![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সহজ মানুষ, ভজে দ্যাখ না রে মন দিব্যজ্ঞ্যানে,পাবি রে অমুল্যনিধি, বর্তমানে, পাবি বর্তমানে।
বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে একটি চিরন্তন নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে; আর সেটি হলো পরিবারতন্ত্র। এই নাটকের কাহিনী বড়ই পুরনো, তবু প্রতিবার নতুন মেকআপ আর কিছু নতুন চরিত্র যোগ করে এটি দর্শকদের মুগ্ধ (!) করতে থাকে। শহরের চকচকে রাজনৈতিক মহল থেকে গ্রামের কাদামাটির ইউনিয়ন পরিষদ, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে পাতি নেতার পাড়ার কমিটি, পরিবারতন্ত্রের বিষবাস্প কোথায় নেই? এ যেন এক অদৃশ্য মহামারী, যা গণতন্ত্রের শ্বাসনালীতে আটকে গিয়ে ধীরে ধীরে তাকে শ্বাসরোধ করছে। তবে চিন্তার কিছু নেই, আমাদের রাজনৈতিক নেতারা এই বিষবাস্পকে ‘পারিবারিক ঐতিহ্য’ আর ‘রাজনৈতিক উত্তরাধিকার’ বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। কী অপূর্ব কৌশল!
এই লেখায় আমরা পরিবারতন্ত্রের এই মহিমান্বিত (!) যাত্রাপথ নিয়ে একটু খোঁজখবর নেব। বিশ্লেষণের ছুরি দিয়ে এর ভেতরটা চিরে দেখব, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মশলাপাতি একটু নেড়েচেড়ে দেখার চেষ্টা করব। তাহলে, চলুন, ঢুকে পড়ি এই রাজনৈতিক সোপ-অপেরার গল্পে।
পরিবারতন্ত্র কী? একটি ‘পবিত্র’ ঐতিহ্য!
পরিবারতন্ত্র বলতে আমরা বুঝি রাজনৈতিক ক্ষমতার সেই অলিখিত উইল, যেখানে ক্ষমতা বাবা থেকে ছেলে, মা থেকে মেয়ে, ভাই থেকে বোন, কিংবা স্বামী থেকে স্ত্রীর হাতে হস্তান্তরিত হয়। এ যেন একটি পারিবারিক ব্যবসা, যেখানে রাজনৈতিক দল বা পদটি হলো ‘দোকান’ আর জনগণ হলো সেই গ্রাহক, যাদের কিনতে হয় পুরনো মাল নতুন প্যাকেটে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই ঐতিহ্য এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, কোনো দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পদে পরিবারের বাইরের কাউকে কল্পনা করা যায় না।
এই পরিবারতন্ত্রের সৌন্দর্য হলো এর সর্বব্যাপ্ততা। বড় দল? অবশ্যই! ছোট দল? তাও বাদ যায় না। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব? হ্যাঁ। মহানগর, জেলা, উপজেলা, ওয়ার্ড/পাড়া/মহল্লা কমিটি-উপকমিটি? তথৈবচ। গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার? ওহ, সেখানেও। যেন পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাই একটা বিশাল পারিবারিক পিকনিক, আর আমরা জনগণ শুধু দর্শক।
বড় দলের বড় পরিবার
বাংলাদেশের রাজনীতির দুই প্রধান দল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, এই পরিবারতন্ত্রের পোস্টার বয়। এই দুই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের গল্প যেন একটা পারিবারিক মেলোড্রামা। একদিকে শেখ পরিবার, অন্যদিকে জিয়া পরিবার। এদের ক্ষমতার দৌড় এতটাই পারিবারিক যে, দলের অন্য নেতাদের মনে হয় তারা শুধুই ‘সেকেন্ডারি কাস্ট’, মূল চরিত্র তো পরিবারের সদস্যরাই।
আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব অবিসংবাদিত, কিন্তু দলের ভেতরে ও বাইরে শেখ পরিবারের প্রভাব কতটা? এ যেন একটা অঘোষিত নিয়ম; পরিবারের সদস্য হলে পদ, প্রতিপত্তি আর প্রভাব সবই আপনার জন্য রিজার্ভ। বিএনপির দিকে তাকালেও একই চিত্র। জিয়াউর রহমানের পর খালেদা জিয়া, তারপর তারেক রহমান; এ যেন একটা রাজনৈতিক রিলে রেস, যেখানে ব্যাটন শুধু পরিবারের হাতেই থাকে। আরও আছে; জাতীয় পার্টির এরশাদ পরিবার, বিজেপির নাজিউর পরিবার, বিকল্পধারার বিচৌধুরী পরিবার, জাগপার প্রধান পরিবার, ইত্যাদি ইত্যাদি। ইসলামী ভাবধারার দলগুলোতেও একই হাল। মজার ব্যাপার হলো, শুধু শীর্ষ নেতৃত্ব নয়, বেশীরভাগ দলেরই কেন্দ্রীয় থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃত্ব এবং পদ-পদবীর ব্যাটনও অন্যান্য নেতা-নেত্রীদের পরিবারের হাতেই থাকে। এ যেন প্রাচীনকালের জমিদারী ও সামন্ত প্রথা, শুধু বংশানুক্রমিকভাবে হাতবদল হয়!
এখানে মজার ব্যাপার হলো, বড় দুই দল সহ সব দলই গণতন্ত্রের বড় বড় বুলি আওড়ায়, কিন্তু দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া? ওটা যেন শুধু পাঠ্যবইয়ের জন্য। নেতৃত্বের পদে কেন পরিবারের বাইরে কেউ আসবে না? কারণ, পরিবারই তো ‘দলের প্রাণ’! এই প্রাণ রক্ষার দায়িত্বে থাকা নেতারা যখন বলেন, “আমরা জনগণের জন্য কাজ করি,” তখন মনে হয়, জনগণের জন্য কাজ করার আগে তারা নিজেদের পরিবারের জন্য একটু বেশি কাজ করে ফেলছেন। কি বিচিত্র সেলুকাস!
গ্রাম থেকে শহর: পরিবারতন্ত্রের সর্বব্যাপী ছায়া
পরিবারতন্ত্র শুধু কেন্দ্রীয় রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে শহরের সংসদীয় আসন পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। গ্রামে গিয়ে দেখুন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পদটি প্রায়ই একই পরিবারের হাতে ঘুরপাক খায়। বাবা চেয়ারম্যান ছিলেন, এখন ছেলে; কিংবা স্বামী মারা গেলে স্ত্রী। এ যেন একটা অলিখিত নিয়ম যে রাজনৈতিক পদটা পরিবারের সম্পত্তি।
শহরের রাজনীতিতেও একই চিত্র। সংসদ সদস্যের আসনগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবারের সদস্যরা বারবার নির্বাচিত হচ্ছেন। কখনো স্বামী, কখনো স্ত্রী, কখনো ছেলে-মেয়ে। এমনকি ছোট দলগুলোতেও এই প্রবণতা কম নয়। কোনো কোনো দলের নেতৃত্ব যেন একটা পারিবারিক কমিটি, যেখানে বাইরের কেউ ঢোকার সুযোগই নেই।
এই প্রবণতার ফলে কী হচ্ছে? রাজনীতিতে নতুন মুখ, নতুন ভাবনা, নতুন নেতৃত্বের জায়গা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক নামই বড় হয়ে উঠছে। ফলে, রাজনীতি হয়ে পড়ছে একটা ‘ক্লোজড সার্কিট’, যেখানে শুধু পরিবারের সদস্যরাই খেলতে পারে।
দলীয় ফোরামে পদ-পদবী: গণতন্ত্রের নামে প্রহসন
এই পরিবারতন্ত্রের বিষবৃক্ষ শুধু দলের শীর্ষ নেতৃত্বেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি দলীয় ফোরামের প্রতিটি পদ-পদবীতেও শিকড় গেড়েছে। ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, কোনো ফোরামই এর কবল থেকে মুক্ত নয়। এসব ফোরামে পদ পাওয়ার জন্য যোগ্যতা বা ত্যাগের চেয়ে ‘পারিবারিক সংযোগ’ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নেতার ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে, এমনকি দূর সম্পর্কের কাজিনও যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদের জন্য যোগ্য! আর যারা রোদে-বৃষ্টিতে মিছিলে হাঁটে, পোস্টার সাঁটে, স্লোগান দেয়, তারা? ওরা তো শুধু ‘কর্মী’, তাদের কাজ খেটে মরা, আর লাড্ডু ভাগাভাগির সময় নেতা-নেত্রী ও তাদের পরিবারের জন্য তালি বাজানো। দলের ভেতরে গণতন্ত্রের নামে যে প্রহসন চলে, তা দেখে হাসি পায়। যে দল নিজের ভেতরে একটা নির্বাচন বা প্রতিযোগিতা সহ্য করতে পারে না, তারা দেশের গণতন্ত্রের জন্য মায়াকান্না করে! এ যেন সেই চোরের মায়ের গলায় বড় গলা।
গণতন্ত্রের গলায় ফাঁস
পরিবারতন্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো গণতন্ত্রের ওপর এর প্রভাব। গণতন্ত্র মানে যোগ্যতা, প্রতিযোগিতা আর জনগণের পছন্দ। কিন্তু পরিবারতন্ত্র যখন রাজনীতির চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়, তখন যোগ্যতার চেয়ে পারিবারিক সম্পর্ক বড় হয়ে ওঠে। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষুণ্ণ হয়, কারণ নেতৃত্বের পদগুলো পরিবারের জন্য রিজার্ভ থাকে।
এর ফলে জনগণের পছন্দের সুযোগও কমে যায়। নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে যদি একই পরিবারের সদস্যদের বারবার দেখতে হয়, তাহলে ভোটারের কাছে বিকল্প কোথায়? এ যেন একটা রেস্তোরাঁ, যেখানে মেনুতে শুধু একই খাবার বারবার পরিবেশন করা হচ্ছে।
আরেকটি মজার দিক হলো, পরিবারতন্ত্রের এই ধারা রাজনীতিকে একটা ‘এলিট ক্লাব’ বানিয়ে ফেলছে। সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতির দরজা ক্রমশ বন্ধ হচ্ছে। আপনার যদি পারিবারিক ‘ব্র্যান্ড’ না থাকে, তাহলে রাজনীতিতে বড় জায়গা করে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে, রাজনীতি হয়ে পড়ছে কিছু পরিবারের একচেটিয়া খেলার মাঠ।
কেন এই পরিবারতন্ত্র টিকে আছে?
এখন প্রশ্ন হলো, এই পরিবারতন্ত্র কেন এত শক্তিশালী? কেন এটি বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গাঙ্গি হয়ে গেছে? এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে:
১. ঐতিহ্যের নামে প্রচার: রাজনৈতিক পরিবারগুলো তাদের উত্তরাধিকারকে ‘ঐতিহ্য’ হিসেবে প্রচার করে। “আমার বাবা দেশের জনগণের জন্য জীবন দিয়েছেন, তাই আমার এই পদে থাকা উচিত”, এই যুক্তি জনগণের মনে আবেগ জাগায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশের জন্য ত্যাগ শুধু কি এই পরিবারগুলোই করেছে? আর যদি করেও থাকে, তাহলে বার বার কেন করবে? কি স্বার্থে?
২. ব্র্যান্ডের শক্তি: রাজনৈতিক পরিবারগুলো একটা ‘ব্র্যান্ড’ তৈরি করে ফেলেছে। শেখ, জিয়া, এরশাদ, এই নামগুলোর সঙ্গে জনগণের আবেগ জড়িত। ফলে, দলের অন্য নেতারা এই ব্র্যান্ডের সঙ্গে পেরে ওঠে না। তাই তারাও এইসব ব্র্যান্ডের ছায়ায় নিজেদের এলাকাভিত্তিক সাব-ব্র্যান্ড তৈরীতে ব্যস্ত থাকে।
৩. পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি: বাংলাদেশের রাজনীতিতে পৃষ্ঠপোষকতা, তোষামোদি বা ‘চামচামি’ একটা বড় ব্যাপার। পরিবারের সদস্যরা নেতৃত্বে থাকলে দলের অন্য নেতারা তাদের চারপাশে ঘুরতে থাকে, কারণ তারা জানে ক্ষমতার চাবি এই পরিবারের হাতে। এদের আশেপাশে থাকলে নিজেদের আখের গোছানোর একটা সুযোগ থেকেই যায়।
৪. জনগণের নীরব সম্মতি: সবচেয়ে বড় কথা, আমরা জনগণও এই পরিবারতন্ত্রকে প্রশ্রয় দিচ্ছি। আমরা যখন একই পরিবারের সদস্যদের বারবার ভোট দিই, তখন আমরা নিজেরাই এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখছি।
কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়?
পরিবারতন্ত্র থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়, কিন্তু অসম্ভবও নয়। প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে হবে। নেতৃত্বের পদে প্রতিযোগিতা হতে হবে, যোগ্যতার ভিত্তিতে। দ্বিতীয়ত, জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে। আমরা যদি পারিবারিক নামের বদলে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিই, তাহলে এই ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ভাঙবে। তৃতীয়ত, নতুন নেতৃত্বের জন্য জায়গা তৈরি করতে হবে। তরুণ, যোগ্য এবং আদর্শবান নেতাদের সুযোগ দিতে হবে।
কিন্তু এসবের আগে আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। আমরা যদি রাজনীতিকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে দেখা বন্ধ না করি, তাহলে এই বিষবাস্প আমাদের গণতন্ত্রকে ধীরে ধীরে গ্রাস করবে।
তবে একটি কথা কিন্তু থেকেই যায়। কেউ যদি নিজের যোগ্যতায় পারিবারিক সুবিধা না নিয়ে নিজের অবস্থান তৈরী করে নিতে পারে তাহলে তাকে বিবেচনা করা যেতেই পারে। সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে শুধু এটা গ্রহণযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে হবে যে উনি পরিবারের সুবিধাভোগী নন।
শেষ কথা: হাসি না কান্না?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র একই সঙ্গে হাস্যকর এবং দুঃখজনক। হাস্যকর, কারণ এটি যেন একটা পুরনো সিনেমার পুনরাবৃত্তি, যেখানে একই চরিত্র বারবার ফিরে আসে। দুঃখজনক, কারণ এটি আমাদের গণতন্ত্রের সম্ভাবনাকে ক্ষুণ্ণ করছে। তবে আশার কথা, আমরা যদি সচেতন হই, যদি প্রশ্ন তুলি, যদি বিকল্পের দাবি করি, তাহলে এই বিষবাস্প থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
তাই আসুন, পরেরবার ভোট দিতে গিয়ে একটু ভাবি যে আমরা কি গণতন্ত্রের জন্য ভোট দিচ্ছি, নাকি কোনো পরিবারের ‘ঐতিহ্য’ রক্ষার জন্য? কারণ, গণতন্ত্র কোনো পারিবারিক সম্পত্তি নয়, এটা আমাদের সবার।
এই লেখা যদি আপনার মনে একটু হাসি, একটু ক্ষোভ বা একটু ভাবনার উদ্রেক করে, তাহলে আমার শ্রম সার্থক। আপনার মতামত জানান, আর এই বিষবাস্প থেকে মুক্তির পথে একসঙ্গে হাঁটুন।
২| ১২ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:৫৮
মেঠোপথ২৩ বলেছেন: পরিবারতন্ত্র নিপাত যাক, গনতন্ত্র মুক্তি পাক। ডক্টর ইউনুস অন্তত পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক
©somewhere in net ltd.
১|
১২ ই জুলাই, ২০২৫ রাত ৯:২১
কামাল১৮ বলেছেন: উইনুসের পরে কে?