![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শব্দে আমার আশ্রয়, লেখায় আমার মুক্তি। এখানে আমি লিখি, ভেবে দেখি, আর খুঁজি মানুষের মনের গল্প।
ঢাকার পুরান এলাকার সরু গলিগুলোতে দিনের পর দিন ছায়া জমে থাকে। সকালবেলায় যখন সূর্যের আলো উঁকি দেয়, তখনও যেন এই গলিগুলোর দেয়াল কিছুটা অন্ধকার রয়ে যায়। সেই অন্ধকারে প্রতিদিন যাওয়া আসা করত আরাফাত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। মেধাবী, শান্ত, আর নিরহংকার। বাবা গ্রামের স্কুলের শিক্ষক, মা অসুস্থ। সংসার চালাতে টিউশনিই ছিল আরাফাতের একমাত্র ভরসা।
সেই টিউশনের ছাত্রীর নাম নিশিতা। ক্লাস নাইন-এ পড়ে, বয়স পনেরো। চোখে মুখে এমন এক সরলতা, যা আজকের পৃথিবীতে বড় দুর্লভ। প্রথম দিন থেকেই মেয়েটা আরাফাতের প্রতি ভীষণ আগ্রহী ছিল।
যখন সে জিজ্ঞেস করত,
—“ভাইয়া, আপনি সব সময় এত চুপ থাকেন কেন?”
আরাফাত মৃদু হাসত,
—“চুপ থাকলেই বেশি শেখা যায়।”
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে—শিক্ষক ও ছাত্রীর সীমার মধ্যে থেকেও, এক অনুচ্চারিত বন্ধন। এক বিকেলে ক্লাস শেষে নিশিতা হঠাৎ বলে ফেলল,
—“আপনি জানেন ভাইয়া, আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে।”
আরাফাত চমকে উঠেছিল, তারপর হেসে বলেছিল,
—“ভালো লাগা মানে?”
—“মানে... আমি জানি না, কিন্তু আপনি অন্যরকম।”
এই সহজ সরল স্বীকারোক্তি শুনে আরাফাতের বুকের ভেতর হঠাৎ এক অনিশ্চিত ভয় ঢুকে পড়ল। সে কিছু না বলে চলে গেল সেদিন।
কিন্তু এই গোপন কথাটাও গোপন রইল না।
নিশিতার দীর্ঘদিনের বন্ধু ও প্রেমিক সায়েম কথাটা জেনে যায়। নয় বছরের সম্পর্ক—ক্লাস ফোর থেকে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া, বিকেলে একই মাঠে খেলা। কিন্তু এখন তাদের সম্পর্কটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।
সায়েম খবরটা শুনেই ভিতর থেকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
—“তুমি বলছো তুমি তোমার টিউটরকে ভালোবাসো?”
—“না সায়েম, আমি শুধু বলেছি, উনি ভালো মানুষ।”
—“তুমি আমার সঙ্গে এমন করতে পারো?”
সায়েমের চোখে তখন প্রেম নয়, ছিল ক্ষোভের আগুন।
সেদিন বিকেলে যখন আরাফাত টিউশন শেষে রিকশায় উঠছিল, হঠাৎ গলির মোড়ে সায়েম এসে দাঁড়াল।
—“তুমি আরাফাত?”
—“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কে?”
—“আমি নিশিতার বয়ফ্রেন্ড।”
আরাফাত হতভম্ব। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তর্ক শুরু হয়—“তুমি ওর জীবনে ঢুকলে কেন?”, “তুমি কি জানো সে আমার?”—এইসব ছোট ছোট বাক্য একসময় ছুরির ফলায় পরিণত হয়।
এক মুহূর্তেই রক্তে রঙিন হয়ে গেল সরু গলির মাটি।
আরাফাত পড়ে রইল নিথর হয়ে। তার পাশেই গড়িয়ে পড়ল টিউশন খাতার ভেতরে লেখা শেষ লাইনটা—
“আগামী ক্লাসে জীবনবোধ নিয়ে আলোচনা করব।”
পরদিন সকালের খবর—
“ছাত্রী পছন্দ করায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী খুন।”
নিশিতা তখন একা বসে ছিল ঘরের কোণে। মা কাঁদছে, পুলিশ গলির মোড়ে ভিড় সামলাচ্ছে। তার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—
“আমি কি সত্যিই কাউকে ভালোবেসেছিলাম, নাকি অজান্তেই এক জীবন নিভিয়ে ফেলেছি?”
জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকছিল, কিন্তু ঘরটা যেন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ।
সেদিন রাতে নিশিতা তার ডায়েরিতে লিখেছিল—
“ভালোবাসা হয়তো আলো, কিন্তু যখন তা মালিকানা হয়ে যায়, তখন তা অন্ধকারের চেয়ে ভয়ংকর।”
©somewhere in net ltd.