নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব-দুই)

০১ লা আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:৩৫

আমার বাবার ইচ্ছে ছিল আমাকে পুলিশ কিংবা উকিল বানানোর, যাতে তার কাজে লাগতে পারি, আবার অঢেল টাকাও রোজগার হয়। জমিজমা নিয়ে বাবাকে অনেক মামলা-মোকদ্দমা করতে হতো, পুলিশ হলে প্রতিপক্ষকে ভয় দেখিয়ে দমিয়ে রাখা যাবে, আর উকিল হলে মামলার খরচ বেঁচে যাবে। বাবার পাকা হিসাব, হিসাব ছাড়া বাবা এক পা ফেলতেন না!

কিন্তু পুলিশ কিংবা উকিল হবার ইচ্ছে আমার মোটেও ছিল না, হইওনি। জীবনে একটা ক্ষেত্রে আমি বাবার পছন্দের বাইরে গিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাও নানান কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল। ভর্তি পরীক্ষা না দিয়েই বাবাকে মিথ্যে বলেছিলাম যে আমি ল’তে চাঞ্চ পাইনি। একই পন্থা অবলম্বন করেছিলাম পুলিশের চাকরির ক্ষেত্রেও, কখনো পরীক্ষা না দিয়েই বাবাকে বলেছিলাম- ‘পরীক্ষায় টিকিনি’। আমার ব্যর্থতার সংবাদ শুনে বাবা পরবর্তী কয়েকটা দিন গজগজ করতেন, উঠতে-বসতে বাঁকা কথা শোনাতেন, আমি মাথা নিচু করে থেকে সামনে থেকে সরে পড়তাম। ছাত্রজীবন থেকেই আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল শিক্ষকতা করার। তাই যখন আমি সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি তখন বাড়ির সবাই খুশি হলেও বাবা খুশি হতে পারেননি। কিন্তু যখন একের পর এক আশপাশের দশ-বিশ গ্রামের বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে, তখন বাবার কাছে আমার মূল্য বাড়তে থাকে। যদিও বাবা আমার সামনে কখনো কিছু বলতেন না, কিন্তু চায়ের দোকানে যেসব আলোচনা হতো, পাড়া-পড়শিদের নিকট তিনি যেসব কথা বলতেন, তার কিছু কিছু আমার কানে আসত যখন আমি সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়িতে যেতাম। এক পর্যায়ে অবস্থা এমন হয় যে পাত্রীপক্ষের অতি আগ্রহের কারণে দেমাগে বাবার পা যেন মাটিতেই পড়ে না! তিনি আকাশচুম্বী যৌতুক দাবী করতে থাকেন পাত্রীপক্ষের কাছে। যৌতুকের আকাশচুম্বী চাহিদার কথা শুনে অনেক পাত্রীর পিতার মোহভঙ্গ হয়, আবার অনেকে আগ্রহ প্রকাশ করলেও বাবা ঝুলিয়ে রাখেন এই জন্য যে যদি আরও ভালো সম্বন্ধ পাওয়া যায়! অবশেষে বাবার পছন্দ মতো একটা সম্বন্ধ নিয়ে আসেন আমার পিসেমশাই, পুলিশ পিতার একমাত্র কন্যা, দুই ভাই তার ছোট, দেখতে সুন্দরী, বিএ পাস, সবে এম এ ভর্তি হয়েছে। পাত্রীর পিতা আমার বাবার চাহিদা অনুযায়ী যৌতুক দিতেও রাজি। শোনামাত্রই বাবা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে এই পাত্রীর সঙ্গেই আমার বিয়ে দেবেন। আমি সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়িতে গেলে বাবা জানালেন যে আগামীকাল পাত্রী দেখতে যেতে হবে। তারপর পাত্রীর বিস্তারিত জানালেন আনন্দচিত্তে। সেই প্রথম আমি বাবার সামনে দাঁড়িয়ে তার মতের বিরুদ্ধে কথা বললাম, ‘বাবা, মাত্রই আমি চাকরিতে ঢুকেছি, একটু নিজের পায়ে ভালো মতো দাঁড়াই, তারপর বিয়ে করব।’

বাবা ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘মাস্টারির চাকরি করে তুমি জীবনেও নিজের পায়ে দাঁড়াবার পারবা না! পুলিশ-উকিল অলি না অয় কতা ছিল। বাপ-ঠাহুরদার জমির ওপরেই তুমারে দাঁড়াতি অবি। তুমি ভাবো কেমনে যে তুমার রোজগারের ওপর নির্ভর করে আমি তুমার বিয়ে দিবার চাতেছি!’

বাবার এমন নির্মম বাক্য নিক্ষেপের পরও আমি বুকে সাহস এনে বললাম, ‘আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না বাবা।’

বাবা আবার বাক্যশেল ছুড়লেন, ‘তুমার চাওয়া বা না চাওয়ায় তো কিছু যায় আসে না। বিয়ে করবা কী করবা না সেই সিদ্ধান্ত যদি তুমিই নিবা তয় তুমার বাপ-মা বাঁচে আছে কী জন্যে!’

হায়, জীবন আমার, বিয়ে করে সংসার করব আমি, অথচ বিয়ের সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আমার নেই! বিয়েটা তো এক রাত্রের যাত্রাপালা না যে ভালো লাগলে দেখলাম, না লাগলে বের হয়ে গেলাম, কিছু এলো-গেলো না!

যত শিক্ষিত-ই হোক, আমাদের সময়ে বাপের মুখের ওপর কথা বলতে পারত কয়টা ছেলে? আর আমি তো বাবার ভয়ে ছোটবেলা থেকেই ছিলাম মুখচোরা আর ভীরু স্বভাবের, বাবার মুখের ওপর এর চেয়ে বেশি কিছু বলবার সাহস আমার ছিল না।

বাবা আসলে পাড়া-পড়শিদের ক্ষমতার গরম দেখাতে পুলিশের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আমি দু-একজন কাছের আত্মীয়-স্বজনকে দিয়ে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সেই চেষ্টাও সফল হয়নি। বিয়ে ঠেকাবার আর কোনো উপায় যখন নেই-ই তখন আমিও বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম আর একদিন সন্ধ্যায় বাবাকে বললাম, ‘বাবা, আমার বিয়ে যখন দেবেনই, তখন আমার একটা অনুরোধ রাখেন।’
বাবা পানের রস গলাধঃকরণ করে বললেন, ‘কও, কী কবার চাও।’

দুরু দুরু বুকে বললাম, ‘আমি শিক্ষক মানুষ, বিয়ে করে আমার যৌতুক নেওয়াটা ভালো দেখায় না। শিক্ষক হয়ে আমি যদি যৌতুক নিই, তাহলে আমার ছাত্রদের আমি কী শিক্ষা দেব! তাছাড়া আমাদের তো কোনো কিছুর অভাব নেই, তাই যৌতুক নেওয়া উচিত না।’

বাবা নাক ঝাড়ার মতো বললেন, ‘বিষয়বুদ্ধি যে তুমার নাই, তা আমি অনেক আগেই বুঝছি। তুমি করে খাবা সুংসার! যা রাহে যাব, তাই ধরে রাখপার পারবা নাকি সাতে-ভূতে খায়ে যাবি তা ভগবান জানে। তুমি যে আমার ছাওয়াল কি না, তা নিয়েই মাঝে মাঝে আমার সন্ধ অয়!’

মায়ের সামনে কোনো বাবা তার ছেলেকে এমন কথা বলতে পারেন! লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো।

বাবা আবার বললেন, ‘তুমারে খাওয়ায়ে-পরায়ে বড় করতি, ল্যাহাপড়া শিহাতি কতো টাহা লাগিছে তা তুমি জানো? মাঙনা বিয়ে দেব বলে আমি ছাওয়াল মানুষ করছি? এই বিষয় নিয়ে তুমি আর এট্টা কতাও আমার সামনে কবা না। আগামী শুক্কুরবার দিন কনেঅলারা তুমারে আশির্বাদ করবার আসপি। এহন আমার সামনের তে যাও।’

পরের শুক্রবার দুপুরবেলা কাঠের পুতুলের মতো আমি আশির্বাদের পিঁড়িতে বসলাম। আমার হবু শ্বশুর হালকা গোলাপী পাথর বসানো সোনার আংটি পরিয়ে দিলেন আমার হাতে, আর তার দেওয়া সোনার চেইন গলায় পরিয়ে দিলেন আমার মাসি। তারপর আমার হবু শ্বশুর টাকাভর্তি একটা ব্যাগ বাবার হাতে দিলেন, বাবা ব্যাগটি হাতে নিয়ে চলে গেলেন ঘরে। বাবা সেদিনই ব্যাগের সমস্ত টাকা গুণে দেখেছিলেন যে ঠিক আছে কি না! নিজেকে একটা হালের বলদের মতো মনে হলো আমার, যেন এক মালিকের কাছ থেকে আরেক মালিকের কাছে বিকিয়ে যাচ্ছি!

মাঘ মাসের এক শীতের রাতে আমাকে পুলিশের মেয়ের গলাতেই মালা পরাতে হলো। কিন্তু তখনো তো বুঝিনি আমার কপালে কী অপেক্ষা করছে। কিছুটা বুঝলাম বাসর রাতে! বন্ধু-বান্ধবদের বিদায় দিয়ে সবে বাসর ঘরের মা গোঁসাই ধরনের কাঁঠাল কাঠের ভারী দরজার খিলটা আটকেছি। অমনি আমার নতুন বউ গম্ভীর গলায় বলল, ‘এত দেরি হলো কেন তোমার?’

আমি বললাম, ‘বন্ধুদের বিদায় দিয়ে এলাম। তাই একটু দেরি হলো।’
‘এত বন্ধু-বান্ধব কেন তোমার?’

‘বাহ, বন্ধু-বান্ধব থাকবে না! স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি; সহপাঠীদের অনেকের সঙ্গেই গভীর বন্ধুত্ব হয়েছে।’
‘অত বন্ধু-বান্ধব থাকা ভালো না। বন্ধু-বান্ধবরা শুধু স্বার্থের জন্য পিছন পিছন ঘুরঘুর করে। স্বার্থ ফুরালে কেটে পড়ে!’

বাসররাতে নতুন বউয়ের মুখে এমন কথা শুনে আমি কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা বিব্রত আর কিছুটা বিরক্তও হলাম। কিন্তু সব গোপন রেখে বললাম, ‘না না, ওরা আমার পিছে স্বার্থের জন্য ঘুরবে কেন! আমরা সবাই খুব ভালো বন্ধু। কেন তোমার কোনো বন্ধু নেই?’

‘না। মেয়েদের আবার বন্ধু কিসের! দু-একজন বান্ধবী থাকতে পারে। কিন্তু সে ঐ বিয়ের আগ পর্যন্ত। বিয়ের পর মেয়েদের কাজ স্বামী-সংসার আর বাচ্চা-কাচ্চার দেখভাল করা। শোনো, তোমার বন্ধুদের বলে দিও তারা যেন ঘন ঘন বাড়িতে না আসে, আমি এসব পছন্দ করি না।’

ফুলশয্যার রাতে বউয়ের মুখে এমন কথা শুনে আমি থ হয়ে গেলাম! আমি কলেজে উঠার পর থেকে বাবা ব্যতিত আর কেউ আমার সঙ্গে এমন কর্তৃত্বপূর্ণ ভাষায় কথা বলেনি।

‘হারিকেনের আলোটা বন্ধ কর। তোমাদের বাড়িতে যা মানুষের হল্লা, একটু শান্তিতে নিশ্বাস ফেলবার জো নেই। আমার খুব মাথা ধরেছে। মাথাটা একটু টিপে দাও।’ বলেই সে শুয়ে পড়ল।

শুনুন, বউয়ের মাথা টিপতে আমার আপত্তি নেই। মনের মতো মানুষ পেলে সারাজীবন শুধু তার মাথা টিপতে টিপতেই আমি মরতে পারি! কিন্তু কথাগুলো বলার সময় আমার বউয়ের কণ্ঠে ভোররাতের উনুনের ছাইয়ের তলার আগুনের উত্তাপ ছিল। যা আমাকে করল অপমানিত-লজ্জিত। হ্যাঁ, শঙ্কিতও করল।

আমি হারিকেনের সলতেটা কমিয়ে খাটের নিচে রেখে বিছানায় উঠে বালিশে ঠেস দিয়ে বসে রইলাম। সে আবার বলল, ‘কই, দাও মাথাটা টিপে!’

সে-রাতে বিয়েবাড়ির কোলাহল থেমে গিয়ে নীরবতার নিবিড় পর্দা নামল, কেবল খেঁজুরগাছের কাঠঠোকরাটা রোজগার মতোই সশব্দে গাছে ঠোকরাতে লাগল। প্রহরে প্রহরে পাখি ডাকলো, ডানা ঝাঁপটালো। পাজি ইঁদুর একটা কচি ডাবের বোঁটা কেটে দিলে মাটিতে আছড়ে পড়লো ডাবটি, বাড়ির কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করতে করতে সেদিকে ছুটে গেল। কুকুরের সাড়া পেয়ে একটা চিকা চিঁ চিঁ করতে করতে খড়ের গাদায় লুকোলো। আমি কেবল শব্দ শুনেই এই দৃশ্যগুলো কল্পনায় দেখতে পেলাম আর বউয়ের মাথা টিপতে লাগলাম। আমার জানালা থেকে জ্যোৎস্নার শেষ ফালিটুকুও চুপি চুপি সরে গেল। শুকতারা ডুবে গেল। শিবুর মায়ের ভোরগোস্টের সুর আর করতালের বাদ্য ভেসে এলো কানে। একসময় আমাদের বাড়ির উঠোনেও এলেন শিবুর মা, আবার ক্রমশ দূরে যেতে যেতে মিলিয়েও গেল তার কণ্ঠ ও করতালের বাদ্য। আমার বউ দ্বিতীয়বারের মতো পাশ ফিরে শুলো।

বাসররাতে আমি কেবল বউয়ের মাথাই টিপেছিলাম!

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ২:২০

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: পর্বপাঠে ভালো লাগল। আগের পর্বটি পড়িনি। পড়ে নিব। ধন্যবাদ আপনাকে।

০১ লা আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ২:৩২

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

২| ০২ রা আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:৩৭

রাজীব নুর বলেছেন: অনেকদিন পর নতুন একটা ধারাবাহিক শুরু করছেন। সাথেই আছি।

০৩ রা আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১২:৫৪

মিশু মিলন বলেছেন: সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.