![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য বক্তৃতা বা ভাষণ দিয়েছেন। কখনো তিনি বক্তৃতা দিয়ে জেলে গেছেন আবার কখনো তিনি জেল থেকে মুক্তি পেয়ে জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছেন। রাজনীতিতে নেতা-নেত্রীদের জনসভায় বক্তৃতা দেওয়া এই অঞ্চলের সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অংশ। স্বাধীনতা-পূববর্তী সময়ে রাজনৈতিক জনসভায় শ্রোতাদের উপস্থিতি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং সাধারণত দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকত। গত তিন দশকে এই সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়েছে অনেকটা। এখন অনেক রাজনৈতিক দলের কোনো জনসভা হলে তাতে ভাড়া করে লোক আনতে হয়। আবার এই লোক সরবরাহ করারও কিছু পেশাদার কারবারি আছে। এমন এক কারবারির সঙ্গে একবার আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। পুরান ঢাকার মানুষ। তিনি শুধু রাজনৈতিক জনসভায় উপস্থিত থাকার জন্য মানুষ সরবরাহ করেন না, হরতালে দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ করার জন্যও মানুষ ভাড়া দেন। দেখা যায়, একই মানুষ সব রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। কর্মসূচির ওপর নির্ভর করে কারবারির রেট। তাঁর নেটওয়ার্ক বেশ ভালো। ২০১৩-১৫ সালে খালেদা জিয়ার পেট্রলবোমা যুদ্ধের সময় সেই ব্যক্তির ব্যবসা বেশ ভালো চলেছে বলে জেনেছি। স্বাধীনতার আগে এই সংস্কৃতি চালু ছিল না। তখন আওয়ামী লীগ আর মওলানা ভাসানীর ন্যাপই ছিল দেশের প্রধান দুটি বড় রাজনৈতিক দল। এ ছাড়া ছিল মোজাফ্ফর আহমদের মস্কোপন্থী ন্যাপ। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অনুমতি দেন। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে ভরাডুবি হওয়ার পর মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর আগে মুসলিম লীগ প্রতিপক্ষের সভা-সমাবেশ বানচাল করার জন্য পুরান ঢাকার কসাই আর গুণ্ডাদের ভাড়া করত। তবে পুরনো পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যায়, কোনো জনসভাতেই উপস্থিতির সংখ্যা আট-দশ হাজারের বেশি হতো না। তবে সময়ের প্রেক্ষাপটে সেই সময় আট-দশ হাজারও অনেক মানুষ। জনসভায় দলীয় নেতাকর্মীর বাইরে সাধারণ মানুষ সম্পৃক্ত হওয়া শুরু হলো ১৯৬৬ সাল থেকে। যখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করে দেশের মানুষকে এটা বোঝাতে সক্ষম হন যে এই ছয় দফাই হচ্ছে বাঙালির মুক্তির সনদ। এই ছয় দফার ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয় সত্তরের নির্বাচন। পূর্ববঙ্গে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। মওলানা ভাসানী ‘ভোটের আগে ভাত চাই’ বলে নির্বাচন বর্জন করেন। অন্য যেসব দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের মধ্যে ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপিসহ কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থী। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনা গোয়েন্দা সংস্থা তখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এখনো করে। যে কারণে রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ছিলেন জেনারেল গোলাম উমর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধান সামরিক প্রশাসক ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণ খুঁজে বের করতে বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেন। হামুদুর রহমান জন্মসূত্রে বাঙালি হলেও তিনি ছিলেন চরম বাঙালিবিদ্বেষী। এ দেশের মানুষ তাঁকে চেনে কুখ্যাত হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের জন্য। কমিশন ২১৩ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে তার প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং বলে বাংলাদেশে যা কিছু হয়েছে তার জন্য পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের লোভ, লালসা ও নিষ্ঠুরতা দায়ী। কমিশন বলে, উমর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের খুবই আস্থাভাজন ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে জুটেছিলেন জেনারেল গুল হাসান ও জেনারেল পীরজাদা। পূর্ব পাকিস্তানে কর্তব্যরত সেনা অফিসাররা নারী ও মদে এমন ডুবে ছিলেন যে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তার খোঁজ নেওয়ার মতো তাঁদের হুঁশ ছিল না। অনেকে পূর্ব বাংলা থেকে পান চোরাচালান করে বেশ লাভবান হয়েছিলেন।
ইয়াহিয়া খান উমরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পাকিস্তানের উভয় অংশ কোন রাজনৈতিক দল কতটা আসন পাবে তার একটা হিসাব দিতে। জেনারেল উমর তাঁর কাছে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব দিয়ে বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গে আওয়ামী লীগ পাবে ৮০টি আর পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি পাবে ৬০ থেকে ৭০টি। এর অর্থ হচ্ছে ৩১৩ আসনের পার্লামেন্টে কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না। সরকার গঠন করতে হলে আওয়ামী লীগ আর পিপলস পার্টিকে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। এর ফলে বঙ্গবন্ধু তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছেন, পাকিস্তানের নতুন সংবিধান প্রণীত হবে ছয় দফার ভিত্তিতে, তা তাঁর পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী, সামরিক-বেসামরিক আমলা—সবাই ছয় দফাকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংস করার নীলনকশার একটি পূর্ব পরিকল্পনা হিসেবে দেখতেন এবং তা প্রচার করতেও দ্বিধা করতেন না। এখানে আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ইয়াহিয়া খান নির্বাচনের ঠিক আগে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক এন এ রিজভীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন শেখ মুজিবের নির্বাচনী প্রচার ও তাঁর অবস্থান দুর্বল করার জন্য অর্থ দিয়ে মওলানা ভাসানীকে ব্যবহার করতে। পশ্চিম পাকিস্তানে মুসলিম লীগ নেতা কাইয়ুম খানকে একইভাবে অর্থ সহায়তা করার জন্যও ইয়াহিয়া নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই অর্থ সংগৃহীত হয়েছিল পাকিস্তানের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় থেকে (জেনারেল রাও আবদুর রশিদ, ‘জো ম্যায় নে দেখা’, ১৯৮৫ সাল)। তবে মওলানা ভাসানীর ক্ষেত্রে এই ষড়যন্ত্র কাজ করেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই, কারণ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সব সময় বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করেছেন।
আরো উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারের সময় বলতেন তিনি ৯০ শতাংশ ভোট পাবেন। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ববাংলার ৫৮ শতাংশ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিল। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হলে ইয়াহিয়া খান তো বটেই, পাকিস্তানের সব সামরিক-বেসামরিক আমলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। বাঙালিরা পাকিস্তান শাসন করছে—তা মেনে নেওয়া যায় না। ইয়াহিয়া জেনারেল উমরের কাছে এই বিপর্যয়ের কারণ জানতে চাইলে উমর নিশ্চুপ থাকেন। আসলে না ইয়াহিয়া না উমর বুঝতে পারেননি কখন শেখ মুজিব একজন প্রাদেশিক রাজনৈতিক নেতা থেকে একজন স্টেটসম্যানে পরিণত হয়েছিলেন। স্টেটসম্যান হতে চাইলে একজন রাজনৈতিক নেতার দূরদর্শিতা থাকতে হয়। মুজিব ইতিহাসের হাতছানি দেখতে পেয়েছিলেন। নির্বাচনের পর মুজিব আর আওয়ামী লীগের নেতা থাকলেন না। তিনি হয়ে উঠলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটি প্রত্যাশিত ছিল যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের প্ররোচনায় ভুট্টো বেঁকে বসলেন এবং বললেন, মুজিব যদি তাঁর ইশতেহারে প্রতিশ্রুত ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করেন তাহলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার মৃত্যু ঘটবে। আসলে ছয় দফাকে পাঞ্জাব ছাড়া পাকিস্তানের অন্য তিনটি প্রদেশ পরোক্ষভাবে সমর্থন করত; কারণ ছয় দফা বাস্তবায়িত হলে প্রদেশগুলো পাঞ্জাবের শোষণ থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হতে পারবে। দেশভাগের পর পাকিস্তানের সব প্রদেশকেই শাসন ও শোষণ করেছেন পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলারা। দেশভাগের আগে থেকেই যেহেতু শিক্ষাদীক্ষায় পাঞ্জাবিরা কিছুটা অগ্রসর ছিল, এই কাজটি করতে তাদের বেশ সুবিধা হয়েছিল এবং এখনো হচ্ছে। পাঞ্জাবিদের কী উপায়ে বাঙালিদের শাসন থেকে রক্ষা করা যায় সেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই। পাঞ্জাবিদের এটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল, তাদের জন্মই হয়েছে শাসন করার জন্য, শাসিত হওয়ার জন্য নয়। সামরিক-বেসামরিক আমলা ছাড়াও এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলেন ইয়াহিয়া ও ভুট্টো। দুজনই মদ ও নারী খুব পছন্দ করতেন।
অনেকটা লোক দেখানোর জন্য ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসবে। সবাই ইয়াহিয়ার এই চাতুর্যপূর্ণ ঘোষণা বিশ্বাস করেছিলেন; একমাত্র ব্যতিক্রম জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, কারণ তাঁরা দুজনেই এই ষড়যন্ত্রের রচয়িতা। ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভুট্টোর পিপলস পার্টির সদস্যরা ছাড়া জাতীয় পরিষদের অন্য সদস্যরা ঢাকা আসতে শুরু করেন। ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের প্ররোচনায় বায়না ধরেন সংসদের বাইরে নতুন সংবিধানের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে মতৈক্য হতে হবে। যার সহজ-সরল অর্থ দাঁড়ায়, ছয় দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করা চলবে না। বঙ্গবন্ধুর সাফ জবাব, তিনি ছয় দফা বাস্তবায়ন করার দাবিতে ১৯৬৬ সাল থেকে আন্দোলন করছেন, এর কারণে নিয়মিত বিরতি দিয়ে জেলে গেছেন, এই ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচনী ইশতেহার রচিত হয়েছে; সুতরাং ছয় দফা নিয়ে কোনো আপস করার প্রশ্নই আসে না। ভুট্টো ঘোষণা করলেন, তিনি ৩ তারিখের সংসদ অধিবেশনে তো যাবেনই না, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেউ গেলে তাঁদের ঠ্যাং ভেঙে দেওয়া হবে। সংসদ অধিবেশনের জন্য সবাই যখন প্রস্তুত, ঠিক তখনই ১ মার্চ পাকিস্তান রেডিও থেকে ঘোষণা করা হয় ৩ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন স্থগিত করা হলো। অখণ্ড পাকিস্তানের কফিনে এই ঘোষণাই ছিল শেষ পেরেক। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। দ্রুত পাল্টে যায় ঢাকাসহ সারা দেশের সার্বিক চিত্র। অফিস-আদালত-সচিবালয় ছেড়ে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। কেমন ছিল সেই অগ্নিঝরা মার্চ তা বর্তমান প্রজন্মকে বোঝানো যাবে না। দ্রুত দেশের বেসামরিক প্রশাসন চলে গেল বঙ্গবন্ধুর হাতে। ১ তারিখই গঠিত হয় ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। ৩ তারিখ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পল্টন ময়দানের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু এক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন এবং বলেন, ৭ মার্চ তিনি রমনা রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। ৩ তারিখের জনসভায় জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয় ‘আমার সোনার বাংলা’ আর উত্তোলন করা হয় লাল-সবুজের মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত একটি পতাকা, যা আগের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে উত্তোলন করা হয়েছিল। শুধু বাংলার মানুষ নয়, বিশ্বের মানুষ পরিষ্কার একটি স্বাধীন দেশের জন্মের আভা দেখতে পাচ্ছিল।
৭ মার্চ সারা দেশে টান টান উত্তেজনা। কী বলবেন আজ নেতা? সবার প্রত্যাশা স্বাধীনতার ঘোষণা। সকালে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল জোসেফ ফারল্যান্ড ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলে এসেছিলেন, বিকেলে যদি তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেন তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাতে সায় দেবে না। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বাঙালি তথা আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের রাজনৈতিক মেধাকে গুরুত্ব দিতে কার্পণ্য করে এবং শেষ পর্যন্ত তারাই ঠকে যায়। দুপুর থেকেই রেসকোর্স ময়দান কানায় কানায় ভর্তি হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের জনসভায় গিয়েছিলেন হাজী গোলাম মুর্শেদের গাড়িতে। মুর্শেদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কলকাতার দিনগুলোর অনুজপ্রতিম বন্ধু। হাজী সাহেব নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। শাহবাগের মোড়ে পৌঁছলে হাজী মুর্শেদ বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চান, তিনি সমবেত জনতাকে কী বলবেন। কোনো চিন্তা না করেই বঙ্গবন্ধুর জবাব ছিল, ‘জানি না। আল্লাহ আমাকে দিয়ে যা বলাবেন তাই বলব।’ সেদিনের ১৯ মিনিটের ভাষণই বলে দেয় বঙ্গবন্ধুকে কেন রাজনীতির কবি বলা হয়। বঙ্গবন্ধু কোনো লিখিত স্ক্রিপ্ট থেকে পড়েননি। তাত্ক্ষণিকভাবে দেওয়া তাঁর সেই ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি দেশভাগের পর থেকে কতভাবে বাঙালিকে শোষণ ও বঞ্চনার স্বীকার হতে হয়েছে তা তুলে ধরেন। দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব চান না, বাঙালির অধিকার চান। তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্য হচ্ছে বাঙালিকে পাকিস্তানের শাসনভার থেকে বঞ্চিত করা। উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে ইঙ্গিত করেছিলেন যুদ্ধ আসন্ন। হতে পারে তিনি ময়দানে থেকে সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। তাঁর অবর্তমানে করণীয় কী তা-ও তিনি পরিষ্কার করে বলেছিলেন। শেষ করেছিলেন সেই ঐতিহাসিক দুটি লাইন দিয়ে। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের আগে ও পরে অনেক রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের বাইরে ভাষণ ও বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু সমসাময়িক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের বক্তৃতা এক কালজয়ী ভাষণ হিসেবে ইতিহাসে এরই মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। এই একটি ভাষণ বুকে ধারণ করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ১৯৭১ সালে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে গিয়েছিল। জয়তু বঙ্গবন্ধু। জয়তু বাংলাদেশ।
©somewhere in net ltd.