![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মোস্তফা জামাল সোহেল
সুজন ও সুমি দুই ভাইবোন। সুজন বড় আর সুমি ছোট। তাদের বয়সের পার্থক্য মাত্র এক বৎসর। বাচ্চা দুটো দেখতে যেমন সুশ্রী তেমনি সুন্দর। আল্লাহ যেন নিজের হাতে ওদের তৈরী করেছেন। দু’ভাই-বোনে খুবই মিল।ওরা যেন মানিক জোর। ওদেরকে একবার কেউ দেখলে আদর না করে শান্তি পায় না। বর্তমানে এরা কালশী মাতবর বাড়ী সংলগ্ন বস্তিতে মা-বাবার সাথে বসবাস করছে। বিকাল বেলায় বস্তির অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে ওরাও রাস্তায় পাশে খেলাধুলা করে। সেদিন কোন একজন ধনী লোকের গাড়ির সামনে পড়লে ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে ওদের আদর করে বললেন, এমন বাচ্চাদের শুধু রাজপরিবারেই মানায়। আল্লাহর কি মর্জি, এদের স্থান হয়েছে বস্তিতে।
আসলে ভাগ্যই তাদের নিয়ে এসেছে এই বস্তিতে। আর এখানে আসার ইতিহাসটাও খুব করুন। তাদের বাবা ছিলেন চাঁদপুরের কাছেই নীল কমল গ্রামের বাসিন্দা। তাদের বাবার নাম করিম ও মায়ের নাম শিরিন। গ্রামে তারা খুব সুখে শান্তিতেই ছিল। সর্বনাশা মেঘনা নদী তাদের বাড়ি থেকে বেশ দূরেই ছিল। কিন্তু ২/৩ বৎসরের মধ্যেই নদী এভাবে তাদের বাড়ী-ঘর এমনি করে গ্রাস করে ফেলবে তা ছিল অকল্পনীয়। নদী যখন খুব কাছাকাছি তখন করিমের এক আত্নীয় বন্ধু তাকে ঢাকা চলে আসতে বললো। কিন্তু গ্রামের লোকের অন্ধ বিশ্বাসের উপর আস্থা রাখতে গিয়েই আজ তাদের সব হারাতে হয়েছে। গ্রামে একটি জনশ্রুতি ছিল,কোন এক ফকির নাকি বলেছিল, কাজী বাড়ির বটগাছের কাছে এসে নদী অন্যদিকে ফিরে যাবে। কিন্তু ফকিরের কথা বিশ্বাস করে গ্রামের মানুষ আজ তাদের শেষ সম্বল ঘর-দরজা পর্যন্তও রক্ষা করতে পারলো না। একদিন গভীর রাতে গ্রামের মানুষের আত্ন চিৎকারে আকাশ-বাতাস কেঁপে উঠলো। নিমিষের মধ্যেই গ্রামটির শত শত ঘর-বাড়ী নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেল। করিম - শিরীনসহ আরও গ্রামবাসী কোনমতে ছেলেপুলে নিয়ে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিল। দেশে এমনিতেই কোন কাজ কর্ম নেই। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে কারো কাছে সাহায্যে চাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। নীলকমল গ্রাম হঠাৎ মেঘনা গর্ভে বিলীন হওয়ার খবর দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হচ্ছে।বহু লোকজন মারা গিয়েছে, কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সব খবরই এখন সবার মুখে মুখে। খবর শুনে করিমের সেই আত্নীয় বন্ধু তাকে ঢাকায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে নীলকমল গেল। করিমের সেই বন্ধুটির নাম আতিক মিয়া। সে গত পাঁচ বৎসর যাবৎ ঢাকার বস্তিতে বসবাস করছে। সে কাঁচামালের ব্যবসা করে। কথা-বার্তায় আতিক মিয়া বড়ই পন্ডিত। এই কারনেই সকলে তাকে বেশ মান্য করে। সুতরাং তার বন্ধুর জন্য ঢাকায় একটি ঘর ঠিক করে দেয়া তার জন্য মোটেও কঠিন কাজ না। তাই সে তাদেরকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করে। প্রথমে তারা আতিক মিয়ার বাসায় উঠে। করিমকে ডেকে আতিক বললো, তোমরা খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম কর। আমি এখনই আসছি। মাতবর বাড়ির বড় মাতবরের সাথে আতিক মিয়ার সম্পর্ক বেশ ভাল। আতিক মিয়া তার বন্ধুর দুঃখের কাহিনী খুলে বলতেই মাতবর বললেন, ‘আমাদের রান্নাঘরের পাশের ঘরটা খালি আছে, ওদের ওখানে থাকার ব্যবস্থা করে দাও । ‘ভাড়ার ব্যাপারে আমি পরে তোমাকে জানাবো’। আতিক খুশিতে আতœহারা হয়ে বিজয়ীর বেশে ঘরে ঢুকলো। এত তাড়াতাড়ি ঘরের ব্যাপারটা সমাধান হবে আতিক মিয়া নিজেও ভাবতে পারেনি। এদিকে তার ঘরে মাত্র দুটি রুম। দু-একদিনের ব্যাপার হলেও চলে। যদি দীর্ঘ সময় এদের এখানে রাখতে হত তখন হয়তো তার বউ সেটা সহজে মেনে নিতো না। মেয়ে লোকের জাত বলে কথা। শুনেছি ওদের মনের ভাব স্বয়ং ভগবানও নাকি বুঝতে পারেন না। যাক, আল্লাহর ইচ্ছায় সবকিছু ভালভাবেই হল। পরের দিন করিন মিয়া ও শিরিন বাচ্চাদের নিয়ে নতুন বাসায় উঠলো। ঘরটা বেশ বড়। লাইট আছে কিন্তু গ্যাস নেই। ঘরটার দক্ষিন দিকটা খোলা থাকায় একটা জানালা রাখা সম্ভব হয়েছে। নইলে থাকাই মুশকিল হত।
শিরিন মনে মনে ভাবছে ঘরের সমস্যা তো দূর হল। রান্না-বান্নার কাজও কম ঝামেলার না। তারপর আবার লাকড়ির যে দাম! স্বামী সবেমাত্র ব্যবসা শুরু করেছে। আয় রোজগার যা হয় তা দিয়ে কোনমতে সংসার চলে।এদিকে বাচ্চারা দিনে দিনে বড় হচ্ছে। ক’দিন পর আবার এদের আবার স্কুলে ভর্তি করতে হবে। সামনে কত খরচ। এসব কথা চিন্তা করতে করতে শিরিনের মন বিষিয়ে ওঠে। তাই মনটা একটু হাল্কা করার জন্য সে মাতবরের বউয়ের কাছে গেল। মাতবরের বউ শিরিনকে দেখে বললেন, ‘কি হয়েছে বউমা’? ‘মুখটা এত মলিন দেখাচ্ছে কেন? শিরিন মাতবরের বউকে সব খুলে বলে। মাতবরের বউ বললো, ‘এখন থেকে তুমি আমাদের গ্যাসের চুলায় পাক করবে, কোন টাকা পয়সা লাগবে না’। শিরিন আর আবেগ সামলাতে পারলো না। মা বলে মাতবরের বউকে জড়িয়ে ধরলো। মাতবরের বউ বললো, ‘আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে’। কিছুক্ষন পর শিরিন নিজের ঘরে চলে আসে। এমনি করে সবকিছু ঘটবে তা শিরিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। এতদিন পরে আজ তার মুখে হাসি দেখা দিল।
এখন সকাল ১০:০০ টা। করিম বেলা ২:০০ টার দিকে চলে আসে। এখনি রান্না-বান্নার কাজে হাত দিতে হবে। গ্যাসের চুলায় পাক করতে আর কতক্ষন ? মনে মনে শিরিন আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো। শিরিনের মনে এখন বেশ ফূর্তি। এমন সময় করিম এসে হাজির হল। শিরিনের ভয় হল, খারাপ কিছু ঘটেনি তো? করিম বললো, ‘খবর ভালো’। ‘এলাকায় একটা বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, আর ঐ অনুষ্ঠানে আমার সব মাল বিক্রি হয়ে গেছে’। ‘ভাল দামও পেয়েছি’। শিরিন হেসে উঠলো। গ্রাম থেকে যেদিন ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল সেইদিন হতে অদ্যাবধি শিরিনের মুখে হাসি ছিল না। করিম যে বুঝতে পারেনি তা না। এমন দুঃখের মধ্যে হাসি পাবে কি করে? সে শিরিনকে বললো, ‘কি খবর? ‘আজ তোমাকে যে অনেক খুশি খুশি দেখাচ্ছে’? শিরিন স্বামীকে সব খুলে বললো। করিম সবকিছু শুনে যারপরনাই আনন্দিত হল। শিরিন বললো, ‘এখন একটা ফ্যান হলেই আমাদের সমস্যা অনেকটা দূর হবে’। শিরিনের কথা শুনে করিম না শুনার ভান করলো। করিম বললো, ‘ফ্যান লাগাতে গেলে নাহলে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দরকার’। ‘বর্তমানে আমার যা আয় তা দিয়ে খাওয়া দাওয়ার খরচই চলে না, আবার ফ্যান’। শিরিন বললো, ‘আমি তো আর আমার জন্য বলছি না, বাচ্চাগুলো গরমের জন্য ঘুমাতে পারেনা’। ‘সারাদিন শুধু ফ্যান ফ্যান করে আমাকে জ্বালায়, তুমি তো আর সারাদিন ঘরে থাকো না’। ‘মায়ের জ্বালা তুমি বুঝবে কি করে’? করিমের মনে খুব কষ্ট হয়। বাচ্চারা যে কথা বাবার কাছে বলতে সাহস করে না তা অবলিলায় মায়ের কাছে বলে ফেলে। হয়তো সারাদিন ফ্যান ফ্যান করে মা-কে জ্বালাতন করে। যাই হোক বাড়তি পরিশ্রম করে একটা ফ্যান কিনতেই হবে। করিম মনে মনে এসব চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলো।
পরের দিন করিম তার বউ বাচ্চার এই আবদারের কথা আতিক মিয়াকে জানালো। আতিক মিয়া বেশী করে মাল কেনার জন্য তাকে দুই হাজার টাকা ধার দিল। এবার করিম মিয়া কাওরান বাজারের আড়ৎ থেকে সরাসরি মাল কিনে এনে বিক্রি করা শুরু করল। একমাস পর যারপর নাই কষ্ট করার পর করিম মিয়া একটি ফ্যানের টাকা যোগাড় করলো। শিরিনকে ডেকে করিম বললো, ‘আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে ফ্যান কিনবো’। আর এই কথা শোনা মাত্র বউ আর বাচ্চাদের আনন্দ দেখে কে? করিম মনে মনে খুব গর্বিত হল। খবরটা বাচ্চাদের পেটে আর হজম হয় না। সুজন ও সুমি দৌড়ে চলে গেল পাশের বাড়ী। পাশের বাড়ির রাজু ও রোজী ওদের সমবয়সী। সুমি রোজীকে বললো, ‘আমার বাবা একটা ফ্যান কিনবে । রোজী বললো, ‘আমাদের বাসায় ২টা ফ্যান আছে’। সুমি রেগে গিয়ে বললো, ‘আমার বাবা ৩টা ফ্যান কিনবে’। সুজন ও সুমির সাথে তাল মিলালো। বাচ্চাদের কিচির মিচির শুনে রাজুর মা এসে বললেন, ‘কি হয়েছে’? ‘তোমরা ঝগড়া করছো কেন’? ওদের কথা শুনে রাজুর মা আর হাসি সামলাতে পারলো না। হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমরা আর ঝগড়া করো না, সবাই মিলে খেলা কর’।
করিম তার কথা রেখেছে। কথামত সে বিশাল এক ফ্যান কিনে এনেছে। আজই ঘরের চালে ফ্যান ঝুলবে। এই কুড়েঁ ঘরে আজ যেন ঈদের আনন্দ বইছে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রির নাম নান্টু মিয়া। নান্টু মিয়া নাট-বল্টু ও অন্যান্য সরঞ্জামাদী নিয়ে এসেছে, এখনই ফ্যান ফিটিং হবে। সুজন ও সুমির আনন্দ দেখে কে ? তীর্থের কাকের মত তারা চেয়ে আছে। করিমকে ডেকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বললো, ‘এ্যাঙ্গেলটা অনেক পুরানো। এটাতে কি ফ্যান ঝুলাবো, নাকি নতুন এ্যাঙ্গেল তৈরী করে এনে পরে ফিটিং করে দেব’? একথা শোনা মাত্র বাচ্চাদের হাসি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। ওরা বললো এখনই যেন ফ্যান ঝোলানো হয়। বাচ্চাদের কথা তো আর ফেলা যায় না। যাক অবশেষে ফ্যান ফিটিং করা হল। সুইচ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্যান ঘুরতে লাগলো। আহ্ কি বাতাস। দু ভাইবোন একসঙ্গে বসে ফ্যানের বাতাস খেতে লাগলো। আহ্ কি মজা। ফ্যান বরাবর ঠিক নিচে বসার জন্য দু ভাইবোন রীতিমত ঝগড়া শুরু করলো। এদের কাহিনী দেখে স্বামী-স্ত্রী হাসি চেপে রাখতে পারলো না। যাক মনে মনে ভাবলো বাচ্চাদের জন্য তো কিছু একটা করতে পেরেছি।
আজ শুক্রবার, বন্ধের দিন। করিম কাজে যায়নি। তাই শিরিনকে নিয়ে আতিকের বাসায় গিয়ে গল্প করার ইচ্ছা হলো। সুজন ও সুমি বললো, ‘তোমরা যাও, আমরা মজা করে ফ্যানের নিচে ঘুমাবো’। করিম ও শিরিন চলে গেল। দু ভাইবোন গলা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। কে জানতো এটাই হবে ওদের শেষ ঘুম। করিম ও শিরিন আতিক আর তার স্ত্রীর সাথে খোশ গল্পে মশগুল। এমন সময় কিসের যেন একটা আওয়াজ সবার কানে এলো। পাশের বাড়ির এক বুড়ো চিৎকার করে করিম ও শিরিনকে ডাকতে শুরু করলো। বুড়োর চিৎকার শুনে এক দৌড়ে করিম ও শিরিন ঘরে পৌছলো। কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ। ঘরের খা ট আর মেঝ রক্তে ভেসে গেছে। ঘরের ফ্যানটি এ্যঙ্গেল ভেঙ্গে ঠিক ভাইবোনের মাথার উপরে আছড়ে পড়ে। এ ঘটনায় বস্তিসহ আশে পাশের এলাকা থেকে শত শত লোক ছুটে আসে। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে অনেকে জ্ঞান হারায়। করিম ও শিরিন বাচ্চাদের লাশের কাছে গিয়ে জ্ঞান হারালো। সকলের মুখে মুখে একই বুলি, একি হলোরে! চারিদিকে কান্নার রোল পরে গেল। বড় মাতবর বল্লেন, ‘এখনই একজন ডাক্তার ডাকো নইলে করিম ও শিরিনকে বাচাঁনো যাবে না’। তাই হলো, আতিকের এক বন্ধু ভিড় ঠেলে ডাক্তার আনতে চলে গেল।এমনি করে অনেকটা সময় পার হলো। এদিকে বাচ্চা দুটির মাটি দেয়ার ব্যবস্থা করার জন্য মাতবর সাহেব গোরস্থানের সরদারকে ডেকে পাঠালেন। ঠিক আসরের নামাযের পর বাচ্চা দুটিকে কবর দেয়া হল।
আজ দু’দিন হল করিম ও শিরিন মুখে এক ফোটাও পানি নেয়নি। ওদের মুখ দিয়ে কোন কথাও বের হচ্ছে না, শুধু বোবার মত একে অপরের দিকে চেয়ে আছে। সোমবার ঠিক ভোরে মাতবরের বউ করিমের বাসায় গেলেন। আজ বাচ্চাদের জন্য মিলাদের ব্যবস্থা করতে হবে। হায় একি? ঘরের দরজা খোলা, জিনিসপত্র যেখানে ছিল ঠিক সেখানেই পড়ে আছে। ঘরের কোথাও করিম ও শিরিনকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তারা কোথায় গেছে কেউ বলতে পারলো না। আজ পযন্ত তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি !
-----------------X-----------------
©somewhere in net ltd.