নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব-তিন)

০২ রা আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৩:০৩

দুই

বুঝতেই পারছেন আমার বাকি জীবনটা কেমন কেটেছে, বউ আর শ্বশুর মিলে আমার জীবনটা আমার থাকতে দেয়নি। মাঝে মাঝে মনে হতো আমার শরীরের কাঠামোর মধ্যে অন্য কোনো আগন্তুক ঢুকে পড়েছে, এ জীবন আমার নয়, যেন অচেনা কারো জীবনের বোঝা বয়ে চলেছি আমি! জীবনটা ব্যর্থ মনে হতো, মনে হতো আমার এই জীবনের কোনো মূল্য নেই। আবার কখনো মনে হতো আমি ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নের ঘোরে আছি, ঘুম ভাঙলেই আবার আগের সেই জীবন ফিরে পাবো। কিন্তু রোজ সকালে ঘুম ভাঙা চোখে দেখা আমার স্ত্রীর মুখটি আমাকে আতঙ্কিত করত এই জন্য যে- না জানি আজ আবার তার কোন কাণ্ড দেখতে হয়!

এজন্যই আজকালকার ছেলে-মেয়েদেরকে বলি- বাপু, প্রেম করেই হোক কিংবা পারিবারিকভাবে সম্বন্ধ দেখেই হোক, পাত্র বা পাত্রীর মন-মানসিকতা বুঝে, চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিয়ে, তারপর বিয়ে কোরো। স্বামী কিংবা স্ত্রী তো আর শো-পিস নয়, যে যখন ইচ্ছে বদলে ফেলবে! অবশ্য বর্তমান প্রজন্ম আমাদের প্রজন্মের মতো নয়, এখন স্বামী-স্ত্রী দু-পক্ষ থেকেই ডিভোর্স কিংবা মিউচুয়াল সেপারেশনের হার বেড়েছে। এতে আমি দোষের কিছু দেখি না, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলে একটা অস্বাভাবিক-অসুস্থ সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর চেয়ে ডিভোর্স করে আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। অবশ্য বাংলাদেশে হিন্দুদের মধ্যে ডিভোর্সের আইন নেই, তবে আদালতের মাধ্যমে মিউচুয়াল সেপারেশনের সুযোগ আছে। কিন্তু আমাদের কালে মিউচুয়াল সেপারেশনের ঘটনা খুব বেশি দেখা যেত না, শহরের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে দু-চারটা মিউচুয়াল সেপারেশনের ঘটনা ঘটত, কিন্তু গ্রামে তা ছিল একেবারেই বিরল। সে-কালে বউয়ের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলে লোকে আড়ালে উপহাস করত, বউ ধরে রাখতে পারেনি বলে কটাক্ষ করত, নপুংসক বলতেও ছাড়ত না। এসব আলোচনা হতো একেবারে নোংরা ভাষায়! একজনের মিউচুয়াল সেপারেশন হলে পুরো পরিবারের সম্মানহানি হতো। সেই পরিবারের অবিবাহিত ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিতে গেলে পাত্র বা পাত্রী খুঁজে পেতে কষ্ট হতো, কেউ তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে চাইত না। আজকের দিনের শহুরে মানুষের কাছে সে-সব হয়ত রূপকথার গল্পের মতোই মনে হবে, কিন্তু তা নিরেট সত্য।

মুসলমান সমাজের চিত্র অবশ্য ভিন্ন ছিল, মুসলমানদের মধ্যে তালাক হতো, তালাকপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়ে উভয়েরই পুনরায় বিয়েও হতো। তবে উভয় সম্প্রদায়েই মধ্যবিত্ত সমাজের কোনো ছেলে বা মেয়ের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য পাত্রী বা পাত্র খুঁজে পেতে কিছুটা বেগ পেতে হতো, এখনো যে একেবারে হয় না তা নয়।

হিন্দুদের মধ্যে একটা সংস্কার কাজ করত, বরের সঙ্গে কোনো মেয়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তাকে কোনো ছেলে বিয়ে করতে চাইত না। হিন্দুদের মধ্যে মিউচুয়াল সেপারেশন কম হবার আরও কারণ এই যে, হিন্দু মেয়েরা মুসলমান মেয়েদের মতো পিতার সম্পত্তির ভাগ পায় না। ফলে কোনো মেয়ের বরের সঙ্গে সেপারেশন হয়ে গেলে সেই মেয়েকে পিতা বা ভাইয়ের সংসারে আশ্রয় নিতে হতো। পিতা-মাতা বেঁচে থাকতে খুব বেশি সমস্যা না হলেও তারা মারা যাবার পর ভাইয়ের সংসারে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতো, এমনকি শারীরিকভাবেও নিগৃহীত হতো। পাড়া-পড়শিদের কটুবাক্য তো ছিলই। ফলে হিন্দু মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার হলেও মুখ বুজে সহ্য করত, ভাই এবং ভাইয়ের স্ত্রীর হাতে নিগৃহীত হবার আশঙ্কায়। এখনও বাংলাদেশে আনুপাতিক হারে মুসলমানদের তালাকের চেয়ে হিন্দুদের মিউচুয়াল সেপারেশনের হার অনেক কম হবার প্রধান কারণ এটাই, আমার অন্তত তাই মনে হয়।

অশান্তি যতই হোক, আমি ঘুণাক্ষরেও আমার স্ত্রীর সঙ্গে মিউচুয়াল সেপারেশনের কথা ভাবিনি। আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে পুলিশের মেয়ের সঙ্গে থাকতে না চেয়ে আদালতের কাছে মিউচুয়াল সেপারেশনের আবেদন জানাবো! মিউচুয়াল সেপারেশন চাইলে বউ-শ্বশুর মিলে আমার এবং আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দিতে দিতে আমাদের ভিটেয় ঘুঘু চড়িয়ে ছাড়ত! আমার জন্য পুরো পরিবারকে হয়ত জেলের ভাত খেতে হতো!

বিয়ের প্রথম মাসেই আমার স্ত্রী আর শ্বশুর আমার বাকতীক্ষ্ণ বাবার মুখ এমনভাবে ভোঁতা করে দিয়েছিলেন, যাতে আর কখনও বাবা নিজের মত তার বেয়াই আর পুত্রবধূর ওপর চাপিয়ে দেবার সাহস না করেন। পিতার মুখ ভোঁতা হলে পুত্রের কী আর বাকি থাকে!

বিয়ের দিন দশেক পর, যেদিন আমি আমার কর্মস্থলে যোগ দেব তার আগের দিন বিকেলে তপতীকে বললাম, ‘আমি কাল চলে যাব।’
ও হ্যাঁ, তপতী আমার স্ত্রীর নাম। আমার কথা শোনামাত্র তপতী বলল, ‘তুমি যাবে মানে? আমাকে নেবে না?’
‘তোমাকে এখনই নেব না। আমি ওখানে একরুমের ছোট একটা বাসা নিয়ে থাকি। একটা বড় বাসা নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে তারপর তোমাকে নিয়ে যাব। তাছাড়া বাবা-মা চান তুমি কিছুদিন বাড়িতেই থাকো।’
‘তোমার বাবা-মার কথায় আমাকে চলতে হবে নাকি! আমি কি তোমার বাবা-মায়ের সেবাদাসী হবার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি?’
নতুন বউ, গা থেকে তখনও হলুদের গন্ধ উবে যায়নি, তার মুখে এমন কথা শুনে আমার বাকরুদ্ধ হবার দশা! বললাম, ‘এভাবে কথা বলছ কেন? সেবাদাসী হতে যাবে কেন, তুমি বাড়ির বউ।’
‘বউ তো স্বামীর সঙ্গে থাকবে, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকবে কেন?’
‘কিছুদিন থাকো, আমি নতুন বাসা নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো।’

আসলে বাবা-মা অনুমতি না দিলে তপতীকে শহরে আমার কাছে নিয়ে যাবার সাধ্য আমার নেই, তারা বিয়ের আগেই আমাকে জানিয়েছেন যে তাদের পুত্রবধূ বাড়িতেই থাকবে, নিজ জেলার বাইরে দূরে কোথাও আমার পোস্টিং হলে তখন স্ত্রী সঙ্গে যাবে। এ বিষয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে তর্কে যাবার সাহসও আমার নেই। তপতীকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই বাসা গুছিয়ে নেবার কথা বলা।

তপতী বলল, ‘আমি কালই তোমার সঙ্গে যাবো।’

আমি পড়লাম অথৈ জলে, এক কূলে বাবা-মা, আরেক কূলে স্ত্রী। আমি কোন কূলে যাবো? তপতীকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবার কথা বাবা-মাকে বলতে গেলে, মা মুখে কিছু না বললেও মন খারাপ করবেন। আর বাবা বাধাবেন কুরুক্ষেত্র! গলা চড়িয়ে সারা পাড়ার লোককে শুনিয়ে বলবেন- আমাদের বংশে কোনো ছেলে বউয়ের আঁচল ধরা মেনি বিড়াল হয়নি। তুমি তোমার বউকে নিয়ে পথ দেখ, তোমাদের আর এই বাড়িতে আসতে হবে না।

বাবা একথা বলবেন আমি নির্ঘাত জানি, আমি তো আমার বাবাকে চিনি।

তপতীকে বললাম, ‘এখন কোনোভাবেই তোমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাই না।’
তপতী খেঁকিয়ে উঠল, ‘জানি তো কেন আমাকে নিয়ে যাবে না, আমি থাকলে ওখানে অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে পারবে না!’

আমি হাঁ হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম! আমাদের ঘোরতর শত্রু প্রতিবেশি অজিতের পরিবারের কোনো লোকও কখনো আমাকে নিয়ে এমন কথা বলতে পারবে না, আর আমার নিজের স্ত্রীর মুখ থেকে শুনতে হলো এমন কথা! মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল, দশদিন আগের শান্তির জীবনে বাবা-মায়ের আদেশে এ কী ঝঞ্ঝা ডেকে আনলাম!

তপতীর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বললাম, ‘তুমি যদি বাবা-মা’র কাছ থেকে আমার সঙ্গে যাবার অনুমতি নিতে পারো, তাহলে তোমাকে নিয়ে যাবো।’

একথা বলেই আমি বাইরে বেরিয়ে গেলাম ওকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে। একা একা রাস্তায় হাঁটলাম, চায়ের দোকানে গিয়ে চা পান করতে করতে পরিচিতদের সঙ্গে আড্ডা দিলাম। কিন্তু একটাই প্রশ্ন আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো- আমি কি বিয়ে করে ভুল করলাম?

সন্ধ্যার অনেক পরে বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবা আর মা তাদের শোবার ঘরের বারান্দায় একজন চেয়ারে, আরেকজন মেঝেতে বসে আছেন গম্ভীর মুখে। বাবা আমাকে দেখেই গর্জে উঠলেন, ‘তুই বৌমারে কইস নাই যে সে বাড়িতেই থাকপি?’

বুঝলাম তপতীর সঙ্গে কিছু একটা হয়েছে। হলে হোক, এই বিয়ে আমি করতে চাইনি, বাবা-মা জোর করে দিয়েছেন। এখন তাদের পুত্রবধূকে সামলাতে পারলে পারুক, না পারলে না পারুক। আমি মাঝখানে পড়ে চ্যাপ্টা হতে চাই না।

বললাম, ‘কইছি তো।’
‘তাইলে আমার মুখের ওপর সে কথা কওয়ার সাহস পায় ক্যামনে?’
‘আপনারা পছন্দ করে বৌমা আনছেন, সে কোথায় থাকবে আপনারাই ঠিক করেন, এর মধ্যে আমারে জড়ায়েন না।’
যেহেতু আমার অমতেই বাবা তপতীকে পুত্রবধূ করে এনেছে, তাই আমাকে আর বেশি ঘাটালেন না। তপতীকে শুনিয়ে আমাকে বললেন, ‘তারে কোয়ে দিস, পুলিশের মিয়া অইছে বলে আমার মুণ্ডু কিনে নেয় নাই! আমার বাড়িতে আমার কতাই শ্যাষ কতা। তারে বাড়িতেই থাকতি অবি।’

সেই রাতে তপতী গজ গজ করে অনেক কথা শোনালো আমাকে, কাঁদলোও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আমি তার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে কয়েক মাস পরই আমি বাবা-মাকে বুঝিয়ে তাকে আমার কাছে নিয়ে যাব, সে ঝাড়ি মেরে আমার হাত সরিয়ে দিলো। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ, আর মাঝখানে একটু উঁচু জায়গায় ভীত হরিণের মতো আমি কোনোমতে রাতটি পার করে সকালে চলে গেলাম বাসায়। বাসায় ফিরে বাসাটাকে আগের চেয়ে আপন মনে হলো, মনে হলো শান্তির নীড়। সপ্তাহান্তে বাড়িতে যাবার ইচ্ছেটাই মরে গেল আমার, কিন্তু না গেলে আবার কী কাণ্ড হবে কে জানে, তাই যেতেই হবে। তবে আপাতত কয়েকটা দিন শান্তি। কিন্তু শান্তি কি আর আমার কপালে আছে? দু-দিন পরই পাশের বাড়ির এক ছোটভাই সুবীর কলেজে এসে উপস্থিত, ‘দাদা, আপনাকে আজই বাড়ি যেতে হবে?’

বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো, কোনো অঘটন ঘটলো নাকি বাড়িতে! তপতী যা জেদি, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সুবীরকে বারবার প্রশ্ন করলেও সে একই কথা বলতে লাগলো, ‘তেমন কিছু না। বৌদির সাথে হয়ত ঝগড়াঝাটি হয়েছে জ্যাঠা আর জেঠিমার।’

ক্লাস শেষে সুবীরের সঙ্গে চললাম বাড়ির পথে। সারা রাস্তায় একই চিন্তা ঘুরতে লাগল মাথায়, তপতী কি কোনো অঘটন ঘটিয়েছে? আত্মহত্যা করেছে? যদি আত্মহত্যা করে তাহলে তো পুরো পরিবারের মান-সম্মান ধুলিস্যাৎ হবেই, সেই সঙ্গে গুষ্ঠি ধরে জেলে যেতে হবে। তার পুলিশ বাপ আমাদের হাড়ে দূর্বা জ্বালিয়ে ছাড়বে! এইসব দুঃচিন্তা করতে করতে গ্রামে পৌঁছলাম।

রাস্তা থেকেই দেখলাম বাড়িতে লোকজনের ভিড় নেই, অর্থাৎ আসবার পথে আমি যে অঘটন নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছিলাম, তেমন কিছু ঘটেনি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাড়িতে ঢুকে দেখলাম আমার শ্বশুরমশাই বারান্দায় বসে আছেন। তার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে ঘরে গিয়ে দেখলাম তপতী শুয়ে আছে বিছানায়, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে খুব কেঁদেছে। আমার সঙ্গে কথা বলল না, পাশ ফিরে শুলো।

রাত্রে শ্বশুরমশাই আমার বাবা-মা, আমার দাদা এবং আমাকে নিয়ে বসলেন, আমি আর তপতী যে-ঘরে তাকি সেই ঘরের বারান্দায়। আমি চলে যাবার পর নাকি তপতী খুব কান্নাকাটি করেছে, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, অবস্থা বেগতিক দেখে আমার বাবা-মা তাদের পুত্রবধূকে বোঝানোর জন্য বেয়াইকে খবর দিয়ে আনিয়েছেন, আর আমাকেও। তপতীকে বাড়িতে রাখার ব্যাপারে বাবা আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে এইসব যুক্তি তুলে ধরলেন যে- নতুন বউ সবে শ্বশুরবাড়িতে এলো, কিছুদিন এখানে থেকে শ্বশুরবাড়ির হালচাল বুঝুক, সংসার চালানো চাট্টিখানি কথা না, শাশুরির কাছে থাকলে সংসার চালানো ভালো মতো শিখতে পারবে, পাকা গিন্নী হয়ে উঠবে, তাছাড়া তাদের ছেলে কলেজে চলে গেলে বউকে বাসায় একা থাকতে হবে, শহরের বাসায় নতুন বউ একা থাকলে বিপত্তি হতে পারে, কিছুদিন বাড়িতে থেকে সংসারটাকে ভালো মতো বুঝুক তারপর ছেলের কাছে যাবে ইত্যাদি।

আমার বাবা যদি হন বুনো ওল, তবে শ্বশুরমশাই বাঘা তেঁতুল! বাবা যতই ধূর্ত গ্রাম্য ভিলেজ পলিটিশিয়ান হোক, শ্বশুরমশাইও মানুষকে সাত ঘাটে ঘোলাজল পান করানো পুলিশ! তিনিও বাবাকে বোঝালেন যে- তপতী তার একমাত্র মেয়ে, বড় আদরে মানুষ হয়েছে, একটু জেদি কিন্তু মনটা ভালো, মেয়ের কোনো আবদার তিনি অপূর্ণ রাখেননি ইত্যাদি। তারপর বোঝাতে লাগলেন যে- দুনিয়ার হালচাল বদলাতে শুরু করেছে, তাদের যৌবনকালের সেই দিন আর নেই, ছেলে-মেয়েরা এখন স্বাধীনভাবে থাকতে চায়, তারা যেভাবে থাকলে সুখে থাকবে মনে করে তাদেরকে সেভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত এইসব কথা।

বাবা এবং শ্বশুর কেউ কারো কাছে সহজে হার মানতে নারাজ! রাত বাড়ে, কথার জট পাকায়, কিন্তু সমাধান হয় না কিছুতেই। শেষে আমার শ্বশুর তার মোক্ষম অস্ত্রটি প্রয়োগ করলেন, ‘আমার মেয়ে এখন আপনাদের পুত্রবধূ। তাকে বাড়িতে রাখবেন না কী ছেলের কাছে পাঠাবেন তা আপনাদের ব্যাপার। তবে কিনা আমার মেয়ে একটু জেদি। ওর যদি কিছু হয়ে যায়, তখন তার দায় কিন্তু আপনাকেই নিতে হবে বেয়াইমশাই। আর আমার মেয়ের কিছু হলে আমি কিন্তু আপনাকে ছেড়ে কথা বলব না।’

এই কথায় বাবা ভয় পেয়ে হাওয়া বের হওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেলেন! এই কয়েকদিনেই তিনি তপতীর জেদের যতটুকু পরিচয় পেয়েছেন, তাতে ওর পক্ষে কোনো অঘটন ঘটানো যে অসম্ভব কিছু না, তা তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনি প্রতিবেশিদেরকে পুলিশ বেয়াইয়ের ক্ষমতার গরম দেখাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেই যে বেয়াইয়ের ক্ষমতার গরম তাওয়ার মধ্যে পড়বেন তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি।

বাবা আমার উদ্দেশে বললেন, ‘অমি, পরের মিয়ার কোনো ক্ষতি অইলে, সেই দায়-দায়িত্ব তো আমরা নিবার পারবো না। তুমি কালকেই বৌমারে তুমার সাথে নিয়ে যাও।’

বাবা সাধারণত আমাকে তুই বলেই সম্বোধন করতেন, কিন্তু সেদিন আমাকে তুমি সম্বোধন করেছিলেন। এই তুমি সম্বোধনের মধ্যে মিশে ছিল তার গোপন কষ্ট। আর আমি শঙ্কিত হয়েছিলাম এজন্য যে বউয়ের কারণে বাবা কি আমাকে দূরে সরিয়ে দিলেন?

পরদিন সকালেই আমি তপতীকে নিয়ে বাসায় চলে গেলাম। যাবার সময় বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন তারা, এতটাই অসহায় লাগছিল তাদের। আমার মনে হলো আমি যেন নির্বাসনে যাচ্ছি, বাবা-মায়ের থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি! জীবনে সেই প্রথম আমি যেন শিকড় ছেঁড়ার যাতনা অনুভব করলাম। জীবনে সেই প্রথম ভিলেজ পলিটিশিয়ান ধূর্ত বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট হলো আমার!



(চলবে.......)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:১০

রাজীব নুর বলেছেন: সাথেই আছি। লিখতে থাকুন।

০২ রা আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:৩১

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.