নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: শেষ পর্ব)

৩১ শে আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৩:৪৭

শোকগ্রস্ত গোধুলিবাড়ি’র পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে আবার শুরু হলো বিয়ের তোড়-জোড়। যেহেতু কিছু কার্ড বিতরণ হয়ে গেছে তাই বিয়ে পিছাতে চাইলো না বাঁধন। কার্ড পাঠানো হয়েছে বাঁধনের বন্ধু-বান্ধবদের, আশ-পাশের গ্রামের দু-চারজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকেও। মানুষ যখন কোনো কিছু পায়, তখন সেই পাওয়ার আনন্দে প্রায়ই যুক্ত হয় কিছু হারানোর বেদনা, আনন্দের ভেতরে মিশে থাকে যাতনা, তাকে বয়ে যেতে হয় আজীবন। আমারও তেমনি হলো সখা পরান বাউলকে হারিয়ে।

বিয়ের আগের দিন দুপুরের পর আমার আর আলপনার গায়ে হলুদ হলো একসঙ্গে, বেণুদির তত্ত্বাবধানে সবাই আমাদের গায়ে হলুদ মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিলেন। আমি কিছুটা লাজুক থাকলেও আলপনা ছিল এমনই সাবলীল যেন একুশ বছরের পরিণত কনে সে! লাল পেড়ে হলুদ রঙের শাড়িতে, গাঁদা ফুলের মালায় সজ্জিত আলপনাকে সত্যিই ভারী সুন্দর লাগছিল! ওর বয়স যেন এক ঝটকায় কমে গিয়েছিল দশ বছর! পশ্চিমা দেশগুলোতে বুড়ো-বুড়ির বিয়ে বিরল ঘটনা না হলেও আমাদের দেশে বিরলই বটে! বিয়েটা এমন ঘটা করে হোক তা আমি চাইনি। কিন্তু বাঁধন আর গোধূলিবাড়ি’র বাকি সবাই ঘটা করেই আয়োজন করতে চাইল। সবার উৎসাহে আমি আর না করতে পারিনি।

বিয়ের আয়োজনে কোনো কমতি রাখেনি বাঁধন, গোধূলিবাড়ি’র বাসিন্দা আর কর্মীরা, গায়ে হলুদের দিনই সারা গোধূলিবাড়ি বাতি দিয়ে সাজানো হলো, বিয়ের দিন প্রায় ষাটজন জন নিমন্ত্রিত অতিথি আসবে, তার জন্য ছিল সবরকম পূর্ব-প্রস্তুতি।

গায়ে হলুদের পর আলপনা আমার ঘরে এলো একজোড়া শাঁখা নিয়ে। শাঁখাজোড়া আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘নাও, তুমি নিজহাতে আমায় শাঁখা পরিয়ে দাও।’
আমি ওর হাত ধরে আমার বিছানায় বসালাম, তারপর ওর হাত থেকে শাঁখাজোড়া নিয়ে দু-হাতে পরিয়ে দিলাম। আলপনা হাতদুটো মুখের সামনে তুলে ধরলো, দুটো সোনার বালার সাথে লেপ্টে থাকা শাঁখাদুটোর দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর শাঁখা পরতে না পারার আক্ষেপ দূর হলো, দু-চোখ ভিজে উঠল, ডানচোখ থেকে গড়িয়েও নামল অশ্রুধারা। ওর আবেগ আমাকেও সংক্রামিত করল, আমার চোখও কিছুটা ঝাপসা হয়ে এলো। আমি ওর কপোলে গড়িয়ে নামা অশ্রুধারা হাত দিয়ে মুছে দিয়ে বললাম, ‘এমন আনন্দের দিনে কাঁদতে নেই।’

বলেই আলপনার কপালে আলত চুম্বন করলাম। ও আমার বুকে মাথা গুঁজে দিল, আমি ওকে বাহুডোরে বাঁধলাম।

অন্যদিনের মতোই বিকেলবেলা পুকুরপাড়ের বেঞ্চে বসে উল আর কাঁটা দিয়ে একটা সোয়েটার বুনছিল আলপনা। প্রতিদিন তো আমি ওর পাশে গিয়ে বসি, তন্ময় হয়ে ওর সোয়েটার বোনা দেখি, গল্প করি, গান-কবিতাও হয়। কিন্তু সেদিন ওর পাশে গিয়ে বসতে আমার লজ্জা লাগছিল, হাজার হোক আমরা বিয়ের পাত্র-পাত্রী বলে কথা! তবু আমি ওর পাশে গিয়ে বসার ইচ্ছে আর ওর অনুভূতি শোনার কৌতুহল দমন করতে পারলাম না। জুঁইকে ঘাড়ে নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আবার সোয়েটার বোনায় মন দিল।

আমি বললাম, ‘আজ আমাদের গায়েহলুদ হলো, কেমন লাগছে তোমার? মানে, পাত্রী হিসেবে অনুভূতি কেমন?’

ও আবার হাসলো, ব্যস্ত হাত থেমে গেল, তারপর পুকুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি বলতে কী উনিশ বছর বয়সে আমার যখন বিয়ে হয়, তার চেয়ে অনেক ভালো। তখন কেমন ভয় ভয় করছিল। ভেতরে দ্বিধা ছিল, আমি সঠিক মানুষকে বিয়ে করছি তো? আশঙ্কা ছিল যে স্বামী কেমন হবে, শ্বশুর-শাশুড়ি কেমন হবে, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সবার মন যুগিয়ে চলতে পারব কি না, সবাই আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে কি না ইত্যাদি। এক ধরনের মানসিক চাপ আর কেমন একটা ঘোরের মধ্য দিয়েই বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু এখন কোনো দ্বিধা নেই, আশঙ্কাও নেই। একেবারে নির্ভার-নিশ্চিন্ত।’
বললাম, ‘আমিও যদি অত্যাচারী স্বামী হই?’

ও শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে আমার হাত ধরে বলল, ‘এই বয়সে আর কী অত্যাচার করবে তুমি! আর ওসব তোমার স্বভাবেই নেই তা বুঝেই তো তোমায় বিয়ে করছি, নইলে এই বুড়ো বয়সে ঘাড়ে বিয়ের ভূত চাপে!’

জুঁই ঘাড় থেকে লাফিয়ে আমার থাইয়ের ওপর নামল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আজ থেকে চুয়াল্লিশ বছর আগে যদি তোমার আর আমার পরিচয় হতো, পরিণয় হতো, তাহলে আমাদের জীবনটা কী সুন্দরই না হতো। দুজনকেই ভুল বিয়ের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হতো না। জীবনটা হয়ত অন্যরকম হতো, সংসার জীবনে হয়ত দুজনেই সুখী হতাম। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য তা হয়নি। পৃথিবীতে প্রতিদিন এরকম কত-শত ভুল বিয়ে হচ্ছে, সংসারে অশান্তি হচ্ছে তবু অনেকে সংসার করে যাচ্ছে, আবার অনেকে সম্পর্ক ভেঙে বেরিয়েও আসছে। অথচ জীবনে সঠিক মানুষটি পেলে এসব হতো না।’

আলপনা শুষ্ক হাসি দিয়ে বলল, ‘সবাই সঠিক মানুষটি পেলে পৃথিবীটা একঘেয়ে হয়ে যাবে, দাম্পত্য জীবনে কোনো দুঃখ-বেদনা থাকবে না। প্রকৃতি বোধ হয় তা চায় না। হয়ত প্রকৃতিও চায় জীবের মধ্যে কিছু ব্যথা-বেদনা থাকুক।’
‘কী জানি প্রকৃতির কী খেয়াল, মানুষকে কষ্ট দিয়ে প্রকৃতির কী সুখ!’

আলপনা উল-কাঁটা রেখে আমার ডান হাতখানা নিজের দুই হাতের নিয়ে মধ্যে নিয়ে বলল, ‘যাক, তবু শেষ বয়সে এসে দাম্পত্য জীবনে একটু অন্যরকম সুখের দেখা পেতে চলেছি, এটাই জীবনের পরম পাওয়া!’

বললাম, ‘বিয়ের পর চলো ঢাকায় যাই। তারপর ভিসা করে ইন্দোনেশিয়ার বালিদ্বীপ থেকে ঘুরে আসি।’
আলপনা হেসে বলল, ‘হানিমুন?’
‘গায়েহলুদ হলো, কালকে বিয়ের পিঁড়িতে বসব, হানিমুন আর বাদ থাকবে কেন!’
আলপনার চোখে জল এলো, বাম হাত দিয়ে জল মুছে বলল, ‘তোমার সঙ্গে দেখা না হলে এই জীবনে বুঝতেই পারতাম না বেঁচে থাকা এত সুখের, এত আনন্দের।’

আমি আলপনার ডানহাতের পাতায় চুম্বন করলাম। সে কয়েক নিমেষ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর পুকুরের ওপর দিয়ে দৃষ্টি রেখে গাইতে শুরু করল তার কণ্ঠে বেশ কয়েকবার শোনা চণ্ডীদাসের পদ-
‘পিরীতি পিরীতি কী রীতি মূরতি
হৃদয়ে লাগল সে।
পরাণ ছাড়িলে পিরীতি না ছাড়ে,
পিরীতি গড়ল কে?’

তখন মাঘের শুরু, বিকেল থেকেই কুয়াশা পড়তে শুরু করে, আর অন্ধকার নামার পর কুয়াশা আরও ঘন হতে থাকে। সেদিনও রক্তিম সূর্যটা হেলে পড়ল রোজকার মতোই পিঠের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোধূলিবাড়ি’তে গোধূলি নামবে। আমার গায়ে ছিল আলপনার বোনা সেই খয়েরি রঙের সোয়েটারটা। কী যেন এক অপার্থিব মায়া সোয়েটারটায়, সারাক্ষণ সেটাই গায়ে দিয়ে থাকতে ইচ্ছে করত, মনে হতো আলপনা আমায় জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা দিচ্ছে!

জুঁই কখনও আমার কোলের মধ্যে গড়াগড়ি দিতে লাগল, কখনও আলপনার কোলে গিয়ে উঠল। আলপনাও খুব ভালোবাসে জুঁইকে, যত্ন করে মাছ দিয়ে ভাত মাখিয়ে খাওয়ায়। হঠাৎ রাস্তা দিয়ে ধুলো উড়িয়ে একটা প্রাইভেট কার ঢুকলো গোধূলিবাড়ি’তে। আলপনা তখন চণ্ডীদাসের পদটুকু দ্বিতীয়বার গাইছে। আমি তার মধুমাখা সুর শুনতে শুনতে তাকিয়ে দেখলাম গাড়ি থেকে দুজন পুরুষ আর একজন নারী নামলো। তারা গাড়ি থেকে নেমে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বারান্দার বেঞ্চে বসে ছিলেন ক্যাপ্টেন। তারা ক্যাপ্টেনের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।
আলপনা বলল, ‘চণ্ডীদাসের এই পদখানা গাইতে কী যে ভালো লাগে!’
বললাম, ‘তোমার কণ্ঠে শুনতেও দারুণ লাগে!’
আলপনা হেসে বলল, ‘আমি যা-ই গাই, তাই তোমার দারুণ লাগে বলো!’
‘ওমা ভালো লাগলে বলব না!’
‘এ তোমার মোহ!’
‘কী জানি, তবে এই শেষ বয়সে এসে খানিকটা মোহ-মায়ার ঘোরে কাটল-ই বা, মন্দ কী!’

ক্যাপ্টেন হাত উঁচিয়ে আমাদেরকে দেখালে তারা তিনজন আমাদের দিকে এগোতে লাগলো। একেবারে আমাদের কাছে চলে আসায় আমি কথা বলা বন্ধ করলাম। পায়ের শব্দ শুনে আলপনা তাদের দিকে তাকাল, ওর মুখে কিছুটা বিব্রতভাব ফুটে উঠল। আমি এদের কাউকেই আগে কখনও দেখিনি। কিন্তু তাদের চেহারা দেখেই কেন যেন অনুমান করতে পারলাম যে এরা কারা।

তারা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালে আলপনা তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতে বলল, ‘এ আমার মেজোছেলে অলক, ও ছোটছেলে পুলক। আর এ আমার মেয়ে পরমা।’

অলকের বয়স বছর চল্লিশের কাছাকাছি হবে, পরমা মধ্য ত্রিশের, আর পুলকের বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ।
সত্যি বলতে কী আমিও বেশ বিব্রতবোধ করলাম। তবু স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললাম, ‘ভালো আছো তোমরা?’

আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না ওরা। শুধু অলক ছেলেটা একটিবার তাকালো আমার দিকে। এতদিন আলপনা গোধূলিবাড়ি’তে এসেছে, এই সময়ে সে একবারের জন্যও বাড়িতে যায়নি, সন্তানরাও কখনও মাকে দেখতে আসেনি। ওরা যে বিয়ের সংবাদ জেনেই এসেছে, সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকে না আমার। কিন্তু বিয়ের সংবাদ ওরা জানল কী করে তা আমার বোধগোম্য হলো না। আমি নিশ্চিত ওরা আমাকে দেখেই অনুমান করেছে যে- আমিই বিয়ের পাত্র।
অলক আলপনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এসব কী শুরু করেছো তুমি?’

আলপনা নীরবে ছেলের মুখের দিকে তাকালো। এবার পরমা বললো, ‘চুপ করে আছো কেন? এই বুড়ো বয়সে ভীমরতি হলো কেন তোমার? এইসব করার জন্যই কি তুমি সংসার ছেড়ে এখানে এসেছো?’
পরমার গলা সৌজন্যতার মাত্রা ছাড়ানো। আলপনা বলল, ‘গলা নামিয়ে কথা বলো। এটা তোমাদের বাসা নয়।’
অলক কথা বলল, ‘ওঠো, তোমার জিনিসপত্র কিছু নেবার থাকলে নিয়ে এসো, তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে।’
‘কোথায়?’ আলপনার স্বাভাবিক শান্ত গলায় প্রশ্ন করল।
পরমা রাগত স্বরে বলল, ‘কোথায় তুমি জানো না? ন্যাকা সাজছো?’
এবার আলপনা একটু কঠিন গলায় বলল, ‘সংযতভাবে কথা বলো। এখানে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন।’

একটু থেমে আলপনা আবার স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘দ্যাখো, আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারলাম যে আমি তোমাদের সংসারে অতিরিক্ত একজন। তারপরও আমি থাকার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু…।’

আলপনার কথা শেষ না হতেই অলক বলল, ‘আমরা তো তোমাকে তাড়িয়ে দিইনি। তুমি যদি বউদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারো…।

অলকের কথা শেষ না হতেই আলপনা বলল, ‘আমি কাউকে দোষ দিচ্ছি না, না তোমাদেরকে, না তোমাদের বউদেরকে। হয়ত আমারই ব্যর্থতা যে আমি আধুনিক বা অগ্রসর মনস্ক নই, সাংসারিক কাজেও আমার অদক্ষতা থাকতেই পারে, একারণে বৌমাদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারিনি, তাই তোমাদের সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি। তোমাদের নিজস্ব জীবন-যাপনের স্রোতে আমি বাধা হয়ে দাঁড়াতে চাইনি কখনো, তোমাদের বিড়ম্বনায়ও ফেলতে চাইনি।’

অলক বলল, ‘তুমি যা করতে যাচ্ছো, আমাদের জন্য এর চেয়ে বড়ো বিড়ম্বনার আর কী হতে পারে! আমাদের সম্মানের কথা একবারও ভাবলে না?’

আলপনা ঠোঁট টিপে শুষ্ক হাসি দিয়ে বলল, ‘দিনের পর দিন বৌদের কাছে মাকে অপমানিত হতে দেখে তোমাদের সম্মান যায়নি; সুস্থ-কর্মক্ষম মাকে বাড়ি ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিতে হয়েছে, তাতেও তোমাদের সম্মান যায়নি; এখন মা যখন তার বন্ধুস্থানীয় একজনকে জীবনসঙ্গী করতে চাইছে, তাতে তোমাদের সম্মান যাচ্ছে!’
পরমা বলল, ‘এত কথা শুনতে চাই না, তুমি এখনই আমাদের সঙ্গে যাবে।’

আলপনা বলল, ‘একটা কথা কী জানো, আমার এই জীবনটা দীর্ঘ নয় বছর ছিল তোমাদের ঠাকুমা-ঠাকুরদা আর বাবার নিয়ন্ত্রণে। তারা যেভাবে চালিয়েছেন আমি সেভাবেই চলেছি। তারপর আমার জীবনটা হয়ে যায় তোমাদের চার ভাই-বোনের। তোমাদের একটা সুন্দর জীবন দিতে নিজের জীবন নিঙড়ে দিয়েছি আমি। আমার জীবনে আমি কোথাও ছিলাম না। তাই এখন আমি চাইছি যে ক’টা দিন বাঁচি, আমার জীবনটা আমার-ই থাকুক।’
‘তার মানে তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে না?’ ঝাঁঝিয়ে উঠল পরমা।

‘যাব না, সে কথা তো আমি একবারও বলিনি! এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। হ্যাঁ, একটা বোঝাপড়াও হয়েছে। তোমাদের বাবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এই ভদ্রলোক এত সময়ে আমাকে যতটুকু বুঝতে পেরেছেন, তোমাদের বাবা দীর্ঘ নয় বছরে তার এক ভাগও আমাকে বুঝতে পারেননি। তোমরা আমাকে নিয়ে যেতে চাইলে, ওনার সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেও আমি যেতে পারি। কিন্তু তাতে কি সব সমস্যার সমাধান হবে? হবে না, আমি যেমনি অবাঞ্ছিত ছিলাম তোমাদের সংসারে, তেমনি থাকব। আমার মনে হয় তোমরা তোমাদের মতো থাকো, আমি আমার মতো থাকি; সেটাই ভালো হবে।’

আলপনার মুখ থেকে নিজের সম্পর্কে এমন কথা শুনে আমি আবেগাক্রান্ত হচ্ছিলাম। কোনোমতে নিজেকে সামলে পুকুরের অপর পাড়ের কদমগাছের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

এবার পুলক বলল, ‘মা তুমি ওঠো, আমাদের সাথে চলো। আমি স্বীকার করছি যে আমাদেরও কিছু ভুল হয়েছে। কথা দিচ্ছি আমরা তা শুধরে নেবার চেষ্টা করব। তবু তুমি আমাদের সম্মানের কথা ভাবো।’

মনে হলো অলক আর পরমার মতো রাগী নয় পুলক। খুব শান্ত কণ্ঠেই কথাগুলো বলল সে।

আলপনা বলল, ‘তোমরা এমনভাবে কথা বলছ যেন আমি বিরাট বড় কোনো অপরাধ করতে চলেছি, যার জন্য তোমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছ। বিয়ে করা তো কোনো অপরাধ নয়, প্রত্যেকেরই সেই স্বাধীনতা রয়েছে।’
পুলক আলপনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আলপনার দু-হাত ধরে বলল, ‘প্লিজ মা, আমাদের অপরাধ ক্ষমা করে তুমি আমাদের সঙ্গে চলো। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার আর কোনো অসম্মান হবে না।’

আলপনা কয়েক মুহূর্ত পুলকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বেশ নরম স্বরে বলল, ‘হাত ছাড়ো পুলক, উঠে দাঁড়াও। আমি উঠতি বয়সের যুবতী না যে পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করার জন্য হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে বসব। আমি কখনো নিজের জন্য কিচ্ছু চাইনি, সবসময় তোমাদের চাওয়াই পূরণ করেছি।’

পুলক তবু আলপনার হাত ধরেই রইল, আলপনার হাঁটুতে মাথা ঠেকালো। আলপনা অসহায়-দ্বিধাগ্রস্থ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালে আমি বললাম, ‘আমরা সন্তান জন্ম দিয়েছি, তাই দায়-দায়িত্ব আমাদেরই বেশি। সন্তানদের সুখের জন্য পিতা-মাতার অনেক চাওয়া-পাওয়া, সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হয়। সারাজীবন ত্যাগ করতে হয়। তুমি ওদের সঙ্গে যাও।’

আলপনা আমার মুখের দিকে তাকিয়েই রইল। আমি বুঝতে পারলাম যে সে শান্ত থাকার চেষ্টা করলেও, তার ভেতরে তখন কেমন তোলপাড় করা ঝড় বইছে। আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের হাঁটু থেকে পুলকের মাথা তুলে ধরে বলল, ‘তোমরা গাড়িতে যাও, আমি আসছি।’

ছেলে-মেয়েরা আর কোনো কথা না বলে গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। আলপনা কয়েক নিমেষ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে, তারপর আমার দিকে চোখ ফেরালো, সে-চোখে তাকানো যায় না, শুষ্ক চোখ, তবু যেন ঝড় বইছে, মরুঝড়! তাকালে কষ্টে ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। সে আমার বাম হাতটি ধরে বলল, ‘জীবনে নিজের করে কিছু পাওয়া আমার কপালে নেই। মাঝখান থেকে তোমাকে বিড়ম্বনায় ফেললাম। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। আমাকে ক্ষমা করে দিও।’

আমি ওর হাতের ওপর আমার ডান হাতখানা রেখে বললাম, ‘ক্ষমা চেয়ে আমাকে অপরাধী কোরো না। তোমার তো কোনো দোষ নেই, দোষ আমাদের ভাগ্যের। ওই যে তুমি বলছিলে না- প্রকৃতি বোধ হয় চায় না সবাই সবকিছু পাক, প্রকৃতিও চায় জীবের মধ্যে কিছু ব্যথা-বেদনা থাকুক। আমরা তো প্রকৃতিরই সন্তান, থাকল না হয় আমাদের কিছু ব্যথা-বেদনা।’

আলপনা একটুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘তুমি শরীরের দিকে খেয়াল রেখো, সময় মতো ওষুধ খেয়ো। আর মাঝে মাঝে ঢাকা গিয়ে শরীরটা পরীক্ষা করিয়ে নিও।’
‘আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। আমি এখানে ভালোই থাকবো। আমার চিন্তা হচ্ছে তোমাকে নিয়ে। আবার যদি তোমাকে অসম্মানিত হতে হয়।’
ঠোঁট টিপে শুষ্ক হাসি দিয়ে আলপনা বলল, ‘তুমি চিন্তা করো না, অপমান-অসম্মানে আমার অভ্যেস আছে। কদিন-ই বা আর বাঁচবো!’
তারপর আমার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ফোন কোরো।’
‘করবো।’
‘জানি না এ জীবনে আর তোমার দেখা পাবো কি না! ভালো থেকো।
‘তুমিও ভালো থেকো।’

তারপর আলপনা আমার হাত ছেড়ে জুঁইয়ের মাথায় আদর বুলিয়ে বেঞ্চ থেকে উঠে সামনের দিকে পা বাড়াতেই আমি আবার বললাম, ‘শোনো।’
ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো।’
‘তুমি জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস করো?’
আলপনা বলল, ‘কখনো ভেবে দেখিনি। তবে জন্মান্তবাদ যদি সত্যিও হয়, মানুষ হয়ে আর জন্মাতে চাই না।’
‘আমি জন্মান্তরবাদ বিশ্বাস করি না। তারপরও জন্মান্তরবাদ যদি সত্য হয়ে থাকে, তুমি একটা সাদা পাখি হয়ে জন্ম নিও, আমি ধূসরপাখি হয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’

আলপনা মুখ টিপে মৃদু হাসতে চেষ্টা করে মাথা নাড়ল, চোখে তার বাঁধে আটকা থই থই জল। আবার পা বাড়াল সামনে দিকে।

ঘর থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে আলপনার একটু সময় লাগল, আমি যেমনি বসে ছিলাম, তেমনিই বসে রইলাম। জুঁই আমার কোল থেকে আবার বাম কাঁধে চড়ে বসল। গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে যেমনি এসেছিল, তেমনি গোধূলিবাড়ি ছেড়ে উঠে পড়লো রাস্তায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের আড়ালে চলে গেল। গোধূলিবাড়ি’তে গোধূলি নামল, পশ্চিম দিগন্তে শুকতারাটি দারুণ হেসে উঠলো। আমি বেঞ্চে বসেই রইলাম শরীরে কাঁচা হলুদের গন্ধ নিয়ে। পাখিরা সব নীড়ে ফিরল। কিন্তু একটা সাদাপাখি আর একটা ধূসরপাখি উড়তেই থাকল আমার কল্পনার আকাশে, আমার কানে বাঁজতে লাগল আলপনার গাওয়া চণ্ডীদাসের পদ-
‘পিরীতি বলিয়া এ তিন আঁখর
না জানি আছিল কোথা!
পিরীতি কণ্টক হিয়ায় ফুটিল,
পরাণপুতলী যথা।’


রচনাকাল: ২০২৩



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ৯:৫৩

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: যদিও শেষটা দিয়েই শুরু...
তবু দারুন লাগলো।

জীবনের শেষবেরার কষ্টগুলো বুঝি এমনই হয়। সুখের পান্সী তীরে ভিড়তে না ভিড়তেই আবার সমুদ্দুরে অজানায় বেসে যায়!

ভাল লাগলো।

+++

৩১ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:০১

মিশু মিলন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

২| ৩১ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১০:২২

রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর একটা উপন্যাস হয়েছে।
প্রথম পর্ব থেকেই আমি এই উপন্যাসের সঙ্গে ছিলাম। পড়েছি। ভালো লেগেছে। বই আকারে বের হবার পর আবার পড়বো।

৩১ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ১১:০৩

মিশু মিলন বলেছেন: শুরু থেকে সাথে থেকে অনুপ্রেরণা দেবার জন্য ধন্যবাদ। অনেক অনেক ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.