নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পাহাড়ের প্রতিধ্বনী

মমতাজ-কলি

ভাল করে বাঁচতে চাই

মমতাজ-কলি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো আদিবাসী নয় অভিবাসী

১০ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১২:৪৫

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি আদিবাসীদের সঠিক পরিচিতি নিয়ে নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি জনগোষ্ঠীদের নিয়ে। ঐতিহাসিক তথ্যসূত্রানুযায়ী তারা বাংলাদেশের আদিবাসী না হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে দাবী করছে । অপরদিকে আদিবাসীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না মর্মে জাতিসংঘের সাথে পশ্চিমারা সম্প্রতি খুব হৈ চৈ শুরু করেছে। মজার বিষয় হচ্ছে, জাতিসংঘের যেসব সদস্য দেশে আদিবাসী রয়েছে, তাদের এ ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই । অন্যদিকে, জাতিসংঘ পশ্চিমাদের বিশেষ কূট-কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাদামী এবং কালো চামড়ার দেশগুলোর ওপর নৈতিকতার দোহাই দিয়ে আ�তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক প্রণীত কনভেনশন ১৬৯ চাপিয়ে দিতে চাইছে। এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এই সনদে স্বাক্ষর করার চাপ দিচ্ছেন। তাই ইতিহাসসম্মত বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুসারে বাংলাদেশে আদিবাসী অভিধাযোগ্য কোন জনগোষ্ঠী আছে কিনা, এখনই পর্যালোচনা দরকার। বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব জনগোষ্ঠী উপজাতীয় হিসেবে বিবেচিত, সেগুলো হলো : চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মগ, কুকি, লুসাই, সেন্দুজ, পাংখো, বনযোগী, খুমি, গারো, হাজং, মণিপুরী, পাঙ্গন, খাসিয়া, সাঁওতাল, ওরাও, রাজবংশী প্রভৃতি ২৯টি জনগোষ্ঠী। এসব জনগোষ্ঠীতে ধর্মীয় দিক থেকে বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান এমনকি ইসলাম ধর্মের অনুসারীও রয়েছে (মৌলভীবাজার জেলার ক�লগঞ্জ থানার প্রায় ৩০ হাজার মুনিপুরী/ পাঙ্গন উপজাতি মুসলীম ধর্মাবলম্ভী)। তারা রাষ্ট্রের সাধারণ মানবমণ্ডলী তথা নাগরিকমণ্ডলীর অবিচ্ছেদ্য অংশ, যাদের কল্যাণে ও উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে অন্যান্য নাগরিকের মতোই। এখানে এ মুহূর্তে যে বিষয়টা গুরুত্ববহ সেটা হলো, নৃ-বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞানের স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুসারে উপরে বর্ণিত জনগোষ্ঠীগুলোকে ভূমিজ সন্তান বলা যায় কিনা? এসব উপজাতিদের নিজস্ব যে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়, তাতে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে যে, তাদের পূর্বপুরুষেরা অদূর অতীতে বাংলাদেশের সীমানার বাইরে অপরাপর রাজ্য কিম্বা অঞ্চল থেকে রাজনৈতিক কারণে এবং বিশেষ করে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে । তারা সবাই কোন না কোন ধর্মানুসারী ছিল, সভ্য জীবনযাপন করত, রাজ্যশাসন করত, প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধ করত এবং যুদ্ধে হেরে বাংলাদেশের কোন না কোন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা উল্লেখযোগ্য। স্বীকৃত সব নৃ-তত্ত্ববিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এরা কোনভাবেই কোন সংজ্ঞায় �আদিবাসী� হিসেবে অভিহিত হতে পারে না।



আদিবাসী বলতে কী বোঝায়

ইংরেজী Indigenous শব্দটির বাংলা হচ্ছে আদিবাসী। A person or living thing that has existed in a country or continent since the earliest time known to people� অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে কোন এলাকার বিশেষ জনগোণ্ঠী যদি ঐ এলাকায় বসবাস করে তাহলে তাদেরকে ঐ এলাকার আদিবাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। Indigenous শব্দটির অর্থ হচ্ছে Nation born originating or produced naturally in a country, not imported অর্থাৎ আদিবাসী হতে হলে অভিবাসী হলে হবে না, বরং সত্যিকারভাবে একটি দেশে প্রাচীনকাল থেকে উৎপত্তি হতে হবে। এ ব্যাপারে আমেরিকার প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ লুইজ মর্গান আদিবাসীকে সজ্ঞায়িত করেছেন এইভাবে, The Aboriginals are the groups of human race who have been residing in a place from time immemorial - They are the Sons of the soil আদিবাসী হতে হলে একটি বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য থাকতে হবে যা হলো �ভূমিপুত্র� বা � Sons of the soil� . জাতিসংঘ থেকে UNPFII (United Nation Permanent Forum for Indigenous Issues) এর মাধ্যমে কারা আদিবাসী হবে তার একটি মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছে। জাতিসংঘ কমিশনের স্পেশাল র‌্যাপোটিয়ার হোসে মার্টিনেজ কোবে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তাতে বলা হয়েছে, �কোন ভূখণ্ডের আদিবাসী সম্প্রদায়, জাতিগোষ্ঠী বা জাতি বলতে তাদের বোঝায়, যাদের ঐ ভূখণ্ডে প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-উপনিবেশকাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে, যারা নিজেদেরকে ঐ ভূখণ্ডে বা ভূখণ্ডের কিয়দাংশে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। সেই সাথে তারা নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইন ব্যবস্থার ভিত্তিতে পূর্বপুরুষের ভূখণ্ড ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দৃঢ়পতিজ্ঞ�। জাতিসংঘের সংজ্ঞায় মূলত তিনটি বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে, যা হলো : ১. যারা কোন উপনিবেশ স্থাপনের আগে থেকেই ওই ভূখণ্ডে বাস করছিল, ২. যারা ভূখণ্ডের নিজস্ব জাতিসত্ত্বার সংস্কৃতি ধরে রেখেছে এবং তা ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ৩. যারা নিজেদের সতন্ত্র মনে করে। এই সজ্ঞাসমূহের আওতায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকগণ সত্যিকার অর্থে কারা আদিবাসী তার উদাহরণ দিতে যেয়ে বলেছেন যে, খর্বাকৃতি, স্ফীত চ্যাপ্টা নাক, কুঁকড়ানো কেশবিশিষ্ট কৃষ্ণবর্ণের �বুমেরাংম্যান�রা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী বা যথার্থ অ্যাবোরিজিন্যালস। তারা ওখানকার ভূমিপুত্র বটে। ঠিক একইভাবে মাউরি নামের সংখ্যালঘু পশ্চাৎপদ প্রকৃতিপুজারি নিউজিল্যাণ্ডের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী সেখানকার আদিবাসী। কিন্তু পার্বত্যচট্টগ্রামের উপজাতিরা এসব সজ্ঞার অন্তভূত নয়। তারা বার্মা থেকে বিতাড়িত হয়ে চট্টগ্রাম তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের অরণ্যে আশ্রয় নিয়েছে ১৭শ খ্রিস্টাব্দ ও ১৮শ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ের দিকে।

উপরোক্ত সূত্রের আলোকে অবশ্যই বলা যায়, একমাত্র বাঙালিরাই এই এলাকার আদিবাসী, যারা ব্রিটিশ কলোনী স্থাপনের আগে তো বটেই, সেই প্রাচীনকাল থেকে বংশ পরম্পরায় ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, স্বতন্ত্র, সামাজিকতা , রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত স্বতন্ত্রবোধ বজায় রেখেছে। সে হিসেবে বাঙালিরাই এখানকার একমাত্র �ভূমিপুত্র�। এখানে আরেকটা কথা উল্লেখ্য যে, ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশরা সেটেলমেন্ট কলোনাইজেশন না করায় এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা বাঙ্গালীদের কখনই মূল ভূখণ্ড থেকে উৎখাত করার পরিকল্পনাতো দূরের কথা, এমনকি বাঙালিদের ভাষা, কৃষ্টি, কালচার এর উপরও কোন প্রভাব বিস্তার করেনি। সুতরাং এই বিবেচনায়ও বাঙ্গালীরাই এই এলাকার প্রাচীনতম ও একমাত্র আদিবাসী। এক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলাদেশের সমতলে কিংবা পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর পরিচয় তাহলে কি হবে ? আদিবাসীর সংজ্ঞা ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে এটাই বোঝা যায় যে, সমতলে কিংবা পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র জাতিগুলো বহিরাগত এবং তারা অভিবাসী জনগোষ্ঠী, কোন ভাবেই আদিবাসী নয়।



পার্বত্য চট্টগ্রামে জনবসতির সূত্রপাত এবং যে কারণে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো আদিবাসী নয়

পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রামেরই অংশ। প্রশাসনিক কারণে ইংরেজ শাসানমলে চট্টগ্রামের পূর্বের অরণ্য এলাকাটি পৃথক করে এর নামকরণ করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। পৃথক হবার পূর্বে থেকে সমগ্র চট্টগ্রাম জুড়েই চট্টগামীরা বসবাস করে আসছে। এমনকি মোগল শাসনামলে সীমান্ত পাহারায় রাঙ্গামাটিতেও একটি সামরিক দূর্গ ছিল। এই দূর্গকে কেন্দ্র করে আশে-পাশে বিপুল সংখ্যক চট্টগ্রামী বসবাস করতো। সে বিষয়ে মোগল শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তে স্পষ্টই জানা যায়। চট্টগ্রামীরা বনজসম্পদ আহরণে অরণ্যে যাতায়াত করতো এবং কর্ণফূলি নদীর তীরবর্তী কোন কোন এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যও গড়ে তুলেছিলো। এমনই সময় অর্থাৎ ১৬শ খ্রিস্টাব্দের দিকে উত্তরাংশে অর্থাৎ আজকের খাগড়াছড়ি এলাকায় কিছুসংখ্যক ত্রিপুরা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে এসে গহীন অরণ্যে জুম চাষাবাদ শুরু করে। এছাড়া আসামের মিজোরামের অরণ্য থেকে কুকি নামক এক উলঙ্গ জাতিও মাঝে মধ্যে বিচরণ করত চট্টগ্রামের এই অরণ্য পথে। তারা কিছুদিন এদিক সেদিক ঘুরে-ফিরে আবার চলে যেত মিজোরামে।

১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে আরাকান থেকে বিতাড়িত একদল চাকমা সর্বপ্রথম নাফ নদী পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের রামু থানার অদূরে নদী তীরে অবস্থান নেয়। তারা সেখানে সল্প সময় অবস্থানের পর গভীর অরণ্যে (আলীকদম উপজেলা) চলে যায়। চাকমারা কেন রামু থেকে আলীকদম এবং আলীকদম থেকে রাঙ্গামাটির দিকে এলো তার একটা ঐতিহাসিক ও ধারাবাহিক তাৎপর্য্য রয়েছে। তা হল- ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার শাহ সুজা আপনভাই সম্রাট আওরঙ্গজেবের সাথে বক্সার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রামের প্রাচীন বন্দর শহর দেয়াঙ-এ (বর্তমানে আনোয়ারা উপজেলা) আশ্রয় নেয়। এক পর্যায়ে তিনি তাঁর অনুগত ১৮ জন সেনাপতির নেতৃতে সেনাবাহিনীকে রামুতে রেখে শুধু তাঁর নিকটাত্মীয়দের নিয়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে আরাকানের রাজধানীতে যান। উল্লেখ্য যে, প্রায় একই সময়ে আরাকান থেকে বিতাড়িত চাকমাদের প্রথম দলটি রামুর নদী তীরে (চাকমারকুল) অবস্থান নিয়েছিল। সে সময়ে মোগল সৈনিকদের সাথে চাকমা শরনার্থীদের যোগাযোগ ঘটে। এদিকে আরাকানের রাজধানীতে আশ্রয়ের কিছু সময়ের মধ্যে আরাকানের তৎকালীন তরুণ রাজা সুবেদার শাহ সুজার এক কন্যাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সুজা তাতে ক্ষুদ্ধ হয়ে আরাকানের রাজার সাথে বাকবিতণ্ডা ও ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন এবং এক পর্যায়ে আরাকানের রাজার হাতে সপরিবারের নিহত হন । এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রামুতে অবস্থানরত মোগল যোদ্ধাদের সাথে আরাকানী সৈনিকদের খন্ড খন্ড যুদ্ধ বেঁধে যায় এবং মোগলযোদ্ধারা রামু ত্যাগ করে পূর্বে গভীর অরণ্যে গিয়ে পুনরায় দূর্গ স্থাপন করে। মোগল যোদ্ধারা ইসলামের অন্যতম খলিফা হযরত আলী (রাঃ)-এর অনুসারী শিয়া সম্প্রদায়ের হওয়ায় তারা হযরত আলীর নামানুসারে ঐ এলাকার নামকরণ করেন �আলীকদম� (বর্তমানে আলীকদম উপজেলা)। মোগলযোদ্ধাদের পিছু পিছু চাকমারকুলের চাকমারাও চলে যায় আলীকদমে। মূলত এখানেই নারী বিহিন মোগল যোদ্ধাদের সাথে চাকমাদের এমন এক সমাজ গড়ে ওঠে যাতে বহু মোগলযোদ্ধা চাকমা রমণী বিয়ে করে সংসার জীবনও শুরু করে।

এদিকে সহোদর শাহ সুজা হত্যাকাণ্ডে ক্ষুদ্ধ হয়ে দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সেনাপতি শায়েন্তা খাঁকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করে বাংলায় প্রেরণ করেন। ১৬৬৬ সালের প্রথম দিকে শায়েস্তা খাঁ আপন পুত্র উমেদ খাঁকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করে আরাকানের অভিযানের নির্দেশ দেন। ২৭ জানুয়ারী ১৯৬৬ তারিখে মোগলরা ব্যাপক হতাহতের মধ্যে দিয়ে চট্টগ্রাম বিজয় করে নেয়। চট্টগ্রাম বিজয়ের পর প্রধান সেনাপতি উমেদ খাঁ চট্টগ্রামের নবাব হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন এবং আলীকদমে আশ্রিত মোগলদের মাধ্যমে কার্পাসকর প্রদানের শর্তে আলী কদমে জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। আর এ জমিদারীর প্রজা হয় বার্মা থেকে বিতাড়িত সেই জুমিয়া চাকমারা। এভাবেই চলছিল কয়েক বছর। পরবর্তীতে মোগল ও আরাকানীদের অব্যাহত খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের কারণে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল ঐ সময় �নো-ম্যান্সল্যান্ড� নামে অভিহিত হয়। ঐ এলাকা চট্টগ্রামের নবাবের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকলেও সেখানকার জমিদার শের জালাল খাঁ নিকটবর্তী আরাকানীদের বারংবার হামলার কারণে আরাকানীদের সাথে মিত্রতা ও তাদের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন নবাব মীর হাদীকে কর না দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এতে চট্টগ্রামের নবাব ক্ষুব্ধ হয়ে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে জমিদার জালাল খাঁ�র প্রাসাদ ও যাবতীয় স্থাপনা ধ্বংস করে দেন। সেই সাথে জুমিয়া চাকমাদের উপরও হামলা চালিয়ে তাদের সবকিছু ধ্বংস করে দেন। ফলে অনন্যোপায় জালাল খাঁ আরাকানের অভ্যন্তরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানেও তিনি আরাকানীদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে প্রাণত্যাগ করেন। জুমিয়া চাকমারাও প্রাণ রক্ষার্থে নানাস্থানে আশ্রয় নেয়।

সে সময় চট্টগ্রামের দেয়াঙে (আনোয়ারায় থানা) বসবাসরত জালাল খাঁ�র সহযোদ্ধা সেনাপতি শেরমস্ত খাঁ�র ছিল বিশাল প্রতিপত্তি যিনি ক্রমান্ময়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণে চকরিয়া-রামু পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূমির জমিদারী লাভ করেছিলেন। আলীকদম ট্রাজেডির ১৩ বছর পর ঐ শেরমস্ত খাঁই মোগল নবাব জুলকদর খানের কাছ থেকে রাঙ্গুনিয়ার কোদালা এলাকা বন্দোবস্তি এবং পার্বত্য অঞ্চলের জুমকর আদায়ের তহশিলদারী লাভ করেন । সেখানে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত আলীকদম থেকে সহযোদ্ধা মোগল সৈনিক ও তাদের পরিবার পরিজন এবং জুমিয়া চাকমা প্রজাদেরকে নিয়ে এসে বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। উদ্বাস্তু এসব চাকমারা শেরমস্ত খাঁর খামার আবাদে নিয়োজিত হয়। উল্লেখ্য যে, সপ্তদশ শতাব্দীতে শেরমস্ত খাঁর অনুসারী হয়ে কোদালা, পদুয়ায় আগত চাকমারা অনেকে মোগলদের ধর্ম গ্রহণ করে।

১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার নবাব মীর কাসিম ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট চট্টগ্রামের শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর ইংরেজ প্রশাসকগণ রাঙ্গুনিয়ার কোদালা-পদুয়া থেকে অনতিদূরে সাংগু নদী এবং সীতাকুণ্ডের নিজামপুর রোড পর্যন্ত পাহাড়ী অঞ্চল নিয়ে পদুয়া-কোদালার জমিদারির সীমানা নির্দেশ করে দিয়েছিলেন যার দায়িত্বে ছিলেন শেরমস্ত খাঁর উত্তরসরী শের জব্বার খাঁ । তিনি মোগল শাসামলের নিয়মেই ইংরেজদের কর প্রদান করতে থাকেন এবং ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই কর প্রদান করেছিলেন। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে বার্মার রাজা বোধপায়া ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে নাফ নদীর তীরবর্তী আরাকানরাজ্য আক্রমণ করে দখল করে নেয়। বর্মী সৈন্যদের নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের ফলে প্রাণ রক্ষার্থে হাজার হাজার মারমা, চাকমা ও অন্যন্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী নাফ নদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার আশ্রয় গ্রহণ করলে তৎকালিন ব্রিটিশ সরকার এসব শরনার্থীদের কর প্রদানের শর্তে পাহাড়ী এলাকায় জুম চাষের সুযোগ করে দেয়। আরাকান থেকে দ্বিতীয় দফায় আগত এ জনগোষ্ঠী চট্টগ্রামের অরণ্যে প্রবেশ করে চলে আসে পদুয়া-কোদালায় এবং পূর্বে আগত গোষ্টিগদ চাকমাদের সাথে সহজেই মিশে যায়। ফলে এসব জুমিয়া চাকমা ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। প্রজার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ইংরেজ কতৃপক্ষ জমিদারে উপর করও বাড়িয়ে দেয়। তৎকালীন জমিদার জানবক্স খাঁ কর বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেন এবং কর প্রদান বন্ধ করে দেয়। তাতে সরকার তার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালালে তিনি কলিকাতায় গিয়ে ব্রিটিশ কতৃপক্ষের কাছে আত�সমর্পন করতে বাধ্য হন এবং পুনরায় জমিদারি পরিচালায় চুক্তিবদ্ধ হন। পুনরায় যাতে বিদ্রোহ না হয় সে জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে উত্তর রাঙ্গুনিয়ার সমতল ভূমিতে জমিদারি কাচারি প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য করে, তারই জমিদারবাড়ির নামানুসারে ঐ এলাকার নামকরণ হয়ে যায় রাজানগর।

রাজানগরে মোগল বংশজাত সর্বশেষ জমিদার বা চাকমাদের রাজা ছিলেন ধরমবক্স খাঁ। তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন চাকমা রমণী কালিন্দীর সাথে এবং মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর জমিদারীর উত্তরাধিকার নিয়ে তারই স্বগোত্রীয় মীর্জা হোসেন খাঁর সাথে রানী কালিন্দীর দ্বিমত দেখা দেয়। একদিকে মীর্জা হোসেন খাঁর নেতৃত্বে মোগল বংশজাত মুসলিমরা অন্যদিকে রানী কালিন্দীর নেতৃত্বে চাকমা জুমিয়ারা। অপর দিকে বার্মা থেকে বিতাড়িত প্রায় ৪ হাজার বিদ্রোহী তঞ্চগ্যা রানী কালিন্দীর সাথে যোগ দিয়ে চাকমাদের শক্তি বৃদ্ধি করতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। ফলে এসব বাঙালি তথা মোগল পরিবারগুলো প্রাণভয়ে সমতলের দিকে ছুটে যায় এবং পার্বত্য জমিদারী পরিচালনায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে আদালত ধরমবক্স খাঁর স্ত্রী হিসেবে রানী কালিন্দীর পক্ষে রায় ঘোষণা করে। সেই সাথে রানী কালিন্দীর খড়গতলে শত বছরের মোগল জমিদারী মুসলিম পরিবারের হাতছাড়া হয়ে যায়। রানী কালিন্দী তাঁর জমিদারীকালে মোগল ঐতিহ্য দেওয়ান পদবি বাতিল করে তদস্থলে তালুকদার নামক একটি নতুন পদ চালু করেন। তাঁর উত্তরসরী হরিশচন্দ্র পূনরায় মোগলদের সাথে মামলায় জড়িয়ে পড়লে আদালত মোগলদের পক্ষে রায় দেয় (উল্লেখ্য যে, বেশ কটি মোগল পরিবার আজও রাঙ্গুনিয়ায় বসবাস করে আসছে)। এতে হরিশচন্দ্র ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং নতুনভাবে বসবাস স্থাপন করেছিলেন রাঙ্গামাটিতে। এভাবেই ১৭শ-১৮শ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক চাকমা, মারমা এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গুলো পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসিত হয়ে যায়।

পূর্ববর্তী আলোচনায় নৃতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, পাহাড়ের বর্তমান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো হল অভিবাসী। সুতরাং তারা চট্টগ্রাম তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের �ভূমিপুত্র� না হওয়ায় আদিবাসী হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

বহিরাগত হওয়ার কারণে ইংরেজ সরকার তাদেরকে নিজ শাসনাধীন মনে করতেন না। চট্টগ্রামের কমিশনার মি. হলহেড ১৮২৯ সালে মন্তব্য করেন যে, � ঞযব যরষষ ঃৎরনবং ধৎব হড়ঃ ইৎরঃরংয ংঁনলবপঃং নঁঃ সবৎবষু ঃৎরনঁঃধৎরবং ধহফ ঃযধঃ বি ৎবপড়মহরুবফ হড় ৎরমযঃ ড়হ ড়ঁৎ ঢ়ধৎঃ ঃড় রহঃবৎভবৎব রিঃয ঃযবরৎ রহঃবৎহধষ ধৎৎধহমবসবহঃ�. ১৯০০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়েলে ব্রিটিশরা এ অঞ্চলকে নন-রেগুলেটড এরিয়া বা অশাসিত-এলাকা হিসেবে উল্লেখ করে এবং ১৯২০ সালে এলাকাটিকে ঊীপষঁংরাব অৎবধ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার এলাকাটিকে একান্ত ঊীপষঁংরাব অৎবধ এর পরিবর্তে উপজাতি এলাকা হিসেবে অভিহিত করে। যদি ১৯০০ সাল থেকেও ধরি তাহলে দেখা যাবে কোথাও কোন পর্যায়ে এ এলাকাকে আদিবাসী এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। ১৯৯৭ সালে যে শান্তিচুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে তাতেও স্থান পায়নি আদিবাসী শব্দটি। এমনকি এসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো তাদের অধিকার আদায়ের দীর্ঘ বছরের সংগ্রামেও নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে উল্লেখ করেছে এমন প্রমাণ কোথাও নেই। অন্যদিকে আ�তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক প্রণীত কনভেনশন ১০৭ (যা বাংলাদেশ সাক্ষর করেছে) অনুসারেও এ এলাকায় কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী থাকলে তারা একমাত্র চাটগাইয়া বাঙ্গালিরা ছাড়া আর কেউ নয়।



বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী বানাতে আন্তর্জাতিক মহল উদগ্রীব

নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নিরিখে জাতিসংঘের আদিবাসী ফোরামের দেয়া মানদণ্ড অনুসারে যারা আদিবাসী হওয়ার যোগ্য নয়, তাদেরই আবার আদিবাসী হওয়ার স্বীকৃতির বিষয়টি আধিপত্যবাদের নতুন কোন ফন্দি ফিকির ছাড়া আর কিছুই নয়। মূলত পশ্চিমারা নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী হীন ও নীচ চিন্তা-ভাবনা থেকেই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিজস্ব রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদিবাসী ইস্যু সৃষ্টি করছে যা পাহাড়ী বাঙ্গালী কারও জন্যেই মঙ্গলকর কিছু আনবে না, বরং জন্ম দিতে পারে নিশংস দাঙ্গা-হাঙ্গমা ও বিভাজনের।



সবাই বাংলা মায়ের সন্তান

ইতিহাসের সততার স্বার্থে কোন প্রকার ধূম্রজাল সৃষ্টি হতে দেয়া উচিৎ নয়। যা সত্য, সহজভাবে তার ছায়াতলে দণ্ডায়মান হলে অনেক প্রকার সমস্যার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় এবং এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। বর্ণিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী জনগনের পূর্বপুরুষেরা প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ থেকে এলেও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ মুহূর্তে বসবাসরত সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগনের জন্ম বাংলাদেশে, তাদের জীবনযাপন বাংলাদেশে এবং সর্বাগ্রে তারা বাংলাদেশের সন্তান। তারা বাংলাদেশেরই নাগরিক এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশের অপরাপর কোন জনগোষ্ঠীও বিন্দুমাত্র দ্বিমত পোষণ করে না। আন্তর্জাতিক কুটিল রাজনীতির পর্দা সরিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে তাকালে দেখা যায়, এ এলাকার শ্রমজীবী জনতা তথা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এবং বাঙালি জনগণ বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, হিন্দু ও মুসলিম যাই হোক না কেন পরস্পর পরস্পরের জীবন সংগ্রামের সহযোদ্ধা । সবাই সবার ভাই এবং সবারই অধিকার সমান। এটাই হচেছ সত্যিকারের বাস্তবতা। সুতরাং, আমরা আমাদের সার্বভৌমত্বকে বলি দিয়ে নতুন কোন দক্ষিণ-সুদান কিংবা পূর্ব-তীমূর সৃষ্টি করতে পারি না। আমাদের উচিৎ বহিঃশত্র�র কুমন্ত্রণায় কান না দিয়ে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থে এক ছাতার নীচে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবন সংগ্রামের পথ পাড়ি দেয়া। �সবার উপরে দেশ� এ মূল-মন্ত্রকে শীরধার্য করে আসুন আমরা আগামী প্রজন্মকে একটি নিস্কণ্টক ভবিষ্যৎ উপহার দিয়ে যাই

সূত্র : বার্তা লাইভ ২৪ ডটকম,জাহাঙ্গীর কামাল, রাঙামাটি (৮ আগষ্ট): Click This Link

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:২৬

ধীবর বলেছেন: এত কথার কাজ নেই। যারা আদিবাসি নামের সামাজ্যবাদিদের খেলায় বাংলাদেশকে ভাঙ্গার কাজে জড়িত, তাদের চিরদিনের মত ইতিহাসে পাতায় স্থান দিতে হবে। পোস্টে প্লাস ও প্রিয়তে রাখলাম।

২| ১০ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ২:৪৪

স্পুতনিক বলেছেন: সুন্দর পোস্ট প্রিয়তে রাখলাম।

৩| ১০ ই আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৩:০৪

ফ্রীডম@মিডনাইট বলেছেন: 08 Aug 2012 03:48:14 PM Wednesday BdST

‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি কতটা যৌক্তিক!
ড. মো. আজিজুল হক, অতিথি লেখক
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসি বর্ষ ঘোষণা করে। তখন থেকে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে এমন দেশে আদিবাসী দিবস উদযাপিত হলেও বাংলাদেশে কখনো তা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়নি। সরকারি ভাষ্য অনুসারে, এদেশে কোনো আদিবাসী নাই, যারা আছেন তারা উপজাতি।

০৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে স‍ামনে রেখে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিভিন্ন সংগঠন ও নেতারা তাদের আন্দোলন জোরালো করছেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে সভা, সেমিনার, মিছিল করছেন।

গত সপ্তাহে ঢাকায় আয়োজিত এমনি একটি জাতীয় সেমিনারে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা ) সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ২৩(ক) অনুচ্ছেদে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের’ শব্দসমূহ পরিবর্তন করে `আদিবাসী জাতিসমূহ` শব্দাবলী সংযোজনের দাবি জানিয়েছেন।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এতোদিন তিনিসহ অন্যান্য নেতারা শুধু আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে এসেছেন, বর্তমানে `আদিবাসী` শব্দের সঙ্গে `জাতিসমূহ` সংযোজন করেছেন। এটা একটি শুভলক্ষণ বলে মনে হয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে তিন ডজনের অধিক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সম্প্রতিক সময়ে সরকার সংবিধান সংশোধনের জন্য হাইকোর্টের দিক-নির্দেশনামূলক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সরকারের সুচিন্তিত এবং ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠনমূলক এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে তাদেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য দাবি করেছেন।

এদেশের কিছুসংখ্যক শিক্ষাবিদ,বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাদের দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এদেশের ভূমিজ সন্তান বাঙালি এবং ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সকল সদস্যের কাছে আমার একটি বিনীত প্রশ্ন, তিন দশক পূর্বে শুরু হয়ে অদ্যাবধি মিয়ানমারের তৎকালীন স্বৈরাচারি সামরিক একনায়ক ও স্থানীয় রাখাইন উপজাতির সীমাহীন অত্যাচার ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে কক্সবাজার জেলার বিভিন্নস্থানে মানবেতর জীবনযাপনকারী রোহিঙ্গা শরনার্থীদের কি মানবিক বিবেচনায় এদেশের আদিবাসী বলে স্বীকৃতি দেওয়া যায়? অথবা বাংলাদেশি হিসেবে? নিশ্চয়ই দেশপ্রেমিক পাঠকমাত্রই এ প্রস্তাবে আঁৎকে উঠে দ্বি-মত পোষণ করবেন। কারণ এরা এদেশে শরণার্থী মাত্র।

প্রিয় পাঠক, তারা যদি এদেশের নাগরিক বা আদিবাসী না হন তবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরাও এককভাবে বাংলাদেশের আদিবাসী নন। কারণ রোহিঙ্গারা যেমন বাধ্য হয়ে এদেশে এসেছেন বিংশ শতাব্দীতে, তেমনি চট্টগ্রাম বিভাগের সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ঠিক একই অঞ্চল আরাকান থেকে বাধ্য হয়েই এ অঞ্চলে এসেছেন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে। কয়েক শতকের ব্যবধান মাত্র। পার্থক্য এই যে, রোহিঙ্গারা বাঙালি ও বাংলাদেশি হওয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা এককভাবে নিজদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চাচ্ছেন। কিন্তু তারা এদেশের আদিবাসী নন। প্রকৃত প্রস্তাবে তারা এক একটি ক্ষুদ্র জাতি। স্ব-স্ব গৌরবময় পরিচয়ে বাংলাদেশি। এদেশের বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতির অংশীদার হয়েছেন তারা।

আদিবাসী হিসেবে দাবিদার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নেতাদের এবং বুদ্ধিজীবীগণের কাছে প্রবন্ধের শুরুতেই আমার সবিনয় প্রশ্ন, উপজাতিরা এদেশের আদিবাসী হলে আমি এবং আমার পূর্বপুরুষ তথা এদেশের মূল জাতিগোষ্ঠী বাঙালি তথা প্রাচীন বাংলার অনার্য জনগোষ্ঠীর বর্তমান প্রজন্ম আমরা কি এদেশে অ-আদিবাসি বা বহিরাগত? বাঙালিরা কি বাংলাদেশের আদি-বাসিন্দা তথা আদিবাসী নয়? ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা বিশেষতঃ বৃহৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত এগারোটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা তৎকালীন আরাকান রাজ্য ও ভারত থেকে এবং উত্তরাঞ্চলের সকল উপজাতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ইত্যাদি অঞ্চল থেকে কর্ম-উপলক্ষে বা পরাজিত শক্তি হিসেবে যখন এদেশে আগমন করেছিলেন, তখন কি এদেশ বিরাণভূমি ছিল? কোনো জনবসতি ছিল না? তারা যে এদেশে বাইরে থেকে আগত, তা ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রমাণিত।

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার শতকরা দুই ভাগের কম কিন্তু ভারতে তা শতকরা আট এর বেশি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বঙ্গ ও বাঙালির ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের এবং তাদের উৎপত্তি ও বিকাশ এদেশের মাটিকে কেন্দ্র করেই। প্রাচীন বাংলার রাজধানী পুণ্ড্রবর্ধনপুর, পাহাড়পুর, জগদল বিহারসহ অঙ্গ, বঙ্গ, কুলিঙ্গ, রাঢ়, বরেন্দ্র, গৌড় ইত্যাদি অঞ্চলে বসবাসরত প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে এদেশে আগত আর্যরা ‘অনার্য বা নিষাদ’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছে। এদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী তাদের কাছে ছিল হীন ও অন্ত্যজ। হিন্দু ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জাতি-বর্ণ প্রথায় এরা ছিল অস্পৃশ্য। প্রাচীনকালের পরিব্রাজকদের কাছে এরাই “পাখির মত কিচির-মিচির ভাষায় কথা বলা” জনগোষ্ঠী। এরাই এদেশের মূল বাসিন্দা বা আদিবাসী।

তাহলে জেনে এবং বুঝে ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করে এদেশের যারা ভূমিজ সন্তান নয় বরং বহিরাগত, তাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি চাওয়ার মূল রহস্য কোথায়? প্রাগৈতিহাসিককালের অখণ্ড ভারতে বর্তমান সার্কভুক্ত দেশসমূহে বসবাসরত সকল নরগোষ্ঠীর সকল গ্রুপ বা মানবগোষ্ঠী বসবাস করছিলেন। সকলেই ভারতের আদিবাসী। ভারত এদেরকে আদিবাসী ও তপসিলি উপজাতি বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।

নিকট অতীতে এদেশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন দেশ বা রাজ্যে বিভক্ত ছিল। অনেক এলাকা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক জনপদবাচক শব্দে পরিচিতি লাভ করে। যেমন বঙ্গ। বঙ্গ জনপদবাচক ভূখণ্ড স্বাধীন দেশ হিসেবে এবং এখানকার বাসিন্দারা বাঙালি বলে আত্মপ্রকাশ করলেও অনেকের ক্ষেত্রে তা হয়নি। অনেক জনপদের স্বাধীন সত্তা বিলীন হয়েছে, অনেক ক্ষুদ্র জাতি সবল জাতির কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজদের একীভূত করেছে।

সুতরাং পানি ঘোলা করার জন্য আদিবাসী দাবি উত্থাপন করে বিতর্ক জিইয়ে রাখা জাতি ও দেশগঠনমূলক কোনো কর্ম হতে পারে না। সকল ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, ব্রিটিশ শাসকদের লিখিত রিপোর্ট এবং নিকট অতীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৃদ্ধিজীবীদের লেখা প্রবন্ধ-বই, নেতাদের সাক্ষাৎকার, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর কাছে চাকমাদের প্রদত্ত লিখিত স্মারকলিপি এবং ১৯৯৭ সালে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পাদিত শান্তি চুক্তিতেও `উপজাতি` শব্দটি লিখিত হয়েছে। সেখানে তারা অকপটে বলেছেন, ``আমরা পাহাড়ি জাতি, জুম্ম জাতি, উপজাতি পরিচয়ে গর্ববোধ করি।``

স্মরণাতীতকাল থেকেই বহু নৃ-গোষ্ঠী, জন-জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ ও এর সামগ্রিক জনপ্রবাহ। উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় হিন্দু জাতি-বর্ণ প্রথার নিচু স্তরে অবস্থান করা লাখ লাখ মানুষ দলে দলে মুসলমান হয়েছেন। যেমন পাঙন, লাওয়া, বিনদ মুসলিম এবং বেদিয়া সম্প্রদায়ের বাঙালি মুসলিম।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে কোঁচ, কৈবর্ত, হাজং, হো, রাজবংশী ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মানুষ হিন্দু ধর্মমত গ্রহণ করে নিজেদের স্বাধীন সত্তা বিলীন করেছে। এরাই এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। সুতরাং বিভিন্ন সময় এদেশে আগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নরগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবি কতটুকু যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে।

বর্তমানে এদেশে `ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী-উপজাতি-আদিবাসী` শব্দ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস চলছে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অশান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসকদের চালু করা ইংরেজি `ট্রাইবাল` শব্দের বাংলা পরিভাষা হিসেবে `উপজাতি` কথাটি ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে। পূর্বে এ নিয়ে আপত্তি না থাকলেও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিগণ বর্তমানে বলছেন,“আমরা কোনো জাতির ‘উপ’ অংশ নই”। তাদের আপত্তির মুখে সরকার `ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী` বলে স্বীকৃতি দিলেও তারা এখন নিজেদের `আদিবাসী` দাবি করছেন। এদেশের বৃহৎ বাঙালি জাতি এ দাবি মেনে নেবে কি-না, তা বিবেচনায় রাখতে হবে। তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অথবা শান্তি অথবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য যদি তর্কের খাতিরে তাদেরকেও বাঙালিরা আদিবাসী বলে মনে করেন, তবে উভয় পক্ষই আদিবাসী। একপক্ষকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

বিবদমান দু’পক্ষের মধ্যে এক পক্ষের দাবি মেনে নিলে বাঙালিদের দাবি ও যুক্তি অসার হয়ে যাবে, মনে হবে বাঙালিদের দাবি সঠিক ছিল না। হয়তো বা অদূর ভবিষ্যতে স্বীকৃত আদিবাসীরা বিশেষ উদ্দেশ্যে বলবেন, বাঙালিরা এদেশে বহিরাগত, কারণ এদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই। এ বিষয়টি মাথায় রেখে এ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও নীতিনির্ধারকগণকে অধিকতর সতর্ক হতে হবে।

এই ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে সরকারের বর্তমান অবস্থান সঠিক (আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এ বিষয়ে সত্যভাষণ করছেন না)। কারণ, যে কোনো স্বতন্ত্র মানবগোষ্ঠীকে নরগোষ্ঠী বা নৃ-গোষ্ঠী বলে। নৃ-বিজ্ঞান বা সমাজবিজ্ঞানে `উপজাতি` বা `আদিবাসী` বলে আলাদা কোনো শব্দ বা প্রত্যয় নেই। বরং `রেস` বা `নরগোষ্ঠী` বা `নৃ-গোষ্ঠী` একটি স্বীকৃত প্রত্যয়।

আসুন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা যে এদেশে আদিবাসী নয় এ বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য এখানে একটু তত্ত্বনির্ভর আলোচনা করি। এই আলোচনাটি হবে প্রধানত ১) সমাজতাত্ত্বিক ২) ঐতিহাসিক ৩) ভাষাতাত্ত্বিক ও ৪) আন্তর্জাতিক ঘোষণার আলোকে।

১) সমাজতাত্ত্বিক:সমাজতাত্ত্বিকভাবে সাধারণত আদিবাসী বলতে আমরা তাদেরকেই বুঝি, যারা প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই কোনো অঞ্চলের আদি বাসিন্দা বা ভূমিজ সন্তান। যারা কোনো ভূখণ্ড বা জনপদের সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সে স্থানের বাসিন্দা। যারা আদিম সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং আদিম সংস্কৃতির কোনো কিছুই ত্যাগ করেনি (আদিম সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- শিকার ও সংগ্রহ ভিত্তিক অর্থনীতি, প্রাকৃতিক শ্রমবিভাগ, লিখিত ভাষা ও বর্ণমালা না থাকা এবং ইঙ্গিতে কথা বলা, অবাধ যৌনাচার ও গোষ্ঠী বিবাহ, লজ্জার চেতনা না থাকা, কাঠামোবদ্ধ পরিবার না থাকা, নিজস্ব সরকার ও বিচার ব্যবস্থা, প্রকৃতিপূজা ইত্যাদি), সভ্যতার আলোকবর্তিকা যাদের দোরগোড়ায় পৌঁছায়নি; যারা অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ।

সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানি উপজাতিরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছে। অনেক জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যগুলোর সামান্যও আর অবশিষ্ট নেই। বর্তমান লেখক রাজশাহী বিভাগীয় শহরে উপজাতীয় কালচারাল একাডেমীর পরিচালক পদে চাকরিরত অবস্থায় পিএইচডি গবেষণাকর্ম সম্পাদনের জন্য মাঠ পর্যায়ে কাজের সময় গভীর উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার সঙ্গে বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। খ্রিস্টান মিশনারিদের অবাধ ও নিরন্তর ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়ার কারণে অনেক উপজাতি শতভাগ খ্রিস্টান হয়েছেন।

যেহেতু ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের আলোকে একজন মানুষের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে বা নির্ধারিত হয়, সেহেতু খ্রিস্টান উপজাতিরা চিরায়ত সংস্কৃতির অনেক কিছুই শতভাগ ত্যাগ করেছে। রাজশাহীর পাহাড়ি উপজাতির লোকেরা নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পারেন না বা জানেন না। এখানে খ্রিস্টান মিশনারিরা পাহাড়িদের বাদ্যযন্ত্র ও হাড়িয়া পানকে হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করেছে। শুধু নাচ আর গান মানেই কিন্তু সংস্কৃতি নয়। সভ্যতার আলোকবর্তিকায় উদ্ভাসিত হয়ে এবং সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টায় প্রায় সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি চাকরির সকল ক্ষেত্রে অবাধে ও স্বাচ্ছন্দে বিচরণ করছেন। অনেকেই সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিও করছেন।

২) ঐতিহাসিক: এটি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, বৃহৎ পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র ১১টি নৃ-গোষ্ঠী মঙ্গোলয়েড নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, উপজাতীয় লেখকদের নিজস্ব গ্রন্থ পর্যালোচনায় প্রমাণিত যে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ সকল নৃ-গোষ্ঠী আরাকান, ত্রিপুরা, মিজোরাম ইত্যাদি অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে এদেশে আগমন করেছেন। চাকমারা বিজয়গিরি নামক একজন যুবরাজের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে আরাকান ও চট্টগ্রামের একটি অংশ দখল করেন। এদেশের চাকমারা মনে করেন, তারা বিজয়গিরির সেই আরাকান বিজয়ী সৈন্যদের বংশধর। ১৭১৫ সালে চাকমা রাজা জলীল খাঁ বা জালাল খাঁ (১৭১৫-১৭২৪) সর্বপ্রথম ১১মণ কার্পাস তুলা উপহার দিয়ে চট্টগ্রামে মোগল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ১৭৩৭ সালে সেরগুস্ত খাঁ (১৭৩৭-৫৮) আরাকানের পক্ষ ত্যাগ করে মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং দেওয়ান পদ লাভ করেন। মারমারা ১৭৫৬ সালে আরাকানে আশ্রয় লাভ করে। ১৭৭৪ সালে রামু, ঈদগড়, মাতামুহুরী এবং সর্বপ্রথম ১৮০৪ সালে বান্দরবান শহরে বসতি স্থাপন করে তারা। ১৭৮৪ সালে বর্মী রাজা বোদপায়ার সেনাবাহিনী স্বাধীন আরাকান রাজ্য দখল করলে সেখান থেকে পালিয়ে হাজার হাজার শরণার্থী কক্সবাজার,পার্বত্য চট্টগ্রাম, পটুয়াখালিতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে। এদেশে দ্বিতীয় বৃহৎ উপজাতি সাঁওতালসহ অন্যান্য গোষ্ঠী এসেছে সাঁওতাল বিদ্রোহের পর। অনেকে এসেছে ব্রিটিশ আমলে মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে। বর্তমানে এরা সকলেই এদেশের স্থায়ী নাগরিক বা বংলাদেশি।

৩) ভাষাতাত্ত্বিক: ভাষাতাত্ত্বিক পর্যালোচনায় জানা যায়, বাংলা ভাষার প্রধান উপকরণ হলো যথাক্রমে (ক.) দেশজ অর্থাৎ আদিম অনার্য, যা কি-না আর্য-পূর্ব (অস্ট্রিক, কোল, মুণ্ডা, দ্রাবিড়, তিব্বত, ব্রাক্ষ্মণ উপকরণ (খ) বহিরাগত আর্য উপকরণ (গ) বিদেশি উপকরণ। ত্রি-বিদ উপকরণের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মূল কাঠামো। এযাবতকাল প্রাপ্ত বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন বিশ্লেষণ করে সাধারণভাবে স্বীকৃত মত হলো, এই ভাষা কমপক্ষে হাজার বছরের প্রাচীন।

পক্ষান্তরে উত্তরাঞ্চলের সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যেমন সাঁওতাল, উঁরাও, মুণ্ডা, মাহালি, পাহাড়ি, মাহাতো, পাহান, রাজবংশী, কোঁচ, কৈবর্ত ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা মূলত কথ্য ভাষা, লিখিত ভাষা নয়। অর্থাৎ এরা বর্ণহীন পরিবারের সদস্য। অধিকাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকে লিখিত রূপ দেবার মতো কোনো অক্ষরই নেই।

চাকমারা আরাকানি-বাংলা ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলে, এ কারণে ভাষাবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন চাগমা-বাংলা। মারমারা বর্মী এবং ত্রিপুরাগণ বোডো সম্প্রদায়ের ভাষার বর্ণ গ্রহণ করলেও অন্য সাতটি জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় নিজস্ব কোনো বর্ণ নেই। সাঁওতালরা অস্ট্রিক ভাষার অন্তর্গত অস্ট্রে-এশিয়াটিক উপ-শাখার মুণ্ডারি ভাষায় কথা বলে। সাঁওতাল ছাড়াও অস্ট্রিক ভাষা-পরিবারের মুণ্ডারি ভাষায় মুণ্ডা, হো, কোল, বিরজা, বিরহোড়, কুরকু, কারমালি, ভূমিজ প্রভৃতি উপজাতীয় মানুষেরা কথা বলে।

সাঁওতালী ভাষায় বাংলাভাষা পরিবারের অসংখ্য বহুবিধ শব্দের সংমিশ্রণ ঘটেছে। ক্ষেত্রবিশেষে বাংলা ভাষায় স্থান করে নেওয়া বিদেশি শব্দ যেমন ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, উর্দু, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ ইত্যাদি শব্দ সাঁওতালি ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সাঁওতালরা সামান্য পরিবর্তন করে বা উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের কারণে বিকৃতভাবে উচ্চারণ করে বাংলা ভাষার অনেক শব্দ ব্যবহার করে।

ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীসমূহ জাতি হিসেবে চূড়ান্ত বিকাশের জন্য অক্ষর আবিষ্কার বা ব্যবহার করতে শিখেনি। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, এরা যাযাবর বৈশিষ্ট্যের মানুষ। এক জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস না করার কারণে এদের ভাষা পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত হয়নি বা পরিপূর্ণতা পায়নি। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে তারা যে অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেছে, বাস্তব প্রয়োজনে তারা সে অঞ্চলের মানুষের প্রধান বুলি ও ভাষার শব্দসম্ভার হতে প্রয়োজনীয় শব্দ গ্রহণ করে নিজস্ব ভাষায় ব্যবহার করেছে। যেমন আরবি শব্দ অক্ত, ফারসি শব্দ বাবা, বাজার, আরসি, আর্জি ইত্যাদি গ্রহণ করেছে।

সাঁওতালরা এদেশের ভূমিজ সন্তান নয়, এর অন্যতম প্রমাণ হলো এদেশে প্রাচীনকাল হতে ব্যবহৃত খাঁটি অনার্য শব্দ সাঁওতাল ভাষায় নেই। এদেশের খাঁটি বাংলাদেশি শব্দ মানেই হলো অনার্য শব্দ। বাংলা ভাষায় অস্ট্রিক শব্দের পাশাপাশি অনেক দ্রাবিড় শব্দ যেমন বগুড়া, শিলিগুড়ি অর্থাৎ ড়া, গুড়ি যুক্ত নাম দ্রাবিড় ভাষাগত। বাংলার বিভিন্ন ধরনের দেশীয় পাখি কাক, দোয়েল, পানকৌড়ি, শালিক প্রভৃতিসহ অজস্র ইতর প্রাণী কাঠবিড়ালী, ই‍ঁদুর, খাটাশ...ইত্যাদি অনেক শব্দ অনার্য বা এদেশি শব্দ। উপজাতীদের ব্যবহার্য শব্দের সাথে এসব নামবাচক শব্দের ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

বাংলা ভাষার সংগে সাঁওতাল ভাষার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাভাষায় বহুল ব্যবহৃত অনেক শব্দের ব্যবহার সাঁওতালি ভাষায় নেই। অসংখ্য শব্দের মধ্যে বোঝার জন্য বিভিন্ন গঠনরীতির কিছু শব্দ তুলে ধরা হলো। যেমন: কর-কর, খন-খন, গন-গন, মচ-মচ, ভাত-টাত, জাত-পাত, আবোল-তাবোল, চোট-পাট ইত্যাদি বহুল প্রচলিত শব্দ সাঁওতালরা ব্যবহার করে না। সাঁওতালরা মানব শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গের বাঙালি নাম গ্রহণ করেনি। কিন্তু এদেশের ফলমূল, দেশি মাছ-পাখির নাম হবহু গ্রহণ করেছে, পশুদের মধ্যে সচরাচর দৃশ্যমান পশুর নাম আলাদা কিন্তু বিদেশি পশুর (উট-জেব্রা) বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বিদেশি নাম তারা গ্রহণ করেছে। খাদ্য-খানা ইত্যাদির নাম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আলাদা তবে এ দেশীয় সবজি যেমন-পটল, ছোলা, বরবটি, ঝাল, পান, মূলা ইত্যাদি নাম সাঁওতালরা হুবহু গ্রহণ করেছে। পাগার, পান ও বরোজ প্রত্যয়টি শুধু উত্তর বাংলা বা পুণ্ড্রবর্ধনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। সাঁওতালী ভাষায় পান ও বরোজ শব্দটি নেই। অর্থাৎ সাঁওতালরা যখন উত্তরাঞ্চলে আগমন করেছে, তখনই শব্দ দু’টি গ্রহণ করেছে।

এছাড়াও রক্ত বা আত্মীয় সম্পর্কীয় সম্বোধন রীতি, সপ্তাহের সাতদিনের নাম, সংখ্যা ও গণনা রীতি দু’সম্প্রদায়ের আলাদা। পক্ষান্তরে বাংলা মাসের অধিকাংশ নাম সাঁওতালরা হুবহু বা সামান্য বিকৃত উচ্চারণে (ভাদর, আশিন) ব্যবহার করছে। বহুমাত্রিক শব্দ বিশ্লেষণে বর্তমান গবেষকের একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা এই যে, এ দেশের আদিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠীর উত্তর পুরুষ হিসেবে বাঙালিরা তাদের মুখের ভাষা অনার্য ভাষা পরিবর্তন করেনি, ক্ষেত্রবিশেষে কিছু বিদেশি শব্দ গ্রহণ করেছে বটে কিন্তু সাঁওতালি শব্দ গ্রহণ করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং সাঁওতালরাই যখন তাদের আদি বাসস্থান সাঁওতাল পরগনা ত্যাগ করে এদেশে আগমন করেছে, তখন জীবনযাত্রার প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে এদেশের প্রচলিত বুলি ফল, পশু, মাছ, পাখি ইত্যাদি বিষয় সংশ্লিষ্ট নাম গ্রহণ করেছে।

মাসের নাম, সংখ্যা, স্থানীয় ফল-মূল ইত্যাদির নাম বাংলাদেশ, আসাম, উড়িষ্যা, বিহার ইত্যাদি অঞ্চলে এক নয়। এ পর্যালোচনা থেকেও প্রমাণিত হয় যে, সাঁওতালসহ অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মানুষ এদেশে আগত, তারা বাংলাদেশের ভূমিজ সন্তান নয়। এ কারণে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর আদিবাসী বলে দাবি করাও যুক্তিসঙ্গত নয়।

৪) আন্তর্জাতিক ঘোষণা: ইউনেস্কো ১৯৬৪ সালে মস্কোতে জাতিসমস্যার জীবতাত্ত্বিক সমস্যাবলী সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে সিদ্ধান্ত হয় যে, বর্তমান বিশ্বের সকল মানুষ ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ নামক একটিমাত্র প্রজাতির অন্তর্ভূক্ত এবং একই মূল থেকে উদ্ভূত। তবুও বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে বংশ-পরম্পরাগত গুণ থাকায় অন্য গোষ্ঠী থেকে পৃথক। এই এক একটি গোষ্ঠীকে `রেস` বা `জাতি` বলে। অর্থাৎ মানুষের একটি বিরাট দলের লোকজনদের মধ্যে যখন পূর্বপুরুষ থেকে পাওয়া কতকগুলো সাধারণ দৈহিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তখন সেই দলকে জাতি বলা হয়। সে অর্থে বাংলাদেশের সকল নৃ-গোষ্ঠীই এক একটি জাতি, ক্ষুদ্র জাতি। এরা ক্ষুদ্র জাতি, এর কারণ অনেক গোষ্ঠী খুবই ক্ষুদ্র, যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিনধ জাতিগোষ্ঠীর পরিবার সংখ্যা মাত্র ২২ এবং জনসংখ্যা শতাধিক।

জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসী’র সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে, ``...Indigenous people are such population groups as we are, who from old age times have inhabited the lands when we live, who are awere of having a characters of our own, with social tradition and means of expression that are linked to the country inhabited from our ancesters, with a language or our own and having certain essential and unique characteristics which confer upon us the strong conviction of belonging to a people,who have an identity in ourselves and should be thus regarded by others (1993).``

আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সম্মেলনে আদিবাসী চিহ্নিত করা হয়েছে এভাবে, ``...Peoples in independent countries who are regarded as indigenous on occount of their decent from the populations which inhabited the country or a geographical region to which the country belongs, at the time of conquest or colonisation or the establishment of present state bound‍aries and who irrespective of their legal status,retain some or all of their social, cultural and political institutions(1989)``

অর্থাৎ “আদিবাসী`` বা দেশজ মানবসমাজ, জনগোষ্ঠী অথবা জাতিসত্তার পরিচিতি পাবার অধিকারী তারাই, যাদের প্রাক-আগ্রাসন ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, যা তারা নিজ বাসভূমিতে তৈরি করেছিলেন। যারা তাদের বাসভূমিতে অথবা কিয়দংশে পাশাপাশি বসবাসকারী অন্যান্য মানবকূল থেকে নিজেকে একটি বিশেষত্বময় পৃথক সত্তার অধিকারী মনে করেন। যারা আজ সমাজের প্রতিপত্তিশালি না হয়েও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য তাদের নিজস্ব গোষ্ঠীসত্তা, সাংস্কৃতিক কাঠামো, সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও বিধিব্যবস্থা রেখে যেতে চান একটি বিশেষ মানবসমাজের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য।”

এ সংজ্ঞানুসারে বাংলাদেশের কোনো উপজাতিই আদিবাসী প্রত্যয়টির আওতায় পড়ে না। কারণ এ সংজ্ঞার শর্তই হলো, আদিবাসী হিসেবে পরিচিতি পাবেন তারাই, যাদের প্রাক আগ্রাসন ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, যা তারা নিজভুমিতে তৈরি করেছিলেন। যারা আদিম সংস্কৃতির ধারক এবং নিজেদের সমাজ, সংস্কৃতি ও চিরায়ত ধর্ম ইত্যাদি গভীর নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা নিয়ে মেনে চলে। অন্যান্য মানবকূল হতে নিজেদেরকে একটি বিশেষত্বময় সত্তার অধিকারী বলে মনে করে। এ সংজ্ঞার শর্তই হলো, যাদের প্রাক আগ্রাসন ও প্রাক-সাম্রাজ্যবাদী অধিকারের আগে থেকেই একটি ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা আছে, যারা প্রতিপত্তিশালী বা শাসকগোষ্ঠীর সদস্য নয়। কিন্তু ইসলাম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-হিন্দু ধর্ম বা ধর্মের মানুষ অবশ্যই প্রতিপ্রত্তিশালী বা শাসক গোষ্ঠী। সুতরাং কোনো প্রকৃতি উপাসক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ যখনই ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-মুসলিম হবে তখন সে শাসক গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হবে এবং আদিবাসী সংজ্ঞার আওতায় পড়বে না।

বাংলাদেশ ও ভারতের সকল উপজাতীয় লেখক, অন্য জাতিগোষ্ঠীর সর্বজন গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিজীবী এবং ব্রিটিশ প্রশাসক ও মিশনারিদের লিখিত বিভিন্ন ক্লাসিক্যাল গ্রন্থসূত্রে প্রমাণিত হয় যে, এদেশে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী তথা উপজাতি জনগোষ্ঠীর আগমন হয়েছে নিকট অতীতে। কিন্তু প্রাচীন ভারতের গ্রন্থসূত্রে (ঐতরেয়, ঋগবেদ প্রভৃতি) প্রমাণিত-- এদেশ এবং দেশজ জাতিগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালির অস্তিত্ব হাজার-লক্ষ বছরের প্রাচীন। ৪৭ পূর্ব অখণ্ড ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আদিবাসী বলে পরিচিত এই জনগোষ্ঠীই ‘আর্য পূর্ব ভারতের আদিম বাসিন্দা’।

কাজেই বোঝা যায়, আদিবাসীরা নিজ নিজ দেশের মূল বাসিন্দা এবং জনপদ সৃষ্টির প্রথম থেকেই স্থানীয় মাটির সাথে তাদের নৃতাত্ত্বিক সম্পর্ক সুগ্রথিত। এ অর্থে এদেশের বাঙালিরাই(হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ) এদেশের মূল বাসিন্দা।

হিন্দু জাতিভেদ প্রথার নিচুস্তরে অবস্থিত দলিত সম্প্রদায়ের সদস্যরা প্রকৃত আদিবাসী। অনার্য জনগোষ্ঠী এবং প্রকৃতি উপাসক জনগোষ্ঠীর উত্তরপুরুষ হিসেবে বাংলাদেশের শতকরা সত্তর ভাগ মানুষ ধর্মান্তরিত মুসলিম। এরাই এদেশের আদি-বাসিন্দা। সুতরাং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি অবশ্যই প্রশংসনীয়।

জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করবে এমন অনাবশ্যক বিতর্ক সৃষ্টি না করে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার কাজে সকলের মনোনিবেশ করা উচিৎ। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা যদি এ অভিধায় সন্তুষ্ট না হন তবে তারা নিজেদেরকে জাতি বলুন, যেমন চাকমা জাতি, সাঁওতাল জাতি তবে তা আদিবাসী জাতিসমূহ নয়। বিষয়টি সমাধানে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আসার বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী এবং দেশের নীতিনির্ধারকমহল ভেবে দেখতে পারেন। আসুন বিতর্ক নিরসনে ঐক্যদ্ধভাবে কাজ করে প্রকৃত অর্থে ``সোনারবাংলা`` গড়ে তুলি।

[email protected]

৪| ১০ ই আগস্ট, ২০১২ বিকাল ৪:০১

এরিস আফ্রোদিতি বলেছেন: মিডনাইট,
আপনার অসামান্য লেখার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আমাদের যু্ক্তিগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে।

৫| ১০ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ৮:৩৭

মমতাজ-কলি বলেছেন: মন্তব্য দেয়ার জন্য ধন্যবাদ ধীবর, স্পুতনিক, ফ্রীডম ৥ মিডনাইট ও এরিস আফ্রোদিতি কে।

৬| ১১ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:২৩

বাঁধ ভেঙে যাই....... বলেছেন: খুবই ইনফরমেটিভ পোষ্ট। আপনার লেখার সাথে একমত।
আদিবাসীর ধূঁয়া তুলে একটি গোষ্টি দেশের জাতীয়তাবাদ কে বিনষ্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
পোষ্টে প্লাস এবং প্রিয়তে।

৭| ১১ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:৩৩

বাঁধ ভেঙে যাই....... বলেছেন: এত ভালো একটা পোষ্টে কেন খুব অল্প কমেন্ট বুজলামনা!!!

৮| ১১ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:৪১

জ্বীন কফিল বলেছেন: পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো আদিবাসী নয় অভিবাসী

৯| ১৮ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:৫৭

এরিস আফ্রোদিতি বলেছেন: ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোকে যারা আদিবাসী বলে সেইসব রাজাকার কুকুরকে এখনই শিকড় সহ মুলোৎপাটন করতে হবে

১০| ২৬ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৮:৪১

নাহিয়ান বিন হোসেন বলেছেন: পোষ্টে প্লাস এবং সোজা প্রিয়তে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.