![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শুভ সন্ধ্যা। আজকে এ সিরিজের শেষ পর্ব তুলে ধরব। আজকে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্বে নারীর উপস্থাপন ও অবদান নিয়ে আলোচনা করব।
ভাষা আন্দোলন ও নারী :
২১শে ফেব্রুয়ারীর সাথে একযোগে উচ্চারিত হয় সালাম, বরকত, রফিকের নাম। যারা ১৯৫২ সালের এই দিনে রক্ত ঝরিয়ে বাংলাকে নতুনকরে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ভাষা আন্দোলনের এই দিন শহীদ দিবস থেকে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রুপ নিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারী এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের। বায়ান্ন ভাষা আন্দোলন জাতীয় আন্দোলন। এ আন্দোলনের শুরু হয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। কিন্তু এর শেকড় ছিল চল্লিশের দশকে। ছাত্রদের মধ্যে এ আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও আপামর জনগণ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সক্রিয় সহযোগিতা করে। পঞ্চাশের দশকে রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ছাত্রদের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও ভাষা আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনে যোগ দেয়। অাহত ছাত্রদের চিকিৎসার সাহায্যার্থে প্রতিকুল পরিবেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাাঁদা তুলে আনেন। ছাত্রদের পুলিশি নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে তাদের নিজেদের কাছে লুকিয়ে রাখতেন। আবার বন্দি ছাত্রদের জন্য খাবার সংগ্রহ করতেন। পোস্টার লেখা এমনকি শহীদ মিনার গড়ার জন্য প্রায় সারারাত ধরে ইট বহন করেছিল। তেমন কিছু নারীদের উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো।
ভাষা আন্দোলনের নারী অংশগ্রহণকারীদের সঠিক তথ্য নেই। শুধু বিক্ষিপ্তভাবে কিছু তথ্য জানা যায়। ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি বেগম সুফিয়া কামাল। অনেক কর্মীর সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ ছিল। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে ভাষাকন্যা নাদেরা বেগম পুলিশের ঘেরাও থেকে আত্মগোপন করেছিলেন। সেসময় সুফিয়া কামালের বাড়িতে বোনের মেয়ের পরিচয়ে ছিলেন। নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দিয়েছিলেন জাহানারা। মুনীর চৌধুরীর বোন নাদেরা বেগমকে হাটখোলার তারাবাগের বাসায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিছুদিন পর ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশ তাকে বন্দী করে। কারাগারে অন্য রাজবন্দীদের সঙ্গে তার উপরও কঠোর নির্যাতন ও অত্যাচার করা হয়। তার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য সেসময় তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত হন।
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী ছিলেন মমতাজ বেগম। তিনি নারায়নগঞ্জ মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। তিনি সেসময় যুবলীগ নেতা শামসুজ্জোহা, সফি হোসেন খান এবং ডঃ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো কারাগারে বন্ড সইয়ের মাধ্যমে মুক্তিলাভে অস্বীকৃতি জানানোয় মমতাজ বেগমের স্বামী তাকে তালাক দেন। এজন্য তার সাজানের সংসার ভেঙ্গে যায়। তার ছাত্রী ইলা বকশী ও বেনু ধরও কারাবন্দী হন। খুলনার স্কুল ছাত্রী হামিদা খাতুন নারীদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় লাঞ্ছিত হন।
ভাষা আন্দোলনে আরও যেসব নারী ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে অন্যতম সিলেটের জোবেদা খাতুন চৌধুরী। তার সহযোগীতায় ছিলেন শাহেরা বানু, সৈয়দা লুৎফুন্নেসা, সৈয়দা নজিবুন্নেসা খাতুন, প্রধান শিক্ষিকা রাবেয়া খাতুনসহ প্রমুখ। সিলেটের ছাত্রী সালেহাকে স্কুলে কালো পতাকা উত্তোলনের জন্য ৩ বছর বহিস্কার করা হয়। পরবর্তীতে তার আর পড়াশোনা হয়নি। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক গাজীউল হক তার একটি লেখায় ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিন মেয়েদের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি সাফিয়া খাতুন, সুফিয়া ইব্রাহিম, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন নাহারসহ আরো অনেকের কথা উল্লেখ করেন।১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ৫২ জন মেয়ের কথা বলেছেন।
সেসময়ে “বেগম” পত্রিকা নবীন ও একমাত্র মহিলা পত্রিকা হওয়া সত্ত্বেও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। দুঃখের কথা এই যে, প্রতি বছর ফেব্রুয়ারীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা একাডেমীতে আলোচনা সভা, সেমিনার অনুষ্ঠিত হলেও ভাষা আন্দোলনে নারী ভাষা সৈনিকদের কথা কখনও তুলে ধরা হয়না। তারা সর্বদা উপেক্ষিত থেকে যায়।
মুক্তিযুদ্ধ ও নারী :
মার্চে শোকের মাতম এবং ডিসেম্বরে বিজয়ের বাজনা এইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উদ্যাপন। সেই স্মরণের তালিকায় সবকিছু আসে, আসে না কেবল সেইসব নারীদের কথা যাদের শোকের শরীক রাষ্ট্র হয়নি। তাদের বিজয় আজও আসেনি। বিজয়হীনা সেইসব নারীদের আমরা বীর ডাকিনা, ডাকি “বীরাঙ্গনা” বলে। “বীরাঙ্গনা” বলতে বোঝায় বীরের নারী, বীরের অঙ্গনা। বীরত্বের যে পুরুষতান্ত্রিক সংজ্ঞা তাতে কেবল পুরুষেরই অধিকার। নারীর কোটায় কেবল বীরের অঙ্গনা হবার অধিকার ছাড়া আর কিছুই করার নেই।
একাত্তরে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ নারীরা। তাদের ঘরে থাকা সহজ ছিল না, পালানো আরও কঠিন ছিলো। যুদ্ধে যেতে যাওয়াও যখন কঠিন ছিল তখনও অনেক নারী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ধর্ষিতার সারিতে তারা, গণহত্যার মোট উল্লেখযোগ্য অংশও তারা। মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কারো মতে ১০ লাখ কারো মতে ৩০ লাখ বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। বেশি সংখ্যাটাই যদি ধরি এবং ২০ শতাংশ যদি নারী হন, তাহলেও ৬ লাখ নারী নিহত হয়েছিলেন। ৪ লাখ চরম নির্যাতিত আর ৬ লাখ নিহত নারীর পরিণতি আমাদের জাতীয় মানসে কোন দাগ রেখে গেল? এই ১০ লাখ নারী কেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাবেনা। যদিও বর্তমানে তাদের নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
ধর্ষনের পরও বেঁচে থাকা নারীদের মধ্যে ২৫০০০ নারী গর্ভধারণ করেছিলেন। ওয়ার ক্রাইমস ফাইন্ডিং ফ্যাক্টস এর পুরোধা এম এ হাসান দাবি করেন এমন নারীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৮ হাজার ২০০। মাত্র ৫০০০ জনের গর্ভপাত সরকারীভাবে করানো হয়েছিল। বাকী প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ নারী গর্ভপাত স্থানীয় ক্লিনিক বা দাইয়ের মাধ্যমে করেছিলেন। এদের অনেকের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এসব নারীদের মান মর্যাদার কথা চিন্তা করে অনেক নথিপত্র নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। এভাবে জাতীয় অহম রক্ষার জন্য নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাসও মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। নির্যাতিত নারীদের স্মরণে কোন শহীদ মিনার বা স্মৃতি সৌধ নেই।
যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী। মা, স্ত্রী, বোন হিসেবে প্রিয়জনকে হারানো বা তার সবচেয়ে বড় সম্পদ সম্ভ্রম হারানো বাংলাদেশী নারীরা যুগে যুগে বিভিন্নভাবে এগিয়ে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন আবার আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছেন। আশ্রয় দিয়েছেন, গোপনে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। বরিশালের করুণা বেগমের স্বামীকে হত্যার পর তিনি গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে পুরুষের ছদ্মবেশে যুদ্ধ করেন। আহত না হওয়া পর্যন্ত তার সহযোদ্ধারা জানত না যে সে নারী। এছাড়া ফাতেমা, রোকেয়াসহ অনেকে ধরা পড়েছেন এবং অত্যাচারিত হয়েছেন। যুদ্ধশেষে তাদের পরিবার তাদের গ্রহণ করেনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নারীর জীবন অধ্যয়নের একটি বড় দিক। এই যুদ্ধে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ ছিল তার জীবনবাজি রাখার ঘটনা। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে মূলধারায় স্থাপন না করার ফলে নারীর প্রকৃত ইতিহাস যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নারী মুক্তিযুদ্ধে যে গৌররবগাঁথা রচনাকরেছিল তা নির্যাতিত এবং ধর্ষিত নারীর ভূমিকায় অদৃশ্য হয়ে আছে। প্রকৃত অবদান খুঁজে নারীকে মূলধারায় না আনার আরেকটি কারণ নিম্নবর্গের নারীরাই এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। নিম্নবর্গীয় নারীর ইতিহাস ক্ষমতাশীল সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পরে ১২ [বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও নারী- হোসেন, সেলিনা কথাসাহিত্যিক, ১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৫]।
©somewhere in net ltd.
১|
১০ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ৯:৩৮
নকীব কম্পিউটার বলেছেন: নারী তার পরিপূর্ণ মর্যাদা ও অধিকার পাক।