![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গতকাল শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হলো। বিয়োগের শোক-ব্যথা-বেদনা এবং দেশপ্রেমের সাহস-আত্মবলিদান-গৌরব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এই দিনে এসে একসঙ্গে মিলেমিশে দিনটিকে মহিমান্বিত করেছে। যত দিন যাচ্ছে, জাতি চড়াই-উৎরাই বাধাবিঘ্ন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যত অগ্রসর হচ্ছে, ততই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, এই দিনটি জাতির ইতিহাসের একটি অনন্য সাধারণ দিন। ৪৫ বছর আগে হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবমণ্ডিত মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে জাতি যখন স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠার দিনক্ষণ গুনছে, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন কোন শুভ মুহূর্তে লড়াই-সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র শহীদের রক্তস্নাত রাজধানী ঢাকায় বিজয়ীর বেশে সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী প্রবেশ করে জাতীয় পতাকা উড্ডীন করবে; তখনই জাতিকে মেধা-বিবেকশূন্য করার হীন ও প্রতিহিংসাপরায়ণ লক্ষ্য চরিতার্থ করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরিকল্পনায় জাতির মুষ্টিমেয় বিশ্বাসহন্তারক নরপিশাচরা ঝাঁপিয়ে পড়ে বুদ্ধিজীবীদের ওপর। সৃষ্টি হয় জাতীয় ও বিশ্ব ইতিহাসের আরো একটি রক্তস্নাত কালো দিন; ১৪ ডিসেম্বর।
এই দিনটি সামনে এলেই তাই একটা প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেতে থাকে যে, বুদ্ধিজীবী হত্যার এই পরিকল্পনা কি ছিল পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিদেশি হানাদার ও তাদের সহযোগী দেশি ঘাতক-দালালদের তাৎক্ষণিক কোনো পরিকল্পনার ছোবল? নাকি তা ছিল ধারাবাহিক নীলনকশার চূড়ান্ত আঘাত? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী জাতির ইতিহাসের কলঙ্কিত হত্যা-খুন, ক্যু-পাল্টা ক্যুর ধারাবাহিক ঘটনাবলি। ইতিহাসের দিকে তাকালেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, যে দিন জাতির ঘাড়ে মধ্যযুগীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক কৃত্রিম রাষ্ট্র চাপিয়ে দেয়া হয়, সেই দিনই এটা ভবিতব্যের মতো স্থিরীকৃত হয়ে যায় যে, কোনোই পরিত্রাণ নেই, এমন একটি রক্তস্নাত কলঙ্কিত দিন আসবেই।
এটা কার না জানা যে, কৃত্রিম কিছু টিকিয়ে রাখতে বাইরের শক্তির প্রয়োজন পড়বেই। রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে এই কৃত্রিম শক্তির রূপ স্বৈরাচারী ও জিঘাংসামাখা হতে বাধ্য। এই রূপ বিদ্যমান থাকলে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কখনো ধীরে কখনোবা প্রবলভাবে, কখনো আলাদা কখনোবা একত্রে ক্রিয়াশীল হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হাজার মাইল দূরের দুই অংশ মিলে কৃত্রিম রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যদিও অধিকার ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে অনেক মধুর কথা শুনিয়েছিলেন, তবুও বাস্তবে বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর স্বৈরাচারী ও প্রতিহিংসাপরায়ণ শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া ভিন্ন আর কোনো পথই খোলা ছিল না। বাঙালির ভাষার প্রশ্নে স্বৈরাচারী মনোভাব ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার ভেতর দিয়েই তা প্রমাণিত হয়ে যায়। প্রকৃত বিচারে বাঙালির মেধা-মননের ওপর পাকিস্তানিদের প্রথম আঘাতটা ছিল ভাষার প্রশ্নে। এ ক্ষেত্রে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, পাকিস্তানিরা যখন ভাষার প্রশ্নে ওই আঘাত হানার চক্রান্ত করে, তখন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন রাষ্ট্রটির শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও পূর্ব বাংলার নির্বাচনের বিষয়েও ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও বাধা প্রদান করতে থাকে। আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলায় তখন কি অবস্থা ছিল, তা ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর ঢাকা শহরে খাদ্যের দাবিতে ভুক মিছিলসহ আন্দোলন এবং এর পরিণতিতে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী ও বাম- কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেপ্তার এবং নির্যাতনের ভেতর দিয়েই প্রমাণিত হয়।
তাই পাকিস্তানের শুরুর দিনগুলোর অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনায় এ কথা বলা চলে, প্রথম থেকেই স্বৈরাচারী কায়দায় যেমন বাঙালির মেধা-মনন তথা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সত্তার ওপর আঘাত হানা হয়, তেমনি রাজনৈতিক-অর্থনীতির ওপরও আঘাত হানার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলে। পুরো পাকিস্তানি আমলে এই তিন ক্ষেত্রেই আঘাত একত্রে ধারাবাহিকভাবে চলে। পকিস্তানি শাসক- শোষক গোষ্ঠী সেই পর্বে পরাজিতও হয় এই তিন ক্ষেত্রেই। ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের ভেতর দিয়ে তা রূপ নেয়। কিন্তু অদৃষ্টের এই পরিহাস, যা আমাদের জাতির পিতা বলে গেছেন, বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে আনতে জানে কিন্তু বিজয়কে রক্ষা করতে পারে না।
ওই বিজয় বাঙালি জাতি ধরে রাখতে পারে নেই। ক্ষুদ্র এ কলামে বেশি কথায় না গিয়ে বলতে হয়, জাতির জীবনে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তজাত অনৈক্য ও বিভেদ এজন্য দায়ী। যুক্তফ্রন্টে বিভক্তি, আওয়ামী লীগে বিভক্তি কোনটা না হয় তখন! জাতির জীবনে নেমে আসে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা এবং অবৈধ শক্তির ৯২(ক) ধারার শাসন। আবারো পূর্ব বাংলার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বৈরশাসন। যা আইয়ুবের সামরিক শাসনের মধ্যে রূপ নেয় ভাষার প্রশ্নে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা প্রতিষ্ঠা এবং রবীন্দ্র সঙ্গীত বন্ধ ও নজরুলের কবিতা ইসলামিকরণ প্রভৃতির ভেতর দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের লোভের টোপও দেয়া হয় ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন এনবিআর ও পাকিস্তান লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের নামে বেসিক ডেমোক্রেসি চালু এবং দুই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা ছিল এরই অনুষঙ্গ। রাজনীতির ক্ষেত্রে গভর্নর হিসেবে মোনায়েম খান, অর্থনীতির ক্ষেত্রে আদমজী-বাওয়ানী ২২ পরিবার আর শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে ওসমান গনিকে বসানো ছিল; একই নীলনকশার তিন বিপদ।
আর এই তিন বিপদকে তছনছ করে জাতি অগ্রসর হয়েছে তিন ক্ষেত্রে লড়াই-সংগ্রামের সমন্বয় সাধন করেই। রবীন্দ্র সঙ্গীতকে জাতীয় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করা কিংবা পহেলা বৈশাখকে বাঙালির উৎসব হিসেবে বরণ করার জন্য যখন সংগ্রাম হয়েছে, তখন দুই অর্থনীতির বিরুদ্ধে যেমন তেমনি গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন, বাক-ব্যক্তি-সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও জনগণের ভাত-কাপড়-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসার মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামও অগ্রসর হয়েছে। এই সংগ্রামেরই পরিণতি হচ্ছে আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ৭ জুন ১৯৬৬-এর রক্তাপ্লুত সংগ্রাম এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৬ দফাভিত্তিক ১১ দফা ও ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। তাই বাঙালির রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিব যখন জেল-মামলায় এবং সবশেষে আগরতলা মামলার মধ্যে নির্যাতিত হয়েছেন, তখন বুদ্ধিজীবীদের মুখপাত্র ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া গ্রেপ্তার এবং ইত্তেফাক বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বাম-কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ যখন গ্রেপ্তার হয়েছেন, তখন বুদ্ধিজীবী রণেশ দাশগুপ্ত ও সত্যেন সেনের ওপরও জেল-জুলুম-নির্যাতনের খড়গ নেমে এসেছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লিখিত ওই লড়াই-সংগ্রামের চূড়ান্ত রূপই হলো মুক্তিযুদ্ধ। তাই দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে পাকিস্তানে জেলের মধ্যে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্য যখন ফাঁসির দড়ি ঝোলানো ও জল্লাদ ঠিক করা এবং কবর খোঁড়া হচ্ছে, তখন হানাদার কবলিত ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের চোখ-মুখ বেঁধে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে মরদেহ শকুন-শেয়ালদের উদ্দেশ্যে যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে বেসরকারিভাবে গঠিত বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পাকিস্তানি সেনা নেতা ঘাতক রাও ফরমান আলী সারা দেশে ২০ হাজার বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। আর সেই উদ্দেশ্য সাধনে হানাদার কবলিত তৎকালীন গভর্নর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে তাদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে দুদিন পরেই পরাজিত হওয়ায় ওই পরিকল্পনা কার্যকর করতে পারেনি। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পরিকল্পিতভাবে মোট ১ হাজার ৭০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। পরে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৭২ সালের বিজয় দিবস স্মারক গ্রন্থে জেলাওয়ারী ৯৮৯ জন শহীদ হয়েছেন বলে লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের পরিহাস হচ্ছে এই যে, ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’-এ নাকি (আমি পড়িনি তাই নাকি লিখলাম) ওই সংখ্যাকে ২৩২ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে। বলাই বাহুল্য ওই সময়ে ঘাতক-দালাল রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর দল জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে ছিল এবং পরে ২০০১-০৬ আমলে ‘আত্মার আত্মীয়’ বিএনপি ওই সব নরঘাতকদের মন্ত্রী বানিয়েছিল, তাদের গাড়িতে-বাড়িতে শহীদদের রক্তরঞ্জিত জাতীয় পতাকা পতপত করে উড়াতে দিয়েছিল। এই সব নরপশুরা তখন উদোর পিণ্ডি ভুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে সদম্ভে ঘোষণা করেছিল, আমরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করিনি। তখন একই দশা হয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলারও। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী জানা যায়, ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ আমলে দায়ের করা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলা। পরবর্তী সময়ে শা-ল-সা সরকাররের অধীনে ভোট ডাকাতির ২০০১ সালে নির্বাচনের পর চাপে পড়ে পরবর্তী বছর পুলিশের তদন্ত বিভাগ সিআইডি কর্তৃক পেশকৃত বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার অনুমোদন দেয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তা কেবল ঝুলেই থাকে না, মামলার নথিও গায়েব হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ আমলে এই মামলার রায় হয়। এমনই হচ্ছে বাংলাদেশ আর দেশবাসীর বিধিলিপি। এক দল ক্ষমতায় এলে বিশ্বের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের আসামিদের মামলা ও বিচার হয় আর অন্যপক্ষ ক্ষমতায় এলে বুদ্ধিজীবী শহীদদের সংখ্যা কমে যায়, মামলার নথি হয়ে যায় গায়েব, হত্যাকারীদের গাড়িতে-বাড়িতে পতাকা ওড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে কালরাত্রিতে ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড এবং এরই ধারাবাহিকতায় জেলখানায় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের ধারাহিকতায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে করে দিয়েছিল ছোট পাকিস্তান। এর ফলেই দেখা যায় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-শিক্ষা-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সব ক্ষেত্রেই ফিরে আসে পাকিস্তানি ধারা। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, লোভ-লালসা দিয়ে দালাল বুদ্ধিজীবী সংগ্রহ, শিক্ষা ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি, ইতিহাস বিকৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যে শিকড় পরিবর্তনের সর্বৈব প্রচেষ্টা, সর্বোপরি জাতীয় চার মূলনীতির পরিবর্তন হচ্ছে পাকিস্তানি আমলের ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আঘাত ও বুদ্ধিজীবীদের ওপর নির্যাতন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যারই ধারাবাহিকতা। একটাকে অপরটা থেকে পৃথক করার উপায় নেই।
যেমন দেশের সুযোগ্য রাজনীতিক কিবরিয়া, আইভী রহমান, আহসানউল্লাহ মাস্টার, মনজুরুল ইমাম, মমতাজউদ্দিনের হত্যাকাণ্ড থেকে সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ, অধ্যাপক ইউনুস প্রমুখদের হত্যাকাণ্ডকে পৃথক করার উপায় নেই। সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতার হত্যা আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উপর্যুপরি চেষ্টাও একই সুতায় বাঁধা। সবই হচ্ছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার হীন উদ্দেশ্যে পরিচালিত। কারা এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করছে, কারা এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পরিকল্পনা করে কখনো সফল বা ব্যর্থ হচ্ছে, কারা বা কোন রাজনৈতিক ধারা খুনিদের অনুপ্রেরণা বা আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা, দেশি-বিদেশি কারা যুক্ত; তা পূর্বাপর ঘটনাবলি থেকে সুস্পষ্ট। বিএনপির দুনম্বর নেতা তারেক জিয়ার কথা যখন পাকিস্তান প্রতিধ্বনিত করে, বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের যৌক্তিকতা যখন পাকিস্তানও তুলে ধরে, তখন সবটাই পরিষ্কার হয়ে যায়। ‘পাগল ও শিশু’ কিংবা নিতান্ত অন্ধ ও জাতে মাতাল তালে ঠিক ব্যক্তি গোষ্ঠী ও মহল ছাড়া দিবালোকের মতো এমন সুস্পষ্ট বিষয়টা না বুঝার এবং তা না বলার কথা নয়। তাই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শতসহস্র শহীদদের স্মৃতি রক্তাক্ত এই বুকে ধারণ করে এককথায় বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধে আমরা শত্রুকে রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক তথা সর্বৈবভাবে পরাজিত করতে পারিনি। সামরিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠাকে আমরা চূড়ান্ত বিজয় মনে করেছি; শেষ যুদ্ধ বলে ভেবেছি। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনে বিজয় ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির ভেতর দিয়েও আমরা সর্বৈবভাবে বিজয়ী হইনি। বিজয়ী যদি হতে হয় তবে কেবল রাজনৈতিকভাবেই নয়, সাংস্কৃতিক-সামাজিক সব ক্ষেত্রেই ওই চিরচেনা শত্রুদের সর্বৈবভাবে পরাজিত ও চূড়ান্তভাবে পর্যুদস্ত করতে হবে।
ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিজয়ের চাইতেও সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের বিজয় বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বিজয় কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমানে শহীদদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা ক্ষমতায় থাকা এবং বিরোধী ধারা ছত্রখান থাকার কারণে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের বিজয় হাতের মুঠোয় রাখা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। অব্যাহত উন্নয়ন তথা প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন সূচক যুগপৎভাবে অগ্রসর হচ্ছে বলে অর্থনৈতিক বিজয়ও সাধ্যানুযায়ী একবিংশ শতাব্দীর উপযুক্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
কিন্তু! কি হচ্ছে সাংস্কৃতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে ওই ধারার অবস্থান? অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ, যা হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রাণভোমরা, কি হচ্ছে তার দশা? অন্ধত্ব অজ্ঞানতা কুসংস্কার ক‚পমণ্ড‚কতার বিপরীতে মুক্তবুদ্ধি মুক্তচিন্তা বিজ্ঞানমনস্কতা পাকিস্তানি আমলে আমাদের গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ও পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তাই আমরা জাতীয় চার মূলনীতিকে বুকে ধারণ করে স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। তখনো কিন্তু ছিল সাংস্কৃতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা। বর্তমানে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বিশ্ব পরিস্থিতিতে জাতির মনোজগতে ওই সব নেতিবাচক উপাদান বহাল তবিয়তে রেখে জাতির বাস্তব জগতকে কি শেষ পর্যন্ত যথাসম্ভব অগ্রসর করা সম্ভব হবে? এমনটা মনে করার কারণ নেই। তাই বর্তমানে সময়ের দাবি হচ্ছে, সাংস্কৃতিক-সামাজিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা সমুন্নত ও শাণিত করে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চলমান অগ্রগতির ধারাকে লক্ষাভিমুখে অগ্রসর করে নেয়া। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আমাদের এই উদাত্ত আহ্বানই জানাচ্ছে। শত লক্ষ শহীদের আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশার জয় হোক। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জানাই সশ্রদ্ধ প্রণতি।
©somewhere in net ltd.
১|
১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫০
চাঁদগাজী বলেছেন:
নন্দলালদের চেয়ে মীর কাশেম আলীরা বেশী ধুর্ত ছিল