নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাব

nothing special

মইণ

মইণ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সাজু কাকা

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৮:২৭

আমার জীবনের একটা বড় অংশ দখল করে আছে সাজু কাকা। আমাদের প্রতিবেশি ছিলেন। আমার মামা-চাচাদের আদর তো দুরের কথা তাদের দেখাই আমি তেমন পাইনি। পেয়েছি সাজু কাকার আদর। উনি আমাকে নিজের ছেলের মতন আদর করতেন। নিজের কোন ছেলে ছিলনা বিধায় হয়ত।



উনি অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরতেন। আর সবসময় আমাকে নিয়ে যেতেন সাথে করে। ঊনার সাথে থেকেই আমার নামাজ শিক্ষা হয়, নামাজের অভ্যাস হয়। উনি ক্লাস ফাইভ থেকেই আমাকে নিয়ে মসজিদে যেতেন। এক সময় আমি ওনার ছায়াতে পরিনত হলাম। উনি গেলে আমি যেতাম, উনি না গেলে আমি যেতাম না।



সাজু কাকার একটা জিনিশ আমার খুব ভালো লাগতো। উনি প্রতি শুক্রবার ইস্ত্রি করা সাদা ধবধবে জুব্বা পরে, আতর লাগিয়ে, চোখে শুরমা দিয়ে, জায়নামায় নিয়ে আর একটা তজবি নিয়ে, আমাকে নিয়ে মসজিদে যেতেন। উনার জুম্মার নামাজের এই আয়োজন টা আমার কাছে খুব ভালো লাগতো।



উনি প্রচুর পান খেতেন। শক্ত সমর্থ ছিলেন। আর সাজু কাকী ছিলেন পুরো উল্টা। সাজু কাকী হাটলে সবাই মনে করতো উনি পরে যাচ্ছেন। দুর্বল শরীর ছিল কাকির। কাকা অবস্যা রোজ ভাত খাওয়ার মতো, তুমুলভাবে কাকীকে মারা একটা রুটিন ছিল। সেও যেন তেন মারা নয়। মরার মতন মারা। হয়ত একটু বেশি বলে ফেললাম। হয়ত দৈনিক ছিলনা। ছিল সাপ্তাহিক রুটিন।



উনার একটা মেয়ে ছিল যাকে উনি প্রচন্ড মারধর করতেন। অনেক সময় আমরা গিয়ে ধরতাম, নাহলে যে মারধর করতো তাতে মনে হতো উনি বুঝি মেরেই ফেলবেন। ওই বাচ্চাটার জন্য আমার খুব কষ্ট হতো। কারন এই মেয়েটা ছিল সাজু কাকার আগের ঘরের মেয়ে। নাম ছিল ‘ডলি’।



এই মেয়েটার মা মেয়েটাকে জন্ম দেয়ার সময় মারা যায়। তারপর সাজু কাকা আবার বিয়ে করেন। বাচ্চা হয়না বিধায় দ্বিতীয় বউকেও পিটাতেন। পরে উনার ঘরে একটা মেয়ে হলো। নাম সাদিয়া।



সাদিয়ার জন্মের পর ডলির কপালে ‘শনি’ ভর করলো। কারন, তখন মা-বাবা কেউ-ই আর ডলিকে আদর করতো না। শুধু মারতো। কথায় কথায় মারতো। এমনকি আমি নিজেও ডলিকে কত সময় মেরেছি দুষ্টমি করার কারনে। যার জন্য আজও আমার হৃদয়ে চাপা আছে কঠিন গ্লানি, অপরাধ বোধ আর অনুশোচনা। এতিম এই মেয়েটিকে আমরা কেউ একটা সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে পারলাম না। ক্ষমা করে দিস, ডলি। তোর জন্য কিছু করে যেতে পারলাম না।



ডলির পরে, সাদিয়ার পরে কাকা আরেকটা বাচ্চা নিলেন। ছেলে বাচ্চা। সাজু কাকার ছেলেটাকে আমি দেখতে যেতে পারিনি। কারন আমার তখন হাত খালি। এই অবস্থায় আমি উনার ফ্যামিলির কাছে গেলে কিছুনা কিছু নিয়ে যেতে হবে। আর যেহেতু আমি লন্ডন থেকে এসেছি, সবাই তেমনটাই আশা করে থাকবে। কিন্তু আমি যে নিঃশেষে বিভাজ্য হয়ে গেছি তা তো তারা বুঝবে না। তাই বাকি কারো সাথে আর দেখা হয়নি দীর্ঘদিন।



সাজু কাকা ছিলেন দৈতচরিত্রের মানুষ। একপাশে উনি ছিলেন একজন কোমল ও প্রশংসনীয় চরিত্রের অধিকারী একজন কামেল ব্যাক্তি। আরেকপাশে উনি ছিলেন প্রচন্ড রাগী ও অত্যাচারী। মানুষের এই দৈতরূপ আমরা প্রকৃতির কাছ থেকেই পেয়েছি। কারন আমরা সবাই প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিতেও কোথাও তুশার পরে সব ঢেকে যায়, কোথাও শরতের সচ্ছ আকাশ। কোথাও বৃষ্টিপাতের কারনে বন্যা হয়, আবার কোথাও হয়ত খরতাপে পুরে মানুষ।



সাজু কাকারা চলে যাওয়ার পরও উনার কাছ থেকে পাওয়া নামাজের অভ্যাসটা আমার রয়ে যায়। তারপর একসময় চিল্লায় গিয়ে হুজুর হয়ে যাই। যদিও খনিকের জন্য।



সাজু কাকা বর্তমানে হার্টের জটিল রোগে ভুগছেন। (আচ্ছা আমরা যদি হার্টের জটিল রোগ না বলে, জটিল হার্টের রোগ বলি, তাহলে কথার অর্থ এতো ব্যপকভাবে পরিবর্তন হয় কেন? তখন মনে হয় রোগটা জটিল না। হার্টটাই জটিল) উনার সাথে গত বছরের (২০১২) সেপ্টেম্বরে দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর পর দেখা হয়। আমি যখন বিদেশে ছিলাম তখন উনি প্রায়ই নাকি আম্মা-আব্বার কাছে আমার কথা জিজ্ঞেস করতেন। আমি ফোন করলে আম্মা বলতেন সাজু কাকা আমার কথা জিজ্ঞেস করেছে। আমার দুটো চোখ তখন জলে ভরে যেতো। কাকার মুমূর্ষু অবস্থায়ও আমি তাকে দেখতে পারছিনা। যে কাকা আমাকে ছেলের মতন মানুষ করেছেন।



যাইহোক, প্রায় ১২ বছর পর উনার সাথে দেখা হয়ে আমার এতো ভাল লাগলো যা বলার কোন ভাষা নেই আমার। তবে কিছুটা খারাপও লাগলো কারন তিনি সেই শক্তসমর্থ সাজু কাকা আর নেই। উনাকে দেখাচ্ছিল শুকিয়ে যাওয়া পাতার মতো কিংবা জীর্ণশীর্ণ এক ভৃত্তের মতো। অনেক কথা হলো। জানলাম ডলির বিয়ে হয়েছে। পারার মানিক-রতন ওরা উনার নিয়মিত খোজ খবর রাখে। উনাকে অনেক সাহায্য করে।



কিছুটা ভরসা পেলাম যে অন্তত কেউ ছিল উনাকে দেখার জন্য। আমি উনার বাচ্চা ছেলেটার জন্য কিছু টুকিটাকি গিফট দিলাম। হাতের কাছে যা কিছু ছিল, যতটুকু সাধ্য ছিল তার চেয়ে বেশি দিয়ে দিলাম। এমনকি আমার ব্যবহার্য শ্যাম্পুর বোতলটাও দিয়ে দিলাম সাদিয়ার জন্য। পরে দোকান থেকে দুই টাকার সানসিল্ক টুনি প্যাক কিনে শ্যাম্পু করতাম।



সাজু কাকার সাথে আই-পড টাচ-এ ছবি তুলে নিলাম। বিদায় দেয়ার সময় বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছিলো তবু বুক মিলিয়ে নিলাম। সান্ত্বনা দিলাম, সব ঠিক হয়ে যাবে।



চলে যাওয়ার সময় আমি উনাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম, আর পাঁচশ টাকার একটা নোট উনার বুক পকেটে গুজে দিলাম। উনি এতো কৃতজ্ঞ হলেন যা আমি আশা করিনি। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, যদি সামর্থ্য থাকতো পাঁচ কোটি টাকা দিতাম আপনাকে, এটাতো কিছুই না। এই ধরায় আমরা বেঁচে থাকি শুধু দুটো কারনে। ‘সুদিনের আশা’ আর ‘মানুষের ভালোবাসা।’



আপনাকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে পারলাম না। তাই ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করা ছাড়া আমার হাতে আর কিছুই নেই।



সাজু কাকা আপনাকে কেন জানি অনেক ভালবাসি। জানি আপনিও আমাকে বাসেন। এইটুকুর জন্যই হয়ত আমাদের বেঁচে থাকা। কিংবা এইটুকুর অভাবেই হয়ত আমাদের মরে যাওয়া। তবে পরজনমে হলেও আপনার কথা আমার মনে থাকবে। আখিরাতে দেখা হলে কেউ যখন আপনাকে একটা দানা পরিমান নেকি দিবেনা, সেদিন ইনশাল্লাহ আমি আপনাকে আমার তরফ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সমস্ত নেকি দিয়ে দিব। কথা দিলাম।



কারন জীবদ্দশায় আপনার জন্য কিছুই করতে পারিনাই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.