নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- উনত্রিশ)

১৪ ই নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৫:২২

বাইশ

নৃপতি বেণের বাটীর সীমানা প্রাচীরের বাইরে মানুষের ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে, বহির্ষ্মতী তো বটেই, বহির্ষ্মতীর দু-চার ক্রোশের মধ্যে থাকা ব্রহ্মাবর্তের অন্যান্য বসতি থেকেও কৌতুহলী মানুষ আসে। বহির্ষ্মতীতে ঘোষণার পূর্বেই বেণের নির্দেশে তিনজন ঘোষক ব্রহ্মাবর্তের অন্যান্য বসতিতে ঘোষণা করেন যে আজ অপরাহ্ণে নৃপতি বেণ ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। ঘোষণা শুনেই পঙ্গপালের ন্যায় ছুটে আসতে থাকে মানুষ। ঘোষকদের পাঠানোর পূর্বেই বেণ এবং কুথান কয়েকজন দূত পাঠান তাদের ঘনিষ্ট কিছু আর্যগোত্রের গোত্রপতি ও অনার্য গোষ্ঠীর সর্দারের নিকট, যেন তারা সংবাদ পাওয়ামাত্র অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্যসহ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে বহির্ষ্মতীতে আসেন। বেণ এই ব্যবস্থা নেন এই জন্য যে তাৎক্ষণিক ব্রাহ্মণগণ এবং তাদের অনুগত ক্ষত্রিয়রা বিদ্রোহ করলে যাতে দমন করতে পারেন। বেণের অনুগত মানব এবং অনার্য বীরগণ বর্শা ও তীরধনুক হাতে সদরদ্বার এবং প্রাচীরের চারিদিকে দাঁড়িয়ে থাকে, যাতে বাটীর ভেতরে কোনো মানুষ প্রবেশ করতে না পারে। মনু ব্যতিত আর কাউকেই বাটীর ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, এমনকি প্রধান পুরোহিত উদয়গিরিকেও নয়। সভাগৃহের কেদারায় গম্ভীর মুখে আসনে উপবিষ্ট মনু। প্রধান পুরোহিতসহ অন্যান্য দ্বিজগণ ও ঋষিগণ অগ্নিচোখে প্রাচীরের বাইরের ভিড়ে দাঁড়িয়ে, একদিন পূর্বেও যা কল্পনা করা যেত না! তাদেরকে ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় তারা অপমানিত বোধ করে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার শুরু করলে, নৃপতি বেণের নাম ধরে তাঁকে বাইরে এসে ঘোষকের বার্তা সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানানোর কথা বললে, আর দ্বিজগণকে অপমান করলে অচিরেই যে বেণ ধ্বংস হবেন সেই বিষয়ে বারংবার সতর্ক করতে থাকলে কুথান বেণের গৃহ থেকে বাইরে এসে একটি পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘দ্বিজগণ আপনারা শান্ত হোন, উত্তেজিত হবেন না। বেণ প্রস্তত হচ্ছেন, তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে এসে আপনাদের কৌতুহল নিবারণ করবেন। আপনারা চিৎকার না করে শান্ত হয়ে থাকুন।’

কুথানের কথা শোনার পরও দ্বিজগণ শান্ত হচ্ছিলেন না, বরং কুথানের প্রতি কটুবাক্য ও অভিশাপ বর্ষণ করছিলেন, তখন পূর্ব-নির্দেশনা অনুযায়ী বেণের অনুগত আর্য ও অনার্য যোদ্ধারা লাঠি উঁচিয়ে ভয় দেখিয়ে সবাইকে শান্ত করেন! ব্রাহ্মণগণ-ঋষিগণ ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে আর অব্রাহ্মণরা গভীর কৌতুহলে অপেক্ষা করতে থাকে ঘোষকের বার্তা সম্পর্কে বেণের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। আগতদের মধ্যে নানা কথার ধূমজাল তৈরি হতে থাকে।

বেণ ও কুথান পূর্বেই ধারণা করেন যে, স্বর্গের অধীনতা থেকে ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং দেবগণ ও ব্রাহ্মণগণের বশ্যতা অস্বীকার করে তারা যেমনি বিদ্রোহ করবেন; তেমনি ব্রাহ্মণরাও সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে, কিছু মানুষকে হয়ত তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে বিদ্রোহ উস্কে দিতে চাইবে। তাই তাৎক্ষণিক ব্রাহ্মণ এবং ঋষিদের যে প্রতিক্রিয়া হবে তা দমন করার জন্যই ভোরবেলায় বেণের অনুগত মানব বীরদের বাটীতে ডেকে তাদেরকে নির্দেশ দেন যে- কোনো পরিস্থিতিতেই যেন বাটীর ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে না পারে। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন কিছু অনার্য যোদ্ধা। এছাড়াও রাক্ষস, পণি এবং নিষাদ যোদ্ধাদের একটি অংশকে বহির্ষ্মতীর নিকটবর্তী অরণ্যে এসে লুকিয়ে থাকার নির্দেশ দেন, যাতে প্রয়োজন হলে তারা বেণকে সাহায্যের জন্য ছুটে আসতে পারে। দূত ফিরে এসে জানান অনার্য যোদ্ধারা অদূরের অরণ্যে প্রস্তুত আছে, সংবাদ পাঠালেই তারা ছুটে আসবে।

মানুষের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বাইরে আসেন বেণ; অঙ্গে অনার্যদের বুনন করা হলুদ রঙের নতুন নিবি, পরনে একই রঙের বাস, মাথায় বন মোরগের পালক লাগানো মাখন রঙের শিরোভূষণ, পায়ে চামড়ার পাদুকা আর ডানহাতে একখানা বর্শা। তাঁকে দেখেই প্রধান পুরোহিত উদয়গিরি উচ্চস্বরে বলেন, ‘এসব কী শুনছি বেণ, তুমি নাকি ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছ; দেবগণ, দ্বিজগণ এবং ঋষিগণকে আর মান্য করবে না? যজ্ঞ নিষিদ্ধ করেছ?’

বেণ বামহাত তুলে তাকে শান্ত হবার ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আপনি এখনই উত্তেজিত হবেন না বিপ্র, আমি কথা বলব, আমার কথা শুনবার জন্যই আজ আপনাদেরকে এখানে আসার আহ্বান জানিয়েছি।’

বেণ এগিয়ে গিয়ে পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে হাতের বর্শাটি ভূমিতে গেঁথে রাখেন, তাঁর বামদিকে সামান্য পিছনে দাঁড়ান কুথান। বেণ সামনে, ডানে, বামে তাকিয়ে আগত মানুষদের মুখের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করেন। নানা বয়সের ব্রাহ্মণ এবং ঋষি একেবারে সামনের দিকে প্রাচীরের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন, তাদের সামনে বর্শা হাতে দাঁড়ানো বেণের অনুগত সৈন্যগণ। এছাড়া নানা বয়সের বিপুল সংখ্যক ক্ষত্রিয় নারী-পুরুষ আছে। আছে রাক্ষস, নিষাদ আর পণিরাও; তারা একেবারে বামদিকে এবং প্রাচীর থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়ানো।

বেণ রাক্ষস, নিষাদ ও পণিদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আপনারা আরো এগিয়ে আসুন, সামনের শূন্যস্থান পূরণ করে প্রাচীরের কাছে এসে দাঁড়ান।’

অনার্যরা সাহস পায় না, তারা দাঁড়িয়েই থাকে, অবাক চোখে বেণের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেণ আবার বলেন, ‘আমি ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি বেণ আদেশ করছি, আপনারা আরো এগিয়ে এসে শূন্যস্থান পূরণ করে দাঁড়ান।’

এবার তারা বারবার আগত ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়দের দিকে তাকায়, কিন্তু নৃপতির আদেশ হয়েছে, তাই তারা অমান্য করতে পারে না, এগিয়ে গিয়ে শূন্যস্থান ভরাট করে প্রাচীরের কাছে এসে দাঁড়ায়। আগত মানুষের জটলার মধ্যে কোথাও কোথাও গুঞ্জন ওঠে, বেণ ডান হাত উঁচু করে সবাইকে চুপ করবার ইঙ্গিত দেন, তারপর বলতে শুরু করেন- ‘ব্রহ্মাবর্তের নৃপতি হিসেবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলবার জন্যই আমি এখন আপনাদের সামনে এই স্থানে দাঁড়িয়েছি। আমার কথা শুনে আপনারা অনেকেই পুলকিত হবেন এবং নিশ্চিতভাবেই কেউ কেউ বিক্ষুব্ধ হবেন। তবে আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি আপনারা আমার কথার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। এমনকি আমার কথা শেষ হবার পরেও নয়।’

কয়েক নিমেষের জন্য থামেন বেণ, সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণদের দিকে তাকিয়ে তাদের মুখের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করেন, তারপর আবার বলতে শুরু করেন- ‘আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে মহাপ্লাবন আমাদের কতটা ক্ষতি করেছে, সমগ্র ব্রহ্মাবর্তকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল মহাপ্লাবন। হড়পা বানে বিপুল সংখ্যক মানুষ আর গবাদীপশু ভেসে যায়, চাষের ভূমি নষ্ট হয়। সেই দুঃসময়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে মানবদেরকে রক্ষা করেছিলেন মান্যবর মনু, তাকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।’

সভাগৃহে উপবিষ্ট মনুর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তার উদ্দেশে করজোড়ে প্রণাম করেন বেণ, উপস্থিত প্রায় সকলেই একইভাবে প্রণাম করেন।
বেণ আবার বলতে শুরু করেন, ‘এত বৎসরেও সেই ক্ষতি পূরণ হয়নি, আগামী শত বৎসরেও পূরণ হবে না। মহাপ্লাবনে ব্রহ্মাবর্তের অর্ধেকের বেশি মানুষের মৃত্যু হওয়ায় আমরা এখনও জনসংকটে ভুগছি। মহাপ্লাবনের পর ব্রহ্মাবর্তে এমন একজন মানুষও ছিল না যিনি তার স্বজনকে হারাননি। কোনো কোনো পরিবার, কোনো কোনো বংশ চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ধরিত্রীর বুক থেকে। সেই বিয়োগব্যথা এখনও হৃদয়ে বহন করে চলেছি আমরা। তার ওপর বারবার স্বর্গ থেকে দেবপতি ইন্দ্রের নির্দেশ আসে অনার্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদেরকে বসতি থেকে উৎখাত করার, যুদ্ধ হলেই প্রাণ ক্ষয় হয়, জনবল আরো কমে যায়। আজ থেকে আমরা আর কোনো জাতিকে আক্রমণ করব না, আমাদের ওপর আক্রমণ হলে শুধু প্রতিরোধ করব।

আপনারা আমাকে যে কর প্রদান করেন তাঁর অর্ধেক দেবপতি ইন্দ্রকে দিতে হয়; বাকি অর্ধেক বৎসরব্যাপী যজ্ঞে ব্যয় হয়, ব্রাহ্মণগণ এবং ঋষিগণ ছাড়াও সেখান থেকে দেবগণও হব্যি পান। কিন্তু আর নয়; আমাদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে পালিত পশু, পশুর মাংস ও চামড়া এবং উৎপাদিত যব ও অন্যান্য ফসলের ভাগ আর কখনো স্বর্গে যাবে না। আজ থেকে আমরা দেবপতিকে কর প্রদান করব না। আপনারা পূর্বে যে কর প্রদান করতেন, আজকের পরে তার চার ভাগের এক ভাগ কর আমাকে প্রদান করবেন। সেই কর ব্যয় করা হবে অতিথি সেবায়, অশ্বদৌড় ও তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতার সময়, বিভিন্ন উৎসবে এবং ব্রহ্মাবর্তের বীরদের জন্য।

আজ থেকে ব্রহ্মাবর্ত আর স্বর্গের অধীন নয়, দেবপতি ইন্দ্রের আজ্ঞা মান্য করতে আমি বাধ্য নই, নৃপতি হিসেবে আজ আমি ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি, আজ থেকে আমি ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীন নৃপতি আর আপনারা স্বাধীন অধিবাসী।’

আগত অধিকাংশ ক্ষত্রিয় উল্লাস করে ওঠে, তাদের দেখাদেখি অনার্যরাও। বেণ দু-হাত উঁচিয়ে তাদের শান্ত হবার ইঙ্গিত করে আবার বলতে শুরু করেন, ‘আজ থেকে ব্রহ্মাবর্তে আর কোনো যজ্ঞ করা হবে না, যজ্ঞ অনর্থক, যজ্ঞে কোনো ফল পাওয়া যায় না। যজ্ঞ থেকে ব্রাহ্মণ এবং দেবগণ লাভবান হন, তাই তারা যজ্ঞকে মঙ্গলজনক আখ্যা দিয়ে আমাদের ঘাড়ে যজ্ঞের বোঝা চাপিয়ে রেখেছেন। অরণ্যে যাতে দাবানল না হয় সে-জন্য আমরা যজ্ঞ করেছি। দাবানল কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি। পঙ্গপাল যাতে ক্ষেতের ফসলে হানা না দেয় তার জন্য আমরা যজ্ঞ করেছি। পঙ্গপালের হানা কি বন্ধ হয়েছে? হয়নি। সময় মতো বৃষ্টির জন্য কারীরী ইষ্টি যজ্ঞ করেছি। সর্বদা সময় মতো বৃষ্টি কি হয়েছে? হয়নি। সময়ে-অসময়ে ব্রাহ্মণদের পরামর্শে আমরা যজ্ঞ করেছি ব্যধি-জরা-অকালমৃত্যু যাতে না হয়, কিন্তু যজ্ঞ করে কিছুই রোধ করা যায়নি। আসলে এসব প্রতিরোধের ক্ষমতা কোনো অলৌকিক পরমপুরুষ কিংবা দেবতাদের হাতে নেই। মাঝখান থেকে আমাদের কষ্টার্জিত সম্পদ দিয়ে আমরা যজ্ঞ করেছি আর লাভবান হয়েছে ব্রাহ্মণ এবং দেবগণ। আজ থেকে সেই রীতির অবসান হলো।
আমাদের ব্রহ্মাবর্তে অনেকেই আছেন যারা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী, পরলোকে অবিশ্বাসী এবং বেদে অবিশ্বাসী বিধায় নাস্তিক বলে গণ্য হন। ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণদের দ্বারা প্রভাবিত সমাজের মানুষ তাদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখে, ঘৃণা করে। অনেক ঋষিও আছেন, যারা নাস্তিক, তারা গভীর জ্ঞানের অধিকারী এবং যুক্তি দিয়ে কথা বলেন। আজ থেকে তারা আর অবজ্ঞার শিকার হবেন না, যোগ্য সম্মান পাবেন। আমি নিজেও বিশ্বাস করি, আমাদের এই সুন্দর ধরিত্রী কোনো পরমপুরুষ সৃষ্টি করেননি, আপনা-আপনি-ই সৃষ্টি হয়েছে। ধরিত্রী ছিল, আছে এবং থাকবে। ধরিত্রীতে প্রাণের জন্ম হবে, মৃত্যু হবে; কিন্তু ধরিত্রী অনন্তকাল রয়ে যাবে।

আজ থেকে ব্রহ্মাবর্তের সমাজে কোনো বৈষম্য থাকবে না; ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় কিংবা আর্য-অনার্য ভেদাভেদ থাকবে না। সকল-জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এক আইন এবং অপরাধের একই দণ্ড কার্যকর করা হবে। আর কোনো অনার্য জাতিকে ব্রাহ্মাবর্ত থেকে উৎখাত করা হবে না। ব্রহ্মাবর্ত সকল জাতির এবং সকল মানুষের, এখানে সবার সমান অধিকার থাকবে। কোনো জাতি কিংবা কোনো মানুষ যদি অন্য কোনো জাতি বা মানুষকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে তবে সেই জাতি বা মানুষকে কঠোর দণ্ড ভোগ করতে হবে। এতদিন কিছু কিছু উশৃঙ্খল মানুষকে শাস্ত্র রক্ষা করেছে, আর এই শাস্ত্রীয় কবচের বদৌলতে তারা দিনকে দিন আরো উশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে, একের পর এক অন্যায় করেছে, কিন্তু কোনো দণ্ড ভোগ করতে হয়নি। আমি তাদের উদ্দেশে বলছি, আপনারা আপনাদের আচরণ শুধরে নেবেন, অন্যথায় কঠোর দণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।

পুরাকালে প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য ছিল না, কিন্তু এখন সমাজে অনেক ধরনের বৈষম্য প্রচলিত। কোনো ব্রাহ্মণ যদি কোনো অনার্য নারীকে বিবাহ করে তবে তিনি পতিত হলেও তাকে কোনো দণ্ড পেতে হয় না, কিন্তু কোনো অনার্য পুরুষ যদি কোনো ব্রাহ্মণ নারীকে ভালোবাসে তবে তাকে দণ্ড পেতে হয়। কোনো পুরুষ পুরুষকে ভালোবাসলে দণ্ড পেতে হয়, কোনো নারী নারীকে ভালোবাসলে দণ্ড পেতে হয়। আজ থেকে প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য এবং বাধা থাকবে না। দুজন মানুষ যদি স্বেচ্ছায় একে অন্যকে ভালোবাসে, হোক তারা ভিন্ন জাতের- একজন ব্রাহ্মণ এবং অপরজন নিষাদ; তাদেরকে কেউ বাধা দান কিংবা মন্দ বাক্য বলতে পারবে না। একইভাবে কোনো নারী যদি অন্য কোনো নারীকে ভালোবাসে কিংবা কোনো পুরুষ যদি অন্য কোনো পুরুষকে ভালোবাসে, তারা যদি বিবাহ করতে চায় কিংবা একসঙ্গে থাকতে চায়, তাদেরকেও কেউ বাধা দান বা মন্দ বাক্য বলতে পারবে না। বাধা দানকারী কিংবা মন্দ বাক্য নিক্ষেপকারীকে দণ্ড ভোগ করতে হবে।

আমাদের সমাজে নিয়োগপ্রথা স্বীকৃত নয়, কিন্তু নিয়োগ কি বন্ধ করা গেছে? যায়নি। গোপনে নিয়োগ প্রথা প্রচলিত আছে। গোপন বলেই নিয়োগের কথা কখনো ফাঁস হয়ে গেলে সেই দম্পতি এবং তাদের সন্তানকে কটুক্তি করে সমাজের মানুষ। কিন্তু যখন কোনো দম্পতি পুরোহিতগণ কর্তৃক পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার পর সন্তান লাভ করে, তখন সেই দম্পতি কিংবা তাদের সন্তানকে কেউ কটুক্তি করে না। কেননা তখন মানুষ বিশ্বাস করে যে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার ফলেই সেই দম্পতি সন্তানলাভ করেছে। আপনারা ভেবে দেখুন তো যজ্ঞ করা পায়েস আহার করলে কি কোনো নারীর পক্ষে গর্ভবতী হওয়া সম্ভব, যদি সে কোনো পুরুষের সংসর্গ লাভ না করে? আর পুত্রেষ্টি যজ্ঞের পায়েস আহার করে যদি কোনো ফল মিলতো তাহলে তো পায়েস আহার করা নারীর শুধু পুত্রসন্তানই হতো, কন্যা সন্তান হতো না। কিন্তু আপনাদের চোখের সামনেই এমন অনেক প্রমাণ আছে যে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার পর অনেক নারী কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এক্ষত্রে পুরোহিতগণ সত্যকে আড়াল করার জন্য বলে থাকেন যজ্ঞে ত্রুটি ছিল। কিন্তু প্রকৃত সত্য কী? প্রকৃত সত্য হচ্ছে কোনো দম্পতি পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার পর স্বামীর সম্মতিতে স্ত্রী অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গলাভ করে গর্ভ ধারণ করেন। তারপর সেই নারী যখন পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তখন ব্রাহ্মণগণ সেটাকে যজ্ঞের ফল হিসেবে প্রচার করেন, আর কন্যা সন্তানের জন্ম দিলে বলেন যজ্ঞে ত্রুটি ছিল। তাহলে কোনো দম্পতিকে যখন অন্য পুরুষের সাহায্য নিয়ে সন্তানের পিতা-মাতা হতে হবে, শুধু শুধু তাদেরকে পুত্রেষ্টি যজ্ঞ কেন করতে হবে? কেন পুত্রেষ্টি যজ্ঞের মাধ্যমে নিজের সম্পদ দেবগণ ও ব্রাহ্মণগণকে দান করতে হবে?

আজ থেকে অন্যান্য যজ্ঞের মতো পুত্রেষ্টি যজ্ঞও নিষিদ্ধ করা হলো, কোনো নিঃসন্তান দম্পতি সন্তান কামনায় তাদের ইচ্ছে মতো কোনো পুরুষকে নিয়োগ দিতে পারবে যদি সেই পুরুষের অসম্মতি না থাকে, এতে কোনো দোষ হবে না, কেউ তাদেরকে কটুক্তি করতে পারবে না। কোনো বিধবা সন্তান কামনায় নিজেই কোনো পুরুষকে নিয়োগ করতে পারবে, অন্য কারো অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না। আজ থেকে নিয়োগপ্রথা সমাজে স্বীকৃত হলো।

এতদিন অধ্যাপনা এবং পৌরহিত্য পেশা ছিল সমাজের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পেশা। এই দুই পেশার পরে ছিল অন্যান্য পেশার অবস্থান। আজ থেকে পৌরহিত্য পেশা নিষিদ্ধ করা হলো। এতদিন বণিক এবং বৈদ্যদেরকে ঘৃণার চোখে দেখা হতো। কিন্তু একবার ভাবুন তো এই দুই পেশার মানুষ না থাকলে আমাদের জীবন কতো কঠিন হতো? বণিকদের কারণেই আমরা দূর-দূরান্তের নানা স্থানের পণ্য খুব সহজেই হাতে পাই। আর বৈদ্য? বৈদ্যদেরকে এতটাই ঘৃণা করা হয় যে ব্রাহ্মণ এবং সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ একই বৈঠকে তাদের সঙ্গে উপবেশন করে আহার করেন না! অথচ বৈদ্যগণই আমাদেরকে নানা প্রকার রোগ-ব্যধি থেকে রক্ষা করেন। মানুষের কল্যাণেই তারা জীবন অতিবাহিত করেন, মানুষের কল্যাণের জন্যই তারা অরণ্যে অনুসন্ধান চালিয়ে ঔষধি বৃক্ষ তুলে আনেন। তাদের জন্যই আমরা দীর্ঘায়ু পাই আর এই ধরিত্রীর আলো-বাতাস গ্রহণ করে সবকিছু উপভোগ করি। আজ থেকে সমাজের সকল পেশাই মর্যাদাপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। সকল পেশার মানুষ একই বৈঠকে উপবেশন করে আহার করতে পারবে।

ধর্ম আর শাস্ত্রের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির ক্ষণ এখন থেকে শুরু হলো, ক্রমান্বয়ে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন ও দণ্ডনীতি নির্ধারণ করা হবে। মনুশাস্ত্র তৈরি করেছেন আমাদের পূর্বপুরুষগণ, মনুশাস্ত্রের মধ্যে মানুষের জন্য কল্যাণকর আইন যেমনি রয়েছে, তেমনি সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু মানুষকে সুবিধা দিতে সাধারণ মানুষের জন্য ক্ষতিকর আইনও রয়েছে। মনুশাস্ত্রের কল্যাণকর আইনগুলো রেখে বা সংস্কার করে এবং ক্ষতিকর আইনগুলো বাতিল করে শীঘ্রই নতুন অনুশাসননীতি তৈরি করা হবে। নতুন এই অনুশাসন নীতির কারণে মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর মানুষ ব্যতিত সমাজের সকল স্তরের মানুষ উপকৃত হবে। আমি জানি, নতুন এই অনুশাসননীতির বিরোধীতা কারা করবেন, তারা দেবতাদের প্ররোচণায় বিদ্রোহী হয়েও উঠতে পারেন, কিন্তু তাতে কোনো ফল হবে না বরং সংঘাত বাড়বে, রক্তপাত হবে। আশা করি আমার বার্তা আপনাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে। এখন আপনারা সুশৃঙ্খলভাবে যার যার গৃহে ফিরে যান। সকলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন, এই কামনা করছি। ব্রহ্মাবর্তের নতুন দিনে আপনাদের সবাইকে স্বাগত। জয় হোক ব্রহ্মাবর্তের, মঙ্গল হোক সকলের।’



(চলবে.....)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: বরাবরের মতোই সুন্দর লেখা।

১৫ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ৯:০০

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.