নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পাহাড়ের প্রতিধ্বনী

মমতাজ-কলি

ভাল করে বাঁচতে চাই

মমতাজ-কলি › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় স্বীকৃতি পেল না জীবদ্দশায় ॥ মৃত্যুই এনে দিলো তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান!

২৭ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:২৯

ধনঞ্জয় ধর (৮০)। একজন অবহেলিত মুক্তিযোদ্ধার নাম। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলা সদরেই তাঁর বসবাস ছিল। গত মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেলেন। মারা যাওয়ার আগে তাঁর ইচ্ছা ছিল মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার। কিন্তু বিধি বাম! জীবদ্দশায় তাঁর কপালে জুটেনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।

কিন্তু মারা যাওয়ার পর অনেক দেন দরবার শেষে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়া হলো। প্রশ্ন উঠেছে জীবদ্দশায় যাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো না, মরণের পর এ স্বীকৃতি কেন?

ধনঞ্জয় ধর জীবদ্দশায় দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরও ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত হতে পারেন নি। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপের কমতি ছিল না।

২০১১ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় ধরের মুখোমুখি হন এ প্রতিবেদক। সে সময় তিনি যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর তাঁর স্মৃতিকথা জানান প্রতিবেদককে। তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো।

“মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি সংসারের মায়া ত্যাগ করে জীবনবাজি রেখে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ভারতের সাবরুম-হরিণা ক্যাম্পে চলে যাই। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরত এসে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। আমার মতো অনেকের ত্যাগে ও কষ্টে এদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণপণ লড়লেও শেষ বয়সে এসে আমার জীবন কাটছে অর্ধাহারে অনাহারে!

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তুলতে অনেকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ‘সনদ’ পাইনি। নানান জনের কাছে গিয়েছি। সকলে আশ্বাস দিয়েছেন বটে। কাজ করেনি। আমি দুর্ভাগা; নইলে স্বাধীনতার এতবছর পরও তালিকায় নাম ওঠেনি কেন!

ধনঞ্জয় ধর জানান, “যুদ্ধকালীন সময়ে আমার গ্রামের বাড়ি ছিলো কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার দিগরপানখালী গ্রামে। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু খুন হবার খবর শুনেই পরদিন ১৬ আগস্ট আমি স্বপরিবারে পাহাড়ি এলাকা আলীকদমে চলে আসি।

স্বাধীনতার ৪০ বছর পরেও আমার জীবনের নৌকার পালে হাওয়া লাগেনি! আমার এখন পড়ন্ত বেলা। এ বয়সেও যখন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলাম না তখন মরণই একমাত্র গতি!”

মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করে ধনঞ্জয় ধর জানান, “চকরিয়ার তেজেন্দে দে, নুর মোহাম্মদ, পুলিন শর্মা ও সন্দিপের শামশু কমাণ্ডারসহ আমরা ৩২ জনের একদল যুবক সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের লোহারবন ১নং সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যাই। ৩০ দিন প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের হরিণা ক্যাম্প থেকে অস্ত্র নিয়ে আমরা ৩২ জন মুক্তিযোদ্ধা রামগড় বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ি। রাঙ্গুনিয়া এলাকায় হানাদার বাহিনীর হাতে আমি ধরা পড়েছিলাম। তবে কৌশলে পালিয়ে আসতে সক্ষম হই। পালিয়ে এসে সাতকানিয়ার পুটিবিলায় যুদ্ধকালীন ক্যাম্পে যোগ দেই। ওই সময় আমরা সাতকানিয়া থানায় হামালা চালিয়ে কিছু গোলাবারুদ সংগ্রহ করি”।

ধনঞ্জয় ধর আরো জানান, “আজিজনগর এলাকা থেকে ১৮ জন পাঞ্জাবী সৈন্যকে ধরে পুটিবিলা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে আমরা হত্যা হত্যা করি”।

এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে চকরিয়ার ঘুনিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জেডএ দিদারুল ইসলাম জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তিনিও সাতকানিয়া থানা আক্রমণে অংশ নেন। এ আক্রমণে সন্দিপের কমা-ার শামশু বিএসসি, উখিয়ার আইয়ুব বাঙ্গালী এবং ধনঞ্জয় ধরসহ অনেকে ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধার গ্রুপ কমা-ার ছিলেন সন্দিপের শামশু বিএসসি। এ গ্রুপে মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয়সহ ৪ জন ছিলেন চকরিয়ার বাসিন্দা’।
সরকারী চাকুরীজীবি মুক্তিযোদ্ধা মোহসিন সর্দারসহ আলাপকালে ধনঞ্জয় ধরকে জিজ্ঞাসা করি, ‘কেন আপনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে সময় তালিকাভূক্ত হতে পারেন নি?’

উত্তরে ধনঞ্জয় ধর বলেন, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরপরই পর্বতময় এলাকা আলীকদমে চলে আসি। আমার পিতা গরীব ছিল। তাই পড়ালেখা করতে পারিনি। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ নিতে হবে সে ধারণা আমার ছিল না। স্বাধীনতার পর সরকারের আদেশে অস্ত্র জমা দিয়েছি। কিন্তু তালিকায় নাম উঠাতে হবে ভাবিনি”।

ধনঞ্জয় ধর আরো জানান, “মুক্তিযুদ্ধের পর চট্টগ্রামের ভাটিয়ারী ক্যাম্পে অস্ত্র জমা দিই। এ সময় মুক্তিযোদ্ধের সর্বাধিনায়ক মুহাম্মদ আতাউল গনী ওসমানী’র নামাঙ্কিত ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র’ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। আমার সনদপত্র নং- এন-৩০৪৯২।”

ধনঞ্জয় ধর তাঁর সনদটি এ প্রতিবেদককে দেখান। সনদে উল্লেখ আছে, “তিনি ১নং সেক্টরে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর অবদান চির উজ্জ্বল হয়ে রইবে”।
২০১১ সালের ২৪ ডিসেম্বর এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয়, চকরিয়া মুক্তিযোদ্ধা (বর্তমানে প্রয়াত) আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালীর সাথে। তিনি জানান, “ধনঞ্জয় একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালীন সময়ে আমার সহযোদ্ধা হিসেবে ধনঞ্জয় ধর ছিলেন”।

তাঁর সাক্ষাত নেওয়ার সময় এ প্রতিবেদক লক্ষ্য করেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ী হলেও জীবনযুদ্ধে পরাজিত ধনঞ্জয় ধরের আক্ষেপের কমতি ছিল না। তিনি জানান, “আমি আনুমানিক ১০ শতক জমিতে ঘর করেছি। তবে এ জমি আমার নামে এখনো সরকারী রেকর্ডভূক্ত হয়নি। আমার ২ মেয়ে ৪ ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। ২ মেয়েকে পাত্রস্থ করেছি। ২ ছেলেও বিয়ে করেছে। আমার বয়স এখন ৭৬। হাঁপানীসহ বার্ধক্যজনিত অসুখে ভূগছি আমি। বর্তমানে আমার কোন আয় নেই। ছোট দু’ছেলের আয়ের ওপর দুঃখ কষ্টে দিন কাটে আমার”।

২০১১ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিকেল। মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় ধরের সাথে আলাপচারিতা শেষ করবো। এ সময় আমি একবাক্যে তার শেষকথা জানতে চাই।

তখন মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয় ধর আক্ষেপের সুরে বললেন, "দাদু, জীবনযুদ্ধে পরাজিত হতে চললেও দেশমাতৃকার যুদ্ধে আমি বিজয়ী বীর। যুদ্ধ করেছি তাই স্বীকৃতি চাই”।

শেষ কথাঃ
ধনঞ্জয় ধর বেঁচে থাকতে হয়তো সরকারী তালিকায় মুক্তিযাদ্ধা হিসেবে নাম উঠাতে পারেন নি! তবে পুরো আলীকদম উপজেলায় তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিতে দলমত নির্বিশেষে কারো দ্বিমত ছিল না।
“যুদ্ধ করেছি তাই স্বীকৃতি চাই”- তাঁর এ ইচ্ছা মরণেই পূর্ণ হলো।

মৃত্যুর পর তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাহ করতে স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগ নেন। তার লাশের কফিনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়ার অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি পতাকা, চেয়ারে বসে চাকুরী করতে পারছি, কথা বলতে পারছি, সে রকম একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, এতে কোন দ্বিধাদ্বন্ধ নেই। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করে ইউএনও বলেন, তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি’।

২৫ আগস্ট, ২০১৫ ইং। বিকাল সাড়ে চারটা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, লামা ও আলীকদমের মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের উপস্থিতিতে পুলিশ ও সেনা সদস্যদের দ্বারা তাঁর কফিনে রাষ্ট্রীয় মর্যদা গার্ড অব অনার দেওয়া হলো!

মরণেই পূর্ণ হলো মুক্তিযোদ্ধা ধনঞ্জয়ের স্বীকৃতি! তাঁর বিদেহী আত্মার সদ্গতি কামনা করছি।


লেখক: মমতাজ উদ্দিন আহমদ
সভাপতি,
আলীকদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.