![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার বড় মামাকে নিয়ে লিখতে গেলে একটা বই লেখা যাবে। আমার বড় মামা ছোটবেলা থেকেই ব্রিলিয়েন্ট ছিলেন। উনি বালিয়াপাড়া প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে রাশিয়া যাওয়ার আগ পর্যন্ত কখনও টাকা দিতে হয়নি পরাশুনার জন্য। প্রাইমারি স্কুলের বৃত্তির কারনে বিনা বেতনে পড়তেন স্কুলে। স্কুলে বৃত্তি পাওয়ার কারনে বিনা বেতনে মেট্রিক পর্যন্ত পড়তে পারলেন। মেট্রেক পরীক্ষার পর ঢাকা আসলেন। উনার মেট্রিক পরীক্ষায় উনি ফার্স্ট ডিভিসন পেয়েছিলেন। তখন ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া ছিল অনেক কিছু। দশ গ্রামের লোকজন এমনকি আরাইহাজার থেকে মানুষ পায়ে হেটে শুধু উনাকে দেখতে এসেছিলেন। আর এখন কি গোল্ডেন জিপিএ পায়, মানুষ ফিরেও তাকায় না।
তারপর ঢাকা কলেজে ভর্তি হলেন। স্কুলের হেডমাস্টার উনার জন্য সুপারিশ করে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যালের বরাবর প্ত্র লিখেন। তারপর ঢাকা কলেজেও পড়লেন বিনা বেতনে। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বোর্ডে কততম স্থান অধিকার করেন তা বলতে পারবোনা। তবে সেই কারনে উনি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গোল্ড ম্যাডেল পেয়েছিলেন। এরপর রাশিয়ায় স্কলারশিপ পেয়ে চলে গেলেন।
মামা রাশিয়া থেকে যখন আসেন তখন আমার জন্ম হয়। তখন উনি আমার ডাক নাম রাখেন- লাফুল। “লাফুল” রাশিয়ার আদরের ছেলে বাচ্চাদের নাম। আর অতি আদরের মেয়ে বাচ্চাদের নাম রাখা হতো “লাফুলি”। অনেকটা আমাদের দেশের বুলবুলী-টুনটুনি, খোকা-খুকি এই ধরনের নাম। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমার লন্ডন না গিয়ে রাশিয়া যাওয়া উচিৎ ছিল। আমার নামের অনেক পার্টনার পাওয়া যেত। বাংলাদেশে কিংবা ইংল্যন্ডে আমি জীবনে কোথাও “লাফুল” নামের কোন ছেলে-মেয়ে খুজে পেলাম না।
আমার এই বড় মামা যখন রাশিয়া থেকে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশে আসেন তখন নাকি জাহাজ ভরে মাল পত্র নিয়ে আসেন। সেই মাল পত্রের অনেক কিছুই এখনও আমাদের ঘরে আছে। আর অনেক ফার্নিচার যেগুলো উনি উনেছিলেন তার অনেকগুলো এখনও ছোট এবং মেজো মামার বাসায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমার ফ্যামিলির ভাষ্যমতে সেই আমলেই তিনি রাশিয়া থেকে ওয়াশিং মেশিন নিয়ে এসেছিলেন যা হয়ত তৎকালীন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী লেভেলের কয়েকজনের বাসায় হয়ত ছিল। যা দেখে আমাদের ফ্যামিলির সবাই চিৎপটাং হয়ে গেল। এটা আবার কি জিনিস!!
রাশিয়া থেকে আসার পর উনি বাংলাদেশে চাকরির চেষ্টা করেছিলেন। এবং রাশিয়া থেকে ফিলসফি ডক্টরেট করে এসেও উনি দেশে তেমন কিছু করতে পারলেন না। কারন দেশে তখন থেকেই তেল দেয়ার প্রচলন শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমার মামাকে সবাই বলেছিল প্রয়োজনে একটু তেল দিয়ে কাজ আদায় করে নেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি খুবই আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন ব্যাক্তি ছিলেন। তাই কাউকে উনার তেলাতেলি করা পছন্দ ছিলনা। শেষ পর্যন্ত যখন কিছু হচ্ছিলনা তখন নানার কিছু জমি বিক্রি করে চলে গেলেন এমেরিকা। এমেরিকা যাওয়ার আগে বড় মামারও আমার মতো মাথা আউলা হয়ে গিয়েছিল। তিনিও আমার মতো পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। দেশে এসে উনার প্রায় দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। উনিও খাঁচায় আটকে যাওয়া পাখির মতো ছটফট করতেন সারাক্ষন।
এখানে বলে রাখি আমার বড় মামা কখনই আমাদের ফ্যামিলির কারো মতন ছিলেন না। উনি এমনকি বাংলাদেশীদের মতও ছিলেন না। উনি ছিলেন সাত ফুট লম্বা, কাগজের মতো সাদা। দেখতে উনি পুরোপুরি ইংরেজদের মতোই ছিলেন। দেখতে ছিলেন একেবারে সেকেলের রাজপুত্রদের/প্রিন্সদের মতো।
রাশিয়াতে উনার প্রেমে পরেছিলেন এক রাশিয়ান মেয়ে। যে মেয়ে মামাকে বিয়ে করার জন্য ধর্মান্তরিত পর্যন্ত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার নানু রাজী হননি বিধায় আর সে বিয়ে হয়নি। কিন্তু সে মেয়ের মন ভাঙ্গার জন্য নাকি মামার জীবনে অভিশাপ লেগেছিলো। মামা এমেরিকা যাওয়ার আগে এক কালো কুচকুচে, কুৎসিত এক চাকুরীজীবী মেয়ের সাথে নাকি বিয়ে হয়েছিল মামার। মেয়ে এতো কুৎসিত আর মামা এতো সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও, সামান্য একটা কি নিয়ে ঝগড়া হওয়ায় সেই মেয়ে মামার মতো সুপুরুষকে ছেড়ে দিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। আমার মামা মান সম্মান বাঁচানোর জন্য সেই মেয়ের পায়ে পরে পর্যন্ত অনুনয় বিনয় করে ঘরে ফিরাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই মেয়ে মামাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। পরে মামা আরেকজন কে বিয়ে করে। বিয়ে করার কিছুদিন পরই উনি আমেরিকা চলে যান। তারপর মামিকেও নিয়ে যান।
আজ প্রায় ২৬ বছর ধরে মামা ফ্যামিলি নিয়ে বাইরে থাকেন। প্রথমে ছিলেন এমেরিকা। তারপর এমেরিকা থেকে এখন থাকেন কানাডাতে। উনার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। ছেলেটার নাম নিঝুম, মেয়েটার নাম ভুলে গেছি। মেয়েটা কানাডাতে জন্ম।
মামা সপরিবারে একবারই বাংলাদেশে এসেছিলেন। ৯৪/৯৫ এর দিকে। ছোট মামা তখন ক্যাপ্টেন, সাভার ক্যন্টনমেন্টে কোয়াটারে থাকেন। এসে উঠেছিলেন ছোটমামার কোয়াটারে। আমরা সবাই সেখানে উপস্থিত হয়ে ছিলাম আগেই। বড়মামি এসেছিলেন জিন্সের প্যান্ট আর সার্ট পরে। সেটা দেখে আমাদের ফ্যামিলির মা খালাদের আক্কেল গুডুম শব্দ করে আকাশ থেকে পরে।
আমার মামাতো ভাই নিঝুম তখন আমার চেয়ে একটু ছোট ছিল। নিঝুম আমাকে খুব ভালবেসেছিল। ও আমাকে যাওয়ার সময় ওর ঝুরি থেকে প্রায় শ’খানেক ছোট ছোট গাড়ি দিয়ে গিয়েছিলো। সেই গারিগুলোর দাম তখন আমার কাছে এই পৃথিবীর চেয়ে বেশি ছিল। আর সেই ছোট ছোট এমেরিকান খেলনাগুলো এতো সুন্দর ছিল যা দিয়ে খেলা যেকোন বাচ্চার জীবনে পরম সৌভাগ্য হওয়ার কথা। পৃথিবী তখন আমার কাছে এক জায়গায় আর সেই খেলনা গুলো এক জায়গায়। মামা চলে যাওয়ার সময় সবাই খুব কান্নাকাটি করেছিল। সেই যে গেলো আর এলনা।
যদিও মামা বলি, কিন্তু মামা বলতে যা বোঝায় তা উনি না। কারন তাকে জীবনে আমি মাত্র দুইবার দেখার কথা মনে আছে। এক- ছোট থাকতে, দুই- এমেরিকা থেকে আসার পর। উনার সাথে আমার জীবনে মাত্র একবার কথা হয়েছে। উনি এককথায় একজন এলিয়েন বা অন্য গ্রহের মানুষ। এলিয়েনদেরও পৃথিবীর প্রতি আকর্ষণ থাকে বিধায় তারা ফ্লায়িং সসারে করে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু বাহাউদ্দিন সাহেবদের মতো এলিয়েনদের নিজের পরিবারের প্রতি পর্যন্ত কোন টান থাকে না। তারা হয় ‘মহাপুরুষ’ গোত্রের। কারো কোনকিছুই তাদের স্পর্শ করেনা।
©somewhere in net ltd.