নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনের ধ্বংসস্তুপেও স্বপ্নের বীজ বুনে যাই

২২ শে আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৫:০১




টুপি-পাঞ্জাবী পরা ছেলেটার নাম সিয়াম, মাদ্রাসায় পড়ে, মাধ্যমিক স্কুলেও ভর্তি আছে। বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ার দত্তপাড়ায় সাতআনী জমিদারবাড়ির কাছেই। সুনসান একটা গ্রাম, জমিদারবাড়ির পাশের রাস্তায় দাঁড়ালে কোনো বাড়ি দেখা যায় না, কেবল সবুজ মাঠ আর গাছপালা। মনে হয় যেন সেই কোন মহাভারতের যুগে আছি! এইসব গ্রাম পৌরাণিক উপন্যাস লেখার সময় আমার খুব কাজে লাগে। এইসব গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি পৌঁছে যাই সূদূর অতীতের পথে, হাজার হাজার বছর আগের সভ্যতায়। দূরত্ব দূরীভূত হয়, আমি সেই সভ্যতার মানুষের সঙ্গে মিশে যাই, তাদের একজন হয়ে যাই। লিখি তাদের যাপিত জীবনের কর্ম, ধর্ম, লড়াই, সুখ-দুঃখের কথা।

সাতআনী জমিদারবাড়ির ভবনগুলো গাছপালায় জঙ্গলাকীর্ণ, রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাতুল আর আমি জমিদারবাড়ির মূল ভবনগুলোর অবস্থান নিয়ে কথা বলতে বলতেই তিন রাস্তার মোড়ে সিয়ামকে পেয়ে যাই, তাকে জিজ্ঞেস করে সব জেনে নিই। সেও আমাদের সঙ্গে জমিদারবাড়িতে যায়। জমিদারবাড়ি সম্পর্কে নানারকম লোকগাঁথা, অন্ধবিশ্বাসের গল্প বলে। রাতুল ততক্ষণে জমিদারবাড়ির গহীনে হারিয়ে গেছে। আমি সামনের ভবন ও মন্দিরের ছবি তুলি, ভিডিও করি, আর সিয়ামের গল্প শুনি। ওর হাতে ক্যামেরা দিয়ে আমি সামনে দাঁড়িয়ে যাই। ওর ছবি তুলতে চাইলে বলে, ‘আমার ছবি তুলতে ভালো লাগে না।’

এই ভালো না লাগাটা যে ওর মাদ্রাসা শিক্ষার কারণে তা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। সিয়াম অতি ভদ্র এবং বিনয়ী ছেলে। পূর্বে যত মাদ্রাসার শিশুদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা ভদ্র এবং বিনয়ী। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, ছবি, ভাস্কর্য ইত্যাদি সিনেমা এসব বিষয়ে যখন নানা প্রশ্ন করেছি; তারা সরলতামাখা সত্য কথা বলেছে। জানিয়েছে এসব তারা পছন্দ করে না, হুজুররা নিষেধ করেছে। জিজ্ঞেস করেছি যে- ‘তোমাদের সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটার হতে ইচ্ছে করে না?’ কিংবা ‘অমুকের মতো সিনেমার নায়ক হতে ইচ্ছে করে না?’

তারা লাজুক হাসি দিয়ে একে-অন্যের দিকে তাকিয়েছে। আমি তাদের মাঝে স্বপ্ন বুনে দেবার চেষ্টা করেছি- তারা যে চাইলেই খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়ক, লেখক হতে পারবে সেই স্বপ্ন। তাদেরকে মাদ্রাসা ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হবার পরামর্শও দিয়েছি।

সিয়ামের ক্ষেত্রেও তাই করি, অনেক কথা বলি। মাদ্রাসা ছেড়ে কেবল স্কুলে পড়ার পরামর্শ দিই। মুফতি মাসুদকে চেনে কি না জানতে চাই, চেনে না। বলি- ‘মুফতি মাসুদ মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন, তার ভিডিও দেখবা ইউটিউবে-ফেসবুকে।’

সে জানায় যে তার বাটন ফোন। অনেক কথার শেষে কিছু কথা আবারও ‍পুনরাবৃত্তি করি, ‘শোনো, তোমার নিজের মনে যা ভালো লাগে তাই করবে, যা হতে ইচ্ছে করবে তাই হবে। শুধু অন্যের ক্ষতিসাধান করবে না, অপরাধমুলক কাজ করবে না। জীবন তোমার, কোনো ধর্মগুরু বা ধর্মীয় পুস্তক নয়, তোমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করবে না। এই যে তুমি ছবি তুলতে চাইছো না, তোমার এই ইনোসেন্ট বয়সটা কিন্তু আগামীতে থাকবে না। প্রতিদিন তোমার চেহারা একটু একটু করে বদলে যাবে। তাই ছবি তুলবে, জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি তুলে রাখবে, স্মৃতি ধরে রাখবে, বৃদ্ধ বয়সে এসব দেখবে আর স্মৃতিচারণ করবে।’

রাতুল এসে আমার আর ওর কথপোকথন শুনে একটা জটিল বাক্য বলে যাতে সিয়ামের বুঝতে অসুবিধা হয়, বাক্যের অর্থ এই দাঁড়ায় যে- ‘ভাই, আপনি মরুভূমিতে জলসিঞ্চনের বৃথা চেষ্টা করছেন!’

রাতুলকে বলি, ‘শোনো, আমি সবকিছুর মধ্যে সম্ভাবনা দেখি, সুপ্ত সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি। জীবনের ধ্বংসস্তুপেও স্বপ্নের বীজ বুনে যাই। তাতে যদি একজনও আলোর পথে আসে, সেখানেই সার্থকতা।’

ভাবুন তো-এককোটির উপরে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, কী বিপুল অপচয়, কত সম্ভাবনার অপমৃত্যু! স্কুলে পড়লে আর ধর্মের বিষ গ্রাস না করলে এদের কারো হাতেই হয়ত বেজে উঠত- সারোদ, সেতার, দোতারা, বাঁশির সুমধুর সুর! কেউ হয়ত লেখক হতো, কেউ বিজ্ঞানী, কেউবা গবেষক, কেউবা অভিনেতা বা খেলোয়াড়!

অথচ প্রতিভার কী অপমৃত্যু, জীবনের কী অপচয়। আজকের এই কোমলমতি শিশুরাই একদিন ভয়ংকর হায়েনা হয়ে উঠবে, কেউ কেউ শিশু বালাৎকার করবে, কেউ নারীদের পোশাক ও কর্মময় জীবন নিয়ে কটুক্তি করবে, কেউ চাপাতি হাতে তুলে নেবে, মানুষ হত্যা করতে একটুও হাত কাঁপবে না!

তারপরও সিয়াম নিজের ছবি তোলে না। আমাকে জমিদারবাড়িগুলো ঘুরে ঘুরে দেখায়, জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় আমার একটু ভয় ভয় লাগলেও সে আমাকে সাহস দিয়ে কয়েকটি ভবনের ছাদে নিয়ে যায়। ভিডিও ধারণ ও ছবি তুলে দেয়। আমার ভয় বলতে সাপের ভয়! শুনে ও বলে, ‘কিছু হবে না। আমি একা কত আসি। আমার আব্বা এই রাস্তা দিয়ে যাইতেই ভয় পায়, কিন্তু আমি একাই আসি, ভয় পাই না।’

ঘুরতে ঘুরতে একটা ভবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন নিচতলায় বিশাল এক গোখরা সাপের খোসা দেখতে পাই, আমি এগোতে সাহস না পেলে সে অভয় দিয়ে বলে, ‘কিচ্ছু হবে না, আসেন।’

বলি, ‘তুমি একা এই বাড়ির ভেতরের দিকে আর এসো না।’

সে বলে, ‘আমার কিছু হবে না। সাপ আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’

সে জ্বীনে বিশ্বাস করে, তাবি-কবজে বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাসের জোরেই তার এত সাহস। বলি, ‘শোনো, জ্বীন বলে কিছু নেই, তাবিজ-কবজেও কোনো কাজ হবে না। সাপ কামড়ালে এখান থেকে হাসপাতালে নেবারও সময় পাওয়া যাবে না।’

একফাঁকে সে নামাজ পড়ে আবার ফিরে আসে, জমিদারবাড়ি থেকে বের হবার আগ মুহূর্তে যখন ড্রোন শট নিচ্ছি, গ্রামের একদল ছেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল, তারা এসে ভিড় জমায়। ড্রোন নামানোর সময় সবাইকে বলি, ‘আসো আমরা সবাই মিলে একটা ছবি তুলি।’

আগে ছবি তুলতে না চাইলেও ফ্রেমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সিয়াম এবার নিজে থেকে এসেই আমার পাশে দাঁড়ায়। এই জন্যই আমি সম্ভাবনা দেখি, ওদের কাঁদামাটির মতো মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দেই।


২২ আগস্ট, ২০২৫

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.