটিকে এখনো যথাসম্ভব অক্ষত রেখেছেন। কিছুক্ষণ পরই নৃত্য-গীতের উৎসব শুরু হবে, তাঁকে যেতে হবে ইন্দ্রের গুহায়, তার পূর্বে পুষ্পটি তাঁর থাকবার গৃহে রেখে আসতে পারলে ভালো হয়।
বেণ সকলের উদ্দেশে বলেন, ‘আর কিছুক্ষণ পরই নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান শুরু হবে, আমি একটু গৃহ থেকে আসছি।’
কুথান বলেন, ‘চলো, আমিও যাব, বড্ড শীত লাগছে, আরো কিছু পোশাক পরিধান করে আসি।’
দেব-দেবীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজন গৃহের দিকে পা বাড়ান। পূর্বদিকের শ্বেত পর্বতের মাথায় ওপরে উঠে গেছে চাঁদ, চাঁদের আলোয় এমন আশ্চর্য সুন্দর দেখায় শ্বেপর্বত, যেনবা সুক্ষ্ম রূপালী পরিচ্ছদে আবৃত!
শ্বেতপর্বতের দিকে তাকিয়ে কুথান বলেন, ‘দেখ, পর্বতগুলোকে কী দারুণ দেখাচ্ছে! স্বর্গের রূপ যতটুকু আমি দেখেছি, তাতেই আমি মুগ্ধ!’
‘সত্যিই স্বর্গের তুলনা হয় না! আর এই জন্যই তো দৈত্য-দানবদের সঙ্গে দেবতাদের এত যুদ্ধ হয়, কেউ-ই স্বর্গের অধিকার ছাড়তে চায় না।’
‘ঠিকই বলেছ তুমি।’ একমত হন কুথান।
হঠাৎ সামনে থেকে হেঁটে আসা কল্পককে দেখে উচ্ছ্বাসে তাকে জড়িয়ে ধরেন কুথান, বেণও আলিঙ্গন করেন। কুশল বিনিময়ের পর বেণ নিজের ভেতরে এতক্ষণ আটকে রাখা কথাটা বলেই ফেলেন, ‘কল্পক, আমি সুরোত্তমার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
কল্পক বেণের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কোনো কথা বলেন না। বেণ আবার বলেন, ‘সে কি আমার আসবার সংবাদ পায়নি? দেখা করতে এলো না যে? সে না আসুক, আমি নিজেই যাব তার কাছে, আপনি আজই আমায় তার কাছে নিয়ে যাবেন কল্পক। এই দেখুন, আমি তার জন্য নন্দনকানন থেকে পুষ্প তুলে এনেছি।’
বেণ হাতের পুষ্প দেখান কল্পককে, সখার পাগলামী দেখে ঠোঁট টিপে হাসেন কুথান।
কল্পক গম্ভীর মুখে বলেন, ‘তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয় নৃপতি।’
‘কেন সম্ভব নয়? তার কি বিবাহ হয়ে গেছে?’ বেণের কণ্ঠে অস্থিরতা।
‘না নৃপতি, বিবাহ তার হয়নি। তার রক্তকাশি হয়েছিল, গত বৎসর শীতকালে সে এই ধরিত্রী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে।’
বেণের বুকের ভেতর যেন হঠাৎ বাউকুড়ানি মোচর দিয়ে ওঠে, মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না! আর শ্বেত পর্বতের মাথার উপরে থাকা সুরোত্তমার প্রিয় চাঁদের দিকে তাকিয়ে কুথানের মনে পড়ে সেই সন্ধ্যার কথা, সুরোত্তমার স্বপ্নের কথা! কোনো দোষ না করেও নিজেকে অপরাধী মনে হয় কুথানের!
(চলবে....)
©somewhere in net ltd.