নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শেষ পর্যন্ত লেখাটাই থাকে। টিভি, রেডিও, ওয়েবসাইট, চলচ্চিত্র, মঞ্চ, বিজ্ঞাপণ, ব্লগ - লেখার যতো মাধ্যম সবখানেই লিখতে হবে। পৃথিবী পাল্টে গেছে - এখন আমরা দুহাতের দশ আঙুলেই লিখি।

মুম রহমান

পেশাদার ও নেশাদার লেখক, মাঝে মাঝে কবি

মুম রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

মনের মানুষের খোঁজে

০৩ রা এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:১৯





No form of art goes beyond ordinary consciousness as film does,

straight to our emotions, deep into the twilight of the soul.



Ingrid Bergman





‘মনের মানুষ’ এমন এক চলচ্চিত্র-প্রয়াস যা মুক্তি পাওয়ার আগেই দর্শক-সাধারণের মধ্যে দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ চলচ্চিত্রস্থ বিষয়বস্তু। বাঙালির আত্মার এক প্রিয় মানুষ লালনকে নিয়ে বিষয়বস্তু আবর্তিত বলে এ চলচ্চিত্রটি শুটিং-পর্ব থেকেই আলোচনায় চলে এসেছে। ‘অন্তর্জলী যাত্রা’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’র মতো ধ্র“পদী চলচ্চিত্রের কারিগর গৌতম ঘোষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস ‘মনের মানুষ’-এর চলচ্চিত্রায়ণের মাধ্যমে লালনকে চলচ্চিত্র মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। তাই ‘মনের মানুষ’ মুক্তি পাওয়ার আগেই বাঙালি দর্শক-মননে বিশেষ কৌতূহল আর আবেগ ঘনীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। বিশেষত যখন এটি সিনেমা হলে মুক্তির আগেই ভারতের গোয়ায় অনুষ্ঠিত ৪১তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের প্রতিযোগিতা বিভাগে সেরা চলচ্চিত্র হিসাবে পুরস্কৃত হয়। ১৯৫২ সালের পর এই প্রথম দুই বাংলায় একই দিনে একই সাথে বাংলাদেশের ৭০টি ও ভারতের ৩০টি মোট ১০০টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে এ চলচ্চিত্র।

লালন সাঁইকে নিয়ে এদেশে ইতোপূর্বে আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে সৈয়দ হাসান ইমামের পরিচালনায় স্বাধীন বাংলাদেশে লালনকে নিয়ে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রটির নাম ছিলো ‘লালন ফকির’ আর ২০০৪ সালে লালনকে নিয়ে মুক্তি পায় তানভীর মোকাম্মল পরিচালিত ‘লালন’। ‘লালন ফকির’ নির্মিত হয়েছে নাটককার আসকার ইবনে শাইখ লিখিত একই নামের নাটক অবলম্বনে আর ‘লালন’ নির্মিত হয়েছে তানভীর মোকাম্মলের গবেষণালব্ধ প্রচেষ্টা থেকে। এ দুটি চলচ্চিত্রই ছিলো লালনের জীবনী কেন্দ্রিক, নামকরণেও এ সত্য স্পষ্ট। কিন্তু গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র লালন হলেও এটি জীবনী বা ইতিহাসভিত্তিক চলচ্চিত্র নয়। বরং এটিকে সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র বলা যেতে পারে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘মনের মানুষ’ গ্রন্থে তাঁর বক্তব্যে স্পষ্টতই উচ্চারণ করেছেন: ‘এই উপন্যাসটি লালন ফকিরের প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যভিত্তিক জীবন কাহিনি হিসেবে একেবারেই গণ্য করা যাবে না। কারণ তাঁর জীবনের ইতিহাস ও তথ্য খুব সামান্যই পাওয়া যায়।’ তাঁর বক্তব্যে তিনি আরও উল্লেখ করেন: ‘লালনের জীবনের মূল ভাব ও আদর্শ ফুটিয়ে তোলাই আমার এই রচনার উদ্দেশ্য। কাহিনীটি আধার মাত্র।’ উপন্যাসকারের এই বক্তব্যই নিশ্চিত করে দেয় যে, এই উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি চলচ্চিত্রে লালনকে ঐতিহাসিক বা জীবন কাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্র ঘরাণায় ফেলা যাবে না। ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় এ চলচ্চিত্রের প্রচারণা কার্যক্রমের সূচনা কালে গৌতম ঘোষ বলেছেন: ‘পৃথিবী এখন অসহিষ্ণু। ধর্মীয়ভাবে, রাজনৈতিকভাবে অসহিষ্ণুতা দিন দিন বেড়েই চলছে। এখন লালনকে আমাদের খুব প্রয়োজন। তাই চলচ্চিত্রটি করা।’ পরিচালকের এই মন্তব্যও পরিষ্কার করে দেয়, শিল্পী নয়, শিল্পদর্শনই এ চলচ্চিত্রর মূল অভিলক্ষ্য। তাই লালন নয়, লালনের বাণীকেই এ চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেছেন চলচ্চিত্রকার। চলচ্চিত্রের একাধিক দৃশ্যে লালন ও জ্যোতিরিন্দ্র নাথের আলোচনা, হিন্দু পুরুত ও মুসলমান মোল্লার সঙ্গে বাহাস এবং দ্দুদু শাহ’র নানা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে লালনের দর্শন পরিস্ফুটিত হয়েছে। একটা বিষয় ছবির মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে পরিস্কার করে নেয়া দরকার যে, লালন নেহাত একজন ব্যক্তি বা বাউল নন, আজ তিনি একাই একটি দর্শন। লালনের জীবিতকালেই দশ সহস্র অনুসারী হয়েছিলো, এ শুধু গানের কারণে নয়, বরং তার দর্শনের কারণেই।

গ্রীক দর্শনে যা ‘গ্লোথি সায়োনথনি’(নিজেকে জানা), ভারতীয় সংস্কৃতিতে তা ‘আত্মা নং জ্ঞানং বিদ্ধি’(নিজকে বা আত্মকে জানাই জ্ঞানের সার), ইংরেজিতে তাই ‘know thyself ’ আর সোজা বাংলায় এই হলো নিজেকে খুঁজে যাওয়া তথা আত্মঅনুসন্ধান। বাউলদের মূল লক্ষ্যও এই আত্ম-অনুসন্ধান। নিজের মধ্যে পরমাত্মা তথা মনের মধ্যে যে মনের মানুষ তাকেই খুঁজে বেড়ায় বাউলাত্মা। তাই লালন ফকিরকে নিয়ে নির্মিত ছবির নাম যখন ‘মনের মানুষ’ এবং ইংরেজি নামকরণ The quest (আভিধানিক অর্থ : অনুসন্ধান, খুঁজে ফেরা) তখন এটা আর বুঝতে বাকি থাকে না যে এ চলচ্চিত্রের মূল উদ্দেশ্য কী। লালন যেমন জীবন ভর খুঁজে ফিরেছেন জীবনের মানে আর মনের ভেতরেই খুঁজেছেন মনের মানুষকে তখন লালনের ভাব-দর্শন খুঁজে পেলে আমরাও অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে পারবো। গৌতম ঘোষ স্বয়ং ‘কালের কণ্ঠ’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন: ‘লালনের প্রতি আকর্ষণটা আমার অনেক দিনের। লালনের গান যেমন টানে, তেমনি ভাবায়ও। এই ছবির মাধ্যমে আমি লালনকে খুঁজেছি।’



এবার আসা যাক গৌতম ঘোষের এই ‘অনুসন্ধানে’র স্বার্থকতা খুঁজে দেখায়। যেহেতু একটি পাঠকপ্রিয় উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ সেহেতু প্রথমেই দেখা যাক মূল উপন্যাসের সঙ্গে গৌতমের চলচ্চিত্রের মিল-ফারাক। কোন ভাল চলচ্চিত্রকারই সাহিত্যের স্রেফ অনুসরণ করেন না। সত্যজিৎ রায় যখন রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ কিংবা তারাশঙ্করের ‘জলসাঘর’ করেন তখন চলচ্চিত্রের প্রয়োজনেই গল্পকে ভাঙচুর করেন। গৌতম ঘোষের ক্ষেত্রেও আমরা তাই লক্ষ্য করি। মূল উপন্যাসে গল্পটি ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে কালের ক্রম রক্ষা করে। আর চলচ্চিত্রের টাইটেল দৃশ্যেই আমরা দেখি নদীতে লালনের লাশ ভেসে যেতে। টাইটেল শেষ হতেই দেখা যায়, বৃদ্ধ লালন বসে আছেন জমিদার জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুরের সামনে। জমিদারের সঙ্গে চলছে গান আর জীবন দর্শন নিয়ে লালনের আলোচনা। আর এই আলোচনার সূত্র ধরেই আমরা লালনের কৈশোর, যৌবন আর পরিণতকালের সব ঘটনা দেখে আসি ফ্ল্যাশব্যাক টেকনিকের ব্যবহারে। ইতালির গুইসেপে টোরানটোরের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘সিনেমা পেরাদিসো’র মতো এ ছবিতেও ফ্ল্যাশব্যাককে গল্প বলার অন্যতম কৌশল হিসাবে স্বার্থকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গৌতম ঘোষ গল্প বলার এই চলচ্চিত্র-টেকনিকের মাধ্যমে দর্শককে ইচ্ছে মতো লালনের জীবনকে উল্টে-পাল্টে দেখার সুযোগ দিয়েছেন। উপন্যাসের সরলীকরণ কাহিনীর থেকে চলচ্চিত্রের এই বৃত্তায়ন অনেক পরিণত মনে হয়। চলচ্চিত্রকে হয়তো আরও আকর্ষণীয় করতে গৌতম অনেক ক্ষেত্রেই কাহিনীর বদল ঘটিয়েছেন। লালনের বন্ধু পাগলা সোলেমান ওরফে কালুয়া মূল উপন্যাসে এক সময় অভিমান করে আখড়া ছেড়ে চলে যায়, লালনের সঙ্গে অন্য এক আসরে দেখা হলে সে বন্ধুকে না-চেনার ভান করে, এমনকি লালনকে পেটায়ও। কিন্তু চলচ্চিত্রের কালুয়া কখনোই লালনকে ছেড়ে যায় না, সে লালনের একনিষ্ঠ অনুসারী, এমনকি ছবির শেষে সে লালনের জন্যে লড়াই করে মৃত্যু বরণ করে। তার পাগলামি যেমন দর্শককে আনন্দ দেয়, লালন অনুরাগ তেমনি মুগ্ধ করে আর মৃত্যু দর্শককে কাঁদায়। সব মিলিয়ে উপন্যাসের পরিণামহীন একটি চরিত্রকে গৌতম পূর্ণ পরিণতি দিয়েছেন। উপন্যাসের সঙ্গে আরেকটি বড় পার্থক্য দেখা যায় সিরাজ সাঁই আর লালনের সম্পর্কের মধ্যে। মূল উপন্যাসে সিরাজ সাঁইয়ের সঙ্গে লালনের দেখা হয় অনেক পরে এবং সিরাজ সাঁইয়ের সঙ্গে লালনের সম্পর্ক ততো গভীর হয় না। কিন্তু ছবিতে আমরা দেখি লালন কৈশোরেই সিরাজ সাঁই দ্বারা অনুপ্রাণিত, পরে সরাসরি তার শিষ্যত্ব লাভ করে এবং সাঁইয়ের আদেশেই নির্জন জঙ্গলে সাধনা শুরু করে। উপন্যাসের যে ঘোড়ার নাম মানিক চাদ সেই ঘোড়ার নাম চলচ্চিত্রে হয়ে যায় রাণী। উপন্যাসের লালন তার পরিচয় ভুলে গেলে গ্রামের বাড়ির অন্য লোকেরা তাকে সনাক্ত করে আর চলচ্চিত্রে সিরাজ সাইঁয়ের একটি কথাতেই লালন ফিরে পায় আত্ম-পরিচয়। উপন্যাসিক সুনীল যেখানে সাহিত্যের সীমানায় তুলে ধরেন লালনের জীবন ও দর্শন সেখানে চলচ্চিত্রকার গৌতম আরও কয়েক ধাপ এগিয়েছেন বলেই মনে হয়। মূল উপন্যাসের সাথে তিনি ইতিহাসের উপাদানকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি নানা চরিত্রের মনস্তত্ত্বও প্রকাশ করেছেন সুদৃঢ়ভাবে। মুসলমান রমণীর হাতে ভাত খেয়ে ফিরে আসা লালনকে হিন্দু সংস্কারবাদী মা ফিরিয়ে দেন আবার বৌকে দিয়ে ভাত পাঠিয়ে দিয়ে আড়াল থেকে খেয়ালও রাখেন। উপন্যাসে লালনের বৌকে হাবাগোবা জড়বুদ্ধির দেখালেও চলচ্চিত্রের লালন-বধূ অনেক বেশি আবেগী। স্রেফ সাহিত্যের অনুসরণ নয়, বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিতে ইতিহাস ও মনস্তত্ত্বের এমন সব উপাদানের সংযোজন চলচ্চিত্রকার হিসাবে গৌতমের গল্প বলাকে আরও ঋদ্ধ করে নিঃসন্দেহে।

এ সুযোগে পাঠকের জন্যে মনের মানুষ চলচ্চিত্রের গল্পটি জানিয়ে দেয়া যাক। চলচ্চিত্র-কাহিনীর পুরোটাই বিধৃত হয়েছে স্বয়ং লালনের মুখ থেকে। বৃদ্ধ লালন গিয়েছেন জমিদার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। জমিদার তার পোট্রেট আঁকছেন আর ফাঁকে ফাঁকে লালনের গান শুনছেন এবং এর মধ্যেই লালন তার কৈাশোর-যৌবন থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সময়ের জীবন-কাহিনী বলে যাচ্ছেন। যুবক লালনকে কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্নের সামনে ধরে নিয়ে আসা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে কবিরাজের ঘোড়া রাণীকে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। কিন্তু আসলে জানা যায়, সে প্রায়শই ঘোড়াটিকে নিয়ে তার স্ত্রীকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়াতো। জানা যায়, লালন পালায় গান গায়, নিজে গান বাঁধে আর ইতোমধ্যেই সাধক সিরাজ সাইয়ের কাছে সে দেহতত্ত্ব বুঝতে চায়। যাহোক, কবিরাজ অন্য রকম এই তরুণটির প্রতি বিশেষ øেহ বোধ করেন এবং তার সঙ্গে গঙ্গাøানে বহরমপুরে নিয়ে যেতে চান। যাতে করে তার ঘোড়াটির দেখা-শোনা হবে, তার গানও শোনা হবে। বৃদ্ধ মা’র অনিচ্ছা সত্ত্বেও লালন চলে যায় গঙ্গাøানে। গঙ্গাøানে গিয়ে লালনের জলবসন্ত হয়। তাকে মৃত ভেবে জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ভাসতে ভাসতে এক ঘাটে এসে লালনের ভেলা ভেড়ে। সেখানে রাবেয়া নামের এক মুসলমান নারী তাকে উদ্ধার করে। ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী এই নারী মাতৃøেহে লালনের সেবা করেন। লালনও সুস্থ হয়ে তাকে মাতৃ জ্ঞান করে। এখানে সিরাজ সাঁই এলে লালন তার সঙ্গে বেরিয়ে যায়। সিরাজ সাঁই লালনকে চিনতে পারে এবং তাকে আদেশ করে পূর্ব পরিচয়ে ফিরে না-যেতে। গুরুর আদেশ অমান্য করেই লালন একদিন তার বাড়িতে ফিরে যায়। কিন্তু মুসলমানের হাতে ভাত খাওয়ায় তার জাত গিয়েছে বলে মা তাকে ঘরে তুলতে রাজী হয় না। সে স্ত্রীকে নিয়ে বিবাগী হতে চাইলেও মা নরকের ভয়ে তাকে নিবৃত্ত করে। ক্ষুব্ধ ব্যথিত লালন ঘর ছাড়ে চিরতরে। গুরুর আদেশেই এক নির্জন বনে ঠাঁই নেয়। এখানে তার সাথে পরিচয় হয় কালুয়া ওরফে সোলেমান পাগলার সাথে। কালুয়াও সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্যত্ব নিতে চেয়েছিলো, কিন্তু সিরাজ সাই তাকে গ্রহণ করেনি। মুসলমান কালুয়া হিন্দু বিধবা কমলীর প্রেমে পড়ে, কিন্তু তাকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সাহস পায় না। কালুয়া ও লালনের বন্ধুত্ব হয়। তারা বনের বাঁশ কেটে গ্রামে গিয়ে বিক্রি করে। একদিন তাদের মাঝে হাজির হয় কাশেম ও কমলী। কমলী সোলেমানকে না-পেয়ে কাশেমের সাথে ঘর ছাড়ে। শুরুতে তাদেরকে ঠাঁই দিতে না-চাইলে লালনের ইচ্ছায় তারা এই বনে ঠাঁই পায়। ধীরে ধীরে ঘর-হারা আরও মানুষ আসতে থাকে এই বনের আখড়ায়। আখড়ার নাম হয়ে যায় আনন্দবাজার। লালনের গান ও তার আখড়ার কথা শুনে কাঙাল হরিনাথ ও মীর মোশাররফ হোসেন আসেন তার সঙ্গে দেখা করতে। কাঙাল লালনের গান তার পত্রিকায় প্রকাশ করতে চায়। সে জানায়, অসাম্প্রদায়িক গান বেঁধে তারা গোড়া হিন্দু মুসলিমের শত্র“ হয়েছে। এদের হাত থেকে বাঁচতে চাইলে শুধু শুধু গান গাইলে হবে না; বরং নিজেদের শক্তি বাড়াতে হবে। হরিনাথের পরামর্শেই লালন হাতে লাঠি তুলে নেয়। তারা লাঠি চালায় আর রণপা পায়ে বনের মধ্যে ঘুড়ে বেড়ায়। একদিন শশ্মানে জোর করে সতী পোড়ানোর চেষ্টা করা হলে সেখান থেকে লালন ও তার দল ভানুমতিকে উদ্ধার করে। ভানুমতি লালনের সেবা দাসী হয়। এই নিয়ে হিন্দু পুরতরা উত্তেজিত হয়, তাদের সঙ্গী হয় মোল্লারাও। লালনের বিরুদ্ধে তারা দল-মত গড়তে থাকে। পাবনার জমিদার বাড়িতে লালনের গানের আসরের নিমন্ত্রণ আসে, ঠিক হয় সেখানেই লালনের সঙ্গে মোল্লা-পুরুতের বাহাস (তর্ক) হবে। কিন্তু যুক্তি-তর্কে হেরে গিয়ে তারা লাঠি চালায়। লাঠির আঘাতে কালুয়ার মৃত্যু হয়। জমিদার দোষীদের শাস্তি দিতে চাইলে লালন তাদেরকে ক্ষমা করে দিতে বলেন। গল্প এটুকু এগুলে সন্ধ্যা নামে, লালনের জন্যে বাইরে গগণ হরকরা অপেক্ষা করছে। লালন জ্যোতিরিন্দ্র নাথের কাছ থেকে বিদায় নেয়। জমিদার লালনকে তার আখড়ার জায়গাটি নিস্কর করে দেয়। যাহোক জমিদারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লালন আসে গগণ হরকরার বাড়িতে। সেখানে সে গান গায় ‘মিলন হবে কতো দিনে, আমার মনের মানুষেরও সনে’। মনের মানুষের সাথে মিলনের আকাঙ্খা দিয়েই চলচ্চিত্রর গল্প শেষ হয়।

গল্পের বাঁধুনিতে কিছু দূর্বলতা অবশ্য উল্লেখ করতে হয়, যেমন সময় ঘটিত সমস্যা। লালন জঙ্গলে এসে কতো দিন কাটালো, কতোদিন পেরিয়ে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো সেগুলো আরেকটু যতœ নিয়ে দেখানো যেতো। হঠাৎ কাঙাল হরিনাথের আগমনেই আমরা বুঝতে পারি তার গান গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু লালন বা তার কোন শিষ্যকেই আমরা গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেড়াতে দেখি না। তবুও সুনীলের উপন্যাসের রূপান্তর করতে গিয়ে গৌতম ঘোষ ইতিহাস, মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগিয়েছেন সাবলীলভাবে। চিত্রনাট্যকে করেছেন চলচ্চিত্রের যথার্থ উপযোগী। এক্ষেত্রে স্মর্তব্য বিখ্যাত পশ্চিমা চলচ্চিত্র পরিচালক ‘স্টারওয়ার্স’ খ্যাত জর্জ লুকাসের উক্তি,``But having a really good understanding of history, literature, psychology, sciences - is very, very important to actually being able to make movies.'' '' তার এই কথার সার্থকতা আমরা খুঁজে পাই গৌতমের চিত্রনাট্যে।



চিত্রনাট্যের পরেই বিশেষ করে বলতে হয় সংলাপের কথা। সংলাপ যথেষ্ট সরেস। লালনের প্রতি কমলীর শারীরিক বাসনা জাগানোর চেষ্টায় কমলী যখন দেখে লালন স্থবির হয়ে থাকলেও তার কাম ঠিক জাগছে, তখন সে তাচ্ছিল্ল করে লালনকে বলে, ‘তোমার বাসনা আছে ষোলো আনা। তুমি ভাবের ঘরে চুরি কর। আমারে শান্ত করো সাঁই।’ জবাবে লালনের অনবদ্য সংলাপ ‘শরীর জাগে শরীরের নিয়মে, মন যদি না জাগে’। মূল উপন্যাসে এরপরও লালনের আরো কিছু সংলাপ থাকলেও চলচ্চিত্রকার শুধুমাত্র এইটুকু সংলাপ ব্যবহারেই তার পরিমিতি বোধের পরিচয় দিয়েছেন। তবে এই দৃশ্যে কমলীর মুখে ‘জ্বালা মেটানো’, ‘শান্ত করো’ জাতীয় সংলাপ কিছুটা স্থুলই মনে হয়। এই দৃশ্যটি সম্পর্কে পশ্চিম বঙ্গের সুখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদার লিখেছেন Ñ ‘‘মনের মানুষ’- এ গৌতম এমন একটি দৃশ্য তৈরি করেছেন যা কোনও ভারতীয় পরিচালক এখনও পর্যন্ত ভাবতে পারেনি। মধ্যরাতে কমলী এসেছে লালনের ঘরে। লালনকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আদর করতে করতে খেপে ওঠে সে, ‘কী হইল, তুমি কি পাথর? কামবাসনা নাই?’ লালন বলেন, ‘থাকবে না ক্যান? সব মাইনষের যেমন থাকে...!’ কমলীর মুখ নীচে নামে। ক্যামেরা তখন লালনের বুকে। কমলীকে দেখা যায় না। কিন্তু তার হাসি, আবিষ্কারের হাসি উছলে ওঠে। সে মুখ তুলে বলে, ‘তোমার বাসনা আছে ষোলো আনা। তুমি ভাবের ঘরে চুরি কর। আমারে শান্ত করো সাঁই।’ লালন বলেন, ‘ ‘শরীর জাগে শরীরের নিয়মে, মন যদি না জাগে’। আমরা কোথাও অশ্লীলতার গন্ধ পেলাম না। জানলাম বাংলা ছবি সাবালক হয়ে গেল।’ এটি ছাড়াও একাধিক দৃশ্যে যৌনতার ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিচালক। তরুণ লালনকে স্থির করতে এবং তাকে সঙ্গ দিতে সিরাজ সাঁইয়ের এক কামুক নারীকে ডাকা, লালনের ঘরে ‘আমার জ্বালা মিটিয়ে দাও গো সাঁই’ বলে কলমীর হাত ও মুখ লালনের গা বেয়ে নিচে নেমে যাওয়া কিংবা ক্ষুব্ধ কালুয়াকে শান্ত করতে কলমীকে ‘সেবা’ করার আদেশ দেয়ার মধ্যে যথেষ্ট যৌন ইঙ্গিত আছে। আর কে না জানে বাউলদের দেহ সাধনায় যৌনতা আবশ্যকীয়। কিন্তু লালন তথা বাউল সম্প্রদায়ের যৌন জীবন চিত্রায়ণে যতোটা মন দেয়া হয়েছে আরেকটু মন দেয়া যেতো লালনের সামাজিক ও কর্ম জীবনে। ‘পুনা মাছের ঝাঁক’ সংলাপটি চলচ্চিত্রে ভিন্নমাত্রা এনে দিয়েছে। লালনের ভেতরে গান আসলেই তার বলে ওঠা ‘ওরে আমার পুনা মাছের ঝাঁক এসেছে’ Ñ এই সংলাপের সাথে মিলিয়ে নিজের স্ত্রীকে পুনা মাছ বলার মধ্যে ভিন্ন আমেজ তৈরি হয়। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিকরা বলেন, বাস্তবেও লালনের ভেতর গান আসলেই তিনি ‘ওরে আমার পুনা মাছের ঝাঁক এসেছে’ কথাটি বলতেন।



আরেক খ্যাতিমান পশ্চিমা চলচ্চিত্রকার অরসন ওয়েলস একদা বলেছিলেন : ‘‘অ ভরষস রং হবাবৎ ৎবধষষু ধহু মড়ড়ফ ঁহষবংং ঃযব পধসবৎধ রং ধহ বুব রহ ঃযব যবধফ ড়ভ ধ ঢ়ড়বঃ.’’ গল্প বলা, চরিত্র নির্মাণ আর আবেগ তৈরিতে চলচ্চিত্রের অন্যতম উপাদান ক্যামেরা। এই ক্যামেরার ভাষা তথা সিনেমাটোগ্রাফির উপর চলচ্চিত্রের সাফল্য অনেকটাই নির্ভরশীল। এখানে উল্লেখ্য যে ‘মনের মানুষ’-এর পরিচালক নিজেই ক্যামেরা ও সম্পাদনার দায় নিয়েছেন, ফলে সামগ্রিক সমন্বয়ের একটা রূপ আমরা দেখতে পাই। সিনেমাটোগ্রাফির কিছু কিছু অংশ যথার্থই নান্দনিক ও অর্থবহ। বট গাছের ঝুরি’র নিচ দিয়ে কবিরাজ ও তার দলের সঙ্গে লালনের তীর্থযাত্রার দৃশ্যটি কাব্যমাত্রা অর্জন করেছে। লালনের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা এটি, এই যাত্রাই তার জীবনকে আমূল পাল্টে দেয়, এই দৃশ্যটি তাই গুরুত্বপূর্ণ। এমনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ নান্দনিক দৃশ্যায়ন লালন ও জ্যোতিরিন্দ্রের নদীর ধার দিয়ে বের হয়ে সর্ষে ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়া। ‘বেঁধেছে এমন ঘর শূন্যের উপর’ গানটির দৃশ্যায়নে গৌতম কাব্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন। প্রথমে ছনের চালার উপর দিয়ে রণপা পরা শিষ্যদের নাচ প্রায় শূন্যে ঘর বাঁধার অনুভূতিই এনে দেয় দর্শক-মননে। চালার উপর থেকে টিল্ট ডাউন করে ক্যামেরা চলে আসে মূল গানের আসরে। লালনের তীর্থযাত্রার দৃশ্যের মতো একাধিক দৃশ্যেই ফ্রেমের উপর থেকে বটের ঝুরির ঝুলে থাকা আলাদা ব্যঞ্জনা দেয়। গাঁয়ে ফিরে এসে স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার দৃশ্যে অসংখ্য নারকেল গাছের সারি শট কম্পোজিশনে নান্দনিকমাত্রা তৈরি করে। তবে চলচ্চিত্রটির একবারে শেষ পর্যায়ে ‘হেইও হেইও’ গানের চিত্রায়ণে পাহাড়ের পটভূমিতে এক ঝাঁক পাখির উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি সঙ্গতিপূর্ণ মনে হয় না। কেননা, বাংলাদেশের যে ভৌগলিক অঞ্চলে পাহাড় পরিবেষ্টিত সেখানে লালনের কোন পদচারণা পড়েনি কখনোই। আর পুরো চলচ্চিত্রেও কোথাও তা দেখানো হয়নি। ফলে আকস্মিক পাহাড় খাপছাড়া লাগে। অবশ্য দুএকটি প্রক্ষিপ্ত দৃশ্যায়ণ ছাড়া বলা যায় ক্যামেরাকে স্বার্থকভাবেই গল্পবলা ও বোধ প্রকাশের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন গৌতম। শেষের দিকের একটি দৃশ্যে সোলেমান পাগলার লাশ নিয়ে জমিদারের সামনে লালন দাঁড়ানো, তার দু’পাশে আউট অব ফোকাসে সাদা জামায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ নিয়ে দাঁড়ানো সঙ্গীরা। লাল-সাদার মাঝখানে রক্তাক্ত ফ্রেমে দাঁড়িয়ে লালন বলে: ‘ওদের মাপ করে দেন’। সংলাপ-দৃশ্যায়নের যথার্থ ব্যবহারে এ দৃশ্য যেন মানবতার দিশা দেখিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, এ দৃশ্যের একটু আগে থেকে যখন লালনের উপর হামলা হয়, রক্ত বইতে থাকে, তখন থেকেই দৃশ্যটিকে সেপিয়া টোনে রূপান্তর করেছেন চলচ্চিত্রকার যা প্রশংসাযোগ্য।

রঙ নির্বাচনে পোশাক পরিকল্পনাকারী বিবি রাসেল ও নীলাঞ্জনা ঘোষ সফল। তবে খাপছাড়া লাগে দ্দুদু শাহ্, ভানুমতি প্রমুখ সাধনসঙ্গীদের কাপড়ের ইস্তিরির ভাঁজ। বাংলার বাউলরা এতো নিখুঁত ভাঁজ করা ইস্তিরিকরা কাপড় পরতেন বলে মনে হয় না। আর সে আমলের বাউলদের কাপড়ে মেশিনে নয়, হাতের সেলাইয়ের প্রাধান্য থাকার কথা। একই কথা খাটে ভানুমতির নাক ফুল নিয়ে। অন্তত বিবি রাসেলের মতো অভিজ্ঞ ডিজাইনারের জানার কথা, তখনকার কোন হিন্দু রমণীর নাকে নাক ফুল থাকতো না। নাকফুল মূলত মুসলিম সংস্কৃতির অংশ, যার প্রমাণ বাঈজি এবং মুঘল মিনিয়েচারে দেখা যায়। এমনকি কোন দূর্গা প্রতিমাতেও আমরা নাকের ফুটো দেখি না। সে বিবেচনায় ভানুমতির নাকফুলের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তুলনায় রূপসজ্জা অনেক ভাল ছিলো। লালনের মুখের দাগ, বৃদ্ধ লালনের বলি রেখা নিখুঁত। তবে বিগ ক্লোজআপে বৃদ্ধ লালনের হাতটি তুলনায় তরুণ লাগে। হাতের শিরায় বয়স আনা যেতো সামান্য চেষ্টাতেই।



চিত্রগ্রহণের মতো সম্পাদনার কাজটিও গৌতম নিজেই করেছেন। একটি দৃশ্যের উদাহরণ দেয়া জরুরি মনে করি। লালন যখন বলছেন ‘জীবনে একবারই গুরুর কথা অমান্য করেছি’ তখন লালন একটি গাছের নীচে শোয়া। ক্যামেরা সেখান থেকে ধীরে ধীরে টিল্ট আপ করে প্রায় পাতাহীন সরু ডালপালায় চলে যায়। গাছেরই এই শীর্ষবিন্দু থেকেই সুপারইম্পোজ করে ক্যামেরা শাপলা পাতাভরা পুকুরে চলে যায়, যে পুকুর লালনের কৈশোরের সাক্ষ¥ী। এক গাছের শীর্ষ থেকে পুকুরের আরেক গাছের পাতায় চলে যাওয়ার এই সুপারইম্পোজটি যেনো লালনের জীবনের এক পর্ব থেকে আরেক পর্বের গল্পেই চলে যাওয়া, এমন অর্থপূর্ণ সম্পাদনা বাংলা চলচ্চিত্রে যথার্থই দূর্লভ। বর্জ্র-বিদ্যুৎ ভরা রাতের আলো-আঁধারিতে লালন আর জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুরের সুফিবাদ, ব্রহ্ম¥তত্ত্ব, সহজীয়াবাদ আলোচনার দৃশ্যায়ণ চিত্রগ্রহণ ও সম্পাদনার যৌথ বাহাদূরী।



লালনকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হবে আর তাতে গানের প্রাধান্য থাকবে না তা হয় না। গৌতম শুধু গানকে যে প্রাধান্য দিয়েছেন তা-ই নয়, বরং গানের মাধ্যমেই তিনি লালন দর্শন ও জীবনী তুলে ধরেছেন। এ চলচ্চিত্রের অন্যতম সম্পদ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকস্থানে গানের ব্যবহার। লালনকে যে তাঁর গানেই খুঁজে পাওয়া যায় এ চলচ্চিত্র তারই প্রমাণ। শুরু থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত তাই গানের তরীতেই ভেসে গেছে ‘মনের মানুষ’। গানে গানেই লালনের জীবনের প্রতিটি পর্ব আর ভাবনাকে একসূত্রে গেঁথেছেন পরিচালক। আর সর্বোপরি সুমধুর লালন গীতি এ ছবির দর্শকের জন্যে বাড়তি বোনাস। ছবিতে ১৯টি গান ব্যবহার করা হয়েছে। শাহাজাদা ফেরদৌসের লেখা ‘জলের উপর পানি’, ‘আমার মাত্র দুইখানা চাকা’ গান দুটি সুলিখিত। জানা যায়, গৌতম ঘোষ অনেক খুঁজেও সিরাজ সাঁইয়ের গান পাননি। সিরাজ সাঁইয়ের কণ্ঠে শাহজাদা ফেরদৌসের এই দুটি গান সার্থক মনে হয়েছে।



এ ধরণের দার্শনিক ও গভীর চিন্তার চলচ্চিত্রে রসবোধ বা সেন্স অব হিউমার দর্শককে ক্ষণিক প্রশান্তি দেয়। ‘গরীবের ঘোড়া রোগ’ -এর মতো একাধিক দৃশ্যে গৌতম তার রসবোধের পরিচয় দিয়েছেন। মোল্লা ও পুরুতমিলে বাঁশের সাঁকোর উপর লালনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। পুরুতের গয়নাসহ সতী চলে যাওয়ার আফসোসের প্রেক্ষিতে মোল্লা সরসভাবে জানিয়ে দেয় অলঙ্কারের জন্যেই এতো দুঃখ! অন্যদিকে একসাথে লালনের বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা করলেও মোল্লা এগিয়ে এলে পুরুত বলে: ‘কাছে আসবেন, ছায়া পড়বে গায়ে।’ এতো ছুৎমার্গ যাঁদের তাঁরাই জমিদারের পেয়াদার তাড়া খেয়ে এইসব ছুৎমার্গ ভুলে গিয়ে হাত ধরাধরি করে পালাতে থাকলে দর্শকের হাসির বাঁধ ভেঙে পড়ে।



এ চলচ্চিত্রের বিশেষ একটি দিক হচ্ছে অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়কর্ম। বিশেষত সিরাজ সাঁই চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ এক কথায় অসাধারণ। তার কণ্ঠ ও শারীরিক ভঙ্গি পুরোপুরি চরিত্রানুগ। ইতোপূর্বে তানভীর মোকাম্মেলের ‘লালন’-এ তিনি লালন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। লালনের চরিত্র চরিত্রায়ণে তিনি অনবদ্য, সিরাজ সাঁই-এর চরিত্রেও তথৈবচ। ওপার বাংলার জনপ্রিয়ধারার চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী প্রসেনজিৎ লালনের চরিত্রে নিজেকে গুঁজে দিয়েছেন বিস্ময়করভাবে। লালনচরিত্র চিত্রণে তাঁর পেশাদারিত্ব যেন পৌঁছে গেছে এক শিল্প মার্গে। তাঁর চোখে সদাই দেখতে পাই মনের মানুষের অনুসন্ধান। এই দুই বড় মাপের অভিনেতার ছোট্ট ক’টি ত্র“টিও চোখে লাগে। ‘ফকিরি করবি ক্ষ্যাপা’ গানে প্রসেনজিৎ এবং ‘বল খোদা বল’ গানে আসাদের হাতে একতারা রয়েছে, গানের সঙ্গীতায়জনেও একতারা আছে; কিন্তু হাতে একতারা ধরে রাখলেও তারা একবারও তারে টোকা দেননি Ñ বড় দৃষ্টিকটু লেগেছে দৃশ্যদ্বয়। তারটি ছিলো, টোকা দিলেই তো হতো, পরিচালকও কি খেয়াল করেননি! দৃষ্টিকটু লেগেছে শেষে এসে গগণ হরকরার বাড়িতে লালনের নেচে নেচে ‘মিলন হবে কতোদিনে’ গাওয়ার ভঙ্গি। লালনের বৃদ্ধ বয়সের সঙ্গে এই চপল নাচ কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। প্রসেনজিৎ-এর মতো প্রাজ্ঞ অভিনেতা এই ডিটেইলগুলোতে আরও যতœবান হতে পারতেন। প্রসেনজিৎ আর আসাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। ভবিষ্যতের একজন সেরা অভিনেতার সব সম্ভাবনাই তাঁর অভিনয়ে প্রকট। সোলেমান, কালুয়া তথা পাগলা চরিত্রকে তিনি এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে তার আকস্মিক মৃত্যুতে দর্শক স্তম্ভিত হয়। সোলেমান কখনো যেন সেই একলব্য যে গুরুর শিষ্যত্ব পায়নি, তবু গুরুর অনুরাগী। সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্য লালনকেই সে পরম বন্ধু জেনে আঁকড়ে ধরে। তাঁর কান্না, হাসি, আকস্মিক পাগলামীর মধ্যে অভিব্যক্তির নানা রঙ খেলে যায়। বিশেষ করে, গভীর রাতে যখন কমলীকে ডাকতে আসে তখন পিছনে একহাত দিয়ে আরেক হাত আঁকড়ে কাচুমুচু করে দাঁড়িয়ে থাকার শারীরিক-ভঙ্গিমাটি অসাধারণ। সমাজপতিদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এই চরিত্রের ক্ষোভ-অভিমানের পাশাপাশি ব্যক্তি প্রেম-কামনা সবই চঞ্চল ফুটিয়ে তুলেছেন দরদ দিয়ে। তুলনায় কমলী চরিত্রে পাওলি দাম অনেক দূর্বল। অভিনয়ের চেষ্টাটা তাঁর মধ্যে বড়ো বেশি মনে হয়েছে, কোথাও বা তাঁকে চরিত্র ও দৃশ্য থেকে খুব আলগা আর বেখাপ্পা লেগেছে। মনে হয় চরিত্রের ভিতরে নয়, বহিরঙ্গেই তাঁর বসবাস। লালনের প্রতি তাঁর ভালবাসা, শারীরিক কামনা, মানসিক ব্যর্থতা, পতিত হওয়ার যন্ত্রণা এবং আত্মত্যাগ এই সব কিছু ফুটিয়ে তোলার পুরো সুযোগ চিত্রনাট্যে ছিলো কিন্তু তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। অন্যদিকে চম্পা, রোকেয়া প্রাচী চিত্রনাট্যের আপাতত সংক্ষিপ্ত দুটি চরিত্রকেই চিত্রিত করেছেন মাতৃøেহের পূর্ণতায়। চম্পা ইতোপূর্বে গৌতমের পদ্মা নদীর মাঝি ও আবার অরণ্যে কাজ করেছেন। সেখানের তুলনায় এ চলচ্চিত্রে তার উপস্থিতি সময় স্বল্প। কিন্তু এইটুক সময়েই নিজেকে তিনি পরিপূর্ণভাবে ভেঙেছেন। স্বামী হারা একমাত্র সন্তানের জননী চম্পা পুত্র প্রেম আর ধর্মের বেড়াজাল Ñ এই দুইয়ের দ্বন্দকেই স্পষ্ট করেছেন তার অভিনয়ে। অন্যদিকে প্রাচী যেন এক আদর্শ সেবিকা নারী। অসহায় অসুস্থ লালনকে মাতৃøেহে আকড়ে ধরে খাওয়ানোর দৃশ্যে তার অভিনয় মনে রাখার মতো।

গৌতমের এই ছবি যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনি সমালোচিতও হয়েছে। কেউ কেউ এ ছবির সম্পর্কে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলেছেন। বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরের আমন্ত্রণে ২৪ জানুয়ারি ২০১১-তে এক লাইভ ব্লগিং-এ মানস চৌধুরী বলেন, ‘এই ছবিতে মিষ্টি প্রেমের গল্প আছে। ডিসলোকেশন আছে। মধ্যবিত্তীয় পছন্দের ফোক ফ্যান্টাসী নির্ভর নানা উপকরণে সমৃদ্ধ। দ্রুত লয়ের গান আছে যাকে আইটেম সং বলা যায়। মোটকথা এর ভেতরে জনপ্রিয়তা উপকরণগুলো আছে। তবে গৌতমের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারাবাহিকতায় এ ছবি উত্তীর্ণ নয়।’ এই মন্তব্যের মধ্যে মধ্যবিত্ত রুচিকে যেমন খাটো করে দেখা হয়েছে, তেমনি ফোক ফ্যান্টাসি, বাংলা চলচ্চিত্রের গানের ধারাকেও খাটো করা হয়েছে বলে মনে করি। মানসের চেয়ে আর বেশি করে আক্রমণ করেছেন সলিমুল্লাহ খান। এই লাইভ ব্লগিংয়ে তিনি বলেন, ‘মুভিটা দেখে মনে হলো লালন কোথাও পিকনিকে গেছে। তাদের জীবিকার কোন ইংগিত নেই।’ এক্ষেত্রে মনে করতে পারি, কালুয়াকে নিয়ে লালন বাঁশ কেটে আনছে। এই বাঁশই বিক্রি করে তাদের উপাজর্ন হচ্ছে Ñ ছবিতে এ ইংগিত দেয়া হয়েছে। তবে সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে এটুকু বলা যায় লালন যে শ্রমজীবি সম্প্র্রদায়ের প্রতিনিধি ছিলো তা এ ছবিতে প্রকট নয়। কিন্তু পিকনিকের প্রসঙ্গটি একটু অতিরঞ্জনই মনে হয়। এমনই অতিরঞ্জিত মনে হয়, ফরহাদ মজহারের মন্তব্য, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে মনের মানুষ ছবিতে লালনকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে। ... লালনীয় গুরুবাদের মধ্যে রাজনীতির ধারণা আছে। অথচ মনে হচ্ছে লালন যেন আনন্দবাজারে একটা ব্রোথেল পরিচালনা করে।’ লালনকে অপমান করা তো দূরের কথা, এ ছবিতে লালনের মানবতাবাদ, ভক্তিবাদ, প্রেম, অসাম্প্রদায়িকতা, দেহতত্ত্ব প্রকাশ হয়েছে সাবলীলভাবেই। লালনকে যারা ভালবাসেন, তাদের মুক্তমনা হয়ে একটা কথা মেনে নিতে হবে যে, চলচ্চিত্র ডায়রির পাতা কিংবা ইতিহাসের খেরোখাতা নয়। পরিচালক তার নিজস্ব ঘরাণায় গল্প বলবেন। আর মৃত্যুর শতবর্ষ পরও কুলিন সমাজে যে লালন পরিচিত ছিলেন না, আর যে লালন আত্ম-প্রচারে বিশ্বাসী ছিলেন না, সেই লালনকে নিয়ে ছবি করতে গেলে ইতিহাসের দোহাই দিয়ে লাভ নেই। কারণ লালনের জীবনি সম্পর্কে আমরা যা জানি, তাই বা কতটুকু প্রামাণ্য দলিল দিয়ে গড়া সে প্রশ্ন উঠতে পারে। কাজেই গৌতম ঘোষ যা করেছেন তা লালন জীবনি নয়, লালনের দর্শনেরই রূপ। সুস্থ চলচ্চিত্র এ দেশে এমনিতে অপ্রতুল আর বাণিজ্যিক ধূমধারাক্কার ভিড়ে লালনকে নিয়ে একটি ছবি হয়েছে দুই বাংলা মিলিয়ে কাজেই সে ছবিটির প্রতি সদয় সমালোচনা করা উচিত। বিধান রিবেরু দৈনিক ইত্তেফাকে এক সমালোচনায় লিখেছেন, ‘‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রে জমিদার ও ভূস্বামীদের মিত্র হিসেবে লালনকে প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের শ্রেণীচরিত্রই শুধু নয়, আপন ছলচাতুরিকেও প্রকাশ করেছেন ঘোষ-গং। প্রান্তিক মানুষের সম্রাট লালনকে, সাধনার গোপনীয়তাকে বুড়ো আঙল দেখিয়ে, যৌনতার মোড়কে যেভাবে তারা উপস্থাপন করেছেন, তাতে লালন পরিণত হয়েছেন পণ্যে, যেভাবে নারীরাও এখানে পণ্য হিসেবে উপস্থাপিত। সমাজে যে ভাষা-বলয় কতৃত্ব করছে, যাদের সংস্কৃতি আধিপত্য বিস্তার করে আছে তারই পুনঃউৎপাদন এই চলচ্চিত্রে দৃশ্যমান। এখানে শত বছর আগের কুষ্টিয়া ছেউড়িয়ার লালন নাই। এখানে যিনি আছে, তিনি কলকাতার জমিদার বাড়ির জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লালন, তিনি বর্তমান সময়ের দুই বাংলার পুঁজিপতিদের লালন।’ বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই মন্তব্য যথেষ্ট রুঢ় এবং লালন যে মানবতা, ভক্তি, বিনয়ের শিক্ষা দেয় তার পরিপন্থী। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে লালনের একমাত্র ছবিটি আমরা ঠাকুর বাড়ির জ্যোতিরিন্দ্র নাথের কল্যাণেই পেয়েছি। শুধু লালন নয়, তখনকার লোক সংস্কৃতি ও বাউল গানের পৃষ্ঠপোশকতাও তারা করেছেন। তাই জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির পৃষ্ঠপোশকতাকে স্রেফ জমিদারী সামন্ত প্রভূর করুণা বা চাতুরি হিসাবে দেখা ঠিক হবে না। যে কোন কাজ নিয়েই সমালোচনা তথা ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু সেটি হতে হবে সৃষ্টিশীল ও সুস্থ। আবার দেশ পত্রিকায় তপন রায় যখন লেখেন ‘ছবিটি শ্রেষ্ঠ অর্থে ধর্মগ্রন্থ হয়ে ওঠে। স্থান নেয় নানক, কবীর, দাদূর দোহার পাশে।’ তখনও অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট মনে হয়। আসলে তুচ্ছ করে কিংবা অতিরঞ্জিত করে দেখা নয়, একটি চলচ্চিত্রকে দেখতে হবে তার সামগ্রিক ভাল মন্দ মিলিয়ে এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে। সেই বিবেচনায় আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মনের মানুষের মতো একটি চলচ্চিত্রের প্রয়োজনীয়তা অনেক। নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের এই সময়ে এমন একটি মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চলচ্চিত্র আমাদেরকে নতুন করে ভাবাবে।

আর সবশেষে বলা দরকার, এমন একটি ছবির জন্যে প্রযোজক গৌতম কুন্ডু, হাবিবুর রহমান এবং ফরিদুর রেজা সাগর দীর্ঘকাল এদেশের চলচ্চিত্র দর্শকের ধন্যবাদ পেয়ে যাবেন। আর আমরা আশা করে রইবো, এক আজান দিয়ে শুরু হয়ে আরেক আজানে যে ছবির সমাপ্তি হয় তার রেশ যেন সহসা কেটে না-যায়।





তথ্যসূত্র :

১. মনের মানুষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ডিসেম্বর, ২০০৮

২. দৈনিক কালের কণ্ঠ, ৬ ডিসেম্বর, ২০১০

৩. বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পাঁচ দশকের ইতিহাস - আব্দুল্লাহ জেয়াদ, জ্যোতিপ্রকাশ, ফেব্র“য়ারি, ২০১০

৪. লালন শাহ, ড. আবুল আহসান চৌধুরী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯০

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ১:১৬

মুবিনুর রহমান বলেছেন: লেখাটি অবশ্যই ভােলা হয়েছে সন্দেহ নেই। এরকম আরো লেখা দেখতে চাই। তবে আরেকটু সঙক্ষিপ্ত হতে পারতো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.