নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
কুড়ি
কয়েক মাস প্রেম করার পর যখন আমরা দুজন দুজনকে আরও ভালোভাবে চিনলাম, জানলাম, বুঝলাম; তখন আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। বিয়েটা আমাদের কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি, এটাই আমাদের একসঙ্গে থাকবার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যেহেতু আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি, যে সমাজের মানুষ বিয়ে না করে আমাদের একসঙ্গে থাকাটা ভালো চোখে দেখবে না, এই কারণেই আমাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে বিয়ের পরও গোধূলিবাড়িতেই বাকি জীবন থাকবো। ঢাকার বাসায় কিংবা অন্য কোথাও মাঝে মাঝে ঘুরতে যাব, কিন্তু থাকব এখানেই। এখানকার যে পরিবেশ এখন গড়ে উঠেছে, তার প্রেম আমরা দুজনের কেউই আর ছাড়তে পারব না। এখন বিয়ে করে এখানে থাকার বিষয়টি বাঁধন অ্যালাউ করলেই হয়। কিন্তু বাঁধনকে কী করে যে বলি, ভীষণ লজ্জা লাগছিল বিয়ের কথাটা ওকে বলতে। বাঁধন নিজেই এখনো বিয়ে করেনি, আর আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি বিয়ে করার আবদার করবো ওর কাছে! বাঁধন কেন বিয়ে করেনি, সেটা আমি কিছুটা আঁচ করতে পারি। ওর জীবনে গভীর কোনো দুঃখ আছে, দুঃখের পলি জমে জমে হৃদয় পাথর হয়ে উঠেছে। বাঁধন এমনিতে যথেষ্ট মানবিক, প্রাণবিক, কিন্তু নিজের প্রতি ওর আচরণ বেশ কঠোর। খুব সাদামাটা থাকে, টাকা থাকলেও কোনো বিলাসিতা নেই। কোনো বাহুল্য নেই।
ভীষণ লজ্জা লাগছিল আমার। তবু এক শুক্রবার বিকেলে পুকুরপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে বাঁধনকে বললাম বিয়ের কথাটা। বাঁধন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘বাহ, এত আনন্দের খবর!’
আমি বাঁধনকে জড়িয়ে ধরলাম। বাঁধনের বুকে মাথা রেখে বহুদিন পর আমি যেন আমার বাবা নয়, মায়ের বুকের উষ্ণতা অনুভব করলাম। ও আমার পিঠে হাত রেখে বলল, ‘বোকা ছেলে, এত লজ্জা পাবার কী আছে! আমার দুইজন ছেলে-মেয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইছে, আমার কাছে এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে!’
রাতে খাবার পর সবাইকে হলঘরে আসার আহ্বান জানাল বাঁধন। সবাই হলঘরে সমবেত হলে ও প্রথমে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল নিয়ে কথা বলল কিছুক্ষণ। জানাল যে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল থেকে টাকা আসতে শুরু করেছে। সবাই খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। তারপর আরও কী কী ধরনের ভিডিও তৈরি করা যায়, কিভাবে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল এগিয়ে নেওয়া যায়, সে সম্পর্কে সবার মতামত জানতে চাইল, নিজেও কিছু আইডিয়া সবার সঙ্গে শেয়ার করল। কাজের কথা শেষ হলে বলল, ‘এবার আপনাদেরকে একটা আনন্দ সংবাদ দিই।’
সবাই কৌতুহলী হয়ে তাকালো বাঁধনের দিকে, বাঁধন বলতে শুরু করল, ‘গোধূলিবাড়ি’র আমার দুই সন্তান নিজেরা নিজেদের পছন্দ করে, ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইছে। আমার সেই সন্তান দুজন হলেন অমিতাভ কাকু আর আলপনা মাসিমা।’
প্রায় সবাই হাততালি দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল, হারুন ভাই শিষ বাজালেন। কেউ প্রশংসাসূচক কথা বলল, কেউবা করল মজার রসিকতা। আমার পাশে যারা বসেছিল, তারা আমার পিঠ চাপড়ে দিল। আমার হাত-পা তখন রীতিমতো কাঁপছিল!
বাঁধন আবার বলল, ‘অচিরেই দুজনের বিয়ের আয়োজন করতে চাই। আপনারা কী বলেন?’
অনেকে একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুভ কাজে আর দেরি কেন!’
আমি সবার রসিকতা শুনছিলাম, মুখ তুলে বাঁধনের দিকে তাকাতেই আমার লজ্জা লাগছিল। খানিকটা দূরে বসা আলপনার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে মাথা নিচু করে লাজুক কিশোরী কনের মতো দাঁতে নখ কাটছে!
মাঘ মাসের ৪ তারিখে আমাদের বিয়ের দিন ধার্য করা হলো। বিশ-পঁচিশ দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেল বিয়ের আয়োজন। আয়োজন দেখে মনে হলো পঁচিশ বছরের যুবকের সাথে বিশ বছরের যুবতীর বিয়ে! বাঁধনকে বললাম, ‘এমন ঘটা করে আয়োজনের দরকারটা কী বাবা! আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে।’
ও বলল, ‘এই প্রথম আমার দুই সন্তানের বিয়ে। আয়োজন না করলে লোকে যে আমার নিন্দা করবে!’
এরপর আমার আর কী বলার থাকে! বিয়ের আয়োজন চলতে থাকলো। এমনকি পরিচিতজনদের নিমন্ত্রণ করতে বিয়ের কার্ডও ছাপালো বাঁধন।
এরই মধ্যে একদিন খুব সকালবেলা একটা ভাড়া গাড়ি নিয়ে আমি আর আলপনা ঢাকায় গেলাম বিয়ের কিছু কেনাকাটা করতে। আটটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম বাসায়। বদ্ধ ফ্ল্যাটে গুমোট গন্ধ, সব জায়গায় ধুলোবালি, দেয়ালের কোথাও কোথাও ঝুল, আসবাপত্রের কোথাও কোথাও মাকড়সার জাল। আমি প্রতিমাসে একবার বাসায় গিয়ে তিন-চারদিন থাকি, আজিজ মার্কেটে গিয়ে দরকারি বই কিনি, শিল্পকলা কিংবা মহিলা সমিতিতে গিয়ে নাটক দেখি, ছায়ানটের অনুষ্ঠান থাকলে দেখতে যাই, তারপর আবার ফিরি গোধূলিবাড়ি’তে। আমি গেলে যতটুকু পারি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করি বাসাটা, আবার ধুলোবালি জমে যায়।
সোফাটা ঝেড়ে-মুছে আলপনাকে বসতে দিলাম। একটুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিয়ে ওকে ঘুরিয়ে দেখালাম বাসাটা। দেয়ালে টাঙানো তপতীর আর সন্তানদের ছবি দেখেই ও বুঝতে পারলো কোনটা কে, আমাকে আর বলে দিতে হলো না। তপতীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দিদি তো খুব সুন্দরী ছিলেন!’
আমি মৃদু হাসলাম আর মনে মনে বললাম, ‘রুক্ষ সুন্দরী, আমার হাড় কালা করেছে!’
বাসা দেখে আলপনার বেশ পছন্দ হলো। বললাম, ‘বিয়ের পর আমরা প্রতি মাসে সপ্তাহখানেক বাসায় থেকে যাব, কি বলো?’
আলপনা সায় দিলো, ‘হ্যাঁ, বেশ হবে।’
আমরা ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা করতে বসলাম টেবিলে। ধানমন্ডিতে এসে একটা রেস্টুরেন্ট থেকে ড্রাইভারকে নাস্তা করিয়ে আমাদের জন্য নাস্তা কিনে নিয়েছিলাম। প্লেট ধুয়ে আলপনা নাস্তা বেড়ে দিল, আমাকে কিছুই করতে দিল না। এক টুকরো পরোটা মুখে দিতেই শোকেসে রাখা ওয়াইনের বোতলে আমার দৃষ্টি পড়ল। আগেরবার বাসায় এসে বোতলটা কিনেছিলাম, অর্ধেকটা রয়ে গেছে। মদের প্রতি তীব্র নেশা আমার কোনোকালেই ছিল না। অকেশনালি ওয়াইনটাই কেবল পান করি। তপতী বেঁচে থাকতে বাড়িতে ওয়াইন ঢোকানোর সাহস হয়নি কখনো। মাঝে মধ্যে বন্ধু ফরহাদের বাসায় কিংবা বারে বসে পান করে আসতাম। তপতী মারা যাবার পর বাসায় আনতে শুরু করি। বিয়ে মানে এক পরাধীন জীবনও বটে, তবু মানুষ বিয়ে করে, আমিও একবার করেছি, আবার করতে যাচ্ছি!
আলপনাকে বললাম, ‘তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব?’
‘নিশ্চিন্তে বলো।’
‘ঢাকায় এলে মাঝে-মধ্যে আমি একটু-আধটু ওয়াইন খাই। আগেরবার এসে কেনা বোতলটায় খানিকটা রয়ে গেছে।’
আলপনা হাসল, ‘অলকের বাবা রোজ রাতে মদ খেত। প্রথম দিকে আমার খুব অস্বস্তি হতো। কিন্তু মেনে নিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে অস্বস্তি ভাবটা কেটে গিয়েছিল। তুমি চাইলে খেতে পারো, আমার কোনো অসুবিধা নেই।’
অলক আলপনার বড় ছেলের নাম।
আলপনার চোখে চোখ রাখলাম, ‘তুমি মন থেকে বলছ তো? তোমার বিন্দুমাত্র অস্বস্তি থাকলে আমি খাবো না।’
আলপনা ওর বামহাতটা আমার ডানহাতের কব্জির ওপর রেখে বলল, ‘আরে বাবা হ্যাঁ, আমি মন থেকে বলছি।’
‘বেশ, তাহলে একটু খাই।’
আমি শোকেস থেকে ওয়াইনের বোতলটা আর গ্লাস নিয়ে এলাম। গ্লাস ধুয়ে বোতল থেকে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে বললাম, ‘আমি ওয়াইনটাই শুধু খেতে পারি। হুইস্কি-ভদকা বা অন্যসব মদ গিলতে পারি না। তুমি কি একটু চেখে দেখবে?’
‘না, না। একবার কৌতুহলবশত অলকের বাবার বোতল থেকে গ্লাসে ঢেলে জল মিশিয়ে একটা চুমুক দিয়েছিলাম, বাবা, সে কী বুক জ্বালা করা! আর কখনো মুখে নিইনি।’
বললাম, ‘ওয়াইন কিন্তু হুইস্কি-ভদকার মতো ঝাঁঝালো না, মিষ্টি একটা স্বাদ। একটু চেখে দেখতে পারো।’
আলপনা হাসল। আমি বললাম, ‘দেই একটু?’
‘আচ্ছা, দাও সামান্য একটু।’
আরেকটা গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে আলপনার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ও নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকল। আমি ওর গ্লাসে আমার গ্লাস ঠুকে বললাম, ‘চিয়ার্স।’
আলপনা গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘হুম, তেমন ঝাঁঝালো না।’
নাস্তা শেষে সোফায় বসে দুজনে কিছুক্ষণ গল্প করলাম। তারপর আমি কফি বানিয়ে আনতে চাইলে আলপনা বলল, ‘কোথায় কী আছে আমাকে দেখিয়ে দাও আমি বানাচ্ছি।’
কফিতে চুমুক দিয়ে গল্প করতে করতে আরও অনেকটা সময় চলে গেল। এক ফাঁকে আমি পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করে এলাম। তারপর ব্যাংকের চেক বইটা নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলে প্রথমে একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকলাম মিষ্টি কিনতে, তারপর সোজা চলে গেলাম রায়ের বাজারে আমার ভাগ্নি সোহিনীর বাসায়। ওকে আগেই বলে রেখেছিলাম যাতে আজকের দিনটা ফ্রি রাখে, ওকে নিয়ে যাবো বিয়ের কেনাকাটা করতে। সোহিনী ছোটবেলা থেকেই আমার খুব ন্যাওটা। আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে সম্ভবত আমাকেই বেশি ভালোবাসে ও, আমার তেমনটাই ধারণা।
কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল সোহিনী। আলপনার সঙ্গে সোহিনীর পরিচয় করিয়ে দিলাম, আর আলপনার পরিচয় দিতে বললাম, ‘আমার বন্ধু আলপনা।’
সোহিনী আলপনাকে বলল, ‘আসুন, ভেতরে আসুন।’
ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলাম আমি আর আলপনা। আমাদের উল্টোদিকে বসল সোহিনী। বললাম, ‘দাদুভাইরা স্কুলে?’
‘হ্যাঁ, স্কুলে।’
‘তোকে ওদেরকে আনতে যেতে হবে?’
‘না। ওরা স্কুলের গাড়িতে আসা-যাওয়া করে।’
সোহিনীর দুই ছেলে, যমজ, দুজনই ক্লাস নাইনে পড়ে। জামাই একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে। একটু কথা বলার পর সোহিনী বলল, ‘আন্টি, আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন, আমি আসছি।’
আমি বললাম, ‘তুই বোস, আমরা নাস্তা করে এসেছি।’
‘কেন নাস্তা করে এসেছো মামা?’
‘দেখলাম তোদের এখানে পৌঁছতে একটু দেরি হবে, তাই নাস্তাটা করে নিয়েছি।’
‘আন্টিকে নিয়ে এসেছ, খালি মুখে যাবে নাকি!’
আলপনা বলল, ‘আরেক দিন এসে খাব মা, আজ কিছুই খেতে পারব না।’
‘অন্তত চা-কফি কিছু খান আন্টি।’
‘বেশ, তা হলে চা দাও।’ বলল আলপনা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সোহিনী চা নিয়ে এসে আমাদের সামনে রাখল। বললাম, ‘তুই বোস, কথা আছে।’
সোহিনী আমাদের উল্টোদিকে সোফায় বসলে বললাম, ‘তোকে নিয়ে বিয়ের বাজার করতে যাব।’
‘কার বিয়ে?’ জানতে চাইল সোহিনী।
আমি একবার আলপনার দিকে তাকালাম, তারপর সোহিনীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমাদের।’
সোহিনী খানিকটা অবাক হয়ে তাকালো প্রথমে আমার দিকে, তারপর আলপনার দিকে, এরপর আবার আমার দিকে।
বললাম, ‘আমরা এই বয়সে বিয়ে করায় তোর আপত্তি নেই তো?’
‘না, না, আমার আপত্তি থাকবে কেন!’
আমি আবার বললাম, ‘বৃদ্ধাশ্রমেই আমাদের প্রথম দেখা, আলাপ। তারপর দুজনকে দুজনের ভালো লেগে গেল।’
সোহিনী বলল, ‘ভালো হয়েছে। শেষ বয়সে একা একা থাকার চেয়ে একজন সঙ্গী পাওয়ায় তোমাদের দুজনেরই সময়টা ভালো কাটবে।’
বললাম, ‘যা, তুই তৈরি হয়ে নে, আমরা বেরিয়ে পড়ি।’
আমরা প্রথমে গেলাম গাউছিয়া আর নিউ মার্কেটে। গোধূলিবাড়ির সকল বাসিন্দা, কর্মী আর স্থানীয় আমার কয়েকজন সুহৃদের জন্য পাঞ্জাবী এবং শাড়ি কিনলাম। বাঁধন, সোহিনী, সোহিনীর বর আর ওদের দুই ছেলের জন্যও নিলাম। আলপনার জন্য কিনলাম বেশ কয়েকটা শাড়ি। ওখান থেকে কেনাকাটা শেষে রওনা হলাম শাঁখারী বাজারের উদ্দেশে। যেতে যেতে সোহিনীকে বললাম, ‘তোকে আরেকটা কাজ করতে হবে মা।’
‘কী কাজ?’
‘বাসাটা ধুলোবালিতে ভরে আছে, চাবিটা তোর কাছে দিয়ে যাব। তুই দুটো কাজের মেয়ে নিয়ে একদিন বাসাটা পরিস্কার করে দিবি। আমি পাশের ফ্ল্যাটের এক ভাবি আর তার ছেলের বউকে বলে এসেছি, ওরা ওদের কাজের মেয়েকে বলে একদিনের জন্য দুটো কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করে দেবে।’
‘অসুবিধা নেই। কবে যেতে হবে তুমি বোলো। ভালো হবে তোমরা বাসায় চলে এলে, আমার একটু যাওয়ার জায়গা হবে।’
‘আমরা যখন ঢাকায় আসব, নিশ্চয় তোরা বাসায় আসবি।’
‘যখন আসবে মানে? তোমরা এখানে থাকবে না?’
‘না। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি গোধূলিবাড়িতেই থাকবো। মাসে হয়ত পাঁচ-ছয়দিন এখানে কাটিয়ে যাব।’
আমরা প্রথমে ইসলামপুরে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম, গরম গরম বিরিয়ানী। তারপর ঢুকলাম শাঁখারীবাজারে। শাঁখারীবাজার ঘুরে ঘুরে কিনলাম বিয়ের ধুতি-শাড়ি থেকে শুরু করে যাবতীয় জিনিসপত্র। আলপনার খুব পছন্দের অলঙ্কার শাঁখা কিনলাম চার জোড়া, বিধবা হবার পর ওর শাঁখা পরতে না পারার আক্ষেপ কিছুটা হলেও পুষিয়ে দেবার জন্য। কিছু স্বর্ণের গহনাও কিনলাম। এসব কিনতে কিনতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। সোহিনীকে বাসায় নামিয়ে দিতে গেলে ও জোর করেই আবার আমাদেরকে বাসায় নিয়ে গেল, সন্ধ্যার জলখাবার না খেয়ে যেতে দেবে না। আমাদের জলখাবার খেতে খেতে জামাইও চলে এলো অফিস থেকে। সোহিনী-ই তাকে সব খুলে বলল। আমি জামাইকে অনুরোধ করলাম যেন সোহিনী এবং দাদুভাইদের নিয়ে বিয়েতে যায়। জামাই কথা দিল যে সে বিয়েতে অবশ্যই যাবে। আমাদের বিয়ের কথা শুনে ওদের দুই ছেলেও খুব খুশি হলো, সোহিনীর প্রভাবে ছেলেরা আধুনিক চিন্তাধারায় বেড়ে উঠছে। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম প্রথম বিয়ের কথা, তখন আমাকে বিয়ের বাজার করতে হয়নি, মানে আমাকে বাজার করার সুযোগই দেওয়া হয়নি। বিয়ের বাজারের আমি কী বুঝি! বিয়ের বাজার করেছিলেন বাবা আর দাদা। তাদের পছন্দ করে কেনা ধুতি-পাঞ্জাবীতেই আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। বিয়ের জন্য তপতীর যে শাড়িটা কেনা হয়েছিল, সেটা তপতীর পছন্দ হয়নি। এর জন্য তপতী বিয়ের পর বহুবার আমাকে কথা শুনিয়েছিল। সত্যি বলতে কী আমারও পছন্দ হয়নি বিয়ের শাড়িটা। কিন্তু এসব নিয়ে কিছু বলতে গেলে বাবা তখন লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাতেন! তপতী তো তবু আমাকে এবং আরও অনেকেই বলেছিল যে বিয়ের শাড়ি ওর পছন্দ হয়নি। কিন্তু আমি তো আজও পর্যন্ত কাউকেই বলতে পারিনি যে বিয়ের পাঞ্জাবী, জুতো, এমনকি মাথার মুকুটটাও আমার রুচির সঙ্গে মানানসই নয়; আমার পছন্দ হয়নি!
তিহাত্তর বছর বয়েসে এবার বিয়ের পিঁড়িতে বসব নিজের পছন্দ করা ধুতি-পাঞ্জাবী পরে, আলপনাও নিজের পছন্দ করা শাড়ি পরবে। রাত্রির অন্ধকারে গাড়িতে বসে ঢাকা ছেড়ে, গাজীপুর শহর ছেড়ে গ্রামের কুয়াশামাখা পথে গোধূলিবাড়ি’তে ফিরতে ফিরতে আমি যখন অতীত-বর্তমানের এইসব নিয়ে ভাবছি, তখন আমার বাম হাতখানা নিজের দু-হাতের মধ্যে নিয়ে সারাদিনের ক্লান্তিতে আমার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে আলপনা।
(চলবে........)
৩০ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১:৩৬
মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। পাঠপ্রিয়তা পেলে নিশ্চয় ভালো লাগবে। তবে এখন আর আমি খুব বেশি আশা করি না। লিখে আনন্দ পাই, বাঁচার অনুপ্রেরণা পাই, কাল আর মানুষের কথা লিখে রেখে যেতে চাই, তাই লিখি।
©somewhere in net ltd.
১| ২৯ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১:০৬
রাজীব নুর বলেছেন: প্রতিটা পর্বেই কিছুটা চমক আছে।
এই উপন্যাস পাঠকপ্রিয়তা পাবে।