নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
কলকাতার যাদবপুরনিবাসী কুতকুতি ভট্টাচার্য: এই ফুটকি, ফেবুতে দেখলাম তুমি বাংলাদেশে গিয়েছিলে, কয়দিন ছিলে?
কলকাতার মানিকতলানিবাসী ফুটকি আচার্য: তিনদিন ছিলাম ঢাকায় আর একদিন কক্সবাজার। জানো কুতকুতি, কী অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওরা এত ভালো, এত আন্তরিক আর অতিথিপরায়ণ তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আমি আমার বন্ধু ছগদুলের বাসায় ছিলাম, মনেই হয়নি যে আমি অন্য দেশে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন ওরা আমার কতদিনের আত্মীয়! ছগদুল আমাকে আমার দিদার বাড়ি দ্যাখাতে নিয়ে গিয়েছিল বিক্রমপুরে। সেই বাড়িতে যে মুসলিম পরিবারটি থাকে, তারাও কত খাতির করেছে! বলে কিনা নিজের বাড়ি মনে করে যখন খুশি চলে আসবেন!
কুতকুতি ভট্টাচার্য: তিন বছর আগে আমি যখন গিয়েছিলাম গান গাইতে, আমারও তেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল গো। সে কী খাওয়া-দাওয়া মাইরি। ওরা খুব খাওয়াতে ভালোবাসে গো।
ফুটকি আচার্য: হ্যাঁ গো, আমার তো দেড়-কিলো ওজন বেড়ে গেছে। এবেলায় সর্ষে ইলিশ, কই মাছ, রূপচাঁদা ফ্রাই তো অবেলা খাসির মাংস-কাতল মাছ!
কুতকুতি ভট্টাচার্য: আমার বন্ধু কোকিলা কুলসুমও আমাকে দারুণ খাইয়েছিল, সারা ঢাকা শহর ঘুরিয়েছিল! ওরা শুটকি ভর্তাটা যা করে না, ফাটাফাটি। এই গাণ্ডুশ্বর তুমি না গত বছর গিয়েছিলে?
বেহালানিবাসী গাণ্ডুশ্বর বসু: হ্যাঁ গিয়েছিলাম, খাওয়া-দাওয়ার কথা আর কী বলব। আমি ছিলাম ঢাকা ক্লাবে। সন্ধ্যার পর লেখক-সাংবাদিক বন্ধুরা আসত, রাজকীয় খাবার-দাবার থাকত। আর মদের সরোবরে সাঁতরাতাম! এছাড়া দুপুরে এবন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ, রাতে ওবন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ তো ছিলই। গন্ধ-ও তো গতবছর গিয়েছিল বইমেলায়।
নিউটাউননিবাসী গন্ধশ্বর মুখুজ্যে: সত্যিই সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা, ওদের আন্তরিকতার কোনো তুলনা হয় না, অমায়িক ব্যবহার সবার! বিকেলবেলা বইমেলার স্টলে মানুষের ভিড় লেগে যেত আমার অটোগ্রাফ নেবার জন্য, আমার সাথে ছবি তোলার জন্য। দৃশ্য দেখে আমার চোখে জল এসে যেত। ব্রিটিশরা চক্রান্ত করে দেশভাগ করেছে ঠিকই, কিন্তু দুই বাংলার মানুষদের, হিন্দু-মুসলমানদের ভাগ করতে পারেনি। মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান!
কুতকুতি ভট্টাচার্য: সত্যিই তাই! চাড্ডিরা মিথ্যে প্রোপাগান্ডা ছড়ায় বাংলাদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মুসলিমরা ভীষণ অসাম্প্রদায়িক। ওরা মন্দির পাহাড়া দেয়।
গন্ধশ্বর মুখুজ্যে: চাড্ডিদের কাজ তো ওটাই, মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিভাজনের রাজনীতি করে। ভারতের মানুষ কবে যে সত্যিকারের মানুষ হবে!
আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা হয়ে থাকেন, তাহলে এই ধরনের কুতকুতি, ফুটকি, গাণ্ডুশ্বর, গন্ধশ্বররা আপনার চারপাশে আছে, আপনি এদের চেনেন। এদের মুখ থেকে আপনি এই ধরনের কথা শুনেছেন। আর আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তের বাঙালি-ই হোন না কেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদের দেখেছেন। এরা দু-চারদিনের জন্য বাংলাদেশে এসে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে গালভরা প্রশংসার সর্টিফিকেট দিয়ে থাকেন। বস্তুত বাংলাদেশের সমাজের নানাস্তর সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আরে ভাই, দু-দিনের জন্য আপনি আসেন বেড়াতে, আপনাকে আপ্যায়ন করবে না তো মারবে নাকি! সামান্য মানবিকতা যার মধ্যে আছে, তার বাড়িতে একটা কুকুর-বিড়াল এলেও তো সে আপ্যায়ন করে। ঢাকা বা চট্টগ্রামে বন্ধুর বাড়িতে বা হোটেলে দু-চারদিন থাকা মানেই পুরো বাংলাদেশ সম্পর্কে জানা নয়। বাংলাদেশে মৌলবাদের শিকড় কত গভীরে তা বুঝতে হলে এই দেশে বাস করতে হবে। তাহলেই বোঝা যাবে পড়শি হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে, সহযাত্রী হিসেবে এরা কেমন।
পশ্চিমবঙ্গের যারা বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে গালভরা প্রশংসার সার্টিফিকেট প্রদান করেন, খুব বেশিদিন নয় মাত্র তিনমাস এখানে এসে থাকুন। সমাজের নানাস্তুরের মানুষের সঙ্গে মিশুন। বাড়িওয়ালা, সরকারি-বেসরকারি অফিসের কর্তা-কর্মচারী, রিক্সাওয়ালা, সবজিওয়ালা, বাস ড্রাইভার-সুপারভাইজার, মুদি দোকানদার, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কাজের বুয়া, কামলা, হোটেলের বয় ইত্যাদি নানা শ্রেণির মানুষের চরিত্র সম্পর্কে জানতে পারবেন। এদের আচার-ব্যবহার কেমন তা জানতে পারবেন। এই শহরে যখন কোনো বাড়িওয়ালা আপনাকে বাড়িভাড়া দেবে না আপনি হিন্দু বলে, যখন কোনো রিক্সাওয়ালা মুখের ওপর বলবে- হিন্দু যাত্রী লই না, যখন কোনো বন্ধু আপনাকে মুসলমান হবার প্রস্তাব দেবে, যখন বন্ধু বা সহকর্মীরা আপনাকে মালু বলবে, তখন আপনার গালভরা প্রশংসার সার্টিফিকেটের বাক্যগুলো একই থাকবে তো?
বাংলাদেশে যখন হিন্দুদের ওপর বড় ধরনের কোনো হামলা হয়, তখন কোনো কোনো কুতকুতি কিংবা গাণ্ডুশ্বর বলে থাকেন যে- দুই দেশের মৌলবাদের চরিত্র একই রকম ভয়ংকর। এটা অতি সরলীকরণ এবং রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ইতিহাস জ্ঞানশূন্য নির্বোধ একটি বাক্য; অথবা ধুরন্ধর চিন্তা প্রসূত অভিসন্ধিমুলক একটি বাক্য। হয় সে পৃথিবীতে ইসলাম বিস্তারের ইতিহাস পড়েনি, অথবা পড়েছে কিন্তু বাজার নষ্টের শঙ্কায় এই ধরনের বাক্য বলে ভারসাম্য রক্ষা করে। পৃথিবীতে কমবেশি চার হাজার দুইশো ধর্ম আছে। এর মধ্যে চার হাজার একশো নিরানব্বইটি ধর্ম আর একটি সন্ত্রাসবাদী ও রাজনৈতিক মতবাদ। ইসলামকে আমি প্রচলিত ধর্মগুলোর মতো ধর্ম মনে করি না, কারণ ইসলাম প্রচলিত ধর্মের বৈশিষ্ট্য থেকে আলাদা। এই চার হাজার একশো নিরানব্বইটি ধর্মের মৌলবাদের ওজন ও ভয়াবহতা ইসলামের সমান নয়। ইসলামী মৌলবাদের কাছে পৃথিবীর কোনো ধর্মের মৌলবাদের তুলনা চলে না। ধর্মগুলোতে রয়েছে কুসংস্কার। অন্যদিকে ইসলামে সন্ত্রাসবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও রক্তপাত। কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মগুলো মানুষের যাপিত জীবনে তেমন প্রভাব ফেলে না। মানুষ স্বাধীন মতো চলতে পারে। ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায়, কিন্তু বলিউডে নায়িকাদের নাচতে অসুবিধা হচ্ছে না, গান গাইতে অসুবিধা হচ্ছে না, খেলাধুলা করতে কেউ বাধা দিচ্ছে না, সমুদ্র সৈকতে বিকিনি পরে ঘুরতে পারে নারীরা, নারীরা যেমন খুশি সাজতে পারে, হাট-বাজার করতে পারে। মানুষ পার্কে বা যেখানে-সেখানে প্রেম করতে পারে। সৌদি আরব, ইরান বা আফগানিস্তানে এসব সম্ভব? এইসব দেশে একজন শাবানা আজমির উত্থান সম্ভব? একজন সানিয়া মির্জার উত্থান সম্ভব? মোটেও না। ধর্মগুলোর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়, কিন্তু সংগঠিত সন্ত্রাসবাদী ও রাজনৈতিক মতবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা যায় না। সংগঠিত সন্ত্রাসবাদী ও রাজনৈতিক মতবাদের মানুষেরা নিজেদের বিশ্বাসের জন্য ভিন্ন মতাদর্শের মানুষকে খুন করে, জাতিগতভাবে নিমূল করে, সংস্কৃতি ও সভ্যতা ধ্বংস করে। বস্তুত ধর্মীয় মৌলবাদ আর সন্ত্রাসবাদী ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মৌলবাদ এক নয়।
ইসলামে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু নেই, আছে ইসলামী স্বাধীনতা। ইসলাম প্রতি পদে পদে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় বাধা দেয়, মানুষের মানবাধিকার কেড়ে নেয়, বিরক্তির উদ্রেক করে। ভোর থেকে রাত অব্দি মসজিদের মাইকে পাঁচবার উচ্চস্বরে আজান দিয়ে শব্দদূষণ করে মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত করে। এবং তাদের এই শব্দ দূষণের সময় বছরে পাঁচ-দশদিন যারা উৎসব করে, তাদের উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ রাখতে বাধ্য করে, অন্যথায় হামলা চালায়। রাস্তা বন্ধ করে নামাজ পড়ে, নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্সও যেতে পারে না। কোরবানির ঈদের সাতদিন আগে থেকে রাস্তা বন্ধ করে গরুর হাট বসায়। রোজার দিনে খাবারের হোটেল জোর করে বন্ধ করে দেয়। কাউকে রাস্তায় কিছু খেতে দেখলে নিপীড়ন করে। নাচ, গান, চিত্রকলা, ভাস্কর্য সব ধরনের শিল্পকলার বিরোধী ইসলাম। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করতে দেয় না হুজুররা। সারা দেশে বাউল ও মাজারপন্থীদের ওপর নিপীড়ন চালায়। কোনো শিল্পী মারা গেলে তার জাহান্নাম কামনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শিয়া এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালায় মাঝেমধ্যেই। ইসলাম বিবাহপূর্ব প্রেম এবং সবপ্রেমকে স্বীকৃতি দেয় না। একজন মানুষ কাকে ভালোবাসবে এরা তা ঠিক করে দিতে চায়। অনেক এলাকায় নামাজ পড়তে না গেলে যুবকদের শাস্তি দেয়। মাদ্রাসায় শিশুদের বালাৎকার করে। মোল্লারা এখন মাইকিং করছে- নারীরা বাজারে গেলে বিক্রেতারা যেন তাদের কাছে পণ্য বিক্রি না করে। কেন? কারণ ইসলাম এসব অনুমোদন করে না। ইসলাম নারীদের ঘরে থাকতে বলে, স্বামীর সেবা ও বাচ্চাদের লালন-পালন করতে বলে। বাজার করা বা কোনো ধরনের চাকরি করা ইসলামে নিষিদ্ধ। ইসলাম নারী নেতৃত্বও অনুমোদন করে না। এসবের বাইরে অমুসলিমদের ওপর হামলা, খুন, ধর্ষণ, জমি দখল সারাবছর লেগেই থাকে।
কুতকুতি কিংবা গাণ্ডুশ্বর, এরপরও কি আপনারা বলবেন, পৃথিবীর সব মৌলবাদ-ই এক, ভারত আর বাংলাদেশের মৌলবাদ মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ? যদি বলেন, তাহলে আপনারা বাংলাদেশে আসুন। মাত্র তিন মাস থাকুন। আসবেন?
৩ ডিসেম্বর, ২০২৪