![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কেন বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা এত অল্প সময়ে পূর্ব বাংলায় প্রায় প্রত্যেকটি মানুষকে দ্রুততার সঙ্গে ৬ দফার প্রতি সমর্থনে উদ্বুদ্ধ করল, তার কারণ অনুসন্ধানে এটা অবশ্যই প্রতীয়মান হবে যে ৬ দফা শুধু একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। মুখ্যত অর্থনৈতিক বিষয় ছিল এর মূল প্রাণশক্তি। যে কোনো দেশে যখন অর্থনৈতিক কারণে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয় তখন তার সমাধানকল্পে অনুসৃত রাজনৈতিক কর্মসূচি যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয় না। অর্থনৈতিক কর্মসূচিরও সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন পড়ে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর (বাঙালি) নির্যাতন ও নিপীড়ন সুদীর্ঘ ২৩ বছর ধরে অব্যাহত ছিল। যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ দিনে দিনে সমৃদ্ধ হচ্ছিল, পর পর তিনটি রাজধানী গড়ে উঠেছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বার্ষিক আয় পূর্ব পাকিস্তানের গড় আয় থেকে অনেক বেশি হয়ে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তখন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিল। সংগৃহীত রাষ্ট্রীয় সম্পদের ৬২% যখন দেশ রক্ষা ও নিরাপত্তা খাতে ব্যয় হচ্ছিল, অন্যদিকে পূর্ব বাংলার মানুষ নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছিল। খাদ্য ঘাটতি দিন দিন বাড়ছিল, প্রাকৃতিক দুর্যোগে লাখ লাখ বাঙালি প্রাণ দিলেও কেন্দ্রীয় সরকার কখনো উদ্বেগ প্রকাশ করা বা প্রয়োজনীয় সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করছিল না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন বলতে যখন পূর্ব বাংলার কোনো কিছুই হচ্ছিল না, ১৯৬৫ সালের পাক যুদ্ধে যখন পূর্ব বাংলার জনগণ অত্যন্ত অসহায় বোধ করছিল, যখন বৈষম্যের পাহাড় দুই অঞ্চলের মধ্যে গড়ে উঠেছিল, অর্থনৈতিক সমস্যা দূরীকরণে তখন তিনি ৬ দফাভিত্তিক ফর্মুলা দিলেন। তাই ৬ দফা বিশ্লেষণে এটা প্রতীয়মান হয় যে, শুধু ফেডারেল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থাভিত্তিক একটা রাষ্ট্র এবং প্রতিটি বয়স্ক নাগরিকের ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন এবং নাগরিকদের প্রতিটি মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণ ৬ দফার মূল লক্ষ্য ছিল না। বরং ৬ দফার মূল লক্ষ্য দুটি অঞ্চলের ভিতর বৈষম্য দূর করে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে, পাকিস্তানের প্রত্যেকটি অঞ্চলের প্রতিটি নাগরিকের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এমন সমতা ও ন্যায়-প্রতিষ্ঠা যাতে প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রকৃত অর্থে সংশ্লিষ্ট হয়ে উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি ছিল দুটি দিকে। প্রথমে যে কারণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে, তার অবসান ঘটানো। একই সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চলে প্রত্যেক মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করা। তাই দেখা যায় ৬ দফায় এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে, যাতে পূর্ব বাংলার সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে এবং এটা করতে হলে মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিল, বঙ্গবন্ধু তাই করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হয় পাকিস্তানের দুই অংশে দুটি আলাদা মুদ্রার প্রচলন থাকবে এবং পৃথকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা নিয়ন্ত্রণ করবে এবং এক অংশ থেকে অন্য অংশে মুদ্রা পাচার করা যাবে না। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য নির্ধারিত কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে জমা হবে। প্রাদেশিক সরকারে তা জমা করবে না। অথবা পাকিস্তানের উভয় অংশে একই মুদ্রা প্রচলন থাকবে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ করবে। এক অংশ থেকে অন্য অংশে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রাদেশিক সরকারের মতামত লাগবে। শুধু ব্যাংকিং নয়, ইন্স্যুরেন্স, শিল্প ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের খাতে যাতে না পৌঁছায় তারও অনুরূপ ব্যবস্থা নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধের সময় মাত্র ৯ মাসে পূর্ব পাকিস্তান ১৬০ কোটি পাট রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হলেও এর এক টাকাও পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেনি, সব পশ্চিম পাকিস্তানে জমা ও উন্নয়নে ব্যয় হয়। অনেকে সমালোচনা হিসেবে বলেছিলেন, সব অর্থই পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যায়, সরকার কীভাবে চলবে এবং সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার কীভাবে চলবে। এরূপ সমালোচনা ঠিক নয়। কেননা ৬ দফায় বলা হয়েছিল একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিশেষ করে সামরিক ব্যয় ও পররাষ্ট্র ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হবে ও আলোচনার মাধ্যমে তা নির্ধারিত হবে। পাকিস্তানের সংসদে বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছিলেন একমাত্র দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো কিছুই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে না। লাহোর প্রস্তাবে যোগাযোগ ব্যবস্থাও না রাখার কথা বলা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যুক্তি দিলেন সমগ্র উপ-মহাদেশে পাকিস্তানের দুই অংশে যোগাযোগব্যবস্থা একই নীতি দ্বারা নির্ধারিত হতে পারে না। পূর্ব বাংলার দুটি পৃথক অংশে যোগাযোগব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকা উচিত নয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে সরাসরি বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনায় বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির অধিকারের কথা বলা হয়। শিল্প-কলকারখানা, আন্তঃ ও বহির্বাণিজ্য সবকিছুই প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের কথা ছিল ৬ দফায়। এটা বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা (পাটের টাকায়) ওইভাবে তিনটি রাজধানী গড়ে উঠতে পারত না। সামরিক বাহিনীর জন্য রাষ্ট্রীয় আয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬২ ভাগ ব্যয় করা হতো এবং পূর্ব বাংলায় ১০% লোকও সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন না। দেশের মূল সম্পদের সবটাই পশ্চিমাদের জন্য ব্যয় হতো। এজন্য বঙ্গবন্ধু সামরিক বাহিনীতে আরো বাঙালিকে নিয়োগ দেয়ার কথাই বলেননি, বরং তিনি দাবি করেন নেভি হেড কোয়ার্টার পূর্ব বাংলায় আনতে হবে। পূর্ব বাংলায় অস্ত্রাগার নির্মাণ এবং পূর্ব বাংলার জন্য পৃথক মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করতে হবে। এসব দাবি ছিল বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ দিনের এবং সংসদে এসব দাবি বার বার তিনি তুলেছিলেন। এসব দাবির পেছনে বোধহয় বঙ্গবন্ধুর মনের কোনো একটা বিশেষ ইচ্ছা লুকায়িত ছিল। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন পূর্ব বাংলাকে যদি সামরিক প্রস্তুতিতে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছে দেয়া যায়, তাহলে বিনা বা কম রক্তপাতে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা সম্ভব হবে। কেন্দ্রীয় সরকার কোনো দাবি গ্রহণ করেনি বরং ইপিআরকে কেন্দ্রীয় সামরিক বাহিনীর আওতায় আনা হয়।
শুধু মুদ্রা পাচারই নয়, মুদ্রাস্ফীতিজনিত কারণে পূর্ব বাংলার যে দুর্মূল্যের সৃষ্টি হয় এবং পাট চাষিরাও দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন সেই কারণে তিনি মুদ্রানীতি পরিবর্তনও করতে চেয়েছিলেন। তবে মুদ্রা পাচার বন্ধ করতে না পারলে উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্ভব নয়, তা তিনি ৬ দফায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন। বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে তিনি শাসনতান্ত্রিক বাধ্য-বাধকতা আরোপ করতে চেয়েছিলেন। অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা যাতে পূর্ব বাংলায় থেকে যায় এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থাকে, বিনা শুল্কে উভয় অংশে আমদানি-রপ্তানি, বিদেশে ট্রেড মিশন ও চুক্তি সম্পাদনের অধিকার, আমদানি রপ্তানির অধিকার ৬ দফায় আঞ্চলিক সরকারের হাতে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। সব ধরনের ট্যাক্স, খাজনা আদায় ও ধার্য্য আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত ছিল। শুধু নির্দিষ্ট অংশ কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা হবে।
৬ দফার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ যখন তিনি বাংলার জনগণের কাছে উত্থাপন করলেন জনগণ তা লুফে নিল। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এক সর্বাত্মক গণজাগরণ সৃষ্টি হলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো গ্রামের একজন বৃদ্ধ কৃষক রাতে সময় মশাল জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকতেন মুজিবকে একবার দেখার জন্য, কেননা ওই পথ দিয়ে বঙ্গবন্ধু যাবেন।
বঙ্গবন্ধুর ছিল অসংখ্য সচেতন কর্মী বাহিনী, বাংলার প্রতিটি গ্রামে হয়তো তিনি যেতে পারেননি, তার প্রাণপ্রিয় অনুগত কর্মীরা তার বক্তব্য পেঁৗছে দেন গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে। বাংলার আকাশে, বাতাসে, ইথারে বহমান একটা নাম শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। আমার নেতা তোমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। মুজিব যখন কোনো জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে জনতা তার কথা শুনত ও তার নির্দেশমতো কাজ করতে উদ্যোগী ছিল। ইস্পাত কঠিন ঐক্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ও মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন বলেই ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে (১৬৯-১৬৭) বিজয়ী হয়ে বাংলার মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে সেই আহ্বান ঘরে ঘরে পেঁৗছে দেন। তাই ৬ দফাকে বলা হয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। ৭ জুন এক ঐতিহাসিক দিন। এক কালজয়ী ক্ষণ। বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় নেয়ার দিন। ৬ দফাই এনেছে স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতির মুক্তি। এজন্য ৬ দফাকে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বলে আখ্যা দেয়া হয়।
ডা. এসএ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক
২| ০৮ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১১:৩০
বৈশাখের আমরণ নিদাঘ বলেছেন: ভালো পোস্ট। তবে ছয়দফা বঙ্গবন্ধু উপস্থাপন করলেও এটা তৈরীর পেছনে কাজ করেছিলেন আরও বেশ কয়জন। এটা বাঙ্গালীর প্রকৃত আকাঙ্খারই প্রতিফলন ছিলো। কিছু অংশ ছাড়া সম্পূর্ণ যৌক্তিকও ছিল। ফেডারেশনটা হত লুজ ফেডারেশন, কিন্তু এত দুরের দুটা অংশের বন্ধন তো এমনিতেই লুজ। একদিক থেকে ২৪ বছর টিকে থাকাও মিরাকল ছিলো।
৩| ০৮ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১১:৩৯
তৃতীয় পক্ষ বলেছেন: ছয়দফা সেই ঐতিহাসিক আন্দোলন, ভাল পোস্ট ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৮ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১১:০৪
ব্লগ সার্চম্যান বলেছেন: ভালো লেখছেন ।