নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন্ত্রক

আমি আমার দেশের জন্যে

মন্ত্রক › বিস্তারিত পোস্টঃ

নেতৃত্ব বিনাশে ষড়যন্ত্র

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৩১

৩রা নভেম্বর ১৯৭৫, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানের নির্মম হত্যাকাণ্ড বাঙালির স্বাধীনতা-পরবর্তী উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় আর একটি মস্ত প্রতিবন্ধক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস, ভয়াবহ এবং কলঙ্কজনক ঘটনার পর বাঙালির ইতিহাসের অপর এক কলঙ্কিত অধ্যায়রূপে চিহ্নিত একই বছরের ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে সংঘটিত ঘটনা— যা জেলহত্যা নামে বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্তাক্ষরে লেখা রয়েছে। বাঙালি জাতির মহানায়ক, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাত্র ২ মাস ২০ দিন পরেই দেশের স্বাধীনতা-বিরোধীচক্র আর একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র সফল করে— শোকে মুহ্যমান দেশবাসী পরপর সংঘটিত দুটি ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত ও দিশাহারা হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতালোভী, দেশদ্রোহী পাকিস্তান সরকারের দোসর ষড়যন্ত্রকারীরা জাতির জনকের রাজনৈতিক সহযোগী বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত জাতীয় চার নেতার ভয়ে ছিল প্রকম্পিত। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যাতে তাঁরা জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে প্রগতিমুখী করতে না পারেন তার জন্যই উপরিউক্ত চার নেতাকে হত্যা করে ও বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করে ছুঁড়ে ফেলে অনাকাঙ্ক্ষিত অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। বঙ্গবন্ধুর অপার স্নেহ ও মহানুভবতায় বেড়ে ওঠা অকৃতজ্ঞ ও সময়ের নষ্ট সন্তানেরা রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য, দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের এক নীলনকশার বাস্তবায়ন ছিল বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর, রাজনৈতিক উত্তরসূরি মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দকে নির্মমভাবে হত্যা। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা নিন্দনীয় ঘটনার অন্যতম— কাপুরুষোচিত এই ঘটনা তাই ঘৃণ্য।
উপরিউক্ত রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের শিকড় ছিল অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত— সে ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য তাই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগী নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছিল হত্যাকারীদের। তারা ঠিকই বুঝেছিলেন, কেবল একজন মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে নিঃশেষ করা যাবে না, তাঁর চেতনার মৃত্যুও সম্ভব নয়। একজন মুজিবের কণ্ঠরোধ করলেই রোধ করা যাবে না বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে, দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ। নেতৃত্ব সৃষ্টির ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দুই যুগে সমগ্র দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার মতো অসংখ্য নেতা তৈরি হয়েছেন— তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবার যোগ্য ছিল একাধিক নেতা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা ধারণ করে যাঁরা দেশকে বিশ্ব দরবারে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। জাতির শত্রুরা জানত বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁরই রেখে যাওয়া নির্দেশনা ও উপস্থিত বুদ্ধি, প্রজ্ঞাপূর্ণ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দ্বারা ১৯৭১ সালে একটি সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে পরাজিত করে দেশকে স্বাধীন করেছিলেন এই সকল নেতা। তাঁরা জীবিত থাকতে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখা যাবে না, নবচেতনায় উজ্জীবিত বাঙালি অপ্রতিরোধ্য, অজেয়। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরও ষড়যন্ত্রকারীরা অস্বস্তিতে ছিল। নিজেদের পথকে নিষ্কণ্টক করার লক্ষ্যেই তারা জাতীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাত্ক্ষণিক বিদ্রোহের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হত্যাকারী খন্দকার মুশতাক ও তাঁর সহযোগীরা জাতির জনকের ঘনিষ্ঠ এই চার সহকর্মীকে পাকিস্তানি কায়দায় গ্রেফতার করে প্রথমে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পাঠায়। পরবর্তী অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্যু,পাল্টা-ক্যুর রক্তাক্ত অধ্যায়ে মানবতার শত্রু ও বঙ্গবন্ধুর হন্তারক ওই একই পরাজিত শক্তির দোসর, বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা সেদিন দেশমাতৃকার সেরা সন্তান জাতীয় চার নেতাকে শুধু গুলি চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, কাপুরুষের মতো গুলিবিদ্ধ দেহকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করে একাত্তরের পরাজয়ের জ্বালা মিটায়। একইভাবে তারা ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর হত্যা করে এদেশের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, চিকিত্সক. দার্শনিক, বৈজ্ঞানিকসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানগণকে। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য, নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিকে প্রগতি-সমৃদ্ধির উজ্জ্বল মিছিল থেকে সরিয়ে এক দিকচিহ্নহীন অন্ধকারে ঠেলে দেয়া। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল অভিন্ন ষড়যন্ত্রের অংশ, একটি ধারাবাহিক হত্যাযজ্ঞ। আসলে হত্যাকারীরা এবং তাদের দোসররা চেয়েছিল পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে— রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে নিক্ষেপ করতে।
জাতীয় এই চার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৩ এপ্রিল মুজিবনগরে সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ চারটি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার জাতীয় চার নেতা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভাইস প্রেসিডেন্ট (প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট); তাজউদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী; কামরুজ্জামান, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, অর্থমন্ত্রী হিসেবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর দেশব্যাপী যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। যুদ্ধ চলাকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামে আপ্রাণ লড়াইরত দেশটির রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড, বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ, প্রতিবেশী দেশে শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য কূটনৈতিক তত্পরতা, যুদ্ধ অব্যাহত রাখাসহ সার্বিক দায়িত্ব এ সরকারকেই পালন করতে হয়। এ সরকারের অগ্রভাগে থেকে সফল নেতৃত্ব দেন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর তাঁর ভাষণটি ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। তিনি বলেন, ‘আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। বিগত বহু বছর যাবত বাংলার মানুষ, তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-অধিকার নিয়ে এগোতে চেয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থ কখনোই তা হতে দিলো না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগোতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিলো না। ওরা আমাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানি হানাদারদেরকে বিতাড়িত করবোই। আজ না জিতি কাল জিতবো। কাল না জিতি, পরশু আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী। আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই। আমাদের রাষ্ট্রপতি জননন্দিত মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব। তিনি বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে আজ কারাগারে বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘যদি বিশ্বাসঘাতকতা করি, তবে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবেন।’ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আত্মবিশ্বাস, আস্থা আর অবিচল নেতৃত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি। কখনো ষড়যন্ত্রের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি দেশমাতৃকার স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন সবসময়।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে সুচিন্তিত মত-বিনিময় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের, চিন্তার মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরকার পরিচালনা ও যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে থাকেন। সুযোগ্য এ নেতৃত্বের ফলে আপামর জনতা মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়। ধীরে ধীরে সূচিত হতে থাকে বিজয়ধারা। এ সরকারের দূরদর্শী কর্মকাণ্ড দ্বারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা আদায়ও সম্ভব হয়। অক্টোবরে ভারত সফররত তত্কালীন সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের উপস্থিতিতেই ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবি করেন। এ দাবির পরিপ্র্রেক্ষিতেই ভারত সরকার যুদ্ধচলাকালীনই (৬ ডিসেম্বর) বাংলাদেশকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়। পরের দিনই ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। ৭ ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাসের পতন হয়। এরপর যশোর আসেন সৈয়দ নজরুল। তিনি সেখানে তাঁর বক্তব্যে সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেন। মূলত যুদ্ধের মাঠে তাঁর বাস্তবভিত্তিক নেতৃত্বগুণ ও পরিস্থিতির আলোকে নেয়া সিদ্ধান্তে নয় মাসের যুদ্ধের ফলে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
ছাত্র থাকাকালীনই সুদক্ষ নেতৃত্বের বিস্ময়কর প্রতিফলন ঘটে সৈয়দ নজরুল ইসলামের চরিত্রে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকাকালে তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এই হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৭-৪৮ সালে সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের সহ-সভাপতি ও কিছুদিন পরে মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন ও ভাবাদর্শে দীক্ষিত ছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৫৭ সালে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। রাজনীতি তাঁর ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হিসেবে চষে বেড়ান সারাদেশ। অকৃত্রিম মানবিক গুণাবলীর কারণে তাঁর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা ছিল। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এ পদে আসীন ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি দেশব্যাপী ৬ দফার পক্ষে প্রচারণা চালান ও জনমত গড়ে তোলেন। ১৯৬৬ সালে দেশের সঙ্কটময় মুহূর্তে সৈয়দ নজরুল আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নিষ্ঠার সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুরের অন্যতম আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ‘ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’ নামে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। তিনি ‘ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি’র আট দফা এবং ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচি খুবই দক্ষতার সঙ্গে সমন্বয় করেন। সৈয়দ নজরুল ১৯৭০-এর নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ আসন থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। তিনি সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করার পর সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালে সংসদের উপনেতা নির্বাচিত হন। শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করেন। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হলে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি হন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)-এর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে সফল নেতৃত্বের প্রতিভু হয়ে দেদীপ্যমান থাকেন জীবনের শেষক্ষণ পর্যন্ত।
তাজউদ্দীন আহমদের কাছে দেশের স্বার্থই সবসময় প্রাধান্য পেত। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না। রণাঙ্গনে যোদ্ধারা যদি পরিবার ছেড়ে থাকতে পারেন, তাহলে তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কেন পারবেন না? কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড ছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাসস্থান। অফিসকক্ষের পাশেই একটি কক্ষে তিনি থাকতেন। নিজের কাপড় নিজেই ধুতেন এবং আহার-নিদ্রা প্রায় ত্যাগ করে তিনি স্বাধীনতার জন্য নিজেকে উত্সর্গ করেছিলেন। যুদ্ধচলাকালীন একবার একমাত্র পুত্র দেড় বছরের শিশু সোহেল মারাত্মক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাজউদ্দীন আহমদকে সে খবর জানালে তিনি দেখতে যেতে অপারগতা জানিয়ে বলেন, তার পুত্রকে তিনি অন্য সবার পুত্র থেকে আলাদা করে দেখেন না। যুদ্ধাবস্থায় তার কাছে সব শিশুই সমান। পরে গোলোক মজুমদার এবং বিএসএফের নিরাপত্তা অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়ের পীড়াপীড়িতে তিনি অসুস্থ পুত্রের শিয়রে অল্প কিছুক্ষণ নিরবে দাঁড়িয়ে দোয়া করে চলে আসেন। দ্বিতীয়বার ৬ ডিসেম্বর, ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দিন, তার পরিবারের উল্টাদিকের ফ্ল্যাটে, সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে মিটিং সেরে যাবার পথে তিনি কয়েক মিনিটের জন্য পরিবারের সঙ্গে দেখা করে অফিসে চলে যান। নিকট দূরত্বে থাকলেও যুদ্ধচলাকালীন তিনি পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেননি। এই মহান নেতার জীবন দর্শন যেকোনো জাতির জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। জাতির শত্রু, দেশের শত্রুদের জন্য তিনি ছিলেন যমদূত—তাই তাঁকে হত্যা করা ছিল হন্তারকগোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য জরুরি। বাঙালি জাতির জন্য তাঁর অনুপস্থিতির ক্ষতি ছিল অপূরণীয়। শত্রুদের কাছে দুটোই ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ—তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যার বিকল্প চিন্তা তাই তারা করেনি।
এম মনসুর আলী ছিলেন গণমানুষের নেতা। পেশাজীবী হিসেবেও সফল। রাজনীতিতে আসার পর খুব অল্প সময়েই ব্যক্তিগত চারিত্রিক মাধুর্য ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে সকলের মন কাড়েন। গঠনের পর প্রথমবারই তিনি বাকশালের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। এ এইচ এম কামরুজ্জামান ছিলেন ব্যক্তিজীবনে খুবই ধার্মিক। ছিলেন অত্যন্ত ধীরস্থির ও ঠাণ্ডা প্রকৃতির। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধাবোধ। তিনি সকলকে সম্মান দিয়েই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ এই জাতীয় চার নেতার অবদান শুধু উল্লেখ্যই নয়, চিরস্মরণীয়। তাঁদের অবদান ও বীরত্বগাঁথা বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাসে তাঁদের ভূমিকা চির উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে থাকবে।
অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.