![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
যেকোনো বিচারেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তো বটেই, বিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে যত রাজনৈতিক বক্তৃতা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী বক্তৃতা ছিল। আনুমানিক ১৯ মিনিটের একটি বক্তৃতায় একটি দেশের পূর্ব ইতিহাস, জনগণের প্রত্যাশা ও তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের প্রতারণা, তাদের ত্যাগ, আগামী দিনের জন্য দিকনিদের্শনা ইত্যাদি বিষয় আর কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বক্তৃতায় আজ পর্যন্ত স্থান পায়নি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি রাজপথ থেকে উঠে এসেছিলেন। দেশভাগের আগে তিনি কলকাতায় একজন ছাত্রনেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসেম, দেশবন্ধু সি আর দাশ প্রমুখের নেতৃত্বে রাজপথে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছেন। তিনি যেহেতু আজীবন গণমানুষের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন সেহেতু তিনি সেদিন এক নিঃশ্বাসে বলতে পেরেছিলেন দেশ ভাগোত্তর বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস।
পাকিস্তানের গণপরিষদের ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর এটি ধারণা করা হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল তথা আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা কখনো চাননি এককভাবে বাঙালির হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর হোক। নির্বাচনের পরই ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গ নির্বাচনের ফলাফল বানচাল করতে ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকেন। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইয়াহিয়া খান মার্চের ১ তারিখে অকস্মাত্ পাকিস্তানের গণপরিষদের ৩ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন স্থগিত করেন। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। আওয়ামী লীগপ্রধান বঙ্গবন্ধু সে সময় হোটেল পূর্বাণীতে দলীয় নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন। তিনি সেই বৈঠক থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে গণপরিষদের বৈঠক স্থগিতে তাঁর ক্ষোভের কথা জানান। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পাল্টে যায় শুধু ঢাকার নয়, সারা বাংলাদেশের চিত্র। আসলে গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিতের আদেশই বাংলাদেশকে অখণ্ড পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। কেমন ছিল সেই উত্তাল দিন, তা আজকের প্রজন্মকে বোঝানো যাবে না। আওয়ামী লীগের ডাকে ঘোষণা করা হলো ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালিত হবে। ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানানো হয়। ১ তারিখ ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ৩ তারিখ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। সেই সভায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়। উত্তোলন করা হয় সেই বাংলাদেশের সেই পতাকা, যা আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশে উত্তোলন করা হয়েছিল। এ সময় দেশে সামরিক সরকার প্রতি রাতে কারফিউ জারি করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু জনতার রোষে সেই কারফিউ অনেকটা অকার্যকর হয়ে পড়ে। প্রতিদিন পালিত হয় হরতাল আর বিক্ষোভ মিছিল। সব মিছিল গিয়ে শেষ হয় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে।
৭ মার্চ সকালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে জানিয়ে দেন, ‘পূর্ব বাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’ যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে বুঝতে মারাত্মকভাবে ভুল করেছিল। তারা বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে প্রায়শ একই ভুল এখনো করে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে সারা পাকিস্তানে ঔত্সুক্য তো ছিলই, বহির্বিশ্বের মানুষও নজর রাখছিল পূর্ব বাংলার দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। সারা দুনিয়া থেকে সাংবাদিকরা ঢাকায় ভিড় করেছিলেন পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি রিপোর্ট করার জন্য। ৭ তারিখ সকালে একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে দেখা করেছিলেন। কেউ হয়তো রমনা রেসকোর্সে তাঁর কী বলা উচিত সে সম্পর্কেও তাঁর সঙ্গে দু-চার কথা বলেও থাকতে পারেন। ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের জনসভায় গিয়েছিলেন কলকাতার দিনগুলো থেকে তাঁর পরিচিত হাজি গোলাম মুর্শিদের গাড়িতে। গত বছর হাজি গোলাম মুর্শিদের সঙ্গে বিটিভিতে আমার কথা হয়। তিনি বলেন, তাঁরা যখন এলিফ্যান্ট রোডে তখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আজ কী বলবেন মুজিব ভাই?’ জবাবে বঙ্গবন্ধু কোনো কিছু তেমন একটা চিন্তা না করেই বলেন, ‘জানি না। আল্লাহ আমাকে দিয়ে যা বলাবেন তাই বলব।’ হাজি গোলাম মুর্শিদ এখনো জীবিত আছেন।
৭ মার্চের সেই ১৯ মিনিটের ভাষণ প্রমাণ করেছে বঙ্গবন্ধুকে কেন রাজনীতির কবি বলা হয়। অনেক বিষয়ের মধ্যে তিনি একপর্যায়ে বলেন, ‘২৩ বছরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস, এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২তে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই।’ এই তিনটি লাইনে তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথম ২৩ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কিভাবে বাঙালিদের শোষণ ও শাসন করেছে তার কথা বলেছেন। অথচ ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে শুধু অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশেই মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছিল। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেই মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয় পায়নি। বাঙালিরা পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল এই বিবেচনায় যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হলে তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়তে পারবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল ঠিক তার উল্টো। চলমান রাজনৈতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ভাষায় বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমি দেশের অধিকার চাই।’ এ দেশের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ২৩ বছরে ১৮ বার জেলে গিয়েছেন, সাড়ে ১১ বছর জেল খেটেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ক্ষমতা দিয়ে আঁচ করতে পেরেছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ আসন্ন। তিনি জনগণকে সেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি এ-ও বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধ একবার শুরু হলে হয় তিনি বন্দি হবেন, নয়তো বা মৃত্যুবরণ করবেন। তিনি তাই তাঁর অনুপস্থিতিতে কী কী করণীয় সেই নির্দেশনাও দিয়ে গিয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে।
অনেকে বলেন, সেদিন বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করে সেনানিবাস আক্রমণ করলে বাংলাদেশ সেদিনই স্বাধীন হয়ে যেত। এটি একটি বালখিল্যসুলভ মন্তব্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল কখনো একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে না। তা করলে সেটি মুক্তিযুদ্ধ হয় না, হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। বিংশ শতাব্দীতে আফ্রিকায় একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হয়েছে। বেশির ভাগই ব্যর্থ হয়েছে। সমসাময়িক ইতিহাসে সুদান ও পূর্ব তিমুর এমন আন্দোলন করে সফল হয়েছে জাতিসংঘ ও বৃহত্ শক্তিগুলোর মধ্যস্থতায়। একাত্তরে জাতিসংঘ বাংলাদেশের পক্ষে তো ছিলই না, তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র, চীন আর প্রায় সব আরব রাষ্ট্র (ইরাক ছাড়া) পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা হতো নিছক বোকামি। কিন্তু একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও বঙ্গবন্ধু ঠিকই তাঁর ভাষণের মাধ্যমে ঘোষণা করেছিলেন আসন্ন লড়াইটার উদ্দেশ্য কী হবে। অন্যদিকে মার্চের ১ তারিখে ইয়াহিয়া খান গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার পরপরই বাংলাদেশের শাসনভার সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। এমনকি ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস ছিল কিন্তু সেদিন সেনানিবাস ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ওড়েনি।
১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদবিরোধী নেতা ড. মার্টিন লুথার কিং সে দেশে বর্ণবাদ বিলুপ্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সেই বিখ্যাত বক্তৃতা ‘I have a dream’ ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। কিং তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি। কারণ তাঁকে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই স্বাধীন দেশের সার্বিক মুক্তি দেখার আগেই তাঁকেও ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়। তাঁর সেই অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব এখন তাঁর কন্যার হাতে। পিতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে কন্যা সফল হবেন—আজকের দিনে সেটাই একমাত্র প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
©somewhere in net ltd.