![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পেশাদার ও নেশাদার লেখক, মাঝে মাঝে কবি
লেখার অপেক্ষা রাখে না, হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট চরিত্র সমূহের মধ্যে হিমু সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং জনপ্রিয় চরিত্র। অন্যদিকে হিমুকে নিয়ে রহস্য আর অলৌকিততারও শেষ নেই। লেখক নিজেই এই রহস্যময়তা সচেতনভাবেই রেখেছেন বলে মনে হয়। এক অর্থে হিমুকে আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় ‘আউটসাইডার’ মনে হয়। এই আগুন্তুক চারপাশের বস্তুতান্ত্রিকতা, বাস্তবতাকে শুধু অষ¦ীকারই করে না, ক্ষেত্রবিশেষে চ্যালেঞ্জও করে।
প্রচলিথ নিয়ম মানা, ‘চলো নিয়ম মতে’ রীতিতে চলা হিমুর ধাচে নেই। তার বয়সের প্রতিটি নাগরিক তরুণ যখন ক্যারিয়ার আর কর্পোরেট স্বপ্নে বিহ্বল, হিমু তখন নেহাতই পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে, খালি পায়ে হাটা এক পরিব্রাজক। ‘হিমু’ উপন্যাসে নিজেকে সে পরিচয় দেয় ‘আমি একজন পরিব্রাজক।’ তাকে বেকার বললেও সে বলে, ঘুরে বেড়ানো তার কাজ। আবার ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসেও মারিয়া যখন জানতে চায় আপনি কে। হিমু বলে, ‘‘মারিয়া, আমি কেউ না। I am nobody.’’ আমরা সবাই যখন কেউ একটা কিছু হয়ে ওঠার কেউকেটা প্রতিযোগিতায় উদগ্রীব হিমু তখন নিজেকে কেউ না বলে সুখী হয়।
হয়তো অনুমান শক্তি, হয়তো ইএসপি কিংবা তীব্র যৌক্তিক ব্যাখ্যার সূত্র ধরেই হিমু অনেক সময়ই অনেক তাক লাগানো কা- করে ফেলে। তার চারপাশের অনেকেই তাকে অলৌকিক কিছু মনে করে। ধর্মপ্রচারকের মতো তারও রয়েছে ভক্তকুল। কিন্ত নিজেকে হিমু কখনোই মহাপুরুষ দাবী করে না, অলৌকিক কোন কিছু করা সম্ভব বলেও দাবী করে না। আবার কখনো বা কিছু রহস্য সে ইচ্ছা করেই রেখে দেয়। সব মিলিয়ে এটুকু নিশ্চিতই সমকালের সমবয়সী তরুণদের সাথে হিমুর ফারাকটা অনেক বেশি। হয়তো এই কারণেই সমকালের তরুণ সমাজের কাছে হিমু এক আইকন। মাসুদ রানা’র পরে এ দেশের তরুণদের সামনে হিমু যথার্থ অনুসরনীয় আদর্শ চরিত্র। মনে মনে প্রতিটি তরুণ, মানুষের ভাল করতে চায়, জোছনা, বৃষ্টি কিংবা রূপার মতো অধরা কোন সুন্দরীকে নিয়ে জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখে। অথচ জীবনের পারিপার্শ্বিক চাপে তা পারে না। হিমু পারে। নিজেদের এই না-পারাটা যার মধ্যে অবলীলায় ঘটতে দেখে পাঠক তো তাকেই নিজের আদর্শ করে নেবেই। তাই হিমু স্বপ্নের, অলীক জগতের চরিত্র হয়েও তরুণদের কাঙ্খিত চরিত্র হয়ে ওঠে। হুমায়ূন আহমেদ তার হিমু সিরিজের ‘পারাপার’ উপন্যাসে যথার্থই বলেন, ‘পৃথিবীর সব নারীই রূপা এবং সব পুরুষই হিমু।’
সাহিত্যের জটিল রীতি-কাঠামো আর বড় বড় তত্ত্বের ধার ধারে না হুমায়ূন আহমেদ। সরল আবেশে তিনি হিমুকে তৈরি করেন মহাপুরুষ হিসাবে। হিমুর বাবা চেয়েছিলো হিমুকে মহাপুরুষ বানাতে। সেই চাওয়া এবং হওয়ার প্রক্রিয়াটিও স্বাভাবিক নয়। ‘হিমু’ উপন্যাসে হিমু নিজেই মনোবিশেষজ্ঞ ইরতাজুল করিমের সামনে স্বীকারোক্তি করে, ‘‘ডাক্তার সাহেব, আমার বাবা ছিলেন একজন অসুস্থ মানুষ। সাইকোপ্যাথ। এবং আমার ধারণা খুব খারাপ ধরনের সাইকোপ্যাথ। তাঁর মাথায় কী করে যেন ঢুকে গেলো Ñ মহাপুরুষ তৈরি করা যায়। যথাযথ ট্রেনিং দিয়েই তা করা সম্ভব। তাঁর যুক্তি হে ছ Ñ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডাকাত, খুনি যদি শিক্ষা এবং ট্রেনিঙে তৈরি করা যায়, তাহলে মহাপুরুষ কেন তৈরি করা যাবে না? অসুস্থ মানুষদের চিন্তা হয় সিঙ্গেল ট্র্যাকে। তার চিন্তা সে রকম হলো Ñ তিনি মহাপুরুষ তৈরির খেলায় নামলেন। আমি হলাম তার একমাত্র ছাত্র। তিনি এগুলেন খুব ঠা-া মাথায়। তাঁর ধারণা হলো, আমার মা বেঁচে থাকলে তিনি তাকে এ জাতীয় ট্রেনিং দিতে দেবেন না Ñ কাজেই তিনি মাকে সরিয়ে দিলেন।’’ কিন্তু এই হিমু তার বাবার ধারণা ও শিক্ষাকেই ধারণ করে চলে। ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসে সে বলে, ‘‘আমার বাবা কি আসলেই অপ্রকৃতিস্থ? কাদের আমরা প্রকৃতিস্থ বলবো? যাদের চিন্তা-ভাবনা স্বাভাবিক পথে চলে তাদের? যারা একটু অন্যভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাদের আমরা আলাদা করে ফেলি Ñ তা কি ঠিক? আমার বাবা তার পুত্রকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন। তার ই ছার কথা শোনামাত্রই আমরা তাকে উন্মাদ হিসাবে আলাদা করে ফেলেছি। কোন বাবা যদি বলেন, আমি আমার ছেলে বড় ডাক্তার বানাবো তখন আমরা হাসি না, কারণ তিনি চেনা পথে হাঁটছেন। আমার বাবা তার সমগ্র জীবনে হেঁটেছেন অচেনা পথে। আমি সেই পথ কখনো অস্বীকার করিনি।’’ আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি হিমু তার বাবার দেখানো অচেনা পথেই হেটে চলেছেন। হিমুকে নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ময়ুরাক্ষী’-তে হিমু বলে, ‘‘আমি মহাপুরুষ নই। কিন্তু এই ভ’মিকায় অভিনয় করতে আমার বড় ভাল লাগে। মাঝে মাঝে এই ভ’মিকায় আমি অভিনয় করি, মনে হয় ভালোই করি। সত্যিকার মহাপুরুষরাও সম্ভবত এত ভালো অভিনয় করতেন না।’’ আমরা সবাই কমবেশি কিছুক্ষণের জন্য হলেও মহাপুরুষ হতে চাই। তখন জাগতিক কদর্যতা, নোংরামিগুলো অনেক বেশি করে আমাদের ভাবায়। হিমুর ক্ষেত্রেও তাই ঘটে।
মহাপুরুষ অথবা মহাপুরুষ হওয়ার চেষ্টায় রত এই বোহেমিয়ান তরুণ তখন চারপাশের জগতের বাস্তবিকতাকে ভিন্ন চোখে দেখে। আমার মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদ অতি সচেতন এবং সূক্ষèভাবেই হিমুকে ‘আউটসাইডার’ করেছেন যাতে করে আমাদের সমকালের ব্যাখ্যাটি তার চোখ দিয়ে করা যায়।
লক্ষ্য করি, সমকালের বাংলাসাহিত্যে হিমু এমন কিছু বিষয় ও বক্তব্য রাখে যা যথার্থ সাহসী ও দূর্লভ। বুদ্ধিজীবির অবক্ষয়, রাজনৈতিক দৈন্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দূর্নীতি এমনি সব বিষয় আমরা হিমু সিরিজের উপন্যাসে ওঠে আসতে দেখি। ‘হিমুর মধ্যদুপুর’ উপন্যাসে আমরা পাই, ‘‘সবচে সহজ পণ্য হল মানুষ। মানুষ কেনা কোনো সমস্যাই না। মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে সহজে কেনা যায় বুদ্ধিজীবিদের।
তারা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেন কখন বিক্রি হবেন।’’
এই সাহসী উক্তির সঙ্গে আমাদের টকশো আর রাজনীতির ইশারায় বিবৃতি দেয়া অনেকের কথাই মনে পড়ে যেতে পারে।
হিমু সিরিজের প্রথম উপন্যাস ময়ুরাক্ষীতে লক্ষ্য করি থানার ওসি’র ঘুষ খাওয়ার বিষয়টি হিমু তুলে ধরে Ñ
‘‘থানার ওসি সাহেবের চেহারা বেশ ভালো।
মেজাজও ভালো। চেইন স্মোকার। ক্রমাগত বেনসন অ্যান্ড হেজেস টেনে যাচ্ছে। বাজারে এখন সত্তর টাকা করে প্যাকেট যাচ্ছে। দিনে তিন প্যাকেট করে হলে মাসে কত হয়? দুশোদশ গুণণ তিরিশ। ছ-হাজার তিনশ। একজন ওসি সাহেব বেতন পান কত, এক ফাঁকে জেনে নিতে হবে।’’ এই অংশে হিমুর সামাজিক দায়-বদ্ধতা সুপ্রকট। একজন ঘুষখোর ওসির চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন খুবই সরল অংকের মাধ্যমে। বাংলাদেশের পুলিশের ঘুষ খাওয়ার বিষয়টি এখানে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে উঠে এসেছে। সমকালের অনেক ওসি’র জন্যই হিমুর এই প্রশ্নবাণ বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ এবং সমাজের ভেতরে থেকে সমাজের সব কাঠামো ও রীতি মেনে চলি তাদের কাছে একজন ওসির বেনসন সিগারেট খাওয়াটা গা সওয়া হয়ে গেছে। চাই কি তার সঙ্গে বেনসন পানের সঙ্গিও হতে পারি। কিন্তু হিমু আউটসাইডার বলেই হাসতে হাসতেই ঘুষ আর দূর্নীতির চিত্রটি তুলে ধরে অবলীলায়।
হিমুর মুখে এইসব প্রশ্ন বা মন্তব্য কখনোই বেমানান ঠেকে না। কেননা, সে কারো ধার ধারে না। যেহেতু হিমুকে ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে হয় না, যেহেতু জাগতিক কোন কিছুরই মূল্য হিমুর কাছে নেই, সেহেতু অনাচার-অন্যায়গ–লো নিয়ে সে অনায়াসে জাগলিং করতে পারে। হিমুর হাত থেকে তাই অতি ক্ষমতাধর রাজনৈতিক সমাজও ছাড় পায় না। হিমু অবলীলায় বলে, ‘‘কিছু কিছু লোক মন্ত্রী কপাল নিয়ে জন্মায়। জিয়া, এরশাদ যেই থাকুক, এরা মন্ত্রী হবেই। জহিরের বাবা এরকম ভাগ্যবান একজন মানুষ।’’ দরজার ওপাশে উপন্যাসের এই উদ্ধৃতির মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সময় সময় দল-পাল্টানোর বিষয়টি উঠে আসে। আমাদের মন্ত্রীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণাও এ উপন্যাসের রফিকের মন্তব্যের মাধ্যমে ফুটে ওঠে, ‘‘তুই কোন মন্ত্রী চিনিস না, তাই না? চেনার অবশ্য কথা না। ভালো মানুষদের সঙ্গে মন্ত্রীর পরিচয় থাকে না। বদগুলির সঙ্গে থাকে।’’ সমকালের রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রের দলিল হয়ে থাকবে হিমু সিরিজের একাধিক উপন্যাস। হিমুর কোন দল নেই। তাই তার কাছ থেকে কেউ রেহাই পায় না। আমাদের জনবিচ্ছিন্ন দুই প্রধান রাজনৈতিক দল নিয়ে হিমু অবলীলায় বলে, ‘‘আমার ধারণা নি¤œশ্রেণীর পশুপাখী মানুষের কথা বোঝে। অতি উচ্চ শ্রেণীর প্রাণী মানুষই শুধু একে অন্যের কথা বোঝে না। বেগম খালেদা জিয়া কী বলছেন তা শেখ হাসিনা বুঝতে পারছেন না। আবার শেখ হাসিনা কী বলছেন তা বেগম খালেদা জিয়া বুঝতে পারছেন না। আমরা দেশের মানুষ কী বলছি সেটা আবার তাঁরা বুঝতে পারছেন না। তাঁরা কী বলছেন তাও আমাদের কাছে পরিষ্কার না।’’ ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসের এই সংলাপ যেন মনে করিয়ে দেয়, লাল টেলিফোনের যোগাযোগহীনতার গল্প। রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার সবচেয়ে বড় পরিচয় ধারাবাহিক হরতাল। উন্নয়নশীল এই রাষ্ট্রের জন্যে টানা হরতাল কতো লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি করে সে হিসাব সত্যিই ভয়াবহ। কিন্তু এই নিয়ে যেন কারো কোনো বিকার নেই, একমাত্র হিমুই বিকারগ্রস্থের মতো একই উপন্যাসে প্রশ্ন করে Ñ ‘‘আজ হরতালের কতদিন চলছে? মনে হচ্ছে সবাই দিন-তারিখের হিসেব রাখা ভুলে গেছে। নগরীর জন্ডিস হয়েছে। নগরী পড়ে আছে ঝিম মেরে। এ রোগের চিকিৎসা নেই। বিশ্রামই একমাত্র চিকিৎসা। নগরী বিশ্রাম নিচ্ছে।’’ অসুস্থ এই ঢাকা নগররীর আরোগ্য নিয়ে হিমুর মনে যে সন্দেহ দেখা দেয় তা যেন পাঠকের মনেও ছড়িয়ে পড়ে Ñ ‘‘এখনকার অবস্থা সে রকম না, এখন অন্য রকম পরিবেশ। জন্ডিসে আক্রান্ত নগরী রোগ সামলে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে পারবে তো Ñ এটাই সবার জিজ্ঞাসা। নাকি নগরীর মৃত্যু হবে? মানুষের মতো নগরীরও মৃত্যু হয়।’’ সমকালীন রাজনীতির চিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে ‘হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম’ উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে একটি দলিল হয়ে থাকবে বলে মনে করি। চলতি রাজনীতির জগতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই উপন্যাসে হিমু এ প্রসঙ্গে বলছে, ‘‘তত্ত্ববধায়ক সরকারের বিল পাশ হয়েছে। খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেছেন। দুই দলের মর্যাদা বহাল আছে। দু’দলই দাবী করেছে তারা জিতেছে। দু’দলই বিজয় মিছিল বের করেছে Ñ সব খেলায় একজন জয়ী হন, অন্যজন পরাজিত হন। রাজনীতির খেলাতেই শুধুমাত্র দুটি দল একসঙ্গে জয়ী হতে পারে। অথবা একসঙ্গে পরাজিত হয়। রাজনীতির খেলা বড়ই মজাদার খেলা। এই খেলায় অংশগ্রহণ তেমন আনন্দের না। দূর থেকে দেখায় আনন্দ আছে।’’
হিমু মূলত এই দূর থেকে দেখছে বলেই সব কিছুকে ব্যাখ্যা করতে পারছে। সমকালের বাংলা গল্প উপন্যাসে র্যাব নিয়ে মন্তব্য চোখে পড়ে না। কলামে, টক শো’তে র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বহু কথা বলা হলেও সাহিত্যের মহলে তাদেরকে আনা হয়নি। হুমায়ূন আহমেদই পারেন ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’, ‘হিমু রিমান্ডে’ নামে উপন্যাস লিখতে। হিমুকে র্যাবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বীনা বিচারে মানুষ হত্যার প্রসঙ্গটি লেখক তুলে ধরেন নিখুত দক্ষতায়। র্যাবের মতো বিশেষ বাহিনী গঠন এবং ক্রসফায়ারে বিনাবিচারে মানুষ মারা নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ ও কলাম লেখা হয়েছে। কিন্তু সৃষ্টিশীল সাহিত্যে তার একমাত্র দলিলনামা আমরা শুধুমাত্র হলুদ হিমু কালো র্যাব উপন্যাসেই দেখেছি। হিমুর সঙ্গে র্যাব কর্মকর্তার কথোপকথন উদ্ধৃতিযোগ্য Ñ
‘‘আপনি কেন আমাদের কর্মকা- সমর্থন করেন না বলুন তো? আপনার যুক্তিটা শুনি। আপনি কি চান না ভয়ঙ্কর অপরাধীরা শেষ হয়ে যাক? ক্যান্সার সেলকে ধ্বংস করতেই হয়। ধ্বংস না করলে এই সেল সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
আমি বললাম, ‘স্যার মানুষ ক্যান্সার সেল না। প্রকৃতি মানুষকে অনেক যতেœ তৈরি করে। একটা ভ্রুণ মায়ের পেটে বড় হয়। তারজন্য প্রকৃতি কী বিপুল আয়োজনই না করে! তাকে রক্ত পাঠায়, অক্সিজেন পাঠায়। অতি যতেœ তার শরীরের একেটা জিনিস তৈরি হয়। দুইমাস বয়সে হাড়, তিন মাসে চামড়া, পাঁচমাস বয়সে ফুসফুস। এতো যতেœ তৈরি একটা জিনিস বিনা বিচারে ক্রস ফায়ারে মরে যাবে Ñ এটা কি ঠিক?’’
হিমুর এই প্রশ্ন মানবিকতার ভিন্ন দূয়ার খুলে দেয়। মানব সৃষ্টি ও মানব জন্মের এমন জয়গান যথার্থই দূর্লভ। এই একই উপন্যাসে বাংলাদেশের রাজনীতির পরিবার তন্ত্রের বিষয়টি সমালোচিত হয়। ডেমোক্রেটিক ক্যাপসুলের আড়ালে আমাদের রাজনীতি যে অলিগার্কি পদ্ধতিতে চলছে হিমুর চোখেই তা ধরা পড়ে। এ উপন্যাসে দেখি হিমু খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে মন্তব্য করে, ‘‘দেশরতœ শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের আগমন। ইন্টারেস্টিং খবর তো বটেই। দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান রাজনীতি করবেন, আর শেখ হাসিনা চুপ করে বসে থাকবেন তা হবে হবে না। এবার হবে পুত্রে পুত্রে লড়াই। আমরা নিরীহ দেশবাসী মজা করে দেখব। পত্রিকা ভর্তি ইন্টারেস্টিং খবর। কোনটা রেখে কোনটা পড়ব? আজ ছুটির দিন বলে পত্রিকার সঙ্গে আছে সাহিত্য সাময়িকী। সাম্প্রতিক গদ্য-পদ্যের মধূ মিলন পাঠ করা যাবে। একটা গল্প ছাপা হয়েছে আজাদ রহমান নামের এক লেখকের। গল্পের নাম ‘কোথায় গেল সিম কার্ড?’ মনে হচ্ছে খুবই আধুনিক গল্প। গল্পকার নিশ্চয়ই হারিয়ে যাওয়া সিম কার্ডের রূপকে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির কথা বলেছেন।’’ এই মন্তব্য শুধু সমকালের রাজনীতি নয়, সাহিত্যকেও কড়া বিশ্লেষণ করেছে। আধুনিক ছোটগল্পের গল্পহীনতা ও অহেতুক জটিলতার এমন সমালোচনা আসলে হিমুর পক্ষেই সম্ভব।
আমাদের রাজনৈতিক অলিগার্কি’র মতো কর্পোরেট অলিগার্কিতেও আমরা আবদ্ধ। যার যেমন খুশি বিজ্ঞাপন বানিয়ে পণ্য বিক্রির নগ্নতায় ব্যস্ত সবাই। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের কর্পোরেট কোম্পানি ও বিশেষ করে ক্ষমতাধর মোবাইল কোম্পানি সমূহের কার্যকলাপ নিয়ে সাহিত্যিকরা প্রশ্ন তোলেন না। হিমুর মাধ্যমে হুমায়ন আহমেদ এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেন ‘আজ হিমুর বিয়ে’ উপন্যাসে। ‘‘বর্তমানকালের প্রেমিক-প্রেমিকারা বিরাট ভাগ্য নিয়ে এসেছে। মোবাইল কোম্পানিগুলো প্রেমের ইজারা নিয়ে নিয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা যাতে রাতভর কথা বলতে পারে তার জন্যেও কতো ব্যবস্থা! কলরেট অতি সামান্য। বিশেষ বিশেষ রাতে আবার ফ্রি। মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিগুলো একটা মটো ‘বাঙালি জাতি! প্রেম করো। প্রেম।’ ‘হে বাঙ্গালি! প্রেমে ধর হাত মম।’’ রাতভর কম পয়সায় মোবাইলে কথা বলার কুফলের অনেক চিত্রই এখন সংবাদ পত্রের পাতায় যেমন দেখা যায় তেমনি পরিবারে পরিবারেও দেখা যায়। স্পন্সরশিপ হারানোর ভয়ে কেউ এইসব নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। হিমুর এমন প্রশ্ন করতে ভয় নেই, দ্বিধা নেই।
একই উপন্যাসে আমাদের পরনির্ভরশীলতা ও রাষ্ট্রীয় দূর্বলতার একটা দিক উঠে আসে। ‘ভিক্ষাবৃত্তিকে আমাদের সমাজে খুব খারাপভাবে দেখা হয় না। আমরা সবাই কোন না কোনভাবে ভিক্ষা করি। আমাদের রাষ্ট্রও ভিক্ষুক রাষ্ট্র। দাতা দেশের ভিক্ষায় আমরা চলি’’ – এই কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে হিমু যেন আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চরিত্রে কষাঘাত হানেন কুশলী প্রহসন শিল্পী হয়ে। প্রহসনের সুরটি হিমু চরিত্রে বড়ই প্রকট। সে পুলিশ, র্যাব, মাস্তান, ব্যবসায়ী কাউকেই খোচা না-দিয়ে যায় না। ‘আঙুল কাটা জগলু’ উপন্যাসে হিমু মাস্তান জগলুর পচিশ লাখ টাকার স্যুটকেস চৌকির নীচে রেখে দেয়, টাকা ভর্তি স্যুটকেস নিয়ে অবলীলায় ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে হিমুর খালু সাহেব এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার আড়াল থেকে মদের বোতল বের করে। উচ্চ মধ্যবিত্তের এমন উৎকট ভন্ডামির মুখোশ খুলে দেয়া হিমুর পক্ষেই সম্ভব হয়।
কর্পোরেট ও বিজ্ঞাপনে জগতের অসারতা ধরা পড়ে যায় ‘হিমু রিমান্ডে’ উপন্যাসে। হিমু টিভি দেখতে দেখতে বলে, ‘বিজ্ঞাপণ শুরু হলো। মনে হচ্ছে আজ আবুল হায়াত দিবস। প্রতিটি বিজ্ঞাপণই তার। প্রথমে লিপটন তাজা চায়ের গুণগান করলেন। তারপর তাকে দেখা গেলো নাসির গ্লাসের গুনগান করতে। নাসির গ্লাসের পর সিংহ মার্কা শরীফ মেলামাইন। আবুল হায়াত দর্শকদের সাবধান করলেন কেউ যেন সিংহ মার্কা না দেখেই শরীফ মেলামাইন না কেনে। সিংহ মার্কার পরেই তিনি চলে এলেন গরু মার্কায়্ জানা গেলো গরু মার্কা ঢেউ টিন ছাড়া অন্য কোন ঢেউ টিন তিনি ব্যবহার করবেন না।’ কর্পোরেট চাহিদা গরু থেকে সিংহ মার্কায় অদল-বদলের এই চিত্র যেন শঙ্খঘোষের ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞপনে’ কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়।
হিমু নিজে কে, কেমন মানুষ তা সুর্নিদিষ্ট নয়। কেননা, সে রহস্যময়। সাধারণ মানুষ নয়, মহামানব বানানোর এক নীরিক্ষার ফসল সে। হিমুর বাবার হিমুকে মহাপুরুষ বানানোর নীরিক্ষা সফল হয়েছে কি হয়নি তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায় আমাদের চেনা জগতকে এক অচেনা আগুন্তুকের চোখে দেখে সে। সত্যজিৎ-এর আগুন্তুক মনমোহন মিত্র কিংবা ক্যামুর আউটসাইডারের মার্সেল থেকে হিমু অনেক বেশি রহস্যময়, অচেনা, তবু বাস্তব।
হয়তো কোথাও আমাদের চেনা জগতেই চেনা রাস্তাতেই অচেনা হিমু হেটে যাচ্ছেন প্রতিদিন। হিমুর ¯্রষ্টা হুমায়ূন তাকে চিনতে পেরেছেন, আমরা পারিনি, কোনদিন হয়তো পারবো।
২০ শে নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৩
মুম রহমান বলেছেন: সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা : ইহা কোন গল্প নয়। ইহা একটি সমালোচনামূল্ক প্রবন্ধ।
২| ২০ শে নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ২:৪১
আমিজমিদার বলেছেন: সংশোধন- ইহা একটি প্রশংসামূলক প্রবন্ধ।
©somewhere in net ltd.
১|
১৯ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৪০
ইখতামিন বলেছেন:
হিমুকে নিয়ে লেখা গল্পটা দারুণ লাগলো..
হয়তো কোথাও আমাদের চেনা জগতেই চেনা রাস্তাতেই অচেনা হিমু হেটে যাচ্ছেন প্রতিদিন।
++++