![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গাঁও গ্রামের ছাওয়াল আমি, গায়ে মাটির গন্ধ; অনেক কিছু না দেখিলেও নই যে আমি অন্ধ
ঐতিহ্যবাহী বিক্রমপুরের শহরতলীর একটি গ্রাম পানহাটা যার বুকচিরে স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে উঠার সর্পিল রাস্তা এগিয়ে গেছে। গ্রামটির অধিকাংশ পরিবারের কেউ না কেউ প্রবাসে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের অর্থনীতি যেমন সচল রেখেছেন তেমনি নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মত বিশাল অবকাঠামো তৈরির স্বপ্নও বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছেন। শহুরে ধাঁচে বাড়ি হয়েছে, হয়েছে রাস্তাও কিন্তু তাঁদের পারুলদের জন্য অপেক্ষা করছে নির্মম পরিণতি। আর পারুল দিয়েছে নীতিনির্ধারকদের নতুন করে ভাববার সুযোগ।
পারুল পানহাটা গ্রামের মরহুম শহর আলীর একমাত্র কন্যা। পারুল অনিন্দ্য সুন্দরী না হলেও একেবারে কম না। দশটি মেয়েকে একসঙ্গে দাড় করালে অনায়াশেই সবার নজর তাঁর দিকেই পড়বে। আর এ নিয়ে তাঁর মায়ের চিন্তার অন্ত ছিল না। এছাড়া পাড়া প্রতিবেশির বিভিন্ন ধরণের টিটকারি পাড়া কথাতো নিয়মিতই শুনতে হয় তাঁর মাকে। এরই মধ্যে জহিরের আগমন। পানহাটা গ্রামেরই রমজান মাঝির তৃতীয় পুত্র জহির বছর দশেক আগে সৌদি আরব গিয়েছিলো। সে কিছুদিন হলো দেশে ফিরেছে। তাঁর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে দেখে তাঁর বাবা মা তাঁর জন্য পাত্রী দেখা শুরু করেছেন। হঠাৎ একদিন কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে বের হওয়ার সময় জহির পারুলকে দেখতে পাই এবং তাঁর সম্পর্কে খোজ নিয়ে জানতে পারলো সে তাঁদের গ্রামের শহর চাচার একমাত্র মেয়ে। সে তাকে দেখে আর ভাবে কত ছোট দেখেছিলাম পারুলকে আর এখন সে কত বড়ই না হয়েছে। কত সুন্দর হয়েছে। জহির তাকে প্রথম দেখাই ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু কিভাবে যে এটি তাঁর পরিবারে জানাবে তাঁর উপায় খুজতেছিলো।
হঠাৎ একদিন পারুলের বাড়িতে তাঁর মামা আয়েন উদ্দিন আসেন যিনি সৌদি আরবে থাকতেন এবং তিনিই মূলত এ সংসারটিকে টিকিয়ে রেখেছেন। জহিরের সাথে আয়েন উদ্দিনের ভালো সম্পর্ক ছিল। যদিও জহির আয়েন উদ্দিনকে ভাই বলে সম্বোধন করে, তারপরও তাঁর ভাগ্নীর প্রতি যে জহিরের দুর্বলতা আছে, সেটা সে প্রকাশ করলো এবং বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে বসলো। আয়েন উদ্দিন দেখলেন এ আর মন্দ কী! যেহেতু তাকেই ভোরণপোষণ দিতে হয়, বিয়ে হয়ে গেলে কিছুটা হাফ ছেড়ে বাচতে পারবেন তিনিও। আর তাছাড়া পাত্র হিসেবেও তো জহির একেবারে মন্দ হবে না। শুধু বয়সটায় একটু বেশি। পরক্ষণেই ভাবলেন পুরুষের আবার বয়স! তিনি নিজেইতো তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের কম বয়সী সাথীকে বিয়ে করে দিব্যি সংসার করছেন। বিষয়টি পারুলের মা’র কাছে তাঁর মামা উঠালে তাঁর মা রাজি হয়ে গেলেন। পারুলের সম্মতি নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করলেন না। পারুল তাঁর সইয়ের কাছ থেকে শুনে তাঁর মা’র কাছে শুধু তাঁর লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়ার কথাই বলেছিলেন।
কোন এক শুভ নাকি অশুভ দিনে জহির তাঁর ভগ্নিপতির মাধ্যমে তাঁর মা বাবাকে পারুলের বিষয়ে জানান। কিন্তু বিধি বাম, জহিরের বাবা রাজী থাকলেও তাঁর মা কোনমতেই এই অপয়া মেয়েটিকে তাঁর ঘরের বউ করতে রাজি হলেন না। পাঠক, এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন যেদিন পারুলের জন্ম হয়, সেদিনই তাঁর বাবা সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। আর তখন থেকেই পারুলকে কেউ কেউ অপয়া বলে মনে করতেন। যাহোক দিন যত যায় জহিরের আর কোন কিছুই ভালো লাগে না। কারণ জহির যে পারুলকে মনে প্রাণে ভালোবেসে ফেলেছে। আর হ্যাঁ, এ ভালোবাসা ছিল সম্পূর্ণ একপক্ষীয় ভালোবাসা এখানে পারুলের কোন সংশ্লেষ ছিলো না। বেশ কিছুদিন কেটে গেলো অনেক মেয়ে দেখলেন তাঁর মা কিন্তু কোন না কোন অযুহাতে জহির রাজি হয় না। উপয়ান্তর না দেখে জহিরের মা শিরি বেগম প্রস্তাব নিয়ে গেলেন পারুলের মায়ের কাছে। আসলে পারুলের মা ঠিক এদিনটির জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলো। নির্ধারিত দিনে আত্মীয় স্বজন উপস্থিত হলেন কিন্তু বাধ সাধলেন পারুলের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে ফোন দিয়ে পারুলের অপ্রাপ্ত বয়সের কথা জানালেন এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) এসে বিয়ে বন্ধ করে দিলেন। এ সুযোগে জহিরের মা আবার জহিরকে শুনালো, “তোরে কইছিলাম না, এই অপয়া মেয়েকে আমার ঘরের বউ করে আনতাম না। এখন হাতে নাতে প্রমাণ পেলি তো। কতজনেরই তো এই বয়সে বিয়ে হচ্ছে। কই অন্য কারো বেলায় তো এমন হয় নাই। আমি এ মুখ কিভাবে দেখায়”। জহির শুধু শুনলো। কিছুই বলল না।
পারুল মনে মনে খুশি হলেও তাঁর এ খুশি বেশিদিন টিকল না। মাস খানিক পরে তারা সম্পূর্ণ গোপনে বিয়ে করে ফেলল। শুরু হলো পারুলের জীবন যুদ্ধ। পারুলের জীবনে সবেমাত্র পনেরো টি বসন্ত পার হয়েছে। আর এখনি তাকে সংসার শুরু করতে হচ্ছে। কিছুদিন না যেতেই তার শাশুড়ি আকারে ইঙ্গিতে তাকে সন্তান নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। আর জহির নিজেও ভাবলো সে আবার বিদেশ যাবে, তাই একটা সন্তান নিয়ে নেওয়ায় ভালো হবে। পরিবার পরিকল্পনার মাঠ কর্মী রুপালী আক্তার শিরি বেগমের কাছে ছেলের বউয়ের খোজ খবর জানতে চাইলে, তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করেন এবং এই বলে শাসিয়ে দেন যেন, তাঁর ছেলের বউয়ের আশেপাশে তাকে না দেখে। যাহোক দিন যায়, একদিন পারুল গর্ভবতী হলেন। রুপালীও বিষয়টি পারুলের কাছে জানতে পেরে তাকে কমিউনিটি ক্লিনিক বা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। পারুল সরল মনে তাঁর শাশুড়িকে জানালে তাঁর শাশুড়ি তাঁর উপরে ক্ষেপে গেলেন এবং একগাদা কথা শুনিয়ে দিলেন। তিনি এও জানালেন যে তিনি পাঁচটা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন কিন্তু কোনদিনও কোন ডাক্তারের কাছে যান নি। পারুল শুধু শুনে, কোন জবাব দেয়না। সে একাকী ভাবে আজ জহির বাড়িতে থাকলে হয়ত সে, ম্যানেজ করতে পারতো। তাঁর পেটে বাচ্চা আসার কিছুদিনের মধ্যেই জহির আবার সৌদি আরব চলে যায়।
দিন যায়, পারুল কেমন যেন হয়ে যায়। এখন তাঁর মায়ের বাড়িতে যাওয়াও বন্ধ। দিনে দিনে পারুল অযত্ন অবহেলায় দুর্বল হয়ে পড়তেছিলো। হঠাৎ একদিন সে মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। তাকে বাড়িতে রেখে মাথায় পানি ঢালা, হুজুর ডেকে এনে দোয়া তাবিজ দেওয়া কোন কিছুর কমতি ছিল না, কমতি ছিল শুধু ডাক্তারের কাছে নেওয়ার। এরই মধ্যে রুপালীর আগমন ঘটে, তিনি দ্রুত পারুলকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পরামর্শ দিলে পারুলের শ্বশুর সে ব্যবস্থা করলেন এবং সদর হাসপাতালে ভর্তি করালেন। ডাক্তার পারুলকে দেখেই তাঁর মাকে বকাবকি শুরু করলেন, কেন তাকে এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলে রাখা ভালো পারুলের শাশুড়ি কিন্তু হাসপাতালে আসেনি। যাহোক, ডাক্তার জরুরি পারুলকে চিকিৎসা দিলেন। পারুল সুস্থ হয়ে উঠল। আবার বাড়িতে গেলো। ইতিমধ্যে রুপালী একদিন পারুলের শাশুড়ির কাছে দুইটা মিসোপ্রোস্টল ট্যাবলেট দিয়ে বললেন, যদি বাড়িতে ডেলিভারি হয় তাহলে গর্ভে আর কোন বাচ্চা নেই নিশ্চিত হয়ে যেন ট্যাবলেট দুইটা খাওয়ানো হয়। অবহেলার সাথে শিরি বেগম প্যাকেট টা রেখে দিলেন।
এদিকে পারুলের প্রসব বেদনা উঠেছে। তাঁর শাশুড়ি পাশের বাড়ির দাইকে ডেকে আনলেন। এ দাইয়ের ঐ এলাকায় রয়েছে ব্যাপক সুনাম। দাই এসে দেখে শুনে কি যেন শিরি বেগমের সাথে বললেন। শিরি বেগম অনেকটা বিরক্তস্বরে বললেন, “বুঝি না বাপু, তুমিও-----।” দাই কথা না বাড়িয়ে চেষ্টা চালাতে লাগলেন এবং ঘণ্টাখানেক পরে ঘর আলো করে একটি শিশু সন্তানের আগমন ঘটলো। কিন্তু পারুলের অবস্থা মোটেই সুবিধার ছিল না। একে তো তাঁর খিচুনি হচ্ছিলো আবার রক্তক্ষরণ বন্ধ হচ্ছিলো না। দাই আশা ছেড়ে দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। হ্যাঁ পারুলকে হাসপাতালে নেওয়া হলো ঠিকই কিন্তু সেটা চিকিৎসার জন্য নয়, ডেথ সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য। জহির সব কিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। তাঁর আর কিছুই ভালো লাগে না। পারুলের মা আজ বড় নিঃস্ব। এক অপয়া আর এক অপয়াকে পৃথিবীতে রেখে শান্তির ঘুম দিচ্ছেন।
রুপালী মাতৃমৃত্যুর প্রতিবেদন নিয়ে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসারের নিকট গেলেন এবং সব কিছু খুলে বললেন। তিনিও ভাবতে লাগলেন। হঠাৎ রুপালীকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমরাও নিতে পারি যদি আপনারা সবাই সহযোগিতা করেন। রুপালী উৎসাহের সহিত বললেন, স্যার, আপনি উদ্যোগ নিলে আমরা সহযোগিতা করব না, এটা ভাবতেই পারিনা। উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার বললেন কেমন হয় যদি আমরা বাল্য বিয়ের শিকার এ সকল নবদম্পতিদের অনাকাংখিত গর্ভধারণ রোধে পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করি? এটি নিশ্চিত করা গেলে পারুলের মত আর কাউকে অকালে ঝরে যেতে হবে না। যে কথা সেই কাজ। নেওয়া হলো উদ্যোগ। শুরু হলো পাইলটিং। আর হ্যাঁ সেটি পানহাটা গ্রাম যে ইউনিয়নে অবস্থিত সেই রামপাল ইউনিয়নেই।
একটি শিশুর গর্ভে যাতে আর একটি শিশু না আসতে পারে সেজন্য বাল্য বিয়ের শিকার নারীদের আলাদা তালিকা তৈরি করা হলো। জনপ্রতিনিধিদেরকে সম্পৃক্ত করা হলো। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পরিবার কল্যাণ সহকারীগণ যারা মাঠ কর্মী হিসেবেই বেশি পরিচিত তাঁরা স্বানন্দে কাজে নেমে গেলেন। যেখানে প্রতি দুই মাসে একবার একজন দম্পতিকে ভিজিট করেন সেখানে এসকল দম্পতিকে প্রতি মাসে একবার পরিদর্শন শুরু করলেন। বাড়িতে না থাকলে পুনরায় পরিদর্শন করেন। পনেরো দিন পরপর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এসকল দম্পতিদের সাথে মাঠকর্মীগণ যোগাযোগ করেন। তাদেরকে সুপারভিশন করার জন্য প্রতিদিন নিয়মিত পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক মাঠে যাচ্ছেন। শ্বশুর-শাশুড়ি সহ মুরুব্বীদেরকেও মোটিভেশন দেওয়া হচ্ছে। কেউ বিষয়টিকে সহজভাবে নিচ্ছেন কেউ পাত্তা দিচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে পরিবার পরিকল্পনা অফিসার নিজেই চলে যাচ্ছেন দম্পতির বাড়িতে। বুঝানোর চেষ্টা করছেন অপরিণত বয়সে গর্ভধারণের ঝুকির কথা। তবে এ কাজটি সহজ করে দিয়েছে পারুল। পারুল আজ পানহাটা গ্রামের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। উদ্যোগটি সাময়িক, কারণ আমরা স্বপ্ন দেখি নিকট ভবিষ্যতেই বাল্য বিয়ের মতো এমন অভিশাপের মৃত্যু ঘটবে।
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৫৪
রাজীব নুর বলেছেন: খুব সুন্দর একটি পোষ্ট লিখেছেন।
এই পোষ্টটি স্টিকি করা যেতে পারে।
আমার বাড়িও বিক্রমপুর। শ্রী নগর থানা।