নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মোস্তফা জামাল সোহেল

মোস্তফা জামাল সোহেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি মুরগীর আত্ন কাহিনী

০১ লা অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ২:১২


মোস্তফা জামাল সোহেল
আমি একটি মুরগী। আমার আত্ন কাহিনীর কথা শুনে অনেকে হয়তো মুখ ভেংচায়ে বলবেন, মুরগীর আবার আত্ন কাহিনী। এইরকম চিন্তা করা মহা অন্যায়। কেননা আমরাও আল্লাহর সৃষ্ট জীব। আমাদেরও তো একটা জীবন আছে। আর জীবন থাকলে জীবন কাহিনী থাকব্ননা কেন? থাক, এসব বিষয় নিয়ে বির্তকে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। আমি সরাসরি আমার কাহিনী বলছি।
আমার জন্ম কুমিল্লা জেলার এক গ্রামে। গ্রামটি শহর থেকে বহু দূরে। গ্রামটি বিভিন্ন ফুল, ফল এবং নানা জাতীয় সু-উচ্চ বৃক্ষরাজি দ্বারা বেষ্টিত হয়ে কালো এক বন দ¦ারা আবৃত ছিল। এখনও কোথাও কোথাও ঘন বনের ছাপ দেখা যায় গ্রামটিতে। সে কারনেই শিয়াল, বানর, বেজী ও বন-বিড়ালের চারনভূমিতে পরিনত হয়েছে এটা। এক দশক আগেও নাকি এখানে নেকড়ের উপদ্রব ছিল। ফলের গাছের মধ্যে আম, জাম, লিচু, কাঠাল ও নারিকেল গাছ প্রচুর। এই এলাকার ফলের স্বাদ ও গন্ধ নাকি একটু আলাদা ধরনের। সেই ছোটবেলায়, বিশেষ করে শীতের দিনে মায়ের পাখার নীচে যখন বসতাম তখন মা আমাদের এই সমস্ত গল্প শুনাতেন। আর বলতেন বড় হলে তোমরাও মজা করে ঐ সমস্ত ফলমূল খেতে পারবে। মায়ের মুখে এ সব কাহিনী শুনে খুব আনন্দ উপভোগ করতাম।
আমরা ভাই-বোন মিলে সর্বমোট ১০ জন। সকালে খোয়াড় থেকে বের হওয়ার পূর্বে মা আমাদের কিছু নির্দেশ দিতেন। সবচেয়ে জরুরী নির্দেশ ছিল মায়ের খুব কাছাকাছি থাকা। মা এই ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন। তখন আমারা এর কারন বুঝতে পারিনি। একদিনের ঘটনা, মা আমাদের নিয়ে যেই রাস্তায় গিয়েছেন অমনি একটা চিল আমাদের আক্রমন করলো। মা আমাদের রক্ষা করার জন্য চিলটিকে পাল্টা আক্রমন করল। মা একদিক, চিল অন্যদিক। এমনি করে বেশ খানিকক্ষন যুদ্ধ চললো। ভাগ্যিস কাছেই ঝোপের মত ছিল। আমরা সকলে সেখানে আশ্রয় নিলাম। মা যে সন্তানের জন্য জীবন দিতে দ্বিধাবোধ করেন না, আমাদের মা তাই প্রমান করলেন। তাছাড়া এখানে কাকের উপদ্রবও কম ছিল না। মা অবশ্য কাককে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। একদিন তো একটা কাক মায়ের কাছে ধরা পরে পরে অবস্থায় বেঁচে গেল। কাকটার নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে আমাদের খুব খারাপ লেগেছিল। এমনি করে দিন যেতে লাগলো আমরাও আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম। এখন বাড়ীর মালিক ও তার আত্বীয়-স্বজন আমাদের নিয়ে অনেক রকম মন্তব্য করেন। একদিন মালিকের এক বন্ধু বললো, তোদের মুরগীগুলোতো বেশ নাদুস নুদুস হয়েছে। বিয়ে শাদীতে তোদের আর মুরগী কেনা লাগবে না। বুঝতে পারলাম আমাদের আয়ু আর বেশিদিন নেই। খুব শীঘ্রই আমরা আশরাফুল মাখলুকাতের বেদীমূলে কোরবানী হতে যাচ্ছি। থাক এসব কথা। আমাদের মালিক ও মালিক পত্নী সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। তারা খুবই ভাল মানুষ। আমাদের প্রতি তাদের আদর যত্নের কোন কমতি ছিল না। শীতের রাতে আমাদের খোয়াড়ে খড়-কুটা বিছায়ে দিতেন যাতে আমরা শীতে কোন রকম কষ্ট না পাই। আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও তারা সব সময় নজর রাখতেন। আমি আগেই বলেছি আমাদের এলাকাটা অনেকটা বনাঞ্চলের মত। কাজেই বন-বাদাড়েও আমাদের খাওয়ার কমতি ছিল না। মায়ের সঙ্গে চড়ে চড়ে কত রকমের পোকামাকড় সহ মজাদার খাবার খেয়েছি তার কোন হিসাব নেই। বন বাদাড়ে চড়ার অনেক অভিজ্ঞতাও আছে। একদিনের ঘটনা বলছি। বনে গাছের পাতার স্তূপ সর্বত্রই থাকতো। পাতা সরানো মাত্রই নানা রকমের পোকামাকড় বেরিয়ে আসতো। আর আমরা ভাই বোন মিলে মজা করে ভক্ষন করতাম। এমনি চড়তে চড়তে আমরা একটি বড় স্তূপের কাছে গেলাম। ভাই বোন সবাই মিলে পাতা সরাতে গেছি ঠিক অমনি একটা বড় গোখরা সাপ পাতার নীচ থেকে ফোঁস ফোঁস করে বেরিয়ে এলো। আমরা সকলে চিৎকার করে এদিকে সেদিকে ছুটে পালালাম। আমাদের মা একটু দূরেই ছিলেন। আমাদের চিৎকার শুনে মা প্রায় উড়েই আসলেন এবং আমাদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে গেলেন। আমার জীবনে এমন আরও বহু ঘটনা আছে। আর এক এক করে বলতে গেলে অনেক সময় দরকার। তাই এই প্রসঙ্গটা বাদ দিতে বাধ্য হলাম। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
প্রিয় পাঠক, আপনারা বুঝতেই পারছেন, এইরকম সুখেই কাটছিল আমাদের জীবন। কিন্তু দুঃখ আসতে কতোক্ষন? মায়ের কাছে শুনেছি সুখ আর দুঃখের সম্পর্ক নাকি দাঁত আর ঠোটের সম্পর্কের মতোই। অর্থাৎ, দাঁত আর ঠোট সর্বদাই একে অপরের সাথে লেগে থাকে। আর আমাদের জীবনে তাই ঘটলো। মায়ের সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে।
আমাদের থাকার ঘরটি তেমন একটা সুরক্ষিত ছিল না। তবে দরজা বন্ধ করলে অনেকটা মাটির ঢিবির মতো মনে হত। ভেতরে কোন জীবজন্তু থাকতে পারে বলে মনে হত না। একদিন কাজের মেয়ের ভুলের খেসারত দিতে হল আমাদের। সে দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেল এক রাতে। আর সে রাতেই শিয়াল আক্রমন করে আমাদের খোঁয়ারে। তখন গভীর রাত। আমরা চিৎকার করে বিপদের জানান দিলাম। বাড়ির মালিকসহ অন্য সকলেই উঠলেন। ধর-মার-কাট প্রভৃতি আওয়াজ করতে করতে আমাদেন সাহায্যে সবাই এগিয়ে এল বটে কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। শিয়াল আমার মা ও দুই ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে ততক্ষনে। আমরা তখন থর থর করে কাঁপছি। মালিক কাজের মেয়েকে অনেক বকাঝকা করলেন। আর কি হবে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এই বয়সে মা আর ভাইদের হারালাম। এই ঘটনার পরও আমাদের ঐ খোঁয়ারেই রাখা হল। শিয়াল আমাদের ঘর চিনে ফেলেছিল। যে কোন সময় আবারও আক্রমন করতে পারে। এই ভয়ে আমরা রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারতাম না। আমার ভাইবোনদের মানসিক অবস্থা দেখে আমি কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অস্থির হয়ে যেতাম। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এল। আমরা সকলে মিলে একদিন রাত-দুপুরে মিছেমিছি চিৎকার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাত তখন গভীর। আমরা যেই চিৎকার শুরু করেছি অমনি সকলেই আমাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল। ভাগ্যিস আমার চালাকিটা কেউ বুঝতে পারেনি। পরের দিন শুনলাম মালিক ও তার ছেলে আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছেন। মালিকের ছেলে বললো, “কাল থেকে মুরগীগুলো আমাদের থাকার ঘরের এক কোণায় থাকবে।” আমাদের থাকার জায়গা হল প্রধান ঘরে। তখন আমাদের আনন্দ আর দেখে কে? ভাই বোনরা সবাই আমার বুদ্ধির প্রশংসা করতে লাগলো। আর বড় হিসাবে মা হারা এই ভাইবোনদের জন্য কিছু করতে পেরে নিজেও গর্ববোধ করতে লাগলাম। কিন্তু কপালে যদি সুখ না থাকে, বিল্ডিং সুখ দেবে কি করে?
এবার আমার ব্যাক্তিজীবনে নেমে এলো এক অবর্ণনীয় ট্রাজেডি। একদিন মালিক পত্নীর চাচা ঢাকা থেকে বেড়াতে আসলেন। সঙ্গে ছিল তার ছোট মেয়ে। তাদের আপ্যায়নে মালিক ও তার পত্নী ব্যস্ত হয়ে গেলেন। মালিক নিজে বাজারে গেলেন গরুর মাংসসহ অন্যান্য বাজার সদাই করতে। আর সেখানেই ঘটলো চরম বিপত্তি। গ্রামের বাজারে গরুর মাংস পাওয়া গেল না। যখন এইসব আলাপ চলছিল তখন আমরা দূর্ভাগ্যক্রমে ঘরের উঠোনেই পায়চারী করছিলাম। মালিক তার স্ত্রীকে বললো, “এক কাজ কর, ২টা মুরগী জবাই কর। তাহলে আর মেহমানদারীতে কোন সমস্যা হবে না।” আর কথাটা শুনা মাত্রই আমার আত্না শুকিয়ে গেল। হায়রে আমাদের জীবন। এখনও মা ও ভাই হারানোর স্মৃতি ভুলতে পারিনি, এরই মধ্যে আবার সেই অগ্নি পরীক্ষা। যেই কথা সেই কাজ। আমাকে আর আমার এক বোনকে ধরা হল। আমার চোখের সামনে আমার বোনকে জবাই করা হল। এবার আমার পালা। মেহমান মেয়েটি কাছেই ছিল। সে বললো, ঐ মুরগীটা জবাই করবেন না। আমি এটাকে পালবো, ঢাকায় নিয়ে যাব। আপাততঃ প্রাণে রক্ষা পেলাম। আমার দু-পা বেশ শক্ত করে বাধা হল। ভীষন ব্যাথা পাচ্ছিলাম। অনেক চিৎকার করলাম। কে শোনে কার কথা? খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। শুরু হল আমার যাত্রা। এত বছরের পুরোনো ভিটেবাড়ি ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। তার উপর আবার ভাইবোনদের হারানোর বেদনা আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। আমি অনেক আকুতি মিনতি করলাম। আমার কথা শোনার কেউ নেই, কারন আমি তো মুরগী, আমাদের মর্যাদা তো শুধু ঔ খাওয়ার টেবিলে। বাসের মধ্যে আমার দেখা শোনার ভার পড়লো কাজের মেয়েটার উপর। জীবনে বাসে চড়ার এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।
গরমে আমার অস্থির লাগছিল। মাঝে মাঝে চিৎকার করে আমার অসুবিধার কথা ঘোষনা করলাম। আমার চিৎকার শুনে ড্রাইভারসহ অন্যান্য আরোহীরাও বেশ বিরক্ত হল। তাদের রাগ দেখে মনে হল এই বুঝি আমাকে বাস থেকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হবে। কষ্ট হলেও শেষমেষ চুপ করে থাকলাম। বিকাল ৫টা নাগাদ আমরা মহাখালী পৌছালাম। আমাদের সুবিধার জন্য স্কুটার ভাড়া করা হল। পৌনে ৬টার সময় আমরা বাসায় পৌছালাম। বাসায় পৌছানো মাত্রই আমাকে কিছু খাবার ও পানি সরবরাহ করা হল। আমি শুধু পানি খেলাম, অন্য কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হল না। নতুন জায়গা, চারিদিকে শুধু বিল্ডিং আর বিল্ডিং। কোথাও কোন গাছপালা নেই বললেই চলে। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখছি আর ভাবছি, মানুষ এই পরিবেশে বসবাস করে কিভাবে? আর এইজন্যই তো শহরে এত রোগের প্রার্দুভাব। যাক আমরা ক্ষুদ্র জীব। এসব চিন্তা-ভাবনা আমাদের মানায় না। শেষে কে কোন মন্তব্য করে বসে কে জানে? রাতে আমার শোবার জায়গা হল বাথরুমে। সারা রাত সরকারী সম্পত্তি ভেবে মশা আমায় হরিলুট করলো, একটুও ঘুমোতে পারলাম না। তার উপর ভাইবোনদের চিন্তাতো ছিলোই।
পরের দিন সকালে আমাকে আবার প্রচুর খাবার দেয়া হলো। কিন্তু পেট খারাপ হওয়ার কারণে পানি ছাড়া অন্য কিছু স্পর্শ করতে পারলাম না। ইতিমধ্যেই আমি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছি। গৃহকর্তা আমাকে পালার পরিকল্পনা ত্যাগ করলেন। শেষে আমি মরে না যাই এই ভেবে আমাকে জবাই করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। হায়রে আমাদের জীবন! বিদায় হে নিষ্ঠুর পৃথিবী, বিদায় হে মানবজাতি!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.