![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পেশাদার ও নেশাদার লেখক, মাঝে মাঝে কবি
হুমায়ন আহমেদের সৃষ্ট একটি কাল্পনিক চরিত্র হলেও হিমু বর্তমানে একটি জন ধারণার অংশ হয়ে গেছে। জনপ্রিয়তার নিরিখে হিমু চরিত্রের সমতূল্য চরিত্র বাংলা সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কাজেই হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র হলেও হিমু হয়ে উঠেছে গণ মানুষের চরিত্র। হিমুর যে বোহেমিয়ান, বাউন্ডুলে, অলৌকিক জগৎ যে হুমায়ূন সৃষ্টি করেছেন, সেই হুমায়ূূনই সৃষ্টি করেছেন বিপরীত মেরুর মিসির আলিকেও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ‘হিমু’ উপন্যাসের শুরুতে হুমায়ূন আহমেদ ‘প্রসঙ্গ হিমু’ নামে ছোট্ট একটি ভূমিকা লিখেছেন Ñ ‘হিমু আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। যখন হিমুকে নিয়ে কিছু লিখি Ñ নিজেকে হিমু মনে হয়, একধরনের ঘোর অনুভব করি। এই ব্যাপারটা অন্য কোনো লেখার সময় তেমন করে ঘটে না। হিমুকে নিয়ে আমার প্রথম লেখা ময়ূরাক্ষি। ময়ূরাক্ষি লেখার সময় ব্যাপারটা প্রথম লক্ষ করি। দ্বিতীয়বার লিখলাম দরজার ওপাশে। তখনো একই ব্যাপার। কেন এরকম হয়? মানুষ হিসাবে আমি যুক্তিবাদী। হিমুর যুক্তিহীন, রহস্যময় জগৎ একজন যুক্তিবাদীকে কেন আকর্ষণ করবে? আমার জানা নেই। যদি কখনো জানতে পারি পাঠকদের জানাব।’’ পাঠককে বরাবরই এক রহস্যময় জগতে রেখেছেন তিনি। হিমু সেই রহস্যের অন্যতম আধার। অন্যদিকে মিসির আলির আবির্ভাবই হয় রহস্যউন্মোচনে। মিসির আলি নিয়ে অন্য কোন লেখায় ভিন্নতর আলোচনার সুযোগ রয়েছে, এখানে আমরা হিমুর জগত নিয়েই কথা বলি। শিরোনামে ফাঁদে না-পড়ে বরং জনপ্রিয় এই চরিত্রের উন্মোচনে যাওয়া যাক। তার আগে হিমু কতোটা জনপ্রিয় তার একটা ধারণা নেয়া যেতে পারে সোস্যাল মিডিয়া থেকে। সোস্যাল মিডিয়াকে জনপ্রিয়তার সাম্প্রতিক মাপকাঠি বলা যায়। এরমধ্যে ফেইসবুক আমাদের দেশে সবচেয়ে সরব। ফেইসবুকের ফ্যানপেইজ, গ্রপ ইত্যাদি লাইকের পরিমাণ দেখে জনপ্রিয়তার একটা হিসাব নিকাশ করা যায়। হুমায়ূন আহমেদ যে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক তার জন্য অবশ্য কোন মিডিয়া বা কোন জরিপের প্রয়োজন হয় না। আর হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে হিমু যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সে কথা বলতেও কোন তথ্য-প্রমাণ লাগে না। তরুণ সমাজের বিরাট একটা অংশ হলুদ পাঞ্জাবি পরতে শিখেছে হিমু চরিত্রের কাছ থেকেই। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণরা হলুদ পাঞ্জাবি আদৌ পরতো কিনা সে ফ্যাশান ডিজাইনাররা গবেষণা করতে পারেন। কিন্তু নানা অজুহাতে হলুদ পাঞ্জাবি পরে জোছনা বিহারের বহু ঘটনাই এ দেশে ঘটেছে এক হিমু চরিত্রের প্রভাবে। নিঃসন্দেহে স্বাধীনতা উত্তর বাংলা কথা সাহিত্যে হিমু সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র। মাসুদ রানা যদি বাংলাদেশী তরুণদের স্বপ্নের আইকন হয়ে থাকে, হিমু নিঃসন্দেহে তাদের প্রাণের মানুষ। প্রতিটি তরুণের ভেতরেই সচেতন বা অবচেতনে একজন হিমু বাস করে। হুমায়ূন আহমেদ স্বশরীরে এই নশ্বর ভূবনে থাকুন বা না থাকুন, হিমু চরিত্রে রয়ে গেছে লক্ষ পাঠকের হৃদয়ে, মননে। অনেক পাঠকই হিমুর সাথে একাত্ম হয়ে নিজেকে হিমু ভাবতে ভালবাসে। শুরুতেই যে সোস্যাল মিডিয়ার কথা বলছিলাম, তার একটু খোঁজ খবর নিতে গিয়ে দেখা গেলো, ৫ ডিসেম্বর ২০১০ সালে ফেইসবুকে হিমু নামে একটি পেইজ খোলা হয় সেখানে সাড়ে ২৬ হাজার লাইক আছে। হিমু এবং আামি নামে আরেকটি পেইজ খোলা হয়েছে ৭ জুন ২০১২ সালে যাতে লাইক আেেছ ২৭হাজার। ২৯ মার্চ ২০১২ তে আরেকটি পেইজখোলা হয় হিমু ও হিমি যাতে লাইক আছে ৭৭০০। তিনটি মাত্র পেইজেই ষাট হাজার লাইক পড়েছে। হুমায়ূন আর তার প্রিয় সৃষ্টি হিমুকে নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে কতো পেইজ, গ্রুপ আছে আর সেখানে কতো সদস্য আর কতো লাইক আছে তা বোধ হয় স্বতন্ত্র গবেষণার দাবী রাখে। এইখানে এই রচনায় সেই আলাপে না-গিয়ে আমরা বরং ঢুকে পড়ি হিমুর অন্দর বাহিরে। হিমুকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখা ২১টি উপন্যাসে আছে। তার সবগুলো উপন্যাস এখানে বিস্তৃত আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমরা আলোচনার সুবিধার জন্য পাঁচটি উপন্যাসকে বেছে নিলাম। পাঁচটি কেন? ‘‘পাঁচ হচ্ছে একটা ম্যাজিক-সংখ্যা। এইজন্যেই বলছি পাঁচ। আমাদের ইন্দ্রিয় পাঁচটি। বেশিরভাগ ফুলের পাপড়ি খাকে পাঁচটি। পাঁচ হচ্ছে একটি মৌলিক সংখ্যা।’’ হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম উপন্যাসে পাঁচের মহত্ত্ব এভাবেই বর্ণনা করেছেন স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদ। আমরা হিমু উপন্যাসের প্রথম তিনটি এবং শেষের দুটি উপন্যাস নিয়ে এখানে বিস্তৃত আলোনা করবো। ময়ূরাক্ষী ‘ময়ূরাক্ষী’ হিমু সিরিজের প্রথম উপন্যাস। প্রথম উপন্যাসের প্রথম লাইন হলো, ‘এ্যাই ছেলে, এ্যাই!’ এই ডাক শুনে বিরক্ত হয়ে মুখভরতি দাড়িগোঁফ নিয়ে যে ছেলেটি তাকায় সে-ই হিমু। তার পরনে হলুদ পাঞ্জাবী, পান খাওয়ার কারণে দাঁত-ঠোঁট লাল, হাতে সিগারেট। চৈত্রের ঝাঁ ঝাঁ রোদে রাস্তায় হাঁটছিলো হিমু, সে যাবে ফার্মগেট। তাকে টুটুল ভেবে এক ভদ্রমহিলা ভুল করে গাড়িতে তুলে নেয়। গাড়িতে বসে থাকা ভদ্রমহিলার তরুণী কন্যা তার মাকে বললেন, এটি টুটুল ভাই নয়। মেয়ের মা বললেন, তুমি টুটুল না? হিমু জানাল সে টুটুল না। টুটুল সেজে গাড়িতে চড়ায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে বলে মেয়েটি। কিন্তু হিমু টুটুল সাজেনি, সে স্বভাবসুলভভাবে কথার জবাব না-দিয়ে হেসেছিলো। এখন রুক্ষ ব্যবহার করায় হিমু তার ব্যাগে হাত দিয়ে ছোট্ট নোটবুকটা চেপে ধরে বলে, গাড়ি স্টার্ট দে। ড্রাইভার ভিতু হলেও বুদ্ধিমান। সে গাড়ি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছে যায়। হিমুর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। বিচারপতি এম সোবাহান সাহেবের মেয়ে ও স্ত্রীকে ভয় দেখানোর অপরাধে তাকে থানায় আনা হয়। থানায় অপেরক্ষারত অবস্থায় হিমু তার কল্পনায় ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে চলে যায়। ময়ূরাক্ষী হিমুর শৈশবের এক কাল্পনিক নদী। জিওগ্রাফির টিচার মফিজ স্যার একদিন বাংলাদেশের নদ-নদী নিয়ে পড়াচ্ছেন। হিমুকে তার প্রিয় নদীর নাম জিজ্ঞাস করায় সে আড়িয়াল খাঁ বলে চড় খায়। স্যার বলেন, এতো সুন্দর সুন্দর নদী থাকতে এমন একটা নাম কেন বললো। কান ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। পরবর্তী স্যারের এই নিয়ে খুব মন খারাপ হয়। কারণ তিনি নদীর নাম জানতে চেয়েছেন হিমু তো যথার্থই নাম বলেছে। তিনি হিমুকে আরেকটি নদীর নাম বলতে বললে হিমু বলে ‘ময়ূরাক্ষী’। এ নামে সত্যি কোন নদী নেই। কিন্তু মফিজ স্যার বলেন, এটি তোর নিজস্ত নদী। ক্যান্সারে আক্রান্ত মফিজ স্যারকে হিমু দেখতে গেলে তিনি স্ত্রী ডেকে বলেন, এই ছেলেটাকে দেখে যাও। এই ছেলের একটা নদী আছে। নদীর নাম ময়ূরাক্ষী। যে রাতে স্যার মারা যান সে রাতেই হিমু স্বপ্নে ময়ূরাক্ষী নদী দেখতে পায়। একবার নদীটিকে স্বপ্নে দেখেই হিমু একে আপন করে নেয়। এরপর সুযোগ পেলেই কল্পনায় এই নদীর কাছে চলে যেতে পারে। যাহোক পুলিশের ডাকে হিমুকে কল্পনার নদী থেকে বাস্তবে ফিরতে হয়। পুলিশ জানায়, বিচারপতির কন্যা কোন মামলা করবে না, অতএব সে যেতে পারে। হিমু পুলিশ স্টেশন থেকে ছাড়া পেয়ে চলে আসে বড় ফুপুর বাসায়। বড় ফুপুর ছেলে বাদল এসএসসিতে খুব ভাল রেজাল্ট করলেও, ইন্টারমিডিয়েট তিন বারেও কিছু করতে পারে না। কারণ পরীক্ষার হলেই তার নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়। বাদল হিমুর অন্ধ ভক্ত। হিমুর প্রতিটি কর্মকা-েরই সে মুগ্ধ অনুসারী। হিমু বড় ফুপুর বাড়িতে এসে দেখে বাদলের ছোট বোন রিনকির বিয়ের কথাবার্তা হয়ে গেছে। রিনকির হবু বর এজাজ মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। সবদিক থেকে ঠিক থাকলেও সে উচ্চতায় খাটো। আজই বিয়ের কথা বার্তা হলেও এরইমধ্যে সে তিনবার ফোন করেছে। টেলিফোন ফুপার ঘরে। হিমু রিনকিকে ফোনটি তার ঘরে এনে দেয়। হিমুর ফুপার আবার মদ্যপানের অভ্যাস। তিনি হিমুকে জরুরি কথা বলতে ডাকেন, ইতোমধ্যেই কয়েক পেগ খেয়ে ফেলেছেন। তিনি হিমুকে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, এ বাড়ির ছায়া তুমি মাড়াবে না। এমনকি তিনি হিমুকে একটি চাকরির প্রস্তাবও দেন। এরমধ্যে তিনি বমি করে ঘর ভাসান। এদিকে এজাজ সাহেব ফোন দিলে হিমু ফোন রিসিভ করে। ফোনেই তিনি হিমুকে চিনতে পারেন। তিনি বলেন, রিনকি বলেছে আপনার নাকি কি সব ক্ষমতা আছে। হিমু সে কথার জবাব দেয় না। এজাজ রিনকির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সে জানায়, রিনকি অসুস্থ বাবার সেবা করছে। এ কথা শুনে এজাজ অতো রাতেই আসতে চায়। হিমু তাকে আসতে উৎসাহ দেয়। এরপর হিমু রূপাকে ফোন করে। রূপার বাবাকে রাগিয়ে দিয়ে সে ফোন রেখে দেয়। তারপর ফোন দেয় জাস্টিস এম. সোবাহানের বাসায়। তার তরুণী কন্যা মীরা ফোন ধরলে হিমু তাকে বলে, সে রাতে পুলিশের হাতে তুলে দেয়ায় পুলিশ তাকে অনেক মেরেছে। হিমু জানায় তার ডাক নামও টুটুল। সে কোন হাসপাতালে আছে জানতে চাইলে হিমু ফোন কেটে দেয়। রিনকিকে বলে, কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দিতে। বাদলের ঘরে এসে হিমু বাদলকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এ পর্যায়ে হিমুর শৈশবের কিছু কথা জানা যায়। হিমুর জন্মের সময়ই তার মা মারা যান। হিমুর বাবা ইন্টারমিডিয়েট পাশ। তিনি কিছুটা অপ্রকৃতস্থ ছিলেন। বাবারা সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিয়ার বানাতে চায়, তিনি তার সন্তানকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। হিমালয়ের মতো উঁচু হবে বলে ছেলেকে হিমালয় নাম দিয়েছিলেন, ডাক নাম হিমু। তিনি পরিবারের কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তিনি বড় বোনকে চিঠি লিখে জানান, তার মৃত্যুর পর হিমুকে যেন মামাদের বাড়িতে পাঠানো হয়। এটাই তাঁর নির্দেশ। হিমুর বাবার অসুস্থতার সময়ই তার দাদার সঙ্গে দেখা হয়। হিমু বুঝতে পারে তার বাবাদের পরিবারটি বেশ অভিজাত। কিন্তু মামারা পিশাচ শ্রেণীর। হিমুর বাবার বিশ্বাস এই পিশাচ শ্রেণীর মানুষদের কাছে থাকলে হিমু অনেক কিছু শিখবে। বাবার মৃত্যুর পর হিমুকে কিছুদিন দাদা বাড়িতে রাখা হলো, সেখানে তার নতুন নামকরণ হলো চৌধূরী ইমতিয়াজ, ডাক নাম টুটুল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বড় মামা এসে হিমুকে এক রকম জোর করেইি নিয়ে গেলেন। হিমু মানুষ হলেন ময়মনসিংহের হিরণপুরে তার তিন মামার কাছে। মামাদের বাড়ি থেকেই হিমু ম্যাট্রিক পাশ করে। এরপর বড় মামা নিহত হন। তার মৃত্যুর পরই হিমু বড় ফুপুর এখানে, ঢাকায় ঠাঁই নেয়। এইসব ভাবতে ভাবতেই হয়তো হিমু ঘুমিয়ে পড়েছিলো, বড় ফুপুর প্রবল ধাক্কায় তার ঘুম ভাঙে। বড় ফুপু জানায়, কেলেঙ্কারি হয়েছে। রিনকির সঙ্গে যে ছেলের বিয়ের কথা বার্তা হচ্ছে সেই ছেলে মাঝরাতে এসে হাজির এবং সারারাত রিনকি ও সে গল্প করে কাটিয়েছে, এখন কোন কারণে বিয়ে ভেঙে গেলে মুখ দেখাবে কী করে এই চিন্তায় বড় ফুপু অস্থির। হিমু বুদ্ধি দেয় এখনি বিয়ে দিয়ে দেও। ছেলেকে রাজী করানো যায় কিনা হিমু তা দেখবে। হিমু নিচে নামতেই এজাজ জানায় সে এখনই রিনকিকে বিয়ে করতে চায়। দুদিন পরই পূর্ণিমা। রিনকির খুব শখ সমুদ্রে জোছনা দেখার। আজ বিয়ে হয়ে গেলে রাতের ট্রেনেই তারা কক্সবাজারের দিকে রওনা হবে। তার বাড়ির লোকদের সে রাজী করাবে। নব বিবাহিত দম্পতিকে হিমু বলে, তোদেরকে আমি আমার ময়ূরাক্ষী নদী ব্যবহার করতে দিয়েছি, তোদের কোন কষ্ট হবে না। প্রিয়জনদেরই আমি এ নদী ব্যবহার করতে দেই। প্রায় দশদিন পর হিমু তার আস্তানা মানে মজিদের মেস দি নিউ বোর্ডিং হাউসে ফেরে। মজিদ জগতের কোন কিছুতেই বিস্মিত হয় না। সে চার-পাঁচটা টিউশনি করে, মাধেমধ্যে প্রুফ দেখার মতো খুচরা কিছু কাজ করে। মজিদের সঙ্গে হিমু অনেক রাত এক চৌকিতে কাটায়। তার কাছ থেকে নির্লিপ্ততা শিখতে চায়। হিমুকে তার ফুপা যে চাকরি দিতে চায়, হিমু চায় তার বদলে মজিদ সে চাকরি করুক। বড় ফুপা মদ খেতে বসে হিমুকে জানায় তার ধারণা, হিমুর বাবা হিমুর মাকে খুব করেছে। হিমুও জানে, তাকে মহাপুরুষ বানানোর পথ মসৃণ করতেই তার মাকে মরতে হয়েছে। মা বেঁচে থাকলে আদর দিয়ে হিমুকে নষ্ট করতো এটাই তার ধারণা। এদিকে হিমু ফোন করে বিচারপতির মেয়ে মীরাকে। মীরার সঙ্গে হিমুর টেলিফোনে কথা হয়। মীরা হিমুর সঙ্গে দেখা করতে চায়। কিন্তু হিমু এড়িয়ে যায়। মীরাকে সে রূপার কথা বলে। রূপা ছিলো হিমুর সহাপাঠী। অসম্ভব তরুণী এই রূপার সঙ্গে সবাই মিশতে আগ্রহী। এই রূপা একদিনে নিজে এসে হিমুর সঙ্গে কথা বলতে চায়। সে হিমুকে ‘তুমি’ বললে হিমু তাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে। রূপা অবশ্য ধরে ফেলে যে হিমু তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য আপনি বলছে। হিমুর সঙ্গে সে অনেক দিন ধরেই কথা বলতে চায় এবং জানতে চায় সে সত্যিই কোন আধ্যাত্মিক ক্ষমতা রাখে কি-না, ভবিষ্যত বলতে পারে কি না? হিমু তাকে বলে দেয় তার ব্যাগ কতো টাকার কয়টি নোট আছে। তার গাড়ি আসবে না আজ। কাকতালীয়ভাবে তার কিছু কথা মিলে যায় বলে হিমু রূপার সামনে থেকে সরে যায় এবং স্বভাবসুলভ ভাবে তিন মাসের জন্য ডুব দেয়। তিন মাস পর হঠাৎ এক রাতে সে রূপাকে ফোন দেয়। রূপা তাকে জানায়, আমি তোমার কথা খুব ভাবি। হিমু বলে সে তা জানে, ভালবাসা টের পাওয়া যায়। হিমু রাতের বেলাই রূপাকে নীল শাড়ি পরতে বলে। সে আসবে বলে আর যায় না। ‘কারণ ভালোবাসার মানুষের খুব কাছে কখনো যেতে নেই।’’ রূপাকে সে একলাইনের চিঠি লেখে Ñ ‘রূপা তুমি কেমন আছ?’ সমস্ত পাতা জুড়ে একটি মাত্র বাক্য। সে চিঠি পড়ে রূপা আবেগাপ্লুত হয়। কিন্তু হিমু তার কাছে যায় না। রূপা জানতে চায়, ‘তোমার কী সমস্যা তুমি আমাকে বল।’ ‘‘আমার সমস্যার কথা রূপাকে কি আমি বলতে পারি? আমি বলতে পারি আমার বাবার স্বপ্ন সফল করার জন্যে সারাদিন আমি পথে পথে ঘুরি। মহাপুরুষ হরার সাধনা করি। যখন খুব ক্লান্তি অনুভব করি তখন একটি নদীর স্বপ্ন দেখি। যে নদীর জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে একজন তরুণী ছুটে যায়। একবার শুধু থমকে দাঁড়িয়ে তাকায় আমার দিকে। তার চোখে গভীর মায়া ও গাঢ় বিষাদ। এই তরুণীটি আমার মা। আমার বাবা যাকে হত্যা করেছে।’’ এই সব কথা সে রূপাকে কখনোই বলে না। বরং দোকানের টেলিফোন থেকে ফোন করে বলে সে যেন এক্ষুণি একটা নীল শাড়ি পরে ছাদের কার্ণিশ ধরে নিচের দিকে তাকায়। হিমু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবে আর একটু রূপাকে দেখবে। হিমুকে বিশ্বাস করে রূপা শাড়ি পরে তৈরি হলেও হিমু যায় না। কেননা, সে আর দশজনের মতো সাধারণ নয়। তাকে অসাধারণ হতে হবে, মহাপুরুষ হতে হবে। গন্তব্যহীন গন্তব্যে তার অনিঃশেষ যাত্রা। হিমু সিরিজের এই প্রথম উপন্যাসেই হিমু চরিত্রের কিছু বিষয় নির্ধারিত হয়ে যায়। প্রথমত, হিমুর বাবা একজন অপ্রকৃতস্থ মানুষ ছিলেন, যিনি ছেলের নাম রেখেছিলেন হিমালয় বা হিমু। হিমুকে তিনি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নয়, মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো’ কিন্তু পারেনি আর হুমায়ূনের হিমুকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলো তার বাবা আর হিমু সেই চেষ্টা আজও করে যাচ্ছে। বাবার মৃত্যু হলেও তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালনের চেষ্টা করে হিমু। সে লোভ, মোহ, মায়া ও জাগতিক টান থেকে উর্দ্ধে উঠে এক নির্লিপ্তি, উদাসীন জীবন যাপন করে। রূপাকে সে ভালবাসে। কিন্তু সে ভালবাসার ডাকে সে যায় না। হিমু হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে ভর দুপুরে কিংবা মধ্য রাতে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। এ যেন ‘আমার এই পথা চলাতেই আনন্দ।’ পৃথিবীর সব ধর্মপ্রচারক কিংবা আধ্যাত্মিক গুরুর মতো হিমুকে ঘিরেও বাস করে কিছু রহস্যময়তা। তার অন্যতম শিষ্য বাদল। হিমুর ফুপা বাদলকে তার প্রভাব থেকে দূরে সরানোর সব চেষ্টা করলেও বাদল হিমুদা বলতে অজ্ঞান। ময়ূরাক্ষী উপন্যাসেই আমরা লক্ষ্য করি, হিমুর সঙ্গে থানা-পুলিশের একটা যোগসাজগ আছে। হিমু সব সময়ই অন্যের উপকার করতে চেষ্টা করে। রিনকি আর এজাজের রাতারাতি বিয়ের ব্যাপারে সে যথেষ্ট বুদ্ধি খাটায়। মজিদের চাকরির এবং মজিদকে বিস্মিত করার ব্যাপারেও তার প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। আপাতত বোহেমিয়ান, বাউন্ডুলে হিমু নিজের জন্য নয় সব সময় পরের জন্যই ভাবে। সবচেয়ে বড় কথা, ময়ূরাক্ষী নামের এক কাল্পনিক আর একান্ত ব্যক্তিগত নদী সৃষ্টির মাধ্যমে হিমু সবার ভেতরেই বহমান একটা নদীর পথ খুলে দেয়। মানুষের ভেতরের মানুষটা জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে হিমুর ভূমিকা অপরিসীম। আধ্যাত্মিকতা, রহস্যময়তা বা অলৌকিক গুণ নয়, শেষ পর্যন্ত হিমুর মধ্যে এক তীব্র মানবিক বোধই হিমুকে সবার কাছে আপন করে তোলে। দরজার ওপাশে ‘দরজার ওপাশে’ উপন্যাসে হিমুকে দেখি বায়েজিদ, রফিক এমনকি মন্ত্রী মোবারক হোসেনের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে। হিমুর সঙ্গে একই মেসে থাকেন বায়েজিদ সাহেব। স্ত্রী’র মৃত্যুর পর তিনি আর বিয়ে করেননি। একমাত্র মেয়েটি মামাদের কাছে থাকে, তার বয়স হয়েছে ১৯ বছর। তিনি হিমুকে বলেন মেয়েটির জন্য দোয়া করতে। হিমুর কলেজ জীবনের বন্ধু রফিক এসে হাজির হয়। অত্যন্ত সুপুরুষ রফিক কখনোই কোন কথার জবাব দেয় না। স্কুলে পড়ার সময় স্যারদের প্রশ্নের জবাব ঠিক মতো দিতে পারতো না বলে সে মার খেতো, সেই থেকে প্রশ্নের উপর তার ভীতি জন্মে গেছে। ছেলেবেলার দুঃসহ স্মৃতি একটি মানুষের মনোগঠনে কতোটা প্রভাব ফেলে রফিক চরিত্র তার অন্যতম উদাহরণ। যাহোক অনেক কায়দা করে হিমু জানতে পারে সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার পরিদর্শনে এসে রফিককে কিছু প্রশ্ন করেছিলো। স্বভাবসুলভ কারণেই সে জবাব দেয়নি, তিনি মনে করলেন রফিক ইচ্ছা করে বেয়াদবি করছে, ফলে তাকে সাসপেন্ড করা হয়। চাকরী বাঁচাতে এখন তার একজন মন্ত্রীর সুপারিশের দরকারর। হিমু জানায় তার স্কুলের সহপাঠী জহিরের বাবা মন্ত্রী হয়েছে। তাকে বলে কিছু একটা করানো যায় কিনা সেটা সে দেখবে। রফিককে বিদায় দেয়ার আগে হিমু বলে, নদীর তীরে বালির ভিতর মানুষ সমান দুটো গর্ত খুঁড়ে রাখতে যেন মানুষ ঢুকলে শুধু মাথাটা বের হয়ে থাকে। মন্ত্রী পুত্র ও সহপাঠী জহির সম্পর্কে হিমুর নিজের বক্তব্য, ‘জহিরের আচার, আচরণ, ভাবভঙ্গি কোনোটাই মন্ত্রীর ছেলের উপযোগী নয়। কোনো কালেও ছিল না। বোহেমিয়ান ধরণের ছেলে। ঘর পালানো রোগ আছে।’ জহিরকে তার বাবা মোটেও পছন্দ করে না, হিমুকে তো নয়ই। হিমু জহিরকে জানায়, নারায়ণগঞ্জের ড্রেজার কলোনিতে নদী খুঁড়ে বালি জমা হয়েছে সেখানে পূর্ণিমায় চাঁদের আলোয় বালি চিকচিক করে। হিমু আরো বলে, রফিক ড্রেজার কলোনিতে থাকে। তাকে দিয়ে গলা পর্যন্ত বালি খুঁড়ে দুটো গর্ত বানানো হয়েছে। জহির গর্তে ঢুকতে রাজি না হলেও হিমুর সঙ্গে যেতে রাজি হয়। তারা দুজন জনবহুল ড্রেজার কলোনিতে হাজির হয়। গর্ত ঘিরে মানুষের ভিড় দেখা যায়। রাত এগারটার দিকে ভিড় কমলে তারা কাাপড় খুলে গর্তে ঢুকে পড়ে। রফিক তাদেরকে কোদাল দিয়ে বালি চাপা দিয়ে বাসায় চলে যায়। তার মার শরীর খারাপ। রাত বারোটায় মধ্যে তাদের ঘিরে ভিড় জমে গেলো। রাত একটায় সে ভিড় আরো বাড়লো। দেড়টার দিকে পুলিশ চলে এল। তাদের এরেস্ট করা হলো। জহির বললো, আমি কে তা জানতে পারলে ওসি সাহেবের প্যান্ট নষ্ট হয়ে যাবে। জবাবে সে সেন্ট্রির চড় খেলো। থানায় আনার পর ওসি সত্যি সত্যি জানতে পারলেন জহির তেল ও জ্বালানী মন্ত্রী ব্যারিস্টার মোবারক হোসেনের ছেলে। মন্ত্রী নিজে এসে জহিরকে নিয়ে গেলেন এবং হিমুকে ভালভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলে গেলেন। হিমুকে বলা হলো এক এক করে আত্মীয় স্বজনের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার লিখে দিতে। হিমু বললো, ‘যে সব প্রশ্নের উত্তর লেখার দরকার নেই সেগুলি আগে করুন।’ কারণ আপনার পেনসিল ভোতা, শার্প করতে হবে কিন্তু কোন শার্পনার খুঁজে পাবেন না। সত্যিই সবাই মিলে খুঁজেও শার্পনার পেলেন না। হিমু আরো বলে যে, ওসি সাহেবের স্ত্রী ভয়াবহ অসুস্থ। স্বভাবসুলভ ভাবেই হিমু ওসিকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। হিমু তাকে বললো, সে বাবার ইচ্ছায় মহাপুরুষ হওয়ার চেষ্টা করছে। বিরক্ত ওসি নাপিত ডাকিয়ে হিমুর চুল, দাড়ি, গোঁফ এমনকি ভ্রু পর্যন্ত কাটিয়ে ফেললো। তাকে হাজতে ঢোকানোর আগেই মন্ত্রী সাহেব ফোন করে ছেড়ে দিতে বললো। হয়তো জহিরের চাপাচাপিতে এমনটা হলো। যাহোক রাত তিনটায় থানা থেকে ছাড়া পেয়ে নারায়গঞ্জের লঞ্চ টার্মিনালে চলে এলো সে। সেখানে চাদর মুড়ি দিয়ে একটা লঞ্চে ঘুমিয়ে পড়লো। ইতোমধ্যে লঞ্চ ছেড়ে দিলো। হিমু নদীতে ঘুরলো কয়েকদিন। চুল, দাড়ি, গোঁফ, ভ্রু ফেলে দেয়ার তার চেহারা হয়েছে ভয়ংকর। সাতদিন পর সে ঢাকা ফিরেই সে বড় ফুপার বাড়িতে গেলো। এ বাড়িতে তার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ। ফুপার বাড়িতে এসেই হিমু জানতে পারলো, মন্ত্রীর ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অপরাধে পুলিশ তাকে খুঁজছে। ফুপার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হিমু ওসিকে টেলিফোন করে। ওসি তাকে অনুরোধ করে মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। হিমু জহিরদের বাড়িতে যায়। জহিরের বোন তিতলি ছুটে এসে জানতে চায়, আমার ভাই কোথায়? হিমুর সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে। কিন্তু জহিরের মা তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে। জহির বাড়ি ছাড়ার আগে একটা চিঠি লিখে যায়। সেখানে সে বলেছে, তার বাবা অসৎ, খারাপ মানুষ, সে আর এখানে থাকতে চায় না। জহিরের বাবা মন্ত্রী মোবারক হোসেন হিমুর সঙ্গে রাতে দেখা করেন। হিমু তাকে বলে, আপনার মন্ত্রিত্ব চলে গেছে। নিজের ইনট্যুইশন থেকে সে এ কথা বলে। মোবারক হোসেন জানান, ছেলের ব্যাপারে তিনি চিন্তিত নন। হিমু তার এখান থেকে চলে আসে। মেসে ঘুম ভেঙে হিমু দেখে তার ঘরে যুথী বসে আছে। যুথী রফিকের স্ত্রী। যুথী জানতে চায়, রফিকের চাকরীর ব্যাপারে সে কিছু করেছে কি-না। রফিককে যুথীর ভাই-ভাবীরা দেখতে পারে না। তারা চায় সে ডিভোর্স নিক। যুথী হিমুকে অনুরোধ করে রফিকের চাকরির ব্যাপারটা যেন দ্রুত দেখে, তাহলে সে রফিকের কাছে ফিরতে পারবে। যুথী চলে গেলে হিমু তার ছোট মামার চিঠি পড়ে। ছোট মামার গৎবাঁধা চিঠিতে হিমুর জন্য যে আলাদা টাকা রাখা আছে তা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য হিমুর মামারা পিশাচ শ্রেণীর হলেও তাকে অসম্ভব ¯েœহ করেন। রাতে হিমুর স্েঙ্গ দেখা হয় এক নিশি কন্যার। হিমু তার কাছে থাকা সব টাকা তাকে দিয়ে দেয়। নিশি কন্যার নাম সেতু। সেতু রাস্তায় দাঁড়িয়ে টাকা গুণতে থাকে। হিমুর মনে হয় এমন একটি মেয়ের এই সময়ে স্বামী সন্তান নিয়ে উঁচু দেয়াল ঘেরা প্রাচীন একটি দোতলা বাড়িতে শুয়ে থাকার কথা। হিমুর মেসে ফিরতে ইচ্ছা করে না। ‘রূপাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। রূপাদের বাড়িটি প্রাচীন। উঁচু দেয়াল-ঘেরা দোতলা বাড়ি।’ বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে হিমু মেসে ফেরে। বায়েজিদ সাহেব তখনো জেগে আছে, তার জন্যেই জেগে আছে। সে জানায়, দুপুরবেলায় রফিক এসেছিলো। রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে সে চলে গেছে। তার মা মারা গেছে। এ খবর শুনে হিমু গভীর রাতে নারায়নগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। রফিকের বাড়িতে এসে দেখে রফিক ঘুমাচ্ছে। সে ভীষণ ক্লান্ত। যুথীর সঙ্গে তার দেখা হয়। যুথীর পরিবার থেকে এখনও চাপ দিচ্ছে বাচ্চ-কাচ্চা হওয়ার আগেই রফিককে ছেড়ে দেয়ার জন্য। ওদের সবার ধারণা, রফিক সাব হিউমেন স্পেসিস। হিমু বলে, রফিক ও যুথীর একসঙ্গে থাকা খুব জরুরি। ‘আপনাদের দুজনকে নিয়ে প্রকৃতির বড় ধরণের কোনো পরিকল্পনা আঠে। আমার মনে হয়, আপনারা জন্ম দেবেন এমন একটি শিশু, যে ভূবনবিখ্যাত হবে।’ হিমু তার ইনট্যুইশন ক্ষমতা থেকে বলে, যুথী কখনো রফিককে ছেড়ে যাবে না। হিমু পত্রিকা মারফত জানতে পারে, মোবারক হোসেনকে মন্ত্রীত্ব থেকে অপসারণ করা হয়েছে, শুধু তাই না, তার বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। হিমু পত্রিকা পড়ে ফুপার অফিসে যায় তার জন্য বরাদ্দ মাসিক টাকা আনতে। ফুপা জানায়, হিমুর বুদ্ধিতে বাদল একটা গাছকে জড়িয়ে ধরে আছে। তিনি হিমুকে বলেন, বিয়ে-সাদী করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে, প্রয়োজনে বিয়ের যাবতীয় খরচ তিনি দেবেন, একতলার দুটো ঘর ছেড়ে দেবেন, মেয়েটিকে একটি চাকরিও দিয়ে দেবেন। তিনি হিমুকে বলেন, রূপাকে জিজ্ঞস করতে যে সে তাকে বিয়ে করবে কিনা। ফুপার চাপে হিমু রূপাকে ফোন করে। রূপাকে সে প্রশ্ন করে তাকে বিয়ে করবে কি না? ‘রূপা শীতল গলায় বলল, তোমার এ জাতীয় রসিকতা আমার ভাল লাগে না। তুমি যে জীবন যাপন কর তাতে এ-ধরনের রসিকতার হয়তো কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। আমার জীবনে নেই। তুমি নানান ধরণের এক্সপেরিমেন্ট তোমার জীবন নিয়ে করতে পার। আমি পারি না।’ কিন্তু একটু পরই রূপা বলে,‘ সত্যি যদি উত্তর চাও তাহলে বলছি Ñ তুমি চাইলে আমি রাজি হবো। আমি জানি তা হবে আমার জীবনের সবচে বড় ভুল। তারপরেও আমি রাজি হবো। আমি যে রাজি হব তাও কিন্তু তোমার জানা।’ হিমু টেলিফোন নামিয়ে রেখে ফুপাকে জানায়, তার প্রস্তাব শুনে মেয়ে হেসে ফেলেছে। ফুপার কথায় টেলিফোন করে সে খামাখা লজ্জার মধ্যে পড়লো। ফুপার অফিস থেকে বেরিয়ে হিমু মন্ত্রী মোবারক হোসেনের কাছে যায়। মোবারক হোসেন ব্যাংক একাউন্টে পাঁচ কোটি টাকা আছে। কিন্তু সব একাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। তিতলী এসে জানতে চায়, ভাইয়ার কোন খোঁজ পাওয়া গেছে কিনা। হিমু বলে সে কোন খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেনি। তিতলী তখন বলে, তাহলে কি তাদের দূর্দশা দেখতে হিমু এসেছে। হিমু বলে, সে এসেছে তদবির নিয়ে। মন্ত্রীত্ব থাকাকালে সবাই সুপারিশ করে কিন্তু যখন মন্ত্রীত্ব নেই হিমু তখন সুপারিশ নিয়ে এসেছে। হিমু মনে করে, মোবারক সাহেবের এখনকার সুপারিশে বেশি কাজ হবে। কারণ সবাই জানে, মোবারক সাহেব আবার আগের অবস্থানে পৌঁছবেন। মন্ত্রী টেলিফোন করে এসে বলে, ‘হিমু তোমার বন্ধুকে আগামীকাল চাকরিতে জয়েন করতে বল। আমি কথা বলেছি।’ মোবারক সাহেবকে হিমু জানায় সারা পৃথিবীতে মাত্র দুধরণের মানুষ আছে। ‘‘প্রথম ভাগে আছে : ‘হ্যাঁ-মানুষ’। এরাই দলে ভারী। বলতে গেলে সবাই এই দলে। মানুষের সব গুণ তাদের মধ্যে আছে, আবার দোষও আছে। কোনোটাই বেশি না। সমান সমান। প্রকৃতি সাম্যবস্থা পছন্দ করে।’’ ‘‘দ্বিতীয় দলে আছে ‘না-মানুষ’। মানুষের কোন কিছুই তাদের মধ্যে নেই, তারা শুধু দেখতেই মানুষের মতো। আসলে এরা পিশাচ ধরনের। প্রকৃতির সাম্যাবস্থা নীতি এদের মধ্যে কাজ করে না। এদের মনে কোনোরকম মমতা নেই। একটা খুন করে এসে হাতমুখ ধুয়ে ভাত খাবে, পান খাবে, সিগারেট টানতে পানতে দু-একটা মজার গল্প করে ঘুমাতে যাবে। তাদের ঘুমের কোন সমস্যা হবে না। কারণ ‘না-মানুষ’রা সাথারণত স্বপ্ন দেখে না। আর দেখলেও দুঃস্বপ্ন কখনো দেখে না।’’ হিমু জানায় এই ‘না-মানুষ’ বা পিশাচ শ্রেণীর সঙ্গে সে দীর্ঘদিন ছিলো। তার মামারা সবাই এই শ্রেণীর মানুষ। হিমু নিজেকে ‘না-মানুষ’ বলে। তার মতে পিশাচ ও মহাপুরুষ সবাই একদলে, এরা কেউ মানুষ নয়। সে মোবারক হোসেনকেও ‘না-মানুষ’ বলে। তারমতে, না-মানুষ জন্মসূত্রে হতে হয়। মোবারক সাহেবকে পিশাচ অর্থে ‘না-মানুষ’ বললেও হিমু বলে, ‘তবে পিশাচ ‘না-মানুষ’দের একটা বড় সুবিধা হচ্ছে এরা খুব সহজেই মহাপুরুষ ‘না-মানুষ’ হতে পারে। হিমু তাকে জানায় তার একটি ইন্টারেস্টিং দৃশ্য দেখা বাকী আছে, সেটি হলো যখন কাউকে ফাঁসি দেয়া হয় তখন সে কী করে, অর্থাৎ ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে কী করে, কীভাবে তাকায়, মৃত্যুক্ষণটা জেনে যাওয়ার পর মানুষ কী করে। মোবারক সাহেব হিমুকে বলেন, ‘মানুষদের যে দুটি শ্রেণীর কথা বললে তার বাইরেও একটা শ্রেণী আছে Ñ উন্মাদ শ্রেণী। তুমি সেই শ্রেণীর। এমন উন্মাদ যে চট করে বোঝা যায় না।’’ মোবারক সাহেবের বাসা থেকে বের হয়ে টেলিফোনে রফিকের চাকরির খবর দেয় হিমু। ফার্মেসি থেকে চারটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে সেখানেই ঘুমানোর আয়োজন করে। মোবারক সাহেবকে চার বছর আগে নিতাই বৈরাগী হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। নারায়নগঞ্জ থানার ওসির সহায়তায় হিমু মোবারক সাহেবের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেন। ওসি সাহেবের ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী রানুকে দেখতে হাসপাতালে যায় হিমু । হিমু মৃতপ্রায় এই মহিলার চোখের ভাষা পড়তে পারে। হিমু বুঝতে পারে, রানু শারীরিক যন্ত্রণা জয় করেছে এবং সে অচেনা জগতে একা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ওসি’র লেখা দরখাস্তে কোন কাজ হলো না। হিমু কারগারে মোবারক হোসেনের সঙ্গে দেখার অনুমতি পেলো না। ‘জেলখানা, পুলিশ, কোর্ট-কাচারি এইসব ব্যাপারে বিশেজ্ঞ হচ্চেন আমার ছোটমামা। ছোটমাামাকে চিঠি লিখলাম। চিঠি পাঠাবার তৃতীয় দিনের দিন তিনি চলে এলেন। আসবেন তা জানতাম। আমার প্রতি মামাদের ভালোবাসা সীমাহীন।’’ ছোট মামার চেষ্টায় হিমু মোবারক হোসেনের সঙ্গে দেখা করলেন। তার কাছেই জানতে পারেন, স্ত্রীকে তার ভাইরা সিঙ্গাপুর নিয়ে গেছে চিকিৎসার জন্য, মেয়েটা একা হয়ে গেছে। পুরানো ঢাকায় তিতলীর সঙ্গে দেখা করতে যায়, কিন্তু তাকে দেখা করতে দেয়া হয় না। হিমু আবার বাদলদের বাড়িতে যায়। ফুপু রাগ করে বেরিয়ে গেছে। বড় ফুপা মদ নিয়ে বসেছে। আর বাদল কাটআউট চুরি করে পুরো বাড়ি অন্ধকার করে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে ধ্যানে বসেছে। মাথা ধরায় হিমু এখান থেকে ওঠে মেসে চলে আসে। মেসে এসে জানতে পারে বায়েজিদ সাহেবের মেয়ের খুব ভাল বিয়ে ঠিক হয়েছে। হিমু ততক্ষণে তীব্র মাথা ব্যথায় অস্থির। মেস থেকে তাকা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। হাসপাতালে হিমু এক ঘোরের জগতে চলে যায়। তার সঙ্গে রূপা, সেতু, তিতলী, মৃত বড় মামা সহ অনেকেই দেখা করতে আসে। এর কোনটি সত্য কোনটি কল্পনা হিমু বুঝতে পারে না। সুস্থ্য হয়ে সে জানতে পারে, মোবারক সাহেবের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। হিমু তাকে দেখতে যায়। মোবারক সাহেব বলেন, ‘আমি জেল-কর্তৃপক্ষকেবলে রেখেঠি ফাঁসির দিন-তারিখ হলে তোমাকে যেন জানানো হয়, যেন তোমাকে এই দৃশ্যটা দেখার অনুমতি দেয়া হয়। তুমি একবার বলেছিলে তোমার খুব শখ এই দৃশ্য দেখার।’’ হিমু জেল কর্তৃপক্ষের চিঠি পায়। তারা বিশেষ বিবেচনায় মোবারক হোসেনের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্যে হিমুকে ফাঁসির সময় থাকতে বলেছে। হিমুর মনে হচ্ছে আজ রাতে তার ঘুম হবে ভাল। ঘুমালেই সে স্বপ্ন দেখবে দরজার ওপাশ থেকে কেউ একজন ফিস ফিস করে হিমু হিমু ডাকবে। কিন্তু সে স্বপ্ন তার দেখতে ইচ্ছা করছে না। সে আজ সারা রাত হাঁটবে। শহরে লোডশেডিং। কিন্তু আকাশ ভেঙে ঝোছনা। ‘‘জোছনা দেখতে দেখতে, আমার হঠাৎ মনে হলো Ñ প্রকৃতির কাছে কিছু চাইতে নেই, কারণ প্রকৃতি মানুষের কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখে না।’’ হিমুর মহাপুরুষ হওয়ার ব্যাপারটিও দ্বিতীয় উপন্যাসেই সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। হিমুর নিজেরই ভাষ্য, ‘‘আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মহাপুরুষদের মতোই গম্ভীর ভঙ্গিতে নিচে নেমে এলাম। ভালো যন্ত্রণা হয়েছে। আমাকে অলৌকিক ক্ষমতাধর মনে করে এমন লোকের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। একটা আশ্রম-টাশ্রম খুলে বসার সময় বোধহয় এসেছে।’’ হিমু হিমু সিরিজের তৃতীয় উপন্যাসটির নাম ‘হিমু’। পূর্ববর্তী দুই উপন্যাসেই হিমু চরিত্র পূর্ণাঙ্গ রূপেই উদ্ভাসিত হয়েছে। পথে পথে হাঁটা, কোন না কোন কারণে থানায় যাওয়া, অন্যের উপকার করা, অতি স্মার্ট বা চতুর কিংবা অতিবিশ্বাসী কাউকে বিভ্রান্ত করা, জোছনা ও বৃষ্টি বিলাস হিমু চরিত্রের এই সব দিক ইতোমধ্যেই প্রকটিত হয়েছে। হিমু পথে ঘাটে হাঁটে। আত্মীয়-স্বজনরা তাকে পথেই খুঁজে পায়। অচেনা মানুষের সাথে তার পথের সূত্র ধরেই পরিচয় হয়। বৃদ্ধা এক নারী রিকশা থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়েছে। হিমু তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। বাড়িতে তার নাতনী এষার সঙ্গে পরিচয় হয়। দাদী শুয়ে পড়ে। বাড়িতে চা-পাতা নেই বলে এষা হিমুকে চা দিতে পারে না। এষাকে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে হিমু বলে সে একজন পরিব্রাজক, ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ, সে বেকার নয়। এষার হিমুকে ড্রইংরুমে বসিয়ে পড়তে যায় এবং তাকে অনুরোধ করে দাদী না-ওঠা পর্যন্ত সে যেন থাকে। ড্রইরুমে বসে হিমু টিভি দেখতে থাকে। দরজায় ড়া নড়লে সে দরজা খুলে দেয়। মোরশেদ বলে একজন আসে এষার সঙ্গে দেখা করতে। হিমু সোজা ঘরের ভেতরে এষাকে ডাকতে যায়। এষা হুট করে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ায় হিমুর উপর বিরক্ত হয়। মোরশেদকে ভেতরে বসতে বলে হিমু বেরিয়ে যায়। শীতের রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে চা খেতে থাকে। মোরশেদ বেরিয়ে যাওয়ার সময় হিমু তার সঙ্গে কথা বলে। মোরশেদ এষার স্বামী। মোরশেদ হিমুকে ছোট মামা বলে ডাকে। হিমু তারে ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করলেও সে তাকে ছোট মামাই ডাকতে থাকে। হিমু রাত একটার দিকে মজনুর দোকানে ভাত খেতে আসে। দোকানের মালিক জানায়, মাছ মাংস প্রচুর আছে তবে ভাত নাই। যা ভাত আছে তাতে অবশ্য হিমুর হয়ে যাবে। ভাতের চালও নাই। মজনু চলে গেলে দোকানের বাবুর্চিকে দিয়ে হিমু মোরগ পোলাও বসিয়ে দেয়। মাঝরাতে তরঙ্গিনী ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে সে কোক নিয়ে আসে। সবাই মজা করে খায়। ঘরে ফিরে সে ইয়াদের চিঠি পায়। ইয়াদ হলো হিমুর বোকা বন্ধুদের মধ্যে একজন। তার অঢেল টাকা হলেও সে নিতান্তই বোকা। ‘ভাসমান জনগোষ্ঠী : আর্থ-সামাজিক নিরীক্ষার আলোকে’ শিরোনামে ভিখিরিদের নিয়ে সে পিএইচডি করছে। হিমু তাকে এই গবেষণায় সাহায্য করছে। ইয়াদে ট্রেলিগ্রামের মতো সংক্ষিপ্ত চিঠি পায় ইংরেজিতে। ইয়াদ হিমুকে খুঁজছে এবং ভিডিও ক্যামেরা কিনেছে। ইয়াদ একেকজন ভিক্ষুক পঞ্চাশটা করে প্রশ্ন করে পাঁচ টাকা দেয়। ভিক্ষুকদের কাছে এক ঘণ্টা প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পর টাকার অঙ্কটা যেমন অকিঞ্চিৎকর মনে হয়, হিমুর কাছে তেমনি ইয়াদের প্রশ্নগুলো অর্থহীন মনে হয়। ইয়াদ বলে প্রশ্নগুলো কম্প্যুটার সফট্যয়ারের মাধ্যমে স্ট্যাটিকাল মডেল হিসাবে তৈরি করা হয়েছে। জবাবে হিমু তাকে গাধা বলে। ইয়াদ বলে, ‘গাধা বলছিস কেন. আমাকে গাধা বলার পেছনে তোর কী কী যুক্তি আছে তুই পয়েন্টওয়াইজ কাগজে লিখে আমাকে দে। আমি ঠা-া মাথায় অ্যানালাইসিস করব। যদি দেখি তোর যুক্তি ঠিক না, তাহলে আমাকে গাধা বলার জন্য তোকে লিখিতভাবে ক্ষমা চাইতে হবে।’ এ হেন ইয়াদের হাত থেকে বাঁচতে হিমু মেস থেকে বেরিয়ে পড়ে। সে প্রথমে রূপার কাছে যায়। ‘ওর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। প্রিয় মুখ কিছুদিন পরপর দেখতে হয়।’ কিন্তু রূপার সঙ্গে তার দেখা হয় না। বরং রূপার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সে এবার খিলগাঁ মোরশেদ সাহেবের বাসায় চলে যায়। মোরশেদ ঠিকানা বলার সময় বাসার সামনে একটা বিরাট আম গাছ আছে বলেছিলে, আসলে তা নেই। এখানে এসে সে জানতে পা,ে মোরশেদ সাহেবকে বাড়িওলা বাসা ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে। ইয়াদের হাত থেকে বাঁচতে হিমু এবার চলে যায় ইয়াদের বাড়িতেই। ইয়দা এদিকে হিমুকে খুঁজতে থাকবে আর হিমু তার বাসাতে বসে থাকবে। ইয়াদের স্ত্রী মিতু হিমুর কাছে জানতে চায় সে কেন ইয়াদকে গাধা বলেছে। ইয়াদা সারারাত ঘুমায়নি। মিতু আরও জানতে চায় হিমু কেন ইয়াদকে বলেছে ভিক্ষুকদের জানতে হলে ভিক্ষুক হতে হবে। ইয়াদকে এইসব উদ্ভট আইডিয়া দিতে সে না করে। মিতু জানায়, সে হিমু মাকড়শার চেয়েও অপছন্দ করে। সে যে কোন দিন তার দুই কুকুর টুটি-ফুটিকে আদেশ দেবে তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলার। নিতু তাকে বলে, তার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে। হিমু তাকে ভবিষ্যত বাণীর মতো করে বলে, আজ রাতে ইয়াদ ফিরবে না। মেসে ফিরে সে আবার ইয়াদের চিঠি পায়। জরুরি প্রয়োজন, যোগাযোগ করার অনুরোধ করেছে সে। পরদিন ভোরেই জগিং করতে এসে ইয়াদ হিমু ধরতে পারে। কাল রাতে নিতুকে ভয় দেখানোর জন্য ইয়াদ তাকে ভৎর্সনা করে। নিতুর হাইপারটেনশন আছে, তার একজন পোষা সাইকিয়াট্রিস্ট আছে। ইয়াদের ফিরতে দেরি দেখে নিতু ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। ইয়াদ সপ্তাহখানেকের জন্যে ভিক্ষুকদের সাথে থাকতে চায়। হিমু বলে, ওদেরকে বুঝতে হলে ওদের একজন হতে হবে, তার জন্য সময় লাগবে। ইয়াদকে দীর্ঘদিন ভিক্ষুকদের সাথে থাকতে হবে, কিন্তু নিতু তা সইতে পারবে না। হিমুর অবশ্য জানায়, যারা ছোটখাট ব্যাপারে অস্থির হয় তারা বড় ব্যাপার সামলে নেয়। ইয়াদ আশা করে হিমু তার সঙ্গে যাবে। কিন্তু হিমু তাকে এবার বেকুব বলে। তার গবেষণা করা দরকার সে থাকবে, হিমু নিশ্চই তার ম্যানেজারি করবে না। ইয়াদকে বিদায় করে দেয় হিমু। বড় রাস্তার ফুটপাতে মোরশেদের সঙ্গে হিমুর দেখা হয়। মোরশেদ তাকে জানায় এষা তাকে ডিভোর্স দিতে চায়, ‘আমি তো মামা অসুস্থ। খারাপ ধরনের এপিলেপ্সি। ডাক্তাররা বলেন গ্র্যান্ডমোল। একেকবার যখন অ্যাটাক হয় ভয়ংকর অবস্থা য়। অসুখের জন্য চাকরি টাকরি সব চলে গেছে।’’ ডাক্তাররা তাকে কড়া ঘুমের ওষুধ দেয়। এসব খেয়ে সে উল্টাপাল্টা দেখে, বাসার সামনে আমগাছ নেই কিন্তু আমগাছ দেখে। হিমু এবার নিতুর পরিচিত সাইকিয়াট্রিস্ট ইরতাজুল করিমের কাছে যায়। সে তার বাবার মহাপুরুষ বানানোর গল্প করে। গল্প শুনে ইরতাজুল করিম বলেন, ঘটনা ইন্টারেস্টিং হলেও হিমু তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। হিমু বলে সে গল্প বলা ছাড়াই তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে। ডাক্তার তা দেখতে চাইলে হিমু বলে, ‘আপনার বাড়িতে এই মুহূর্তে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনার ছোট মেয়ে কিছুক্ষণ আগে তার পায়ে কিংবা হাতে ফুটন্ত পানি ফেলেছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।’’ ডাক্তার তার বাড়িতে ফোন করে জানলেন তার ছোট মেয়ে ভালই আছে। সে হিমুকে প্রশ্ন করে, আপনি আমাকে ভয় দেখালেন কেন? হিমু বলে সে ভয় দেখায়নি, বিভ্রান্ত করেছে। চাইলেই ইরতাজুল করিমের মতো শিক্ষিত ব্যক্তিকে হিমু বিভ্রান্ত করতে পারে। এরপর হিমু তার বাবার কর্মকা-ের বর্ণনা দেয়। ইরতাজুল করিম জানতে চায় হিমুর বাবার এক্সপেরিমেন্ট কী সফল হয়েছে। হিমু জানায়, হয়নি। কারণ তার বাবা শুধু তাকে মানুষের অন্ধকার দিকগুলো দেখিয়েছে। হিমুর প্রয়োজন ছিলো ঈশ্বরের কাছাকাছি একজন মানুষের যে আলোকিত দিকগুলোও দেখাতে পারে। তবে হিমু বিশ্বাস করে, মহাপুরুষ বানানো সম্ভব। ডাক্তারকে হিমু বলে, সে ভবিষ্যতবাণী করতে পারে। মাঝে মাঝে তা ফলেও যায়। ডাক্তারকে বলে ছোট মেয়েটির খেঁাঁজ নিতে। ডাক্তার হিমুর কথা পাত্তা দেয় না। তারা একসাথে বের হয়। হিমু তাকে বলে, সে তার এক বন্ধুকে নিয়ে আসতে পারবে কিনা। তার বন্ধুটি খিলগাঁও থাকে, বাড়ির সামনে গাছপালা নেই তবু সে একটি আম গাছ দেখে। ডাক্তার তাকে নিয়ে আসতে বলে। হিমুকে নিজের বাড়িতে ডিনার করতে বলে ডাক্তার। বাড়ির সামনে গাড়ি এসে পৌঁছলেই তিনি একটা জটলা দেখেন। তার গোসলের জন্য তৈরি করা গরম পানিতে ছোট মেয়েটি পুড়ে গেছে। তিনি হাসপাতালে ছুটে যান। মোরশেদ সাহেবকে নিয়ে হিমু মজনুর ভাতের হোটেলে যায়। মজনু হিমুর উপর রাগ করে। হিমু সেদিন রাতে জানতো মজনু রিকশা থেকে পড়ে পা মচকাবে, দুদিন হোটেলে আসবে, সেটা কেন বলেনি তা নিয়ে রাগ করে। পীর ফকির মানুষ বলে সে তাকে খুব মান্য করে অথচ বিপদের কথা আগে বললে সে সাবধান হতো। মোরশেদ সাহেবের হাতে টাকা নেই। সে স্ত্রীর জন্য শখ করে কেনা একমাত্র ক্যামেরাটি কিনতে চায়। হিমু প্রথমে ইরতাজুল করিমকে পরে নিতুকে ফোন করে ক্যামেরা বিক্রি করতে চায়। নিতু ক্যামেরা কিনবে না তবে কতো টাকা দরকার জানতে চায়। হিমু তাকে মোরশেদের ঠিকানায় পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিতে বলে। হিমু এষার সঙ্গে দেখা করে। মোরশেদ সাহেব প্রসঙ্গে কথা বলে। ইরতাজুল করিমের সঙ্গে হিমু দেখা করলে তিনি জানান, তার মেয়েটি ভয়বাহ অসুস্থ, তিনি এখন রুগী দেখছেন না। তবে হিমুর একটা ডিনার পাওনা আছে, চাইলে আজ সেটি সারা যেতে পারে। ডিনার করতে করতে ইরতাজুল করিম বলেন, ‘আমার কিন্তু ধারণা, আপনার ক্ষমতা আছে। আপনার বাবা পুরোপুরি ব্যর্থ হননি Ñ ঝঃৎধহমব কিছু জিনিস আপনার ভেতর তৈরি করতে পেরেছেন। তার একটি হচ্ছে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা আপনার প্রচুর আছে।’’ নিতু তার ম্যানেজারকে দিয়ে হিমুকে চিঠি পাঠিয়েছে। নিতু বলেছে, সে ইয়াদকে প্রচন্ড ভালবাসে। ইয়াদ বাড়ি ফিরছে না, পুরোদমে ভিক্ষুক হয়ে গেছে। সে তার পিছনে দুজন লোক লাগিয়ে রেখেছে। ইয়াদের কিছু হলে সে হিমুকে ছাড়বে না। ম্যানেজারকে নিয়ে ইয়াদের সঙ্গে দেখা করতে যায় হিমু। মিরপুর দশ নম্বরে সিন্ডবি গুদামে ঠাসাঠাসি করা রাস্তার কালভার্টের একটি স্ল্যাবে ইয়াদ থাকে। এখানে গাদাগাদি করে অন্য ভিক্ষুকরা থাকে। ইয়াদ জানায়, সে ভাল আছে। ভিক্ষুকদের সম্পর্কে তাকে জানতে হলে এই এক জীবনে হয়তো সব জানা হবে না। নিতুর কথা তার মনে পড়ে না, হিমু বলায় মনে পড়ে। নিতু চাইলে এখানে এসে তার সঙ্গে থাকতে পারে। হিমু ম্যানেজারকে জানায় সে শীঘ্রই নিতুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে। এষার সঙ্গে দেখা করে হিমু জানতে পারে সে শীঘ্রই আমেরিকা চলে যাচ্ছে তার মেজোভাইয়ের কাছে। হিমু ভবিষ্যতবাণী করে যে, এষার যাওয়া হবে না। হিমু বাদলকে ফোন করে বলে,সে জেলখানা থেকে ফোন করেছে। সে বের হতে পারছে না, বাদলকে একটা কাজ করে দিতে হবে। মোরশেদ নামের একজন লোক গভীর রাতে মাঝে মাঝে ১৩২ খিলগাঁও-এর একটি বাড়ির সামনে আসে। সেখানে কোন আমগাছ নেই, কিন্তু সে একটি আমগাছ দেখতে পায়। এই লোকটিকে বলতে হবে ১১ তারিখ বেলা ৩টার আগে এয়াপোর্টে থাকতে। ঐ দিন এক মহিলা দেশ ছাড়বেন তার সঙ্গে মোরশেদের দেখা হওয়া জরুরি। বাদল বলে, সে নিজেও এয়াপোর্টে উপস্থিত থাকবে। নিতুর সঙ্গে দেখা করতে যায় হিমু। হিমু বলে, ইয়াদ একদিন ফিরে আসবে, নিতুর ভালবাসাই ফিরিয়ে আনবে। নিতু এইসব মন-ভোলানো কথা মানতে রাজী নয়। তার ধারণা হিমু বরং ইয়াদকে বলে দিয়েছে, দুজন লোক তাকে অনুসরণ করছে। ইয়াদকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এ জন্য হিমুকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। হিমু তো ভবিষ্যত বক্তা, কী শাস্তি হবে নিতু তা অনুমান করতে বলে। হিমু যখন আন্দাজ করে তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। টুটি ফুটি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাসপাতালে হিমু জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যায়। টুটি-ফুটি তার পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে দিয়েছে। ঘোরের মধ্যে এক সময় সে টের পায় ডাক্তার তাকে হাত-পায়ের আঙুল নাড়াতে বলছে। একসময় তার জ্ঞান ফেরে। মোরশেদ সাহেবের মুখ সে দেখতে পায়। এষাও বাইরে অপেক্ষা করছে। হিমু বেশি কথা বলতে পারে না। আবার ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যায়। সে ঘুমের মধ্যেই দেখতে পায় বিশাল একটা আম গাছের পাতায় ফোঁটায় ফোঁটায় জোছনা পড়ছে। হাত ধরাধরি করে দুজন মানুষ হাঁটছে। সে তাদের পরিচয় জানতে চায়। ভারী গলায় উত্তর আসে, আমি কেউ না, ও ধস হড়নড়ফু. আমি কেউ না Ñ এই সরল বাক্য দার্শনিক অভীক্ষা সুদুরপ্রথিত। যুগ যুগ ধরে মানব সম্প্রদায় আত্ম পরিচয়ের সংকটে ভূগেছে। গ্রীক দর্শনে যা ‘গ্লোথি সায়ন্থথি’ বা কহড়ঃিযুংবষভ সংস্কৃত দর্শনে তা-ই আত্মানং জ্ঞানং বিদ্ধি বা নিজেকে জানাই জ্ঞানের পরিণতি বলে পরিচিতি। যুগ যুগ ধরে সাধু-সন্নাসীরা নিজেকে জানার চেষ্টাই করে এসেছে। হিমুকেও যায় আত্ম পরিচয়ের অনুসন্ধানে ব্রতী। নিজেকে জানার সবচেয়ে বড় এবং প্রথম পাঠই হলো নিজেকে কেউ না হিসাবে গণ্য করা। বাউল দর্শনেও আত্ম অনুসন্ধান এবং নিজেকে বিনীত করে তুলে ধরা হয়েছে। আত্ম অনুসন্ধানের এই পাঠ আমরা হিমুর মধ্যেও লক্ষ্য করি। ‘হিমু’ উপন্যাসের শেষটায় নিজেকে ‘কেউ না’ বলে উল্লেখ করে। ইতোপূর্বে তরঙ্গিনী স্টোরের নতুন কর্মচারী ছেলেটিকেও হিমু বলে, ‘আমার কোন পরিচয় নেই। আমি কেউ না। আমি হলাম নোবডি।’’ এই ‘নোবডি’ হয়ে ওঠা যেন মানবতার কাছাকাছি পৌঁছানোর প্রয়াস। এক অর্থে নিজেতে ‘কেউ না’ মনে করার মধ্যেই রয়েছে নিরহংকারী পরমপুরুষের লক্ষণ। প্রসঙ্গত এমিলি ডিকিনসনের বিখ্যাত কবিতা উদ্ধৃতিযোগ্য মনে করছি -
I’m nobody! Who are you?
Are you nobody, too?
Then there’s a pair of us — don’t tell!
They’d banish — you know!
How dreary to be somebody!
How public like a frog To tell one’s name the livelong day
To an admiring bog!
I’m nobody! Who are you? – Emily Dickinson
হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী নিজেকে চেনার প্রচেষ্টা হিমুর মধ্যে প্রবল এবং হিমু সিরিজের শেষের দিকের উপন্যাসে তা প্রকাশিত হয়েছে সুস্পষ্টভাবেই। হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী উপন্যাসে হিমুর সঙ্গে রাশিয়ান-বাবা মার কন্যা এলিতার সঙ্গে হিমুর বিয়ে দিতে চান মাজেদা খালা। জন্মসূত্রে আমেরিকান এলিতার সাথে হিমুর বিয়ে দেয়ার জন্য তাকে স্যুট টাই পরানো হয়। মাজেদা খালা বলেন, হিমু কে সুন্দর মানিয়েছে, আয়নায় তাকিয়ে দেখতে বলে। ‘আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি Ñ নকল হিমু। আয়নার হিমুকে মনে হচ্ছে এই হিমু ব্রিফকেস নিয়ে ঘুরে। সে বিরাট ধান্দাবাজ, সন্ধ্যাবেলা ক্লাবে যায়, বোতল খায়।’’ হিমুর এই আত্মপোলব্ধি যেন আত্ম আবিষ্কার। হিমু যেন এতোদিনে সুনিশ্চিত হয়ে গেছে আসল হিমুটা দেখতে কেমন আর নকল হিমুটাই বা কেমন। আত্মপরিচয়ের আলোয় সে উদ্ভাসিত। স্যুট টাই পরলেও খালু জুতা হিমুর পায়ে হয় না। সে হিমুর মতোই খালি পায়ে পথে নামে এবং লক্ষ্য করে নগরবাসীর বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। স্যুট টাই পরে একজন লোক খালি পায়ে হাঁটছে তা কারো নজরে পড়ছে না। কিন্তু যে কৌতুল আর বিস্ময়ের অনুসন্ধান মানুষের মধ্যে হিমু খোঁজে তা এখনও রয়ে গেছে তানিজার মতো ছোট্ট শিশুর মধ্যে। পথ চলতি এই শিশু সামাজিকতার ধার দিয়ে না-গিয়ে হিমুকে প্রশ্ন করে, ‘আপনার পায়ে জুতা নেই কেন?’ শিশুটির মা স্বভাবতই হিমুকে সন্দেহের চোখে দেখে। সে যতো তানিজাকে কথা বলতে না করে, হিমু এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে, হিমু ততোই পিছু নেয়। তানিজা হিমুকে বলে তার বাবার এক জোড়া জুতা দেবে। হিমু ওদের বাড়ির কাছে চলে আসে। তানিজার মার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু হিমু এর শেষ দেখতে চায়। সে তানিজার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। দ্রুত কিছু উৎসাহী লোক জুটে যায়। এদের মধ্যে নেতা গোছের একজন হিমুর কাছে জানতে চায় সে এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছে। হিমু বলে, তাকে জুতা দেবার কথা বলে জুতা দিচ্ছে। আলম জুতার দাবীতে জোড়ালো বক্তব্য রাখে। জুতা দিতে হবে এই দাবীতে হট্টগোল বেঁধে যায়। ট্রাফিক জ্যাম হয়। উত্তেজিত জনতা গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। একসময় পুলিশ আসে। আলমকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। হিমু অবশ্য তার আগেই সরে পড়ে। পরদিন পত্রিকায় সংবাদ আসে বিখ্যাত জুতা সন্ত্রাসী আলম গ্রেফতার। খালুর কোটের পকেটে হিমু তার মানিব্যাগ পেয়ে যায়। সেখানে ডলার, টাকা, কাগজপত্রের সাথে একাধিক ব্যাংকের কার্ডও পাওয়া যায়। পত্রিকায় গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে হিমু থানা হাজতে আলমের সঙ্গে দেখা করতে যায়। আলামত হিসাবে জুতা নিয়ে যায়। ওসি আবুল কাশেম প্রথমে কোট-টাইয়ের কারণে হিমুকে চিনতে না-পারলেও পরে ঠিকই চিনতে পারে। হিমুকেও হাজতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। সেখানে আলমের সাথে এক কিশোর কয়েদি কাদেরও বিদ্যমান। হিমু এদেরকে নিয়ে হাজতে দেয়ালে টানানো কাল্পনিক টিভিতে বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের খেলা দেখে। তাদের কা-কারখানা দেখে ওসি হিমুকে ছেড়ে দিতে চায়। কিন্তুকাদের ও আলমকে ছাড়া হিমু যেতে রাজী হয় না। অবশেষে তাদের তিনজনকেই ছাড়া হয়। হিমু ওসিকে আলতার কথা বলে বিভ্রান্ত করে। আলতা ওসির স্ত্রীর নাম। আলম ও বালক কাদের মেসে হিমুর ঘরের পাশেই একটা ঘরে ঠাঁই পায়। টিউশনি করে জীবনযাপন করা আলম এখন পত্রিকার কল্যাণে জুতা সন্ত্রাসী। ফলে সে আর লজ্জ্বায় ঘর থেকে বের হয় না। তার চুল দাঁড়ি গজিয়ে যায়, চেহারায় সন্নাসী ভাব চলে আসে, চালচলনেও। সে একটা কেরোসিনের চুলা কিনে নিজের রান্না নিজে করে খায়। আলম সারাক্ষণ ঘরে থাকে আর আলম সারাদিন বাইরে থাকে, মাঝে মাঝে রাতে আসে। হিমুকে জানায় সে একজনকে খুন করবে, বুধবার দিবাগত রাতে। হিমু বলে ওই দিন এলিতা আসবে, তাকে এয়াপোর্ট যেতে হবে, কাজেই পঞ্জিকা দেখে অন্য কোন ভাল দিনে খুন করতে হবে। ভাল কাজ চিন্তা ভাবনা না করে করা যায়, কিন্তু মন্দ কাজ করতে হয় অনেক ভেবে। মাজেদা খালা হিমুকে জানায় খালুর মানিব্যাগ পকেট মার হয়েছে। হিমু তার খালুকে ফোন করে বলে, ধোঁয়া বাবা মানিব্যাগ খুঁজে দিবে। ধোঁয়া বাবা ইতোমধ্যে জানিয়েছে মানিব্যাগে বাংলাদেশি টাকার সাথে সাতশ মার্কিন ডলারও আছে। খালু অবশ্য মানিব্যাগে রাখা একটা টেলিফোন নাম্বার নিয়ে চিন্তিত। হিমু মাজেদা খালাকে বলে, এই নাম্বারটি হয়তো কোন নারীর। মাজেদা খালা মোটামুটি নিশ্চিত ধারণা করেন যে তার স্বামী পরকীয়া করছে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন স্বামীর মুখে এডিস মারবেন। পুরুষরাই শুধু নারীদের এসিড মারবে তা নয়, নারীরাও মারতে পারে। হিমুকে এসিড জোগাড় করার দায়িত্ব দেয়া হয়। হিমু দুই লিটার ভিনেগার কিনে দেয়। ভিনেগার এসিপ হলেও সুখাদ্য। ওসি আবুল কালাম হিমুর কাছে আসে। তিনি কাদেরের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেন। তিনি হিমুকে জিজ্ঞাস করেন তার আসলেই কোন আধ্যাদ্মিক ক্ষমতা আছে কিনা? ইংরেজিতে এমএ পাশ ওসি হিমুকে কবিতা শোনায়। হিমু হঠাৎ ওসিকে বলে, পায়ের আলতায় সুন্দর হলেও তাকে পায়েই থাকতে হয়, এর উপরে ওঠে না। ওসি চমকে যায়। সে জানায় তার স্ত্রী’র নাম আলতা। হিমু কী করে জানলো? হিমু তানিজাদের বাড়ি যায়। তানিজা মা তাকে ও কাজের মেয়েকে তালা দিয়ে বাইরে গেছে। হিমু জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চা খায়। তানিজার বাবার জুতা ফেরত দিয়ে আসে। হিমু আর কাদের এয়াপোর্টে এলিাকে আনতে যায়। সে টিচার রেখে বাংলা শিখেছে। ‘আচ্ছা ঠিক আছে’-কে সে বলে ‘আইচা টিক চে’, ‘কিনিত বিরাকত’ মানে ‘কিঞ্চিৎ বিরক্ত’। কাদেরকে দেখে সে বলে, বালকের চশখু পবিত্রতা হয়’। অর্থাৎ এই বালকের চোখের মধ্যে পবিত্রতা আছে।’’ এলিতা পেয়িং গেস্ট থাকতে চেয়েছিলো মাজেদা খালার বাসায়, কিন্তু হিমু তাকে জানায় এসিড ছুঁড়ে খালুর মুখ ঝলসে দেয়ার পরিকল্পনা করেছে খালা কাজেই সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া এলিতা এতো সুন্দরী যে কোন নারী তাকে পেয়িং গেস্ট রাখবে না। এলিতা হিমুর মেসে যেতে চায়। হিমু বলে সেখানে পায়রার খুপড়ির মতো ঘর, বাড়িওলা মশা, মাছি, তেলাপোকা পোষেন, কমন বাথরুমে লাইন ধরে যেতে হয়। এলিতা এসব বিশ্বাস করে না। সে ক্লান্ত হয়ে গাড়িতেই হিমুর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। মেসে এসেও সে ঘুমায়। ঘুম ভাঙলে আলম তাকে বেগুন ভাজি, দেশি মুরগীর ডিম আর নতুন আলু ভাজি খাওয়ায়। এলিতা হাত দিয়ে এ খাবার খেয়ে মুগ্ধ হয়। সে জানতে চায় আজকের খাবারের ‘শেফ’কে। সে বলে, জীবনে যতো ভাল খাবার খেয়েছে আজকের খাবার তার মধ্যে একটি। আলমের চোখে পানি এসে যায়। হিমু জানায় আলম কোন প্রফেশনাল শেফ নয়, সে জটিল সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করে দিন কাটায়। এলিতার কোন চিন্তার বিষয় থাকলে আলমকে বললেই চিন্তা শুরু করবে, এ জন্য সে কোন ফিসও নেয় না। তারা অবশেষ এলিতাকে সোনারগাঁ হোটেলে রেখে আসে। পরদিন তারা ছবি তুলতে বের হয়। এলিতা মূলত একজন ফটোগ্রাফার। বাংলাদেশে সে এসেছে ফুড সিরিজের ছবি তুলতে। রিকশার চড়ে সে ছবি তুলতে বের হয়। পেছনের রিকশায় হিমু। তাদের টেনে ভ্যানগাড়িতে রিফ্লেকটর, সান গান ইত্যাদি নিয়ে আলম আর কাদের। এলিতা এক রিকশায় যেতে চাইলেও হিমু বলে একসাথে গায়ে গা লাগিয়ে চললে একজনের ইলেকট্রন আরেকজনের গায়ে লাগবে তাতে বন্ধন তৈরি হবে আর সাত কদম একসাথে চললে বন্ধুত্ব হয়। এলিতা ডাস্টবিন থেকে খাবার সংগ্রহ করছে এমন মানুষের ছবি তুলতে চায় হিমু বলে বাংলাদেশে এখন আর কেউ ডাস্টবিনে খাবার খুঁজে বেড়ায় না। এ সব দারিদ্রকে তুলে ধরার জন্য বানানো ফুটেজ। চাইলে টোকাই সংগ্রহ করে নকল ছবি তৈরি করে দেয়া যাবে, কিন্তু এলিতা তাতে রাজী হয় না। এক পর্যায়ে এলিতা হিমুকে বলে, ‘তুমি বাজে তর্ক করতে পছন্দ কর। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আমি বের হব না।’ হিমু তার ওই দিনের পেমেন্ট একশ ডলার নিয়ে চলে যায়। কাদের আর আলম রয়ে যায়। এলিতা পরে হিমুকে চিঠি লিখে জানায় যে, তোমার সার্ভিসের আর প্রয়োজন নেই। সে আলম এবং কাদেরকে চায়। পেয়েমেন্টের বিষয়টা তাদের সঙেঙ্গ ঠিক করা যাবে। হিমু কাদের ও আলমের কাছে ছবি তোলার নানা রকম গল্প শোনে। পিতা আর পুত্র পরস্পরকে কলা ছিলে খাওয়াচ্ছে, কাওরান বাজারে একটা কালো কুকুর ইলিশ মাছ নিয়ে দৌঁড়চ্ছে, তার পিছনে একদল ছেলেপুলে Ñ এমনি সব ছবি। মাজেদা খালা এলিতার উপর বিরক্ত। ফেসবুকে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিলো। বাংলাদেশে আসার পর সে মাজেদা খালার ফোন ধরেনি। হিমুকে তিনি বলে এই অহংকারী অভদ্র মেয়ের গাইড হওয়ার দরকার নেই। হিমু জানায় এলিতা তাকে আগেই এ কাজ থেকে অব্যহতি দিয়েছে। গাইড হয়ে এলিতাকে মুগ্ধ করা, তাকে বিয়ে করা আর হলো না। মাজেদা খালা বলেন, এ নিয়ে হিমু যেন না ভাবে, রূপ দিয়ে কিচ্ছু হয় না। হিমু খালুর খোঁজ নেয়। মাজেদা খালা বলে বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যেই খোঁজ পাওয়া যাবে। কোন মেয়ের সাথে যদি খালুর সম্পর্ক থাকে খালা অবশ্যই তার মুখে এসিড মারবে। হিমু বুদ্ধি দেয় ঠা-া মাথায় কাজটা করতে, যাতে বেঁচে থাকলেও চোখটা যেন নষ্ট হয়ে যায়। শুনে খালা বলেন, হিমু একটা ক্রিমিনাল। তাকে এ বাড়িতে আসতে না করে দেয়। তার স্বামী একটা কেন দশটা পরকীয়া করলেও সে তার চোখ নষ্ট করে দিতে পারে না। হিমুকে বিদায় নিতে বলে। যাওয়ার সময় হিমু খালুর সঙ্গে দেখা করে। ধোঁয়া বাবার কল্যাণে মানিব্যাগ খুঁজে পেয়েছে সে বলে। মানিব্যাগে পঞ্চাশ টাকা কম কারণ ধোঁয়া বাবা ধোঁয়া খাওয়ার জন্য সেটা রেখে দিয়েছেন। খালু সাহেব আকস্মিক মানিব্যাগ পেয়ে বিস্মিত হয়। মেসে ফিরে হিমু দেখে পেন্সিল ওসি আবুল কালাম বসে আছে। সে কাদের ব্যাপারে হিমুকে জানায়। হিমু বলে বালক কাদের একটি খুন করতে চায়। পঞ্জিকা দেখে হিমু তাকে ভাল একটা দিন বেছে দেবে। বাংলাদেশে শাহরুখ খান আসবে। কাদের শাহরুখ খানের খেলা দেখার পর তার কাজ সারবে। ওসি বলে, কাদেরকে টোপ হিসাবে বাইরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, এখন তাকে গ্রেফতার করার মতো যথেষ্ট ইনফরমেশন হাতে আছে। হিমু বলে, ‘‘এতদিন যখন অপেক্ষা করেছেন আরো কয়েকটা দিন করুন। কিং খানের খেলাটা হয়ে যাক।’’ ঢাকা কলেজের এক ছাত্রকে বাস চাপা দেয়া কলেজের ছাত্ররা জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে। একটা বাচ্চা মেয়ে ছুটে এসে হিমুকে জড়িয়ে ধরে জ্ঞান হয়ে যায়। হিমু দেখে এই বাচ্চাটি তানিজা। ডাক্তারখানায় নেয়ার আগেই হিমুর জ্ঞান ফেরে। তানিজা হিমুকে চিনতে পারে। তানিজাকে বাড়িতে নিয়ে গেলে দেখা যায় বাসায় তালা দেয়া, ভেতরে কাজের মেয়ে। ওসি আবুল কালামকে হিমু হারানো শিশুর বিষয়ে জানিয়ে আসে। তানিজাকে নিয়ে হিমু কোক পিজা খায়। জানা যায়, আজ তার জন্মদিন। হিমু তানিজার কাছে আরও জানতে পারে, তার বাবা-মা আলাদা থাকে। তার মা খুবই রাগী। তাদের ঝগড়া হয়। তারা ঢাকা কলেজের সামনে আবার আসে, তানিজার মাকে খোঁজাখুঁজি করে। তানিজা বলে, ‘‘মা’কে পাওয়া না গেলে অসুবিধা নাই। মামা আমি তোমার সঙ্গে থাকব।’’ তানিজা হিমুকে মামা ডাকতে শুরু করে। হিমু তাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যায়। তানিজাকে নিয়ে রাতে এলিতার কাছে যায় হিমু। সে এলিতাকে বলে হিমু তাকে আনতে যেদিন এয়াপোর্ট গিয়েছিলো সেটার পেমেন্ট করেনি। এলিতা তাকে তক্ষুনি পেমেন্ট করে দেয়। তানিজার কথা জিজ্ঞেস করলে হিমু বলে এ শিশুকে সে পথে কুড়িয়ে পেয়েছে। হিমু তার কাছে কিছুক্ষণ তানিজাকে রাখতে বলে। এলিতা রাজি হয় না। হিমু বলে আজ তানিজা ও এলিতা দুজনেরই জন্মদিন তোমরা একসাথে থাকো। মেসে ফিরে হিমু দেখে তানিজার মা বসে আছে। হিমু তাকে বলে এক শর্তে সে মেয়ে দেবে যদি তানিজা মা বাবা আর ঝগড়া করবে না বলে মুচলেকা দেবে। তানিজার বাবা উপস্থিত হয়। বুকে হাত দিয়ে বলে, ‘শাহানা আমার বুকে ব্যথা করছে।’ শাহানা কাজগে কী লিখতে হবে জিজ্ঞেস করলে হিমু বলে, কিছু লেখা লাগবে না, সোনারগাঁ হোটেলে ৭৩২ নাম্বার কক্ষে একটি পরী আছে, তারও আজ জন্মদিন, তানিজাকে সেখানেই রাখা হয়েছে। হিমু মেজো খালু (বাদলের বাবা) বাসায় গিয়ে দেখে শাহরুখ খানের অনুষ্ঠান দেখা নিয়ে খালা খালুর ঝগড়া হয়েছে। খালা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু যাবার আগে খালুর মদের বোতল সরিয়ে রেখে গেছে। হিমু খালুকে বুদ্ধি দেয়, খালা এই জিনিস নিয়ে যাবে না আবার এতো দামি জিনিস ফেলেও দেবে না, তার ধারণা খালা এটি বাথরুমে বেসিনের নিচে কাবার্ডে রাখতে পারে। খালু দৌঁড়ে গিয়ে সেখান থেকে এটি উদ্ধার করে। মল্ট হুইস্কির দামী বোতল উদ্ধারের পরই খালু সাহেব যথাবিহিত তা নিয়ে বসে যান এবং নেশায় বুদ হয়ে পড়েন। হিমুর মেসে এলিতা আসে। তার ক্যামেরা ছিনতাই হয়ে গেছে। ক্যামেরার মধ্যে থাকা অসাধারণ সব ছবির জন্য সে হাহাকার করে। হিমু তাকে বলে পুলিশের কাছে গিয়ে কোন লাভ নেই, তারা ¯্রফে একটা জিডি করবে। বরং হিমু তাকে ধোঁয়া বাবার কাছে নিয়ে যেতে চায়। বুড়িগঙ্গা পার হয়ে তারা ধোঁয়া বাবার আস্তানায় এসে পৌঁছায়। হিমুকে ধোঁয়া বাবা রাতের খাবারের আমন্ত্রণ জানায়। হিমু ও এলিতা কাচ্চি বিরিয়ানি, মুরগির রোস্ট, দৈ মিষ্টি দিয়ে রাতের খাবার খায়। এলিতা খাবারের ব্যাপক প্রশংসা করে আর ইতোমধ্যে তার সামেন ক্যামেরা ও চামড়ার ব্যাগ হাজির করা হয়। এলিতা হিমুকে রাতে তার সঙ্গে থাকতে বলে। হিমু বলে, ‘‘হায় সখা এত স্বর্গপরী নয় পুষ্পে কীট সম হেথা তৃষ্ণা জেগে রয়।’’ পথে নেমেই হিমু প্রবল বৃষ্টিতে পড়ে। একেকটা গাড়ি তার গায়ে পানি ছিটিয়ে চলে যাচ্ছে। হিমু অপেক্ষা করে একটা গাড়ি তার গা ঘেঁসে যাবে কিন্তু তাকে ভেজাবে না। কিন্তু সব গাড়ি তাকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। অবশেষে প্রাইভেট কার হিমুর পাশে থামে। হিমুর মতে ঝড় বৃষ্টির রাতে এক শ্রেণীর প্রাণী অপেক্ষা করে। ‘এরা রাতের অন্ধকারেও চোখে কালো চশমা পরে থাকে বলে এদের চোখ দেখা যায় না। শীত গ্রীস্ম সব সময় এরা হাতে গ্লাভস পরে থাকে বলে হাতও দেখা যায় না। একা কাউকে পেলেই এরা কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। পাখির মতো কিচকিচ করে কথা বলে। হ্যান্ডসেকের জন্যে হাত বাড়ায়।’’ হিমুর সামনে কালো চশমা পরা এমন কেউই হয়তো গাড়িয় থামায়। প্রবল বৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ ভেজায় হিমুর দুটো লাংসই আক্রান্ত হয়। সে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকে। একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায় সে। তাকে দেখতে এলিতা, তানিজা, পেনসিল ওসি আবুল কালাম আসে। পেনসিল ওসির জানায়, হিমুকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে এলিতা, খরচপাতি সে দিয়েছে। হিমু বলে এলিতা দেখতে কি আলতার মতো? ওসি বিস্মিত হলে হিমু বলে, আলতার মতো এলিতার নাম নিতেও ওসির কণ্ঠস্বর কোমল হয়ে ওঠে সে কারণেই তার এমন মনে হয়েছে। এটা কোন অলৌকিক উপায়ে বের করেনি। এলিতা জানায়, তার অসুস্থ অবস্থায় সে একটি চমৎকার ছবি তুলেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, তানিজা পবিত্র জমজমের পানি খাওয়াচ্ছি, চামচে করে মুখে মেয়েটা পানি ঢালছে আর হিমুর গাল বেয়ে পানি পড়ছে। এলিতা হিমুর রোগমুক্তি উপলক্ষে হিমুর প্রিয় রঙ নীল শাড়ি পরতে চেয়েছিলো। কিন্তু শাড়ি পরতে অনেক আয়োজন লাগে বলে সে তা পারেনি। হাসপাতাল থেকে মুক্তি পেয়ে হিমু মেসে ফিরে আসে। আলম হিমুর রোগ মুক্তির জন্য এক হাজার রাকাত নামাজ মানত করেছিলো। সে দরজা না-খুলে নামাজ পড়েই যাচ্ছে। কাদেরের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। হিমু তার স্বভাব মতো ঢাকার পথে ঘাটে ঘুরতে বের হয়। কিন্তু শরীর দূর্বল থাকায় না-হেঁটে সে রিকশা নেয়। ইছহাক নামের এক রিকশাওয়ালাকে ঘণ্টা হিসাবে হিমু ভাড়া করে। মাজেদা খালার বাসা হয়ে, বাদলদের বাড়িতে গেলো হিমু। সে বুঝতে পারলো এরা কেউ তার অসুখের খবর পায়নি। দুপুরে রাস্তার পাশে খেয়ে, ডাবল জর্দা দিয়ে পান খায় হিমু। ইছহাকের ব্যবস্থায় সে রাস্তার পাশের পলিথিন ঘেরা এক ঘরে ঘন্টা হিসাবে ভাড়া নিয়ে বিশ্রাম নেয়। ঘুম থেকে ওঠে হিমু বলে, তার কাছে কোন টাকা পয়সা নেই। ইছহাক মিয়া জানায়, শরীর অসুস্থ থাকায় হিমুকে প্রথমে চিনতে না-পারলেও পরে পেরেছে। হিমুই তাকে পাঁচ ছয় বছর আগে রিকশা কেনার টাকা দিয়ে ছিলো। সে হিমুকে বলে শরীরের যতœ নিতে আর যখন ইচ্ছা তার মোবাইলে ফোন দিতে। হিমু বলে তার মোবাইল নাই আর এভাবে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়াই ভালো। এলিতাকে হিমুকে একটি দীর্ঘ চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে সে জানায়, ধোঁয়া বাবা যে একজন ক্রাইম ওয়ার্ল্ডের গড ফাদার তা সে প্রথম দিনই বুঝতে পেরেছে, কিন্তু তা প্রকাশ করেনি। এই ক্রিমিন্যালের সঙ্গে হিমুর কীভাবে সখ্যতা হলো সেটা জানার জন্যই সেদিন রাতে সে তাকে থাকতে বলেছিলো, যৌনসঙ্গী হবার জন্য নয়। এলিতার এই প্রস্তাবে লজ্জা, ঘৃণাবোধ থেকেই হিমু নিজেকে কষ্ট দেয়ার জন্য বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হয়েছে। এলিতা নিজেও একবার মা’র উপর রাগ করে তুষারপাতের মধ্যে ঘর থেকে বের হয়েছিলো এবং অর্ধমৃত হয়ে গিয়েছিলো। এলিতার জীবনটা অনেকটা চর্যাপদের ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’র মতো কেটেছে, তার রূপই তার কাল হয়েছে। সে ব্রোকেন পরিবারের সন্তান। ফুটবল কোচ বাবার চাকরি চলে গিয়েছিলো এলকোহলিক হওয়ার কারণে। মা অন্য একজনকে বিয়ে করে। এলিতার ঠাঁই হয় পালক বাবা মা’র কাছে। পালক বাবা’র কাছে সে নিগৃহীত হয়। সরকারের কাছে আবেদন করে সে ফোস্টার পরিবার বদলায়। কিন্তু সব জায়গায়ই এক অবস্থা। এক পর্যায়ে এলিতা তার নারী সত্তার প্রতি বিরক্ত হয়ে পুরুষ বেশ ধরে। রাশিয়ান জার পিটার দ্য গ্রেটের অনুপ্রেরণা নিজেকে সে ‘পিটার’ বলে পরিচিত করায়। দীর্ঘ চিঠির এক পর্যায়ে এলিতা জানায় সে পরশু দিন চলে যাচ্ছে। তবু তার মন চায়, এই দরিদ্র দেশটায় থেকে যে, হিমু তার সঙ্গে যে লুকোচুরি খেলছে তার শেষ দেখতে। এলিতা হিমুকে বুঝতে পারছে না। একদিকে হিমু ধোঁয়া বাবার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধীর সাথে যুক্ত অন্যদিকে রূপকথার মতোই তানিজার বাবা-মাকে মিল করিয়ে দেয়। তার দুঃখ হয়, জীবনে কোন একজন হিমুর সাতে আগে দেখা হলে তার জীবনটাও হয়তো তানিজার মতো হতে পারতো। চিঠিতে এলিজা জানায়, কাদের হিমুকে প্রচন্ড পছন্দ করে। হিমুর সম্পর্কে খারাপ কথা বললে সে তার ‘কল্লা ফালায়ে’ দিতে চায়। এই ছেলেটি তাকে মাইজি ডাকে। ভিনদেশের অচেনা একটি ছেলে তাকে মা ডাকে এতে এলিজা বিস্মিত। সে কাদেরের জন্য দশ হাজার ডলার রেখে যায়। হিমু যেন কাদেরের জন্য কিছু করে এলিজা তা দেখতে চায়। আলমের বাড়ি থেকে ছোটভাই বদরুল আসে। সে খেয়াল করে তার বড় ভাই পীর ফকিরের মতো হয়ে গেছে। গভীর রাত পর্যন্ত আলম নামাজ পড়ে, জিকির করে। এলিতা দেশে চলে যাবে। আলম ও কাদের প্রথমে যেতে না চাইলেও পরে ঠিকই এলিতাকে বিদায় দিতে এয়াপোর্টে যায়। সেখানে দুজনই কান্না শুরু করে দিলো। কাদের এলিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মাইজি! আপনারে যাইতে দিব না।’ সিকিউরিটির লোকজন এসে গেলো। এলিতা ফ্লাইট ক্যান্সেল করলো। সে সেদিনই যাবে যেদিন সবাই তাকে হাসিমুখে বিদায় দিবে। এলিতা সরাসরি হিমুর মেসে এসে উঠলো। কাদের তার ঘরে মেঝেতে ঘুমায়। ঘুম ভাঙার পর দুজনে ফিনাইল, ব্রাশ নিয়ে বাথরুম পরিষ্কার করে। মেসের রান্নাঘর, ডাইনিং সব পরিস্কার করে। সে ডাইনিং ও বাথরুমের জন্য আলাদা আলাদা স্যান্ডেল কিনেছে। মেস ম্যানেজার শামসুদ্দিন হহতাশ। এলিতা তার ঘরে সন্ধ্যার পর থেকে বাবুর্চির এসিট্যান্ট জরিনা ও কাদেরকে লেখা পড়ায় শেখায়। শামসুদ্দিন ভয় পাচ্ছে একদিন হয়তো তার এই ঘরেই নৈশ স্কুল চালু হয়ে যাবে, ছাত্র-ছাত্রী বাড়তে থাকবে। এদিকে আলম ‘অশ্রু ভাই পীর’ নামে পরিচিত হয়ে যায়। তার কাছে কেউ দোয়া নিতে হলে সে দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া করে এবং তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। পেনসিল ওসি আবুল কালাম হিমুকে থানায় ডেকে নিয়ে যায়। এলিতার উদ্দেশ্য কী জানতে চেয়ে সে বলে ফেলে ‘আলতা’র উদ্দেশ্য কি। ওসি লক্ষ্য করে আলতা ও এলিতা নামের মধ্যে কতো মিল! আলতা বেঁচে থাকলে এলিতা-আলতাকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে ছবি তোলা যেতো। আলতা বিয়ের রাতেই আত্মহত্যা করেছিলো। সে অন্য একজনকে ভালবাসতো, জোর করে ওসির সঙ্গে বিয়ে দেয়াই সে আত্মহত্যা করে। ওসি জানায়, একজন হাজতি হিমুর সঙ্গে দেখা করতে চায়। হিমু বুঝতে পারে ধোঁয়া বাবা তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ধোঁয়া বাবা তার দলবল সহ ধরা পড়েছে। ওসি ঠিকই তার কাছ থেকে তথ্য বের করতে পারবে তবু হিমুকে অনুরোধ করে ধোঁয়া বাবা গোপনে হিমুকে যা বলতে চায় তা যেন তাকে এসে বলে দেয়। কিন্তু হিমুরা গোপন কথা গোপনেই রেখে দিতে জানে। হিমু আবার তার হন্টন জীবন শুরু করেছে। মাঝে মাঝে এলিতা তার সাথে যোগ দেয়। পুলিশের গাড়ি দূর থেকে তাদের অনুসরণ করে। হিমু জানে না, এ কেবলই পুলিশি অনুসন্ধান নাকি ওসি তার মৃত স্ত্রীর ছায়া খুঁজে বেড়ান এলিতার মাঝে। এলিতা জানায়, তার বাবার ধারণা ছিলো সে তার মেয়ে না। কিন্তু বাবার বুকের মতো তার বুকেও ‘ব’ অক্ষরের জন্মদাগ আছে। হিমুকে সে জন্মদাগ দেখাতেও চায়। বাবা অবশ্য মৃত্যুর আগে তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। এলিতাকে চিঠি লেখে গিয়েছিলেন। এলিতাকে নিয়ে হিমু মাজেদা খালার বাসায় গেলে মাজেদা খালা বলেন ‘হিমু এই মাগী তো তোর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।’ হিমু খালাকে সাবধান করে বলে, এলিতা এখন সব বাংলাই বোঝে। মাজেদা খালা অশ্রুভাইয়ের কাছ থেকে তাবিজ এনে দিতে বলে তার মাথার চুল ওঠা বন্ধ করার জন্য। এলিতা আর হিমু এক বৃষ্টির রাতে পথে বের হয়। হিমু বলে পরিবার থাকা মানেই যন্ত্রণা। পরিবারহীন মানুষ আছে কি-না এলিতা জিজ্ঞেস করে। হিমু বলে, ‘আছে। তারা মানুষের মতোই কিন্তু মানুষ নয়। প্রবল ঝড় বৃষ্টির রাতে এরা রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। আমি এদের নাম দিয়েছি পক্ষীমানব। পক্ষীমানবদের চেনার উপায় হচ্ছে তাদের চোখে থাকে সানগ্লাস। হাতে গ্লাভস। তাদের হাতের আঙুল পাখির নখের মতো বলে এরা আঙুল গ্লাভসের ভেতর লুকিয়ে রাখে।’ ঝড়-বৃষ্টির রাত হলেই এলিতা হিমুর সঙ্গে পক্ষীমানবের খোঁজে বের হয়। মানুষের জীবন কোন না কোন কিছুর অনুসন্ধানেই কাটে। এলিতা আর হিমু অনুসন্ধান করে সামান্য পক্ষীমানবের। হিমুকে নিয়ে তোলা এলিতার ছবিটি টরেন্টোর একটি উৎসবে পুরস্কৃত হয়। হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D.বল্টু ভাই হিমু বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ উপন্যাস ‘হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D. বল্টু ভাই’। লক্ষ্যণীয়, প্রথম দিককার উপন্যাস ময়ূরাক্ষী, দরজার ওপাশে উপন্যাসে হিমুকে আমরা রোমান্টিক আবরণে পাই। উপন্যাসের নামকরণও তাই বলে। শেষের দিকে হিমু উপন্যাস সমূহে প্রহসন, সামাজিক নকশার লক্ষণ প্রতীয়মান। ‘হিমু এবং হার্ভার্ড চয.উ. বল্টু ভাই’ উপন্যাসের নামকরণের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। হার্ভার্ড পিএইচডি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বে যথেষ্ট সম্মানজনক। চৌধুরী আখলাকুর রহমান পদার্থ বিজ্ঞানের ঈশ্বর কণার উপর গবেষণা করে হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন। মাজেদা খালা হিমুকে যখন হার্ভার্ডের পিএইচডির গল্প শোনায় তখনই সে বলে যারা বড় অবস্থানে থাকে তাদের ডাক নাম হাস্যকর হয়, হয়তো দেখা যাবে ডক্টর চৌধুরী আখলাকুর রহমানের ডাকনাম বল্টু। বিস্ময়কর হলেও সত্য মাজেদা খালা ফোনে জানতে পারেন, সত্যিই তার ডাক নাম বল্টু এবং তার ভাইয়ের নাম নাট। নাট-বল্টু দুই ভাই। যাহোক, খালার আদেশে হিমু হোটেল সোনারগাঁও-এর চারশ একুশ নাম্বার রুমে যায় একটি লুঙ্গি, গামছা ও বাংলা ডিকশনারি দিতে। হিমু তাকে প্রথমেই বল্টু ভাই বলে সম্বোধন করে, কিন্তু তিনি এতে কিছু মনেই করেন না। হিমুকে তিনি বলেন, ডিকশনারিতে ‘তুতুরি’ নামে কোন শব্দ আছে কি-না তা খুঁজে দেখতে। তুতুরি শব্দের অর্থ ‘সাপের বাঁশি’। তুতুরি একটা মেয়ের নাম, কিন্তু সে নিজের নামের অর্থ জানে না। বল্টু ভাই তাই এই নামটার অর্থ তাকে জানাতে চান। হিমু তাকে পরামর্শ দেয়, এতে মেয়েটি অখুশি হবে, প্রকারান্তরে বলা হবে, মেয়েটি এতোই মুর্খ যে নিজের নামের বানান জানে না। বল্টু ভাই তাকে ‘ফুতুরি’ শব্দের অর্থ দেখতে বললে ডিকশনারিতে তা পাওয়া যায় না। অশনি বল্টু ভাইয়ের মনে হয় বাংলা ভাষায় ফুতুরি শব্দটি যোগ করা যায়, যার অর্থ হবে ‘ফুঁ দিয়ে যে বাঁশি বাজায়’। বাঁশি, সানাই, ব্যাগ পাইপ এ ধরণের সব বাদ্যযন্ত্র এই ‘ফুতুরি’ দলে পড়বে। বল্টু ভাই হিমুকে ডিকটেশন দিয়ে তখনই বাংলা একাডেমির সভাপতির কাছে এই নতুন শব্দ যোগ করার জন্য আবেদন পত্র লেখান। বল্টু ভাই হিমুকে চাকরিতে বহাল করে। হিমুর চাকরি হলো ‘ঈশ্বর শূন্য আত্মা শূন্য’ শিরোনামের বইটি লিখতে বল্টু ভাইকে সাহায্য করা। হিমু বলে, এই বই লিখলে তার রগ কেটে ফেলা হবে। বরং বল্টু ভাইয়ের উচিত ‘ভূত আছে’ টাইপের কোন বই লেখা। হার্ভার্ডের পিএইচডি’র কাছ থেকে এমন বই পেলে মানুষ খুশি হবে। বল্টু ভাই বিরক্ত হন। হিমুকে বের করে দেন। বাংলা একাডেমির ডিজি’র পিএসকে হিমু বলে, সে প্রধাণমন্ত্রীর একটি গোপন চিঠি নিয়ে এসেছে। পিএস তাকে ডিজি’র খাস কামরায় ঢুকতে দেয়। বাংলা ভাষায় নতুন শব্দ ‘ফুতুরি’ সংযোজনের জন্য হিমু আবেদন পত্র নিয়ে এসেছে শুনে ডিজি সে চিঠি আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতে বলেন। হিমু জানায়, যে ভদ্রলোক এই শব্দটি সংযোজন করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন, তিনি হার্ভার্ডের পিএইচডি এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছেন। এই তথ্য শুনে ডিজি সাহেব বিগলিত হয়ে গেলেন। তিনি সোনারগাঁও-এ ফোন করে বল্টু ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি জানান, আগামী কাউন্সিলেই এই প্রস্তাব তোলা হবে। হিমু তাকে বলে, সে-ও বাংলা ভাষায় নতুন একটি শব্দ সংযোজন করতে চায়। শব্দটি হলো ‘ভুতুরি”, যার অর্থ ভূতের নাকে ফুঁ দিয়ে বাঁশি বাজানো। শচীন কর্তার গানে যেমন ‘ডাকাতিয়া বাঁশি’ আছে হিমু তেমনি ‘ভূতুরিয়া বাঁশি’ শব্দটি সংযোজন করতে চায়। ডিজি’র সামনে হিমু সুর করে গায় ‘বাঁশি শুনে আর কাজন নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি।’ বল্টু ভাইয়ের ফুঁতুরি শব্দের সঙ্গে হিমু বাংলা অভিধানে ‘ভূতুরি’ শব্দটিও যোগ করতে বলে। চৌধুরী আখলাকুর রহমান হার্ভার্ডের পিএইচি অথচ তার ডাক নাম বল্টু, ভাইয়ের নাম নাট Ñ এই তথ্য পেয়ে ডিজি বিস্মিত হয়। হতাশ আর হতভম্ব অবস্থায় ডিজিকে রেখে হিমু পথে নামে। ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ তুরিন গোলকধাঁধাঁ থেকে বের হওয়ার বিশেষ পদ্ধতি বের করেছিলেন। পদ্ধতিটি হলো যতো মোড় আসুুক বারবার ডানদিকে যাওয়া। হিমু এই পদ্ধতিতেই ঢাকা শহরে হাঁটা শুরু করে। সে সবগুলো ডানের গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাদরের দোকান দেখে। সেখানে বাদর ও হনুমান শিকল দিয়ে বাঁধা, কিন্তু সেগুলো বিক্রি হয় না। একটা রেস্টুরেন্ট খুঁজে পেলো সে যেখানে লেখা আছে, ‘গোসলের সুব্যবস্থা আছে। পরিষ্কার গামছা দেয়া হয়। মহিলা নিষেধ।’ আরেক গলিতে দেখা গেলো ঘোড়া দিয়ে ঘানিতে সরিষার তেল ভাঙানো হচ্ছে। সবাই চোখের সামনে ঘানিতে ভাঙানো তেল নিয়ে যাচ্ছে। ডান দিকে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে হিমু এক অন্ধগলির মাথায় এসে পড়ে। এরপর আর যাওয়ার জায়গা নেই। এখানে লালসালু দেয়া মাজার শরিফ। এই মাজারের নাম ‘বাচ্চাবাবার গরম মাজার।’ বাচ্চাবাবার মাজারের খাদেম হুজুরের দুই পা কাটা। হিমু তাকে চা-সিগারেট খাওয়ায়, এমনকি রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাও করে। খাদেমের পা নেই তবু যে জায়গায় পা ছিলো সেই জায়গা টিপে দেয়। খাদেমের পায়ের আঙুল ফোটালে তার শব্দও হয়। হিমু অবশ্য ধরে ফেলে যে হুজুর আসলে পায়ের আঙুল ফোটানোর সময় হাতের আঙুল ফুটিয়ে শব্দ করে। হুজুর তাকে তার অ্যাসিসটেন্ট হতে বলে, তার আগের অ্যাসিসটেন্ট হাকিম মাজারের দান-বাক্সের টাকা চুরি করে পালিয়েছে। হিমু ফ্রিল্যান্স, পার্ট টাইম কাজ করতে চায়। যদিও কোন বেতন নেই, তবু সময়-সুযোগ মতো খাদেম হুজুরের সেবা করতে চায় হিমু। হুজুরও হিমুর ব্যবহার ও সেবায় খাশ দিলে দোয়া করে। হিমু হুজুরের সঙ্গে জিকিরে অংশ নেয়। হুজুরের মোবাইল থেকে ডিজিকে ফোন করে ভূতুরি বানানে কয়টা চন্দ্রবিন্দু থাকবে তা নিয়ে মাঝ রাতে আলোচনা করতে চায়। ডিজি অত্যন্ত বিরক্ত ও দ্বিধান্বিত হয়। তিনি হিমুকে ‘সান অব এ বিচ’ বলেন। তার মতে, বাংলাদেশটা মতলববাজ লোকে ভর্তি এবং সব মতলববাজ লোকের পেছনে একটা দুটা মন্ত্রী আছে। হিমুও হয়তো এমন কেউ। তিনি বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়েন এই ভেবে যে, তার বিশেষ হটলাইনের নাম্বার হিমুকে কে দিলো। এ ব্যাপারে পিএস দবিরকে তিনি সন্দেহ করেন। বাংলা একাডেমির ডিজি সাহেবের সমস্যা হলো তিনি কাউকে ‘না’ বলতে পারেন না। সরকারি ছাত্রদলের এক সময়ের বড় নেতা তাকে ‘বাংলার ঐতিহ্য চেপা শুটকির একশত রেসিপি’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ এবং গ্রামবাংলার ভর্তাভাজি’ নামে দুটি পা-ুলিপি জমা দিয়েছে। তিনি মনে করেন এই দুই পা-ুলিপি এবং বাংলাভাষায় ‘তুতুরি’, ‘ভূতুরি’ শব্দ সংযোজনের প্রস্তাবনা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রেরই অংশ। মাজেদা খালার বাড়িতে গিয়ে হিমু দেখে, খালা কাঁদছে। খালু সাহেব খালাকে কুত্তি বলেছেন তার বান্ধবীর মেয়ে তুতুরিকে পেতœী বলেছেন। তুতরি আর্কিটেক্ট, ডিজাইনে গোল্ড মেডেল পাওয়া। মাজেদা খালা তাকে এনেছেন বাড়ি নতুন করে ডিজাইন করতে। শুধু তাই না খালু সাহেবের বন্ধু ছেলে হার্ভার্ডের পিএইচডি বল্টু ভাইয়ের সঙ্গে তাকে বিয়ে দেবার চেষ্টাও করছেন। খালু সাহেব অবশ্য তুতুরিকে ইচ্ছা করে পেতœী বলেননি, ওরহান পামুকের একটি উপন্যাসে পেতœী বর্ণনা পড়তে পড়তে তিনি মেয়েটিকে পেতœী বলেছেন, কিন্তু খালাকে গালি দিয়েছেন ইচ্ছা করেই। শুধু তাই না, তিনি খালাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। খালা রাগ করে হিমু ও তুতুরিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলেন। খালা ঘর থেকে বের হয়েই ফুটপাথের মনুষ্যবর্জ্যে পা দিয়ে ফেললেন। তিনি সাাবান, পানি ইত্যাদির জন্য চেচামেচি শুরু করলেন। হিমু আর তুতুরি সাবান কিনতে যায়। হিমু তুতুরিকে বুদ্ধি দেয় এই মুহূর্তে খালাকে ফেলে তারা দুজন দুদিকে চলে গেলে খালা কিছুক্ষণ একা চিৎকার চেচামেচি করে বাড়ি ফিরবে। খালা খালুর মিলন হবে। হিমুর বুদ্ধিটা তুতুরির পছন্দ হয়। হিমু তার কাছে চা-নাস্তা খেতে চায়। তার কাছে এক হাজার টাকার নোট। হিমু তাকে বলে তার বস পীর বাচ্চাবাবার মাজারের খাদেমের জন্য এক প্যাকেট সিগগারেট কিনে দিতে বলে, তাতে এক হাজার টাকার নোটের ভাংতিও পাওয়া যাবে। হিমু জানায় সে খাদেম হুজুরের পা দাবায়, তার বো যতœ করে। মাজারের জন্য সুন্দর একটা ডিজাইন করে দিতে বললে তুতুরি বিস্মিত হয়। হিমু বলে বড় বড় আর্কিটেক্টরা মাজারের ডিজাইন করেছেন, যেমন স¤্রাজ শাহজাহানের স্ত্রীর মাজার তাজমহলের ডিজাইন করেছেন ইশা আফেন্দি, অটোমান সা¤্রাজ্যের অনেক মাজারের ডিজাইন করেছেন সিনান। তুতুরিকে বাচ্চাবাবার মাজারের ডিজাইন করতে বলে হিমু হুট করে চলে যায়। তুতুরির ধারণা হিমু তার সাথে চালবাজি করেছে। পুরুষদের কাজই হলো চালবাজি করে মেয়ে পটানো। স্থাপত্যবিদ্যার কিছু জ্ঞান দিয়ে হিমু তুতুরিকে প্রথমেই চমকে দেয়ার চেষ্টা করে। আজকাল ইন্টারনেটের কল্যাণে সবাই এ সব জানে। হিমু মাজারের খাদেমের কাজ করে এ কথাটাও তুতুরির কাছে সত্য মনে হয় না। মেয়েদের ফাঁদে ফেলার জন্য পুরুষরা অনেক কিছুই করে বলে তার ধারণা। তার বান্ধবী শর্মিলা এমনি এক ফাঁদে পড়ে জীবন দিয়েছে। তাদের অংক স্যার জহির খন্দকার অদ্ভূত সব গল্প বলতেন। তার গ্রামের বাড়িতে একটা মাছ আছে যেটির মুখ দেখতে অবিকল মানুষের মত Ñ এই গল্প শুনে শর্মিলা একদিন জহিরের গ্রামের বাড়িতে হাজির হয়। জহির তার বন্ধু পরিমলকে নিয়ে শর্মিষ্ঠাকে মার্গারিটা খাইয়ে বেহুশ করে ফেলে। পরে তাদের যৌনক্রিয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছাড়া হয়। ভিডিওতে শর্মিলাকে চেনা গেলেও জহিরকে চেনা যায় না। শর্মিলা ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করে। তুতুরির ইচ্ছা জহির নামের এই শয়তান ও তার বন্ধু পরিমলকে শিক্ষা দেয়ার। তুতুরি কাছে হার্ভার্ডের পিএইচডি বল্টু ভাইকেও শয়তান মনে হয়। সে তুতুরি নামের অর্থ খুঁজে দিয়ে পটানোর চেষ্টা করছে বলে তার ধারণা। মাজেদা খালা সত্যিই ফুটপাথে বিষ্ঠার উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। লোকজনের নানা মন্তব্যে বাধ্য হয়ে সে ঘরে ফিরে যায়। ঘরে ফিরে দেখেন খালু সাহেব ভয়াবহ অসুস্থ। তাকে কোন রহম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার মেসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। যমে-মানুষে টানাটানি করে তাকে জীবিত করা হয়। খালু সাহেবের জ্ঞান ফিরলে তিনি জানান, মরে যাওয়ারর আগে জানিয়ে দেয়া দরকার যে, যে ফ্ল্যাটে তারা বসবাস করে সেটি খালার নামেই কেনা, উত্তরার ফ্লাটটিও। হাসপাতালে হিমু নতুন গামছা, লাইফবয় সাবান, স্যাভলন নিয়ে হাজির হয়। খালা বিরক্ত হয়ে হিমুকে বলে কোনদিন যেন তার সামনে না-আসে। হিমুকে বকা দিলেও মনে মনে তিনি হিমুর জন্য মায়া অনুভব করেন। বল্টু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে হিমু দেখতে পায়, হার্ভার্ডের ফিজিক্সের এই পিএইচডিধারী গত রাতে স্বপ্নে ইলেকট্রন হয়ে যায়। তারপর সারা রাত ইলেকট্রন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করেছে। হিমুকে বোঝাতে গিয়ে তার মাথায় অংকের সমীকরণ এসে যায়। সে বলে, হিমু যেন দরজার বাইরে পাহারা দেয় কেউ যেন ঢুকতে না-পারে। হিমুকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুতুরি খুবই অবাক হয়। সে তুতুরিকে বলে, বল্টু ভাই ইলেকট্রন হয়ে গেছে এবং নেগেটিভ চার্জের কারণে সময়ের উল্টোদিকে চলছে। তুতুরি মাজেদা খালার কাছে হিমু সম্পর্কে জেনেছে। মাজেদা খালার ধারণা, হিমুর আধ্যাত্মিক শক্তি আছে। তুতুরি এ সব বিশ্বাস করে না, তার ধারণা মানুষ কোন অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে আসে না, দুষ্টুমি, কুকর্ম করার ক্ষমতা নিয়ে আসে এবং হিমু নিশ্চয়ই অনেক কুকর্ম করেছে। হিমু বলে সে কোন কুকর্ম করেনি, তবে একটা করবে, তুতুরির চেনা অংকের এক শিক্ষককে শিক্ষা দেবে। হিমু কীভাবে এই তথ্য জানলো তা জিজ্ঞেস করলে, হিমু বলে সে মনের কথা বুঝতে পারে। এই মুহূর্তে তুতুরি ভাবছে, হিমু নামের লোকটা ভয়ঙ্কর, তার হাত থেকে একশ হাত দূরে থাকতে হবে। তুতুরি হিমুর কথায় বিভ্রান্ত হয়ে যায়। হিমু বলে, ‘‘কনফিউজড থাকা ভালো। প্রকৃতি চায় না আমরা কোনো বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হই।’’ হিমুকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিয়ে তুতুরি চলে যায়। সিগারেট নিয়ে হিমু হুজুরের কাছে আসে। খাওয়ার অভাবে হুজুর রোজা রেখেছে। কিন্তু চা-সিগারেট খায়। এ বিষয়ে তার নিজস্ব যুক্তি আছে। হুজুর দাবী করে, যৌবনে সে একটা বড় সোয়াব করেছে। আল্লাহর ব্যাংকে সেই সোয়াব বাড়ছে, লাইতুল কদরের রাতে আল্লাহ তার সোয়াব দ্বিগুণ করে দেয়। কিন্তু কী সোয়াব করেছে সেটা সে বলে না। কারণ সোয়াবের কথা বললে তা কমে যায়। হুজুর হিমুকে খুবই ¯েœহ করা শুরু করে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, যে সোয়াবটি সে করেছে তা হিমুকে বলবে। যৌবনে তিনি একটা বাচ্চা মেয়েকে ট্রাকের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন, নিজে ঝাঁপ দিয়ে মেয়েটির জান বাঁচিয়েছিলেন, সে সময়ই তার পা দুটো কাটা যায়। আসরের ওয়াক্তের সময় বল্টু ভাই মাজারে এসে হাজির। তিনি দুপুরে ঘুমানোর পর পজিট্রন হয়ে গিয়েছিলেন। খাদেমের সঙ্গে তার দেখা হলে সে বলে আত্মা বলে কিছু নেই। হিমু কানে কানে বলে, এই সেই বিরাট জ্ঞানী লোক যে আত্মা মানে না। বল্টু ভাই খাদেম হুজুরকে বলে পা নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না, পা আবার গজাবে। তিনি বলেন স্টেমসেল নিয়ে যে গবেষণা আছে তা মানুষের হারানো অঙ্গ টিকটিকির খসে যাওয়া লেজ কিংবা মাকড়শার ঠ্যাংয়ের মতো আবার গজাবে। তিনি আরও বলেন, মানুষ ক্রমশ পয়েন্ট অব সিঙ্গুলারিটির যাচ্ছে এবং শীঘ্রই অমরত্ব পেয়ে যাবে, আজরাঈল বেকার হয়ে যাবে। হুজুর তাকে ইফতারির আগে আর কথা বলতে না করে, কারণ তার কথা শুনলে অজু নষ্ট হয়ে যাবে। ইফতারির সময় হিমু, বল্টু ভাই ও খাদেম হুজুর একসাথে বসে। তারা বিছমিল্লাহ হোটেলের বিখাত মোরগ পোলাও, খাসির বটি কাবাব ও বোরহানি খায়। খাবার বল্টু ভাইয়ের দারূণ পছন্দ হয়, সে এটির রেসিপি এবং প্রয়োচনীয় স্পাইস নিয়ে যেতে চায়। এই চমৎকার খাবারের সাথে সে রেড ওয়াইনের অভাব অনুভব করে। রেড ওয়াইন জিনিসটা মদ এটুকু শুনে হুজুর আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ে। বল্টু ভাই খেয়ে দেয়ে নিমগাছের নিচে পাটি পেতে শুয়ে পড়ে এবং আরামের ঘুম দেয়। হুজুর তার মোবাইলটি হিমুকে দিয়ে দেয়। তুতুরি মোবাইলে হিমুকে ফোন দিয়ে তাটে পটাসিয়াম সায়ানাইড জোগাড় করে দিতে বলে। পটাসিয়াম সায়ানাইড এমন বিষ যা খেতে মিষ্টি এবং খাওয়ার সাথে সাথেই মৃত্যু। তুতুরি শরবতের গ্লাসে এটা মিশিয়ে জহির ও তার বন্ধুকে খাওয়াতে চায়। এদিকে মাজেদা খালা ও খালু সাহেবের মধ্যে ঝগড়া হয়। মাজেদা খালা খালুকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। উত্তরার ফ্লাটেও যেতে না-করে। তুতুরিকে নিয়ে তিনি এবার বাড়ির নতুন ইন্টরিয়র ডিজাইন ভাবতে থাকে। তিনি হিমুর জন্য হলুদ রঙের একটা ঘর রাখতে বলে। জহিরের সঙ্গে তুতুরি দেখা করে। সে গ্রামের বাড়িতে বিশেষ ধরণের মাছটি দেখতে যাবে বলে জানায়। তাকে বাচ্চাবাবার মাজারে আসতে বলে, কারণ হিসাবে বলে ওখানের খাদেমের অ্যাসিসটেন্ট তার পরিচিত। এই গরম মাজারের ডিজাইন সে করছে বলে জানায়, এটি কয়েক কোটি টাকার প্রজেক্ট, কিন্তু টাকা যে দিচ্ছে তার নাম গোপন রাখতে হবে। হার্ভার্ডের পিএইচডি করা লোকও এই মাজারে গিয়ে আটকা পড়ে, অনেক বড় বড় মন্ত্রীরা গোপনে এই মাজার জেয়ারত করে। জহির অবশ্য মাজারের ব্যাপারটা গুরুত্ব দেয় না। তুতুরি যে তার ফাঁদে ধরা পড়তে যাচ্ছে এতেই তিনি খুশি। তবে তার ধারণা, হিমু লোকটা হয়তো শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে রওনা হবে। তাতে অবশ্য সমস্যা নেই, সব ব্যবস্থাই তার জানা আছে। বল্টু ভাই মাজারে বেশ ভালই আছেন। সোনারগাঁ হোটেলের রুম ছেড়ে এখানে তিনি আরামের ঘুম দিচ্ছেন। একদিন তিনি রেস্টুরেন্ট থেকে গোসল করে আসলেন, ঘানিতে তেল ভাঙানো দেখলেন, খাঁটি সরিষার তেল কিনলেন, শুধু তাই না, বাদরের দোকান থেকে দুইটা ট্রেনড মাঙ্কিও কিনলেন। এদিকে খালু সাহেবও মাজারে এসে হাজির। সে বল্টুকে মাজারে শুয়ে থাকতে দেখে জানায়, এদের বংশেই পাগলামী আছে, এর ভাই নাটও পাগল। তিনি বল্টুকে পরামর্শ দেন, তুতুরিকে বিয়ে করতে, কারণ তুতুরি স্ক্রু ড্রাইভার টাইপের মেয়ে যে তাকে টাইট দিতে পারবে। তিনি ফিজিক্স বাদ দিয়ে একেবারে বিপরীত কিছু নিয়ে বল্টুকে ভাবার পরামর্শ দেন। বল্টু ভাই বাংলার ভূত নিয়ে ইংরেজিতে বই লেখা শুরু করেন যার বাংলা অনুবাদ বাংলা একাডেমি থেকে ছাপা হবে। হিমু বাংলা একাডেমির ডিজিকে ফোন করে বই লেখা শুরু হয়েছে এ সংবাদ দেয়। ডিজি মাজারের ঠিকানা নেয়, কারণ হিমুর সাথে দেখা করে একটা হেস্তনেস্ত করতে চায়। জহির মাজারে এসে হাজির হয় তুতুরির খোঁজে। হিমু তাকে বলে, পটাসিয়াম সায়ানাইড জোগাড় করতে গিয়ে তার আসতে দেরী হচ্ছে। মার্গারিটা নামের ককটেলের সঙ্গে পটাসিয়াম সায়ানাইড মিশিয়ে জহির ও তার বন্ধুকে তুতুরি খাওয়াবে Ñ হিমুর মুখে এ তথ্য শুনে জহিরের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। সে মাজারের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। হিমু তাকে বলে, দুষ্টু কোন লোক এই মাজারে হাত রাখলে সে আটকে যায়। হিমুর অটোসাজেশন দূর্বল চিত্তের জহিরের উপর খেটে যায়। সে সত্যিই আর হাত সরাতে পারে না। ঘন্টা তিনেক পরে জহিরের বন্ধু পরিমল এসে এ ঘটনা দেখে সেখান থেকে সরে যায়। বাংলা একাডেমি ডিজি মাজারে এসে জহিরকে দেখে চিনতে পারে। ‘বাঙলার ঐতিহ্য চেপা শুটকির একশত রেসিপি’ বইয়ের লেখক পরিমলের বন্ধু সে। তুতুরি মাজারে এসে জহিরের আটকে পড়া অবস্থা দেখে। তুতুরিকে দেখে খাদেম হুজুর চিনতে পারেন। এই মেয়েটির আসল নাম জয়নাব, যাকে প্রাণে বাঁচাতেই তিনি পা হারিয়ে ছিলেন। তুতুরির সাথে পরিচিত হয়ে ডিজি বিস্মিত হন, তুতুরি থেকেই যে ‘ফুতুরি’, ‘ভূতুরি’ তা বুঝতে পারেন। মাজারে একজন দুষ্ট লোক আটকা পড়েছে এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চ্যানেলের রিপোর্টার চলে আসে। উত্তেজিত জনতার হাতে পরিমল ধরা পড়ে। ডিজি সাহেবের সঙ্গে বল্টু স্যারের পরিচয় হয়। তিনি জানতে পারেন, হার্ভার্ডের পিএইচডি বল্টু স্যারের লেখা দ্য বুক অব ইনফিনিটি নামের বইটি নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্টা সেলার। তিনি ‘বাংলার ভূত’ পা-ুলিপির সূচনা অংশ পড়েই মুগ্ধ হন। তিনি এই বই বাংলা অনুবাদ করে বাংলা একাডেমি থেকে ছাপার সিদ্ধান্ত নেন। বল্টু স্যারের কিনে আনা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাদর দেখে হুজুর খুব খুশি হন। মাজারের চারপাশে ভিড় রেখে হিমু একসময় পথে নেমে আসে। তার সঙ্গী হয় পথের কুকুর। হিমুর পাঁচটি গল্প আলোচনা করেই আমরা ‘হিমু’ চরিত্র এবং এই সিরিজের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্যসমূহ লক্ষ্য করতে পারি। প্রথম উপন্যাস থেকেই লক্ষ্য করি সামাজিক দ্বায়-বদ্ধতা প্রকাশের ক্ষেত্রে হিমু বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রথম উপন্যাস ময়ূরাক্ষী থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি Ñ ‘‘থানার ওসি সাহেবের চেহারা বেশ ভালো। মেজাজও ভালো। চেইন স্মোকার। ক্রমাগত বেনসন অ্যান্ড হেজেস টেনে যাচ্ছে। বাজারে এখন সত্তর টাকা করে প্যাকেট যাচ্ছে। দিনে তিন প্যাকেট করে হলে মাসে কত হয়? দুশোদশ গুণণ তিরিশ। ছ-হাজার তিনশ। একজন ওসি সাহেব বেতন পান কত, এক ফাঁকে জেনে নিতে হবে।’’ এই অংশে হিমুর সামাজিক দায়-বদ্ধতা সুপ্রকট। একজন ঘুষখোর ওসির চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন খুবই সরল অংকের মাধ্যমে। বাংলাদেশের পুলিশের ঘুষ খাওয়ার বিষয়টি এখানে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের সাহিত্যে মন্ত্রী কিংবা রাজনীতিবিদদের চরিত্র উন্মোচন খুব একটা প্রকট নয়। কিন্তু হিমু সিরিজের উপন্যাসে তা উল্লেখযোগ্যভাবেই লক্ষ্য করা যায়। ‘‘কিছু কিছু লোক মন্ত্রী কপাল নিয়ে জন্মায়। জিয়া, এরশাদ যেই থাকুক, এরা মন্ত্রী হবেই। জহিরের বাবা এরকম ভাগ্যবান একজন মানুষ।’’ দরজার ওপাশে উপন্যাসের এই উদ্ধৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সময় সময় দল-পাল্টানোর বিষয়টি উঠে আসে। আমাদের মন্ত্রীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাও এ উপন্যাসের রফিকের মন্তব্যের মাধ্যমে পুটে ওঠে, ‘‘তুই কোন মন্ত্রী চিনিস না, তাই না? চেনার অবশ্য কথা না। ভালো মানুষদের সঙ্গে মন্ত্রীর পরিচয় থাকে না। বদগুলির সঙ্গে থাকে।’’ প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম নামের উপন্যাসে আমাদের প্রধাণ রাজনৈতিক দুইদলের জনবিচ্ছিন্নতা প্রকাশ পায়। হিমু এক পর্যায়ে মন্তব্য করে, ‘‘আমার ধারণা নি¤œশ্রেণীর পশুপাখী মানুষের কথা বোঝে। অতি উচ্চ শ্রেণীর প্রাণী মানুষই শুধু একে অন্যের কথা বোঝে না। বেগম খালেদা জিয়া কী বলছেন তা শেখ হাসিনা বুঝতে পারছেন না। আবার শেখ হাসিনা কী বলছেন তা বেগম খালেদা জিয়া বুঝতে পারছেন না। আমরা দেশের মানুষ কী বলছি সেটা আবার তাঁরা বুঝতে পারছেন না। তাঁরা কী বলছেন তাও আমাদের কাছে পরিষ্কার না।’’ এই তীব্র শ্লেষের পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধারাবাহিক হরতালের বিষন্নতাও এই উপন্যাসের গায়ে লেগে আছে। হরতালের রাস্তায় পথ চলতে চলতে হিমুর মনে হয়, ‘‘আজ হরতালের কতদিন চলছে? মনে হচ্ছে সবাই দিন-তারিখের হিসেব রাখা ভুলে গেছে। নগরীর জন্ডিস হয়েছে। নগরী পড়ে আছে ঝিম মেরে। এ রোগের চিকিৎসা নেই। বিশ্রামই একমাত্র চিকিৎসা। নগরী বিশ্রাম নিচ্ছে।’’ অসুস্থ এই ঢাকা নগররীর আরোগ্য নিয়ে হিমুর মনে যে সন্দেহ দেখা দেয় তা যেন পাঠকের মনেও ছড়িয়ে পড়ে Ñ ‘‘এখনকার অবস্থা সে রকম না, এখন অন্য রকম পরিবেশ। জন্ডিসে আক্রান্ত নগরী রোগ সামলে গা-ঝাড়ি দিয়ে উঠতে পারবে তো Ñ এটাই সবার জিজ্ঞাসা। নাকি নগরীর মৃত্যু হবে? মানুষের মতো নগরীরও মৃত্যু হয়।’’ সমকালীন রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম উপন্যাস এই ব্যবস্থার একটি দলিল হয়ে থাকবে। উদ্ধৃতির লোভ সামলাতে পারছি না, ‘‘তত্ত্ববধায়ক সরকারের বিল পাশ হয়েছে। খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেছেন। দুই দলের মর্যাদা বহাল আছে। দু’দলই দাবী করেছে তারা জিতেছে। দু’দলই বিজয় মিছিল বের করেছে Ñ সব খেলায় একজন জয়ী হন, অন্যজন পরাজিত হন। রাজনীতির খেলাতেই শুধুমাত্র দুটি দল একসঙ্গে জয়ী হতে পারে। অথবা একসঙ্গে পরাজিত হয়। রাজনীতির খেলা বড়ই মজাদার খেলা। এই খেলায় অংশগ্রহণ তেমন আনন্দের না। দূর থেকে আনন্দ আছে।’’ শুধু যে রাজনীতিই হিমুর শ্লেষ ও প্রহসনের কষাঘাত খেয়েছে, তা নয়, হিমুর হাতের কয়েকটি নীল পদ্ম উপন্যাসে আমাদের কবি-সাহিত্যিক তথা জাতিগত মানসিক দৈন্যও ফুটে ওঠেছে তীব্র ভাবে। ‘‘আমাদের সারাদেশে অসংখ্য স্মৃতিস্তম্ভ আছে Ñ যে সব ভারতীয় সৈন্য আমাদের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন তাদের জন্যে আমরা কিন্তু স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করিনি। কেন করিনি? করলে কি জাতি হিসাবে আমরা ছোট হয়ে যাবো? আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা স্বাধীনতা নিয়ে কতো চমৎকার সব কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখলেন Ñ সেখানে কোথাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনীর অবদানের কোন উল্লেখ নেই। উল্লেখ করলে ভারতীয় দালাল আখ্যা পাবার আশঙ্কা। বাংলাদেশে এই রিস্ক নেয়া যায় না।’’ উপন্যাসের হালকা গল্পের চলন এই কয়েক লাইনে এসে যেন কলামের গাম্ভীর্য পেয়ে যায়। হলুদ হিমু কালো র্যাব উপন্যাসে বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবার তন্ত্রের বিষয়টি সমালোচিত হয়। উপন্যাসে হিমুর সংবাদ পত্র পড়তে গিয়ে মন্তব্য করে, ‘‘দেশরতœ শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের আগমন। ইন্টারেস্টিং খবর তো বটেই। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহহমান রাজনীতি করবেন, আর শেখ হাসিনা চুপ করে বসে থাকবেন তা হবে হবে না। এবার হবে পুত্রে পুত্রে লড়াই। আমরা নিরীহ দেশবাসী মজা করে দেখব। পত্রিকা ভর্তি ইন্টারেস্টিং খবর। কোনটা রেখে কোনটা পড়ব? আজ ছুটির দিন বলে পত্রিকার সঙ্গে আছে সাহিত্য সাময়িকী। সাম্প্রতিক গদ্য-পদ্যের মধূ মিলন পাঠ করা যাবে। একটা গল্প ছাপা হয়েছে আজাদ রহমান নামের এক লেখকের। গল্পের নাম ‘কোথায় গেল সিম কার্ড?’ মনে হচ্ছে খুবই আধুনিক গল্প। গল্পকার নিশ্চয়ই হারিয়ে যাওয়া সিম কার্ডের রূপকে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির কথা বলেছেন।’’ এই মন্তব্য শুধু সমকালের রাজনীতি নয়, সাহিত্যকেও কড়া বিশ্লেষণ করেছে। আধুনিক ছোটগল্পের গল্পহীনতা ও অহেতুক জটিলতার এমন সমালোচনা আসলে হিমুর পক্ষেই সম্ভব। একটু বড় মুখ করেই বলতে চাই, বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ধারা থেকে শুরু করে সাহিত্যের ধারা নিয়ে আর কোন উপন্যাস নজরে পড়েনি। হুমায়ূন ও হিমুর দুঃসাহসিক যুগলবন্দীতেই এটি সম্ভব হয়েছে। র্যাবের মতো বিশেষ বাহিনী গঠন এবং ক্রসফায়ারে বিনাবিচারে মানুষ মারা নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ ও কলাম লেখা হয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিশীল সাহিত্যে তার একমাত্র দলিলনামা আমরা শুধুমাত্র হলুদ হিমু কালো র্যাব উপন্যাসেই দেখেছি। হিমুর সঙ্গে র্যাব কর্মকর্তার কথোপকথন উদ্ধৃতিযোগ্য Ñ ‘‘আপনি কেন আমাদের কর্মকা- সমর্থন করেন না বলুন তো? আপনার যুক্তিটা শুনি। আপনি কি চান না ভয়ঙ্কর অপরাধীরা শেষ হয়ে যাক? ক্যান্সার সেলকে ধ্বংস করতেই হয়। ধ্বংস না করলে এই সেল সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আমি বললাম, ‘স্যার মানুষ ক্যান্সার সেল না। প্রকৃতি মানুষকে অনেক যতেœ তৈরি করে। একটা ভ্রুণ মায়ের পেটে বড় হয়। তারজন্য প্রকৃতি কী বিপুল আয়োজনই না করে! তাকে রক্ত পাঠায়, অক্সিজেন পাঠায়। অতি যতেœ তার শরীরের একেটা জিনিস তৈরি হয়। দুইমাস বয়সে হাড়, তিন মাসে চামড়া, পাঁচমাস বয়সে ফুসফুস। এতো যতেœ তৈরি একটা জিনিস বিনা বিচারে ক্রস ফায়ারে মরে যাবে Ñ এটা কি ঠিক?’’ হিমুর এই প্রশ্ন মানবিকতার ভিন্ন দূয়ার খুলে দেয়। মানব সৃষ্টি ও মানব জন্মের এমন জয়গান যথার্থই দূর্লভ। ঠিক তেমনি আমাদের কর্পোরেট কোম্পানি ও বিশেষ করে ক্ষমতাধর মোবাইল কোম্পানি সমূহের কার্যকলাপ নিয়ে সাহিত্যিকরা প্রশ্ন তোলেন না। হিমুর মাধ্যমে হুমায়ন আহমেদ এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেন ‘আজ হিমুর বিয়ে’ উপন্যাসে। ‘‘বর্তমানকালের প্রেমিক-প্রেমিকারা বিরাট ভাগ্য নিয়ে এসেছে। মোবাইল কোম্পানিগুলো প্রেমের ইজারা নিয়ে নিয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা যাতে রাতভর কথা বলতে পারে তার জন্যেও কতো ব্যবস্থা! কলরেট অতি সামান্য। বিশেষ বিশেষ রাতে আবার ফ্রি। মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিগুলো একটা মটো ‘বাঙালি জাতি! প্রেম করো। প্রেম।’ ‘হে বাঙ্গালি! প্রেমে ধর হাত মম।’’ একই উপন্যাসে আমরা হিমু ও হুমায়ূন আহমেদের বিস্তৃত পর্যবেক্ষণ শক্তির নমুনা দেখতে পাই। নাগরিক জীবনযাত্রার বদলে যাওয়ার এক অনন্য বর্ণনা আমরা হিমুর মুখে শুনি, ‘‘গাড়ি ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েছে। জ্যামের বাজার শুরু হয়েছে। ফেরিওয়ালারা এক গাড়ির জানালা থেকে আরেক গাড়ির জানালায় যাচ্ছে। তাদের কারণে ভিক্ষুকরা সুযোগ পাচ্ছে না। কনুইয়ে গুঁতো দিয়ে তারা ভিক্ষুক সরাচ্ছে। কেউ হাতে দুটা পাকা পেপে নিয়ে ঘুরছে, কেউ কানকোয় দড়ি বাঁধা কাতল মাছ নিয়ে ঘুরছে। পপকর্নের প্যাকেট নিয়ে বেশ কয়েকজন আছে, এই আইটেমটা মনে হয় চালু। এতো কিছু থাকতে হঠাৎ পপকর্ন আইটেম চালু হয়ে গেলো কেন কে বলবে! ভ্রাম্যমান লাইব্রেরিও আছে। দশ বারোটা পেপারব্যাক বই নিয়ে কয়েকজন ঘুরছে। হ্যারি পটার, জেনারেল মোশাররফের আত্মজীবনী। বিক্রিও হচ্ছে।’’ এই উপন্যাসেই আমাদের পরনির্ভরশীলতা ও রাষ্ট্রীয় দূর্বলতার একটা দিক উঠে আসে। ‘ভিক্ষাবৃত্তিকে আমাদের সমাজে খুব খারাপভাবে দেখা হয় না। আমরা সবাই কোন না কোনভাবে ভিক্ষা করি। আমাদের রাষ্ট্রও ভিক্ষুক রাষ্ট্র। দাতা দেশের ভিক্ষায় আমরা চলি’’ – এই কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে হিমু যেন আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চরিত্রে কষাঘাত হানেন কুশলী প্রহসন শিল্পী হয়ে। প্রবাদ, প্রবচন, ধাঁধাঁ ইত্যাদির ব্যবহার বাংলার লোক সংস্কৃতির অংশ। লক্ষণীয় হিমু সম্পূর্ণ নাগরিক একটি চরিত্র, হিমু সিরিজের প্রতিটি উপন্যাসই নাগরিক প্রেক্ষাপটে রচিত। কিন্তু হিমু উপন্যাসমালায় বহুবার আমরা লোকজ উপাদান ব্যবহৃত হতে দেখি। প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহার হিমু উপন্যাসের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। দরজার ওপাশে উপন্যাসে আছে Ñ ‘‘তোমাদের বাংলায় একটা প্রবচন আছে না Ñ দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো? উল্টা প্রবচনও আছে স্যার Ñ ‘নাই গরুর চেয়ে কানা গরু ভালো।’ অবশ্যি প্রবচনটা একটু অন্যভাবে আছে Ñ নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। মূল ভাব কিন্তু এক।’’ ‘সে আসে ধীরে’ উপন্যাসের শুরুটি উল্লেখ করি Ñ ‘‘আক্কেলগুড়–ম’ নামে বাংলা ভাষায় একটি প্রচলিত বাগধারা আছে। যা দেখে গুড়–ম শব্দে আক্কেল থুবড়ি খেয়ে পড়ে Ñ তাই আক্কেলগুড়–ম। মাজেদা খালাকে দেখে আমার মাথায় নতুন একটা বাগধারা তৈরি হলো Ñ ‘দৃষ্টিগুড়–ম’।’’ উল্লেখিত উদ্ধৃতি দুট থেকেই বোঝা যায় হিমু শুধু প্রবাদ প্রবচন ব্যবহারই করে না, সেগুলোকে নিজস্ব কায়দায় ব্যবহার করে। ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি নাগরিকতা হিমু উপন্যাসমালার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উপন্যাসের নামকরণেও তা লক্ষ করি Ñ ‘তোমাদের এই নগরে’। প্রতিটি উপন্যাসে এই নগর অর্থাৎ ঢাকাকে কেন্দ্র করেই হিমুর পদযাত্রা। মাঝরাতে নগরের পথে পথে পরিক্রমা আর দুপুরে নগরের পার্কের বেঞ্চে ঘুম দেয়া তার অন্যতম বৈশিষ্ট। পারাপার উপন্যাসে হিমু বলছে Ñ ‘‘দুপুরে আমার ঘুমের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে Ñ পার্ক। কখনো সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, কখনো চন্দ্রিমা উদ্যান, কখনো শস্তা দরের কোন মিউনিসিপ্যালটি পার্ক। যখন যেটা হাতের কাছে পাই।’’ এই নগর আর নগরের মানুষদের কেন্দ্র করেই তার চিন্তা প্রসারিত। হিমুর রূপালী রাত্রি উপন্যাসে পথে পথে ইয়াকুবকে খুঁজতে গিয়ে সে নানা জনকে প্রশ্ন করে। ‘‘আচ্ছা নগরীর মানুষ কি বদলে যাচ্ছে? তারা এত সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠছে কেন? সবাই সবাইকে সন্দেহ করছে। আপনার নাম কি ইয়াকুব? এই নির্দোষ প্রশ্নে আতঙ্কে অস্থির হওয়ার মানে কি? আপনার নাম কি গোলাম আযম? এই প্রশ্নে শঙ্কিত হওয়া যায়। এমন প্রশ্ন তো করছি না।’’ একমাত্র ‘হিমুর আছে জল’ উপন্যাসটি নাগরিক প্রেক্ষাপটে রচিত নয়। এই গ্রন্থের ভূমিকা হুমায়ূন লিখছেন Ñ ‘হিমুর পায়ের নিচে সবসময় মাটি থাকে। সে হেঁটে বেড়ায় বিষন্ন ঢাকা নগরীর পথে পথে। আচ্ছা, তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরিয়ে নিলে কেমন হয়? সে থাকুক কিছু সময় পানির উপরে। দেখা যাক তার চিন্তা-ভাবনায় কোন পরিবর্তন আসে কি না!’’ উল্লেখ্য এই উপন্যাসের পুরো ঘটনাটিই ঘটে একটি তিনতলা লঞ্চের মধ্যে। হিমু নিজে কে, কেমন মানুষ তা সুর্নিদিষ্ট নয়। কেননা, সে রহস্যময়। সাধারণ মানুষ নয়, মহামানব বানানোর এক নীরিক্ষার ফসল সে। হিমু প্রচলিত ধারণার বাইরের একটি চরিত্র। সে সংসারে বাস করেও সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা তার চরিত্রে রহস্য, নির্লিপ্ততা এনে দিয়েছে। হিমুর পুরো নাম হিমালয়। আগে পিছে আহমেদ মোহাম্মদ কিচ্ছু নেই। এই নামের কারণে তাকে স্কুলে ভর্তি করতে সমস্যা হয়েছিলো। বাবার মৃত্যুর পর হিমুর দাদা তার নাম রাখে চৌধূরী ইমতিয়াজ টুটুল। কিন্তু হিমু কখনো হিমালয় বা হিমু ছাড়া অন্য কোন নামে পরিচিত হয়নি। একবার শুধু ময়ূরাক্ষী উপন্যাসে তাকে একজন টুটুল বলে ডাকলে সে সাড়া দেয়। এক মেস থেকে আরেক মেসে যাতায়াত করে সে। ঠিকানা নিয়মিত পাল্টায়। চৈত্রের দুপুরে কড়া রোদে হাঁটে সে আবার মাঝরাতেও হাঁটতে পছন্দ করে। প্রায়শই ফুটপাথে বা পার্কের বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়ে সে। সময়ে অসময়ে আত্মীয় কিংবা বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে সে তাদেরকে চমকে দেয়। দরজার ওপাশে উপন্যাসে হিমু বলে, ‘‘দুপুর দুটা, চৈত্র মাসের দুপুর দুটায় কারো বাড়িতে যাবার উৎকৃষ্ট সময় নয়। তারপরেও যাচ্ছি, কারণ অসময়ে মানুষের বাড়িতে উপস্থিত হবার অন্যরকম মজা আছে। আমি অল্প যে-কটি বাড়িতে যাই, ইচ্ছা করে অদ্ভূত অদ্ভূত সময়ে উপস্থিত হই। জহিরদের বাড়িতে একবার রাত দেড়টায় উপস্থিত হলাম।’’ মানুষকে চমকে দিতে ভালবাসে হিমু। সচেতন ভাবেই সে এ কাজটি করে। এ বিষয়ে ‘হিমুর দ্বিতীয় প্রহর’ উপন্যাস থেকে মিসির আলির ব্যাখ্যা গ্রহণ করা যেতে পারে। উল্লেখ্য এটি হিমু সিরিজের এক অনন্য সংযোজন। এটিই একমাত্র উপন্যাস যেখানে হিমু আর মিসির আলি’র সাক্ষাৎ হয়। এ যেন লজিক আর এন্টিলজিকের মুখোমুখি আলাপন। হিমু সম্পর্কে মিসির আলির ভাষ্য, ‘আমার ধারণা আপনি একধরনের ডিলিউশনে ভূগছেন। ডিলিউশন হচ্ছে নিজের সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা। যে-কোনো কারণেই হোক, আপনার ভেতর একটা ধারণা জন্মেছে আপনি সাধুসন্ত-টাইপের মানুষ। আপনার খালি পা, হলুদ পাঞ্জাবি এইসব দেখে তা-ই মনে হচ্ছে। যে-কোনো ডিলিউশন মানুষের মাথায় একবার ঢুকে গেলে তা বাড়তে থাকে। আপনারও বাড়ছে। আপনি নিজে আপনার ভবিষ্যত বলার ক্ষমতা নিয়ে একধরনের অহংকার বোধ করছেন। আপনাকে যতই লোকজন বিশ্বাস করছে আপনার ততই ভালো লাগছে। এখন রাত দুটায় আপনি আমার কাছে এসেছেন Ñ বিশ্বাসীর তালিকা বৃদ্ধির জন্যে। রাত দুটার সময় না এসে আপনি সকাল দশটায় আসতে পারতেন। আসেননি, কারণ যে সাধু সেজে আছে সে যদি সকাল দশটায় আসে তাহলে তার রহস্য থাকে না। রহস্য বজায় রাখার জন্যই আসতে হবে রাত দুটার দিকে। হিমু সাহেব!’’ মিসির আলির এ ব্যাখ্যার সাথে হিমুর অসময়ে চলাফেরা করার অনেকটা যুক্তি হয়তো খুঁজে পাওয়া যায়। ভবিষ্যত বলার ক্ষমতা সত্যিই আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ‘হিমু’ উপন্যাসে সাইকিয়াট্রিস্ট ইরতাজুল করিমকে হিমু বলে, ‘‘আমি ঠিক জানি না। মাঝে মাঝে Ñ যা ভাবি তা হয়ে যায়। সে তো সবারই হয়। আপনারও নিশ্চয়ই হয়?’’ বাদল থেকে শুরু করে হিমুর আশেপাশের অনেকেরই ধারণা হিমু ভবিষ্যত বলতে পারে। একাধিক উপন্যাসে লক্ষ করি হিমুর বলা ভবিষ্যত কাকতালীয়ভাবে মিলে যায়। ‘হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী’ উপন্যাসে হিমু সোনারগাঁ হোটেলের বেকারিতে তানিজা ও এলিতার জন্য কেকের অর্ডার দিয়ে চলে যায়। কেকে লেখা Ñ ‘তানিজা এলিতা হারিয়ে যাওয়া সব সময়ই আনন্দময়।’ হিমুর মধ্যে এই হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারটি প্রবল। তার এবং আত্মীয়-স্বজনের ভাষায় সে প্রায়শই ‘ডুব দেয়’। এক মেস থেকে আরেক মেসে চলে যায় সে, নিয়মিত ঠিকানা বদল করে, যেন কেউ চাইলেও তাকে খুঁজে বের করতে না-পারে। হিমুর বড় ফুপা (বাদলের বাবা) নিয়মিত তাকে টাকা দেন। টাকা দেয়ার শর্ত, সে যেন বাদলকে এড়িয়ে চলে। মাজেদা খালা (বড় খালা), মালেহা খালা, মামারা তাকে প্রায়শই টাকা দেয়। সে কোন চাকরী বা আয় উপার্জন করে না। বোহেমিয়ান ও ভবঘুরে তার চরিত্রের অন্যতম প্রধাণ দিক। বাউন্ডুলে আর রহস্যময় জীবন পার করতেই সে পছন্দ করে। সে যেখানেই যায় সেখানেই কোন না কোন অসম্ভব রূপবতী তরুণীর সঙ্গে তার ভাব হয়। তারা তার প্রেমে পড়ে, কেউ কেউ বিয়ে করতে চায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বিয়েটা হয় না। হিমু প্রায়শই ভবিষ্যত বাণী করে যা মিলে যায়। সে অবশ্য এর কোনটিকে ব্যাখ্যা করে যৌক্তিক কারণে এমনটা ঘটেছে, কোনটিকে বলে, ¯্রফে কাকতালীয় বলে মিলে গেছে। এই তরুণ হলুদ পাঞ্জাবি পরে ঘুড়ে। অধিকাংশ সময়ই এ পাঞ্জাবীর পকেট থাকে না। মাঝে মাঝে গায়ে হলুদ চাদরও থাকে। সে খালি পায়ে থাকে। মাটির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা এর কারণ। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে হিমু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সে এখান থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ালেখা শেষ করে কোন ডিগ্রী নিয়েছে কিনা তার উল্লেখ কোথাও নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে হিমু প্রচুর পড়াশোনা করে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তার প্রচুর জ্ঞান আছে। দরজার ওপাশে উপন্যাসে হিমু আর জহির নদীর বালু খুঁজে তাতে সারা শরীর ঢেকে রাখে, শুধু মাথাটা বের করে রাখে। জহিরকে বোঝানোর জন্য সে জানায়, ‘না, এই আইডিয়া ধার করা। জগদীশচন্দ্র বসু এই জিনিস করতেন। শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িতে যখন বেড়াতে যেতেন তখনি পদ্মার চরে গর্ত খুঁড়ে মাথা বের করে পড়ে থাকতেন। তাঁর ধারণা, এতে শরীরে বায়োকারেন্ট তৈরি হয়। সেই বায়োকারেন্টের অনেক উপকারী দিক আছে।’’ ‘আজ হিমুর বিয়ে’ উপন্যাসে খালু তাকে স্টুপিড, ফাজিল বলে গালি দিলে হিমু বলে, Ñ ‘‘খালু সাহেব, ঝঃঁঢ়রফ শব্দের উৎপত্তি কি আপনি জানেন? সর্বপ্রথম এই শব্দ ব্যবহার করা হয় অ্যাথেন্সবাসীদের প্রতি। সমগ্র অ্যাথেন্সবাসীকেই ঝঃঁঢ়রফ বলা হয়েছিলো কারণ তারা গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে অংশ নেয়নি। চুপ ফাজিল! ফাজিল শব্দের অর্থ জানলে আপনি আমাকে এই গালি দিতেন না। এটা আরবি ভাষার একটি শব্দ। এর অর্থ জ্ঞানী।’’ একই উপন্যাসের অন্যত্র হিমু বলছে, ‘‘পিথাগোরাস বলে গেছেন তিন খুব শক্তিশালী সংখ্যা। তিন-এ আছে আমি, তুমি এবং সর্বশক্তিমান তিনি। সেজন্যেই ত্রিভূবন, ত্রিকাল এবং ত্রিসত্যি। কবুল বলতে হয় তিনবার। তালাক বলতে হয় তিনবার। পৃথিবীর রঙও মাত্র তিনটা। লাল, নীল, হলুদ। বাকী সব রঙ এই তিনের মিশ্রণ।’’ এই সব উদ্ধৃতি থেকে সুষ্পষ্ট গ্রীক দর্শন, সংখ্যাতত্ত্ব, শব্দতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তার পড়াশোনা আছে। একাধিক উপন্যাসে হিমুকে জীবনানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা আওড়াতে দেখা যায়। হিমু চরিত্রে বৈপরীত্য প্রবল। এই বৈপরীত্যও রহস্যময়তা সৃষ্টি করে। হিমু একাদিকে নির্লিপ্ত হতে চেষ্টা করে, জাগতিক সব মায়া মোহ থেকে মুক্ত, অন্যদিকে হিমু ধূমপানের মতো সাধারণ নেশায় আসক্ত। একদিকে হিমু বাবার বর্ণনা ও শিক্ষা অনুযায়ী মহাপুরুষ হবার সাধনায় রত, অন্যদিক থেকে সে পলায়নবাদী, বা¯তব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন। উল্লেখ্য হিমুর মানস গঠনে তার শৈশব বিরাট ভূমিকা রেখেছে। মায়ের মৃত্যু এবং পিতা কর্তৃক মায়ের মৃত্যু তার মধ্যে বিচিত্র মনোবৈকল্য এনে দিয়েছে। হিমু উপন্যাসে নিতু বলে, ‘‘আপনি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলুন। আপনার মধ্যে যে সব অস্বাভাবিকতা আছে Ñ একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট তা দূর করতে পারবে। আপনি অনেক দিন থেকেই মহাপুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করছেন। অভিনয় করতে-করতে আপনার ধারণা হয়েছে আপনি একজন মহাপুরুষ। মনোবৈকল্যের পাশাপাশি হিমু শারীরিকভাবেও দূর্বল। প্রায়শই তাকে নানা অসুখে ধরে। ‘হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী’ উপন্যাসে সে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে হাসপাতালে ভর্তি হয়। তার লাংসে সমস্যা দেখা দেয়। ‘হিমুর দ্বিতীয় প্রহর’ উপন্যাসে সে মাঝরাতে আকস্মিক ভয় পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে, হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। হিমুর প্রায়শই মাথা ব্যথা হয়। তীব্র মাথা ব্যাথা। দরজার ওপাশে উপন্যাসে দেখা যায় মেসের ঠিকা ঝি ময়নার মা তাকে ‘বদ্যি গেরামের একখান তেল’ এনে দিতে চায়। ‘হিমু’ উপন্যাসে সে নিজেই বলে Ñ ‘‘কেন জানি মাথায় ভোঁতা ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে। মেসে ফিরে যাওয়াই ভাল। মাথার এই যন্ত্রণা ইদানিং আমাকে কাবু করে ফেলছে। হালকা ভাবে শুরু হয় Ñ শেষের দিকে ভয়াবহ অবস্থা! এক সময় ইচ্ছা করে কাউকে ডেকে বলি Ñ ভাই, আপনি আমার মাথাটা ছুরি দিয়ে কেটে শরীর থেকে আলাদা করে দিতে পারেন?’’ সন্দেহ নেই হিমু প্রচন্ড বুদ্ধিমান। আপাতত অযৌক্তিক মনে হলেও আসলে সে ভীষণ যুক্তিবাদী। ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসে সে বলে Ñ ‘‘জগৎ মোটেই রহস্যময় নয়। মানুষের মাথাটা রহস্যময়। যা ঘটে মানুষের মাথার মধ্যে ঘটে। মনসুর এসেছিলো আপনার মাথার ভিতর। আমার ধারণা, সে তার পরিবারের ঠিকানা ঠিকই দিয়েছে। আপনার মাথা কীভাবে কীভাবে এই ঠিকানা বের করে ফেলেছে।’’ প্রায়শই সে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। লোকজন মনে করে তার অলৌকিক ক্ষমতা আছে। এ ব্যাপারটি সে সরাসরি স্বীকার করে না। আবার প্রশ্রয়ও দেয়। তার রসবোধ তীব্র। প্রায়শই হিমু অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ‘হিমু’ উপন্যাসে হিমু বলছে, ‘ইয়াদের হাত থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে ইয়াদের বাসায় গিয়ে বসে থাকা। সে বসে থাকবে আমার মেসে, আমি বসে থাকবো তার বাড়িতে। চোর-পুলিশ খেলার ভাল স্ট্র্যাটেজি আর হয় না। ফুল প্রুফ।’ফাজলামি করে বা উল্টোপাল্টা কথা বলে সে মানুষকে বিভ্রান্ত বা বিরক্ত করে দেয়। পারাপার উপন্যাসে হিমু বলে ‘‘আমি হাসলাম। আমার স্টকে অনেক ধরনের হাসি আছে। এরমধ্যে একটা ধরণ হলো Ñ মানুষকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে দেয়া হাসি।’’ ‘হিমু’ উপন্যাসের শুরুতেই সদ্য পরিচিতি এষাকে সে ভড়কে দেয় পাঞ্জাবির পকেট থেকে ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট বের করে দিয়ে। হিমু হলুদ পাঞ্জাবি পরে, কখনো তাতে পকেট থাকে, কখনো থাকে না। ‘এবং হিমু’ উপন্যাস থেকে জানতে পাই Ñ ‘‘পকেটহীন এই পাঞ্জাবি আমাকে রূপা কিনে দিয়েছে। খুব বাহারি জিনিস। পিওর সিল্ক। খোলা গলা, গলার কাছে সূক্ষè সুতার কাজ। সমস্যা একটাই Ñ পকেট নেই। পাঞ্জাবীর এই বিরাট ত্রুটির দিকে রূপার দৃষ্টি ফেরাতেই সে বললো, পকেটের তোমার দরকার কী!’’ আবার ‘একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা’ উপন্যাসে দেখি Ñ ‘‘আমি পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলাম। পকেটবিহীন পাঞ্জাবিগুলিতে আমি এখন বিরাট বিরাট পকেট লাগিয়েছি। যখন চলাফেরা করি পকেট ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে চলাফেরা করি।’’ হিমু খালি পায়ে হাটে। কিন্তু হিমুর চেহারার তেমন কোন বর্ননা উপন্যাসে নেই। তোমাদের এই নগরে উপন্যাসে আশা হিমুকে বলে, ‘আচ্ছা হিমু সাহেব শুনুন, কেউ কি আপনাকে বলেছে আপনার চোখ খুব সুন্দর?’’ পুরুষ মানুষের এত সুন্দর চোখ এর আগে আশা দেখেনি বলে আশা জানায়। হিমুর চোখ সুন্দর। মাজেদা খালা হিমুকে স্যুট-টাই পরিয়ে তাকে সুন্দর বলেছে। কিন্তু হিমুর চেহারার বর্ণনা কোথাও নেই। ‘হিমুর বাবার কথামালা’ গ্রন্থে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন Ñ ‘‘চরিত্রের চেহারা বর্ণনা সাধারণত আমি করি না। দায়িত্ব পাঠকের ছেড়ে দেই, তাদেরকে চেহারা কল্পনা করে নিতে দেই।’’ হিমু নিজেকে অবশ্য ‘কেউ না’ বলে উল্লেখ করে। হিমু উপন্যাসে বলা আছে Ñ ‘‘আমি কথা বলি না। চোখ বন্ধ করে ফেলি Ñ আবারও তলিয়ে যাই গভীর ঘুমে। ঘুমের ভিতরই একটা বিশাল আম গাছ দেখতে পাই। সে গাছের পাতায় ফোঁটা-ফোঁটা জোছনা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে। হাত ধরাধরি করে দুজন হাঁটছে গাছের নীচে। মানব ও মানবী। এরা কারা? কী ওদের পরিচয়? দুজনকেই খুব পরিচিত মনে হয়। কোথাও যেন দেখেছি! আবার মনে হয় Ñ না তো, এদের তো কোনদিন দেখিনি। অনেক দূর থেকে চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসে। আমি চমকে ওঠে বলি Ñ কে আপনি? কে? ভারী গম্ভীর গলায় উত্তর আসে : আমি কেউ না, ও ধস হড়নড়ফু.’’ ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসেও মারিয়া যখন জানতে চায় আপনি কে। হিমু বলে, ‘‘মারিয়া, আমি কেউ না। ও ধস হড়নড়ফু.’’ হুমায়ূন সাহিত্যের অন্যতম একটি দিক রসবোধ। উচ্চ মানের রসবোধ দিয়ে তিনি পাঠকের হৃদয় জয় করেছেন অকাতরে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় হিমু উপন্যাসমালাতে। হিমুর রসবোধ অত্যন্ত প্রবল। ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি Ñ ‘‘এরকম রূপবতী একজন তরুণীর সামনে আমি ছেঁড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যে-কোন সময় কাঁথা গা থেকে পিছলে নেমে আসবে বলে একহাতে কাঁথা সামলাতে হচ্ছে, অন্য হাতে লুঙ্গি। তাড়াহুড়া করে বিছানা থেকে নেমেছি বলে লুঙ্গির গিঁট ভালমতো দেয়া হয়নি। লুঙ্গি খুলে নিচে নেমে এলে ভয়াবহ ব্যাপার হবে Ñ আধুনিক ছোটগল্প। গল্পের শিরোনাম Ñ নাঙ্গু বাবা ও রূপবতী মারিয়া।’’ ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’ উপন্যাসের উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে Ñ ‘‘মহিলা সমিতিতে কারা যেন নতুন নাটক নামিয়েছে Ñ ‘পবনবাবুর শেষ খায়েশ’। মন্দ কী? সব মানুষের শেষ খায়েশ বলে একটা ব্যাপার। পবনবাবুর শেষ খায়েশ থাকতে পারে।’’ হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম উপন্যাসে অন্য রকম হিমুকে দেখতে পাই। উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে যথাবিহিত হিমু হাঁটা শুরু করে। তার সঙ্গী হয়, পথের একটি কুকুর। হিমু বলে, ‘‘তুই যে আমার সঙ্গে আসছিস আমার খুব ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে খুব একা লাগে, বুঝলি? আমার সঙ্গে কী আছে জানিস? পদ্ম-নীলপদ্ম! পাঁচটা নীলপদ্ম নিয়ে ঘুরছি। কী অপূর্ব পদ্ম! কাউকে দিতে পারছি না। দেয়া সম্ভব নয়। হিমুরা কাউকে নীলপদ্ম দিতে পারে না। চৈত্রের রোদ বাড়ছে। রোদটাকে আমি জোছনা বানানোর চেষ্টা করছি। বানানো খুব সহজ Ñ শুধু ভাবতে হবে Ñ আজ গৃহত্যাগী জোছনা উঠেছে Ñ চারিদিকে জোছনা থৈ থৈ করছে। ভাবতে ভাবতেই এক সময় রোদটাকে জোছনার মতো মনে হতে থাকবে। আজ অনেক চেষ্টা করেও তা পারছি না। ক্লান্তিহীন হাঁটা হেঁটেই যাচ্ছি Ñ হেঁটেই যাচ্ছি।’’ এই উপন্যাসে আমরা দেখি মায়া ও ভালবাসাকে এড়িয়ে যাওয়া হিমু ক্ষণিকের জন্য হলেও মারিয়ার জন্য তীব্র টান অনুভব করে। হিমুর ভেতরের ভালবাসা-কাঙাল তরুণটি এখানে প্রকাশিত হয় Ñ ‘‘মারিয়ার গলা ধরে এসেছে। সে আবার মাথা নিচু করে ফেলেছে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমার ভেতর একধরনের বিভ্রম তৈরি হলো। মনে হলো আমার আর হাঁটার প্রয়োজন নেই। মহাপুরুষ না, সাধারণ মানুষ হয়ে মমতাময়ী এই তরুণীটির পাশে এসে বসি। যে-নীলপদ্ম হাতে নিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম, সেই পদ্মগুলি তার হাতে তুলে দিই। তার পরই মনে হলো Ñ এ আমি কী করতে যাচ্ছি! আমি হিমু – হিমাালয়।’’ হলুদ হিমু কালো র্যাব উপন্যাসে হিমু র্যাবের এক অফিসারের সন্তান শুভ্রকে দেখে মমতায় আপ্লুত হয়। ‘‘কাউকে মা ডাকা বা বাবা ডাকা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। এই প্রথম নিয়মের ব্যতিক্রম করে শুভ্র’র কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘না রে বাবা, যুক্তি শেষ কথা না। যুক্তি হলো শুরুর কথা।’’ এন্টিলজিকের জগতের বাসিন্দা হিমু আবেগ তাড়িত হবে এটাই স্বাভাবিক। একাধিক উপন্যাসেই মহাপুরুষ হতে চাওয়া হিমুকে মানুষের প্রতি মায়া ও মমতায় ঘণিভ’ত হতে দেখি। হিমুর শৈশব ও মানস গঠনে তার বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তিনি পুত্রকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। এইজন্য নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, আলাদা খাতায় বাণী লিখে গেছেন। হিমুর বাবার বিখ্যাত বাণী ভরা খাতার কথা জানা যায় দরজার ওপাশে উপন্যাসে। ‘‘চামড়ায় বাঁধানো তিনশ একুশ পৃষ্ঠার একটা খাতায় তিনি এইসব বাণী মুক্তার মতো গোটা গোটা হরফে লিখে রেখে গেছেন। পুরো খাতাটাই হয়তো ভরে ফেলার ইচ্ছা ছিল। সময় পাননি। মাত্র চারদিনের নোটিশে তাঁকে পৃথিবী ছাড়তে হলো। জ্বর হলো। জ্বরের চতুর্থ দিনে বিস্ময় এবং দুঃখ নিয়ে তাকে বিদায় নিতে হলো। আমাকে হতাশ গলায় বললেন, ‘আসল কথা তোকে কিছুই বলা হলো না। অল্পকিছু লিখেছি Ñ এতে কিছুই হবে না।’ তিনি আঠারো পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখেছিলেন।’’ হিমু উপন্যাসে নিতুর অনুরোধে হিমু সাইকিয়াট্রিস্ট ইরতাজুল করিমের কাছে যায়। তাকে বলে, ‘‘ডাক্তার সাহেব, আমার বাবা ছিলেন একজন অসুস্থ মানুষ। সাইকোপ্যাথ। এবং আমার ধারণা খুব খারাপ ধরনের সাইকোপ্যাথ। তাঁর মাথায় কী করে যেন ঢুকে গেলো Ñ মহাপুরুষ তৈরি করা যায়। যথাযথ ট্রেনিং দিয়েই তা করা সম্ভব। তাঁর যুক্তি হচ্ছে Ñ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাকাত, খুনি যদি শিক্ষা এবং ট্রেনিঙে তৈরি করা যায়, তাহলে মহাপুরুষ কেন তৈরি করা যাবে না? অসুস্থ মানুষদের চিন্তা হয় সিঙ্গেল ট্র্যাকে। তার চিন্তা সে রকম হলো Ñ তিনি মহাপুরুষ তৈরির খেলায় নামলেন। আমি হলাম তার একমাত্র ছাত্র। তিনি এগুলেন খুব ঠা-া মাথায়। তাঁর ধারণা হলো, আমার মা বেঁচে থাকলে তিনি তাকে এ জাতীয় ট্রেনিং দিতে দেবেন না Ñ কাজেই তিনি মাকে সরিয়ে দিলেন।’’ মহাপুরুষ তৈরি করার কারিগর হতে চেয়েছিলেন হিমুর বাবা। বাবার সম্পর্কে হিমুর প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ধরণের। বাবা মারা গেলেও তার প্রতিটি আদেশ সে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। হিমু বিষয়ক প্রায় প্রতিটি উপন্যাসেই হিমুর বাবার প্রসঙ্গে এসেছে। ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসে বাবার প্রতি হিমুর অনুরাগ লক্ষ করা যায়, ‘‘আমার বাবা কি আসলেই অপ্রকৃতিস্থ? কাদের আমরা প্রকৃতিস্থ বলবো? যাদের চিন্তা-ভাবনা স্বাভাবিক পথে চলে তাদের? যারা একটু অন্যভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাদের আমরা আলাদা করে ফেলি Ñ তা কি ঠিক? আমার বাবা তার পুত্রকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছার কথা শোনামাত্রই আমরা তাকে উন্মাদ হিসাবে আলাদা করে ফেলেছি। কোন বাবা যদি বলেন, আমি আমার ছেলে বড় ডাক্তার বানাবো তখন আমরা হাসি না, কারণ তিনি চেনা পথে হাঁটছেন। আমার বাবা তার সমগ্র জীবনে হেঁটেছেন অচেনা পথে। আমি সেই পথ কখনো অস্বীকার করিনি।’’ আঙুল কাটা জগলু উপন্যাসে জগলুকে হিমু জানায়, ‘আপনি শুনলে অবাক হবেন আমার বাবা আপনার মতোই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন।’’ হিমুর শৈশবেই বাবার মৃত্যু হলেও তার বেড়ে ওঠা ও জীবন যাত্রায় বাবার প্রভাব সর্বাধিক। বাবার অনুপস্থিতিতে মামারাই হিমুর দেখা শোনার দায়িত্ব পায়। হিমুর জীবন যাত্রা মামাদের প্রভাবও প্রবল। ‘দরজার ওপাশে’ উপন্যাসে হিমুর মামাদের সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানা যায়। ‘আমার বড় মামা নিজে খুন হয়েছিলেন। কিছু লোকজন মাছ মারার বড় থোর দিয়ে তাঁকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলেছিল। এই অবস্থাতেও তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ডেথ বে কনফেশন করে চারজন নির্দোষ মানুষকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেলেন। বললেন এরাই তাকে মেরেছে। ডেথ বেড কনফেশনের কারণে ঐ চারজনের যাবজ্জীবন হয়ে গেছে।’’ ‘‘আমার মেজোমামা গোটা পাঁচেক খুন করেছেন। অতি ধুরন্ধর ব্যক্তি। তাকে কেউ ফাঁসাতে পারেনি। বহাল তবিয়তে এখনো বেঁচে আছেন Ñ সত্তরের উপর বয়স। চোখে দেখতে পান না। কেউ কাছে গিয়ে বসলে খুনের গল্প করেন। এই গল্প বলতে পারলে খুব আনন্দ পান। তাঁর কাছ থেকেই শুনেছি মানুষ জবেহ করলে কণ্ঠনালী দিয়ে ফুস করে গরম বাতাস বের হয়।’’ ‘দরজার ওপাশে’ উপন্যাসেই দেখি হিমুর একটি মাত্র চিঠি ছোট মামা তার সব কাজ কর্ম ফেলে কীভাবে ছুটে আসেন। পিশাচ শ্রেণীর এই মামারা হিমুর প্রতি প্রবল দরদ দেখিয়েছেন। হিমুর ফুপাত ভাই বাদল। মহাপুরুষদের একাধিক শিষ্য থাকে। হিমুরও আছে। তবে তার প্রধাণ শিষ্য বা অনুচর হলো বাদল। প্রথম উপন্যাস ময়ূরাক্ষীতে আছে Ñ ‘বড়ফুপুর বাসায় দুপুরে যাবার কথা। উপস্থিত হলাম রাত আটটায়। কেউ অবাক হলো না। ফুপুর বড় ছেলে বাদল আমাকে দেখে উল্লসিত গলায় বলল, হিমুদা এসেছে? থ্যাংকস। অনেক কথা আছে, আজ থাকবে কিন্তু। আই নিড ইউর হেল্প। বাদল এবার ইন্টারমিডিয়েট দেবে। এর আগেও তিনবার দিয়েছে সে পড়াশোনায় খুবই ভালো। এস.এস.সি-তে বেশ কয়েকটা লেটার এবং স্টার মার্কস পেয়েছে। সমস্যা হয়েছে ইন্টারমিডিয়েটে। পরীক্ষা শেষ পর্যন্ত দিতে পারে না। মাঝামাঝি জায়গায় একধরণের নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে যায়। তার কাছে মনে হয় পরীক্ষার হল হঠাৎ ছোট হতে শুরু করেছে। ঘরটা ছোট হয়। পরীক্ষার্থীরাও ছোট হয়। চেয়ার-টেবিল সব ছোট হতে থাকে। তখন সে ভয়ে চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে আসামাত্রই দেখে সব স্বাভাবিক। তখন সে আর পরীক্ষার হলে ঢোকে না। চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি চলে আসে।’’ বাদল প্রায়শই নানা ঝামেলা করে। সে হিমুর মতো জোছনা দেখতে চায়, নিজেকে জানতে চায়। একাধিক উপন্যাসে নানা সমস্যা থেকে বাদলকে একমাত্র হিমুই উদ্ধার করতে পারে। বাদলের প্রতি হিমুর ¯েœহ প্রবল। সুদর্শন এই ছেলেটির প্রতি হিমুর মায়া বোঝা যায় ‘ হিমুর দ্বিতীয় প্রহর’ উপন্যাসে Ñ ‘‘বাদলের চেহারা খুব সুন্দর। আজ এই সকালের আলোতে তাকে আরও সুন্দর লাগছে। ক্রিম কালারের এই শার্টটা তাকে খুব মানিয়েছে।’’ হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম উপন্যাসে উল্লেখ আছে, ‘‘বাদল শুধু যে বুদ্ধিমান ছেলে তা না, বেশ বুদ্ধিমান ছেলে। মারিয়ার সাংকেতিক চিঠির পাঠোদ্বার করতে তার তিন মিনিট লেগেছে। এই ছেলে আমার সম্পর্কে এমন ধারণা করে কী করে আমি জানি না। আমি যদি হিমু-ধর্ম নতুন কোন ধর্ম প্রচার শুরু করি তাহলে অবশ্যই সে হবে আমার প্রথম শিষ্য। এবং এই ধর্ম প্রচারের জন্যে সে হবে প্রথম শহীদ।’’ হিমুর বান্ধবী এবং প্রেমিকা এবং ভালবাসার মানুষ রূপা। হিমু যে কোন সমস্যায় পড়লে তার সাথে যোগাযোগ করে। রূপাকে সে নীল শাড়ি পরে অপেক্ষা করতে বলে। কিন্তু কখনো তার সামনে যায় না। একসাথে জোছনা দেখতে যাওয়ার কথা বলেও যায় না। পারাপার উপন্যাসে জানতে পারি, রূপার বাড়ি পুরানা পল্টন। এই উপন্যাসে হিমু একজন নিষ্পাপ মানুষ খুঁজতে বের হয়। রূপা প্রসঙ্গে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে Ñ ‘‘আমি ক্লিনিকে ঢুকলাম। লবিেেত রূপা বসে আছে। শুধু একটি মাত্র মেয়ের কারণে পুরো লবি আলো হয়ে আছে। মানুষের শরীর হলো তার মনের আয়না। একজন পবিত্র মানুষের পবিত্রতা তার শরীরে অবশ্যই পড়বে। সে হবে আলোর মতো। আলো যেমন চারপাশকে আলোকিত করে, একজন পবিত্র মানুষও তার চারপাশের মানুষদের আলোকিত করে তুলবে।’’ হিমু সিরিজের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র মাজেদা খালা। বড় খালা বা মাজেদা খালা সম্পর্কে চলে যায় বসন্তের দিন উপন্যাসে হিমুর বক্তব্য, ‘দড়ি দেখলে যারা সাপ মনে করে তিনি তাদের চেয়েও দুই ডিগ্রী ওপরে Ñ যে-কোনো লম্বা সাইজের জিনিস দেখলেই তিনি সাপ মনে করেন। কাছে গিয়ে দেখবেনও না Ñ সাপ কি-না। দূর থেকেই চিৎকার চেঁচামেচি Ñ ওমাগো, দোতলায় সাপ এলো কীভাবে?” এই মাজেদা খালা প্রায়শই তাকে মহাবিপদে আছেন বলে চিঠি দেন, চিঠির সঙ্গে পাঁচশ টাকার নোট স্ট্যপাল করা থাকে। আজ হিমুর বিয়ে উপন্যাসের শুরুতেই আছে Ñ ‘মাজেদা খালাকে আপনাদের মনে আছেতো? কঠিন মহিলা। ইংরেজিতে এই ধরণের মহিলাদের বলে ঐধৎফ ঘঁঃ. কঠিন বাদাম। কঠিন বাদাম জাতীয় মানুষদের মাথায় কিছু ঢুকে গেলে বের হয় না। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। মাজেদা খালার মাথায় এখন ‘বিবাহ’ ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি আমাকে বিয়ে দেবার মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন। ভোরবেলাতেই টেলিফোন। তাঁর উত্তেজিত গলা।’’ হুমায়ূন আহমেদ হিমু সমগ্রের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন, ‘হিমুর মাজেদা খালা এক বই-এ হয়ে গেলো মাজেদা ফুপু।’ বাদলের বাবা অর্থাৎ বড় ফুপাকেও একাধিক উপন্যাসে পাওয়া যায়। তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার ছাদে মদের আসর বসান। হিমুকে দেখতে পারেন না, কিন্তু মদ খেলেই ব্যবহার মধুর হয়ে যায়। দরজার ওপাশে উপন্যাসে হিমু বলেÑ ‘বড় ফুপা ঘোষণা করে দিয়েছেন, আমাকে যেন তাঁর বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয়া না হয়। আমি একটি পাবলিক ন্যুইসেন্স। আমার আসল স্থান Ñ মানসিক রুগীদের জন্যে নির্ধারিত কোন হোম। হোমে জায়গা পাওয়া না গেলে সেকেন্ড চয়েস, মীরপুর চিড়িয়াখানা। আমার ফুপু তাঁর স্বামীর কোনো বক্তব্যের সঙ্গে একমত হন না, শুধু এই বক্তব্যে একমত। ফুপার বাড়িতে তারপরও মাসে দুমাসে একবার যাই। ফুপার দুই ছেলেমেয়ে বাদল এবং রিনকি Ñ এই দুইজনের কারণে। দুজনই আমার মহাভক্ত।’’ ময়ূরাক্ষী উপন্যাসে হিমু বলছে, ‘আমার বড়ফুপা ঘোর নাস্তিক ধরনের মানুষ এবং বেশ ভালো ডাক্তার।’’ বড় ফুপা, মাজেদা খালা, বাদল, রূপা, হিমুর বাবা ও মামাদের নিয়েই হিমুর বেঁচে থাকা। একাধিক উপন্যাসেই তারা হিমুর সহযাত্রী হয়। হিমুর পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ এদেরকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা চরিত্রে রূপ দিয়েছেন। হিমু এবং তার আশেপাশের মানুষদের নিয়ে তৈরি হয়েছে প্রচলিত ধারার বাইরের এক ভিন্ন জগত। সেই জগতের তীব্র মায়া আমাদের টানে। হুমায়ূন আহমেদ তার হিমু সমগ্রের প্রথম খন্ডের ভূমিকা বলেছিলেন, ‘হিমুকে নিয়ে কতগুলি বই লিখেছি নিজেও জানি না। মন মেজাজ খারাপ থাকলেই হিমু লিখতে বসি। মন ঠিক হয়ে যায়। বেশি লেখার ফল সব সময় শুভ হয় না। আমার ক্ষেত্রেও হয়নি। অনেক জায়গাতেই ল্যাজে গোবরে করে ফেলেছি। হিমুর পাঞ্জাবির পকেট থাকে না অথচ একটা বই-এ লিখেছি সে পকেট থেকে টাকা বের করল। হিমুর মাজেদা খালা এক বই-এ হয়ে গেলো মাজেদা ফুরু। তবে হিমু যে ঠিক আছে তাতেই আমি খুশি। হিমু ঠিক আছে, হিমুর জগৎ ঠিক আছে। তার বয়স বাড়ছে না। সে বদলাচ্ছে না। এই আনন্দ সংবাদ দিয়ে ভ’মিকা শেষ করছি।’’ পাঠকের জন্য বেদনার সংবাদ তারা আর নতুন করে চির তরুণ হিমুকে পাবে না। এই বেদনা সংবাদ দিয়েই শেষ করছি। কালক্রমিক ভাবে হুমায়ূন আহমেদের হিমু উপন্যাসের প্রকাশকাল নি¤œরূপ : ১. ময়ূরাক্ষী, অনন্যা, মে ১৯৯০ ২. দরজার ওপাশে, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২ ৩. হিমু, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৩ ৪. পারপার (১৯৯৪) ৫. এবং হিমু, সময়, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ ৬. হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম, দিব্যপ্রকাশ, এপ্রিল ১৯৯৬ ৭. হিমুর দ্বিতীয় প্রহর, কাকলী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ ৮. হিমুর রূপালী রাত্রি জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, অক্টোবর ১৯৯৮ ৯. একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁঝিঁপোকা, পার্ল পাবলিকেশন, মে ১৯৯৯ ১০. তোমাদের এই নগরে, অনন্যা, ফেব্রুয়ারি ২০০০ ১১. চলে যায় বসন্তের দিন, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০২ ১২. সে আসে ধীরে, অন্যপ্রকাশ, ২০০৩ ১৩. হিমু মামা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ফেব্রুয়ারি ২০০৪, শিশুতোষ ১৪. আঙুল কাটা জগলু, কাকলী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০০৫ ১৫. হলুদ হিমু কালো র্যাব, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৬ ১৬. আজ হিমুর বিয়ে, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৭ ১৭. হিমু রিমান্ডে, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৮ ১৮. হিমুর মধ্যদুপুর, অন্বেষা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ১৯. হিমুর নীল জোছনা, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১০ ২০. হিমুর আছে জল, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১১ ২১. হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০১১ ২২. হিমু এবং হাভার্ড চয.উ. বল্টু ভাই, অন্যপ্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১২ হিমু প্রসঙ্গে অন্যান্য গ্রন্থ ১. হিমুর বাবার কথামালা, অন্বেষা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ ২. হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার, গল্পগ্রন্থ, অন্বেষা প্রকাশন, অক্টোবর, ২০০৮ লক্ষণীয় ১৯৯০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর হুমায়ূন আহমেদ হিমুকে নিয়ে একটি করে উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন (এরমধ্যে কেবল ১৯৯১, ২০০১ ব্যতিক্রম)। ২০১১ সালে তিনি হিমুকে নিয়ে দুটি উপন্যাস লিখেছেন। এ বিষয়ে ‘হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী’ উপন্যাসের ভূমিকা লক্ষ্যনীয় Ñ ‘‘আমাদের কালচারে অনুরোধে ঢেঁকি গেলার ব্যাপারটা আছে। লেখালেখি জীবনের শুরুতে প্রচুর ঢেঁকি গিলেছি। শেষের দিকে এসে রাইস মিল গেলা শুরু করেছি। ‘হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী’ তার উদাহরণ। বৎসরে আমি একটাই হিমু লিখি। বিশ্বকাপ বাংলাদেশে হচ্ছে বলে দু’জন হিমু। একজন মাঠে বসে খেলা দেখবে অন্যজন পথে পথে হাঁটবে।’’
১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:১৭
মুম রহমান বলেছেন: উপপাদ্য, আমি আপু না, ভাইয়া, স্যরি!
২| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১১:২৫
দৈববানী বলেছেন: খুব খুব ভাল লাগলো.......................
++++++++++++++++++++++++++++++++++
৩| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৪২
হৃদয় রিয়াজ বলেছেন: "উপপাদ্য বলেছেন: আপু বেশী লম্বা হয়ে গেছে।
ভাগ ভাগ করে কিংবা পয়েন্ট আকারে দিলে ভালো হতো।
অথবা পর্ব পর্ব করে।
পোস্ট ভালো লেগেছে।
অনেক ধন্যবাদ।"
স্ক্রল করে শেষ করতে পারছি না। দেখেই ভয় লাগছে
৪| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:১২
শাহিন বলেছেন: লিখাটা খুবই সুন্দর হয়েছে তবে, উপপাদ্য এর সাথে সহমত ।
৫| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:১২
পরাজিত মধ্যবিত্তের একজন বলেছেন: সাহিত্যিকের মৃতু্য এবং আমাদের গদগদে আবেগ। পড়ার আহবান জানাই
Click This Link
৬| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৩
মামুন রশিদ বলেছেন: চমৎকার লাগলো হিমু বিশ্লেষণ! জনপ্রিয় চরিত্র হিমুকে নিয়ে আগে এরকম মৌলিক বিশ্লেষণ হয়েছে কিনা জানা নাই ।
একজন হিমুর চেয়েও আমাদের অনেক বেশি দরকার যুক্তিশীল মিসির আলি ।
চমৎকার পোস্টে ভালোলাগা জানবি দোস্ত ।
৭| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:২২
উপপাদ্য বলেছেন: দুঃখিত। ভাইয়া।
৮| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৩১
নাজমুল হাসান মজুমদার বলেছেন: হিমু ..।.।.।.।.।.।.।.।.।.।
৯| ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:০৫
পরাজিত মধ্যবিত্তের একজন বলেছেন: গদগদে আবেগে লেখা। শীর্ষেন্দুর কাগজের বউ পড়েছেন? তাহলে বুঝতেন হিমু চরিত্রটি কোত্থেকে এসেছে
পড়ার আহবান জানাই
সাহিত্যিকের মৃতু্য এবং আমাদের গদগদে আবেগ
Click This Link
১৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৫১
মুম রহমান বলেছেন: কাগেজর বউ পড়েছি, আপনার লেখাটি পড়লাম। তবে একমত নই। কেন একমত নই, তা জানতে হলে আমার আরো লেখা আপনার পড়তে হবে। ব্লগেই আছে, সময় পেলে পড়তে পারেন। ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ৮:৩৪
উপপাদ্য বলেছেন: আপু বেশী লম্বা হয়ে গেছে।
ভাগ ভাগ করে কিংবা পয়েন্ট আকারে দিলে ভালো হতো।
অথবা পর্ব পর্ব করে।
পোস্ট ভালো লেগেছে।
অনেক ধন্যবাদ।