![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাধারণত গল্প লেখি, কবিতা আর তেমন মনে আসে না। এক কথায় গল্প নিয়ে আমার বসবাস। নিজের মত জোরালোভাবে প্রকাশের চেষ্টা করি। দেশকে ভালোবাসি, প্রেমকে শ্রদ্ধা করি।
'শুদ্র দ্য গংরিড'-এর ষষ্ঠ অধ্যায় 'শ্বেতরাজ্য' একসাথে প্রকাশ করা হলো।
-মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী
-------------------------------------
রাজকুমারী ইলি আর শুদ্র দাঁড়িয়ে আছে বাগানে। তার একটু দূরে কয়েকটি কবুতর সবুজ ঘাসের উপর খেলা করছিল। শুদ্র রাজকুমারী ইলিকে বলে, ‘ইলি, দেখবে কি হয়?’
শুদ্র হাত ইশারা করে কবুতরের দিকে তাকিয়ে। আর মুখে শিশিসসসকক করে শব্দ করতে লাগল। কবুতরেরা উড়ে শুদ্রের চারপাশে উড়তে লাগলো। ইলিতো বলে ওঠে, ‘আশ্চর্য! তুমি এটা কি করে করলে? এটা অসাধারণ!’
কবুতরেরা তাদের সাদা পাখা ঝাপটে এক অন্যরকম স্বর্গীয় পরিবেশের সৃষ্টি করলো। এমন সময় সোমান্দ্র আসে। সোমান্দ্র রাজকুমারী ইলিকে চলে যেতে বলে।
সোমান্দ্র বলে, ‘লুলু, তোমাকে রাজপ্রাসাদ ছাড়তে হবে। সমুদ্রে যেতে হবে।’
শুদ্র উৎসাহী হয়ে বলে, ‘সমুদ্র? সমুদ্রযাত্রা?’
শুদ্র সমুদ্রের কথা শুনেছে তবে কখনো ভাবতেই পারে নি সে এত দ্রুত সমুদ্রযাত্রায় যাবার সুযোগ পাবে। তাই তার উৎসাহের মাত্রা খুব বেশি।
সোমান্দ্র বলে, ‘হ্যা। আমরা সমুদ্রযাত্রায় যাবো। উত্তরের শ্বেতদেশে।’
শুদ্র বলে, ‘শ্বেতদেশ? সেটা আবার কোন দেশ?’
শুদ্রকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোমান্দ্র বলে, ‘সে এক আজব দেশ লিলু। আজব দেশ, সেই দেশ দেখতে সাদা। আমি জীবনে একবারই গিয়েছি শ্বেতদেশে।’
শুদ্র বলে, ‘শ্বেত দেশে কারা থাকে লিলু?’
সোমান্দ্র বলে, ‘সুন্দর সেই দেশ, ভয়ঙ্কর সেই দেশ। সব জানতে পারবে তুমি।’
শুদ্র বলে, ‘লিলু, আমরা কবে যাচ্ছি?’
সোমান্দ্র বলে, ‘কালকে সকালেই। রাজার নির্দেশে সব ব্যবস্থা করা শেষ। তোমার বাবা-মা আজকে তোমাকে বিদায় দিতে আসবে। আর সিদুও আমাদের সাথে যাচ্ছে।’
শুদ্র তটস্থ হয়ে পড়লো, সোমান্দ্রকে বলে, ‘লিলু, আমার বনের বন্ধুদের বিদায় দিবো না আমি?’
সোমান্দ্র বলে, ‘ঠিক আছে, তুমি বিদায় দিয়ে এসো। তবে দেরি করো না, দ্রুত ফিরে এসো।’
শুদ্র সিদুকে নিয়ে বনে চলে যায়। শিয়াল, বাঘ, হরিণ, কুমির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসে। বনের প্রাণীরা তার শুভ কামনা করে তাকে বিদায় দেয়। বিদায় বেলায় বনের প্রাণীদের চোখ ছল ছল করে ওঠে।
রাজপ্রাসাদে ফিরে দেখে তার বাবা-মা তার জন্য অপেক্ষা করছে। শুদ্র অশ্রুসজল চোখে বাবা মাকে বিদায় দেবার পর তার সহপাঠী বন্ধুদের বিদায় দেয়। অবশেষে চাঁদনী সেই রাতে তাকে বিদায় দিতে আসে রাজকুমারী ইলি। বিদায়কালে ইলি শুদ্রকে একটা গোলাকার তামার চাকতি দেয়।
বলে, ‘এটা সবসময় কাছে রাখবে, তাহলে দেখবে কোন বিপদ তোমার ধারের কাছে ঘেঁষছে না।’
শুদ্র বলে, ‘কে বলেছে তোমাকে?’
ইলি বলে, ‘বাবা বলেছে। বাবা এটা আমাকে দেবার সময় বলেছিল এটা আশীর্বাদপুষ্ট এক চাকতি। নানান রকম বিপদ থেকে মুক্তি দেয় এই চাকতি।’
শুদ্র বলে, ‘সত্যি! ধন্যবাদ তোমাকে।’
ইলি শুদ্রকে বলে, ‘তোমার সমুদ্রযাত্রা শুভ হোক।’
শুদ্র রাজকুমারীকে বিদায় দেয়। সেদিন সমুদ্র যাত্রার উৎসাহে তার ঘুম হারাম হয়ে গেল। আবার অন্যদিকে তার মন খারাপ হয় এই ভেবে যে, তার বন্ধুদের সাথে তার দেখা হবে না। বনে ঘুরোঘুরি করা হবে না। আবার সে জানেও না এ যাত্রা কতদিনের।
সকালে দরজায় টোকা পড়তেই দরজা খুলে দেয় শুদ্র। সোমান্দ্র দেখে শুদ্র সম্পুর্ণ প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে এসে দেখে সব সন্নারা দাঁড়িয়ে আছে। সন্নারা একে একে তার কপালে হাত দিয়ে দ্রুত মুখ নাড়তে থাকে। শুদ্র বুঝতে পারে সন্নারা তাকে আশীর্বাদ করছে। সন্নাদের কাছ থেকে বিদায় নিল শুদ্র।
ঘোড়ার পিঠে চড়ে শুদ্র, সোমান্দ্র আর সিদু বঙ্গের সমুদ্র বন্দরের দিকে রওনা দিল। শুদ্র চড়ল সোমান্দ্রের পিছনে। সমুদ্র বন্দর চিতলা শহরে অবস্থিত। চিতলা শহরে প্রবেশ করতে না করতে শুদ্র অবাক হয়ে গেল। শহরের মানুষগুলো একটু ব্যতিক্রমী। তাদের ভাষাও কিছুটা দুর্বোধ্য। একেকজনকে দেখলে মনে হয় ঠিকরে তাকিয়ে দেখছে তাদের। শুদ্র সোমান্দ্রকে বলে, ‘লিলু, এখানকার মানুষগুলো এভাবে তাকায় কেন?’
সোমান্দ্র বলে, ‘এ শহরের প্রায় সবাই নাবিক। সমুদ্রে থাকলে চারিদিকে চোখ কান খোলা রাখতে হয়। তাই সমুদ্রে এদের আচরণ যেমন এখানেও। কোন মানুষকে দেখলে এরা তা ধরে তাকে দেখে। ভয়ের কিছু নেই, ওরা ভালো করেই জানে আমরা রাজার লোক।’
তারপর কিছুদুর যেতেই একদল লোক হাতে মোটা গাছের ডাল নিয়ে তাদের ঘিরে ধরে। সোমান্দ্র ওদের বলে, ‘তোমারা জানো যে আমরা রাজা আজাকার লোক।’
লোকগুলো মাতাল ছিল, চিৎকার করে বলে, ‘রাজা আজাকা! সে আবার কোথথাকার রাজাআআ! মাটির নাকি আকাশের?’
শুদ্র মুখ চেপে হাসে। সোমান্দ্র বলে, ‘লুলু, তুমি চোখ বোজ।’
সোমান্দ্রের কথামতো শুদ্র চোখ বোজে। একটু পর চোখ খুলে দেখে মাতালগুলো অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
শুদ্র সোমান্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে, ‘লিলু, এটি হলো। ওরা কি মারা গেছে?’
সোমান্দ্র বলে, ‘না, অজ্ঞান হয়েছে। এদেরকে নিয়ে আমাদের ভাবলে চলবে না। চলো আমরা এগোই।’
শুদ্র বুঝতে পারে এটা সোমান্দ্রের কারসাজি। সে জানে, সন্নারা অনেক কারসাজি দেখাতে পারে, কিন্তু নিজে চোখে কখনো দেখে নি।
সন্ধ্যায় তারা জাহাজে পৌঁছে গেল। জাহাজ এত বড় হতে পারে শুদ্রের ধারণা ছিল না। সেতো জাহাজের উপর দৌড়া-দৌড়ি শুরু করে দিল। ৩৩ জন নাবিক আর ক্যাপ্টেন নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হলো সেই রাতে। নীল সমুদ্রের বুকে তাদের জাহাজ চলতে লাগলো। সমুদ্রতটের মিটমিটে আলো আস্তে আস্তে শুদ্রের চোখের আড়ালে চলে গেল। জাহাজের এখানে ওখানে অনেক বাতির ব্যবস্থা ছিল। জাহাজের উপর দাঁড়িয়ে রাতের প্রকৃতি দেখতে থাকে শুদ্র। নীল সাগরে রাতের প্রকৃতি তাকে বিমোহিত করে ফেলে। তারা আকাশ এত স্পষ্ট দেখা যায় যে, তা তাকে পাগল করে ফেলে। জাহাজের এদিক থেকে ওদিক শুদ্র শুধু দেখে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এবং একসময় চোখ বুজে আসলে সে ডেকেই ঘুমিয়ে পড়লো। সোমান্দ্র তাকে জাহাজের কেবিনে নিয়ে শুইয়ে দিলো।
ভোরে সিদু তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে, বলে, ‘চলো, সুর্যোদয় দেখি আমরা।’
শুদ্র একলাফে ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে ডেকে চলে যায়। ডেক থেকে পুব আকাশে তাকিয়ে দেখে, শুদ্রের কাছে এটা মনে হয় অন্য রকম কিছু, এ যেন এক নতুন সূর্যোদয়। সিদুও শুদ্রের পাশে এসে সূর্যোদয় দেখতে থাকে।
সিদু বলে, ‘এই সমুদ্র যাত্রার পর তোমার জীবন হবে এই সূর্যের মতো।’
শুদ্র’র একথার অর্থভেদ করার তাড়া নেই, সে সমুদ্র দেখতেই ব্যস্ত। এভাবে কয়েকমাস মাস চলে গেল। জাহাজ আস্তে আস্তে উত্তরের দিকে চলতে থাকে। বিভিন্ন বন্দরে বিভিন্ন রকমের মানুষ দেখে শুদ্র, বিভিন্ন দেশ দেখে, দেখে সমুদ্রের নানা মাছ, পাখি। ডলফিনের খেলা দেখতে তার খুব ভালো লাগে। কয়েকদিনে ডলফিনের সাথে ভাব হয়ে যায় তার। ডলফিনেরা প্রতিদিন বিকালে আসতো।
একরাতে প্রতিদিনের মত ডেকে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গুনছিল শুদ্র। সোমান্দ্র তার কাছে এসে দাঁড়ায়।
শুদ্র বলে, ‘লিলু, শ্বেতদেশ আর কতদূর?’
সোমান্দ্র বলে, ‘অনেক দূর এখনো। মাত্র অর্ধেক পথ এসেছি আমরা।’
শুদ্রের বনের কথা, বাবা-মার কথা, রাজ প্রাসাদের কথা, রাজকুমারী ইলির কথা মনে পড়ে। এ দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় সে কিছুটা মুচড়ে পড়ে। তাই সোমান্দ্রকে জিজ্ঞাসা করে, ‘লিলু, চলো আমরা ফিরে যায়। শ্বেতদেশে গিয়ে আমরা কি করবো?’
সোমান্দ্র বলে, ‘এখন সময় হয়েছে তোমাকে বলার। তুমি কি জানো তুমি অন্যদের মত নও। আর দশ-পাঁচটা ছেলের মতো। তুমি প্রাণীদের ইশারায় নির্দেশ দিতে পারো। আর তোমার কি মন চাই না প্রাণীদের সাথে কথা বলতে?’
শুদ্র বলে, ‘হ্যাঁ মন চাই, আমি প্রাণীদের চোখে শত শত আবেগ ভেসে উঠতে দেখি। কিন্তু ওদের কথার ভাষাতো বুঝতে পারি না। কিন্তু লিলু, ওদের সাথে কথা বলতে হলে তো আমাকেও লিলু হতে হবে। তোমাদের মত সন্না হতে হবে। আর আমি সন্না হতে চাই না।’
সোমান্দ্র বলে, ‘সন্না হতে হবে না তোমাকে। তুমি লুলু হয়েই থাকবে। কিন্তু তুমি যদি বনের প্রাণীদের সাথে কথা বলতে পারো তাহলে এটা হবে আমাদের রাজ্যের জন্য ভালো।’
শুদ্র বলে, ‘কেন?’
সোমান্দ্র বলে, ‘কারণ বন পুরাণের ভবিষ্যৎবাণীর কথা কেউ জানে না। সেই ভবিষ্যৎবাণী উদ্ধার না করতে পারলে বঙ্গরাজ্যের অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।’
শুদ্র বলে, ‘তা ঠিক আছে, তো শ্বেতরাজ্যে যেয়ে কি হবে? শ্বেতরাজ্যে গেলে কি আমি প্রাণীদের সাথে কথা বলা শিখে যাবো।’
সোমান্দ্র বলে, ‘শ্বেতরাজ্য এক বিরাট রাজ্য। যেখানে শুধু বরফ আর বরফ। এই রাজ্যে থাকে এক সাদা ভাল্লুক। এই সাদা ভাল্লুকই হচ্ছে শ্বেতরাজ্যের রাজা। শ্বেতরাজ্যের প্রতিটি প্রাণীরা ভাল্লুকের কথা শোনে। সেই ভাল্লুকের কাছে আছে এক শক্তিদন্ড। যার শক্তিতে সে পুরো শ্বেতরাজ্য শাসন করে। শ্বেতরাজ্যের প্রজারা সব বরফের তৈরি। রাত হবার সাথে সাথে শ্বেতরাজ্য জাগ্রত হয়ে ওঠে। আর শক্তিদন্ডে শক্তির সঞ্চার হয়। এই শক্তিদন্ডে লুকায়িত আছে সকল প্রাণীর ভাষা। কেউ যদি ভাল্লুককে বধ করে একবার ওই দন্ড স্পর্শ করে আসতে পারে তবে সে সব ভাষা বুঝতে পারবে। তবে কাজটা সহজ নয়। শ্বেতরাজ্যের সব প্রজাদের ফাঁকি দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে হবে।’
শুদ্র বলে, ‘লিলু, এটা দুঃসাহসিক। আমি পারবো তো।’
সোমান্দ্র বলে, ‘তোমাকে পারতে হবে। আমাদের এই অভিযান সফল করতেই হবে। রাজ্যের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ।’
এরপর থেকে শুদ্র নিজের মনকে প্রস্তুত করে শ্বেতরাজ্যের জন্য। সোমান্দ্র তাকে বলেছে সে তার সাথে থাকবে, তবু সে জানে আসল কাজ তাকেই করতে হবে। ভাল্লুককে দৃষ্টি দিয়ে বিমোহিত না করতে পারলে নির্ঘাত মরতে হবে তাদের। এদিকে দিন যত যায় সমুদ্রপথ তত দুর্গম হয়ে ওঠে। বরফের চ্যাঁইকে পাশ কাটিয়ে জাহাজ এগিয়ে চলে ধীরগতিতে। একদিন ভর দুপুরে সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠলো। চারিদিক অন্ধকার নেমে আসলো মূহুর্তে। শুদ্র ভয় পেয়ে গেল। জাহাজের নাবিকেরা ছুটোছুটি করতে লাগল। জাহাজ এদিক ওদিক দুলতে লাগলো। সবাই ভেবে নিল হয়তো হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়েছে জাহাজ। তবে সেই সময় সন্না সোমান্দ্র জাহাজের মাঝখানে বসে ধ্যান করতে লাগলো। জাহাজের ক্যাপ্টেন মরিয়া হয়ে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করছিল। সন্না সোমান্দ্রের কড়া নির্দেশ ছিল, যাই হয় যাক না কেন জাহাজ সামনে বাড়ানোর। তাই ক্যাপ্টেন এই ঝঞ্ঝার মধ্যেও জাহাজ সামনে বাড়িয়ে নিয়ে চলল।
কিছু সময় পর হঠাৎ করেই এক প্রকান্ড জলের দানো ভেসে উঠলো সমুদ্রে। দানোটা দেখতে কালো রঙের। দানোটা জাহাজের দিকে আসতে লাগলো। জাহাজের উপর যদি দানোটা আছড়ে পড়তো তবে জাহাজটা ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। তবে প্রথম দফায় জাহাজের পাশে গিয়ে পড়লো। এরপর দানোটা উঠতেই সন্না সোমান্দ্র দাঁড়িয়ে হাত উচিয়ে জোরে এক চিৎকার দিলো। জলের দানো এই চিৎকারে মুচড়ে পড়ে পালালো। মূহুর্তে অন্ধকার আলোতে পরিণত হলো। সমুদ্র শান্ত হয়ে উঠলো।
এ ঘটনার কয়েকদিন পরেই তারা শ্বেতরাজ্যে এসে পৌঁছালো। বরফে ঢাকা শ্বেতরাজ্যে হাড় কাপানো শীত। ভারী পোশাক পড়ে শুদ্র, সোমান্দ্র আর সিদু শ্বেতরাজ্যে পা দিল। দিনের বেলা হওয়ায় শ্বেত রাজ্যের রূপ তখনো প্রকাশিত হয় নি।
সোমান্দ্র হাত উঁচিয়ে বিরাট এক বরফের পর্বত দেখিয়ে বলে, ‘ঐ চুড়ায় বসবাস করে শ্বেত রাজ্যের রাজা সাদা ভাল্লুক। ভাল্লুক দিনে শিকারে বের হয়। তখন তার গুহা বন্ধ থাকে, কেউ প্রবেশ করতে পারে না গুহায়। শুধু রাতে ঐ গুহায় প্রবেশ করা যায়।’
শুদ্র সন্না সমান্দ্রের হাত চেপে ধরে হাঁটতে থাকে। দিনের বেলা তারা চলতে থাকে আর রাতের বেলা তাবু টাঙিয়ে থাকে। তাবু বরফে ঢেকে দেওয়ায় বরফের জন্তু জানোয়ারেরা টের পায় না। রাত হতে না হতেই বরফ রাজ্য কেঁপে ওঠে। নানা রকম শব্দ ভেসে ওঠে। দু’দিনে তারা অর্ধেক পথ পাড়ি দেয়। দ্বিতীয় দিন রাতেও তারা ঘুমিয়ে গিয়েছিল তাবুতে। মাঝরাতে শুদ্রের ঘুম ভেঙে গেল। বাইরের নানান বিচিত্র শব্দ তাকে মোহিত করে ফেলে। চুপি চুপি উঠে তাবুর বাইরে গিয়ে দেখে এক ব্যস্ত নগরী। বরফের মানুষেরা তাদের নিত্য কাজ করে বেড়াচ্ছে। আকাশের চাঁদের আলোয় বরফ রাজ্য আলোকিত হয়ে সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। একটু দূরেই একটা বরফের খরগোশ খেলা করছিল। শুদ্র খরগোশটাকে আদর করতে তার কাছে গেল। খরগোশটা দৌড়ে পালায়। এভাবে শুদ্র বরফের মানুষদের কাছে চলে গেল। বরফ মানুবেরা তাকে দেখে অবাক হলো। কেউ কেউ তার গায়ে হাত দিয়ে ছুতে লাগলো। তার বয়সী এক বরফ মানবের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলল শুদ্র। যদিও তাদের ভাষা সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। একরকম তার চারপাশে বরফ মানবদের জটলা লেগে গেল। এসময় শুদ্র ভাবল, লিলু তাকে অযথাই বাইরে বেরাতে দেয় না গতকাল।
তবে হুট করে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। বরফ মানবেরা যে যেদিকে পারলো ছুটতে লাগলো। মূহুর্তের মধ্যেই সে দেখতে পেল, একদল কালো জন্তু তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। আসলে এগুলো ছিল শ্বেতরাজ্যের শয়তান নেকড়ে। এরা রক্তের গন্ধ পেলে ছুটে আসে শিকার করতে। এছাড়া বরফ মানবদের গুড়িয়ে দিয়ে এরা শান্তি পায়। কেননা বরফ মানবেরা তাদের কথা না শুনে সাদা ভাল্লুকের কথা শোনে।
শুদ্র এই পরিস্থিতিতে ভয়ে চিৎকার করতে পারতো। তবে বাঘ-কুমিরকে যেখানে সে ডরায় না, সেখানে এত দ্রুত সে নেকড়েদের ভয় পেল না। প্রথমে নানা শব্দে নেকড়েদের সাথে ভাব বিনিময় করার চেষ্টা করে। তবে শুদ্র তখনো জানে না নেকড়েরা কতটা ভয়ঙ্কর। নেকড়ের বড় বড় দাঁত আর জ্বলজ্বলে চোখ তার মনে ভয়ের সঞ্চার করতে লাগলো। তবে এমন অঙ্গ ভঙ্গিমা সে করতে লাগলো যার জন্য নেকড়েরা তাকে আক্রমণ করতে সময় নিচ্ছিল। এছাড়া সেই মূহুর্তে তার মনে পড়ে রাজকুমারী ইলির দেওয়া চাকতির কথা। চাকতিটা কাঁপা হাতে বের করে নেকড়েদের দিকে ধরে। তামার চাকতিটা জ্বলে ওঠে আলোর মতো। নেকড়েরা কিছুটা পিছু হটে কিন্তু তাকে চারপাশ থেকে ঘিরেই থাকে।
এমন সময় বিকট একটা শব্দ হতে লাগলো। শব্দটা আর কিছুর না সাদা ভাল্লুকের ছিল। এ বিকট ডাকে সোমান্দ্র আর সিদুর ঘুম ভেঙে গেল। পাশে শুদ্রকে না পেয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। সোমান্দ্র আর সিদু তাবু থেকে বের হয়ে দেখে কিছু দূরে শুদ্রকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে নেকড়েরা। তারা তাদের তরবারি বের করে এগুতে থাকে। কিন্তু আবার বিকট শব্দে ডেকে ওঠে ভাল্লুক। নেকড়েরা সেই গর্জন শুনে পিছু হটতে থাকে। নেকড়েরা যেতেই শুদ্র দৌড়ে সোমান্দ্রের কাছে এসে কান্না শুরু করে বলতে থাকে, ‘লিলু! লিলু!’
সোমান্দ্র শুদ্রকে নিয়ে তাঁবুতে ফেরে তবে শুদ্রকে কিছু বলে না। সোমান্দ্রের মনে একটা কথাই ভাসতে থাকে ‘শ্বেতরাজ্যের রাজা কারণ ছাড়া ডাকে না। আর এটাও বুঝতে পারলো সাদা ভাল্লুক আশেপাশেই আছে। কিন্তু রাতে তো রাজা বাইরে বের হয় না।’ কোন সন্নাই আজো সাদা ভাল্লুকের ডাক শুনতে পায় নি। এই ডাক কিসের পূর্ব সঙ্কেত তা সোমান্দ্র বুঝতে পারলো না। এটা ভাগ্যের না দুর্ভাগ্যের তা সারা রাত ধ্যান করেও বের করতে পারলো না সোমান্দ্র।
সকালে যাত্রা করতে করতে শুদ্র সিদুকে বলে, ‘জানো কাল রাতে আমি কি দেখেছি?’
সিদু বলে, ‘কি?’
শুদ্র বলে, ‘বরফের খরগোশ। এছাড়াও বরফ মানব দেখেছি। ওদের সাথে আমি হাত মিলিয়েছি। তবে কালো জন্তুগুলো আসার সাথে সাথে ওরা বরফের চাইয়ের ভিতর গা মিলিয়ে গেল।’
সোমান্দ্র বলে, ‘ওরা হচ্ছে প্রজা। আর যে কালো জন্তুগুলো দেখেছ ওগুলো শ্বেতরাজ্যের রাজার জাতশত্রু।’
গতরাতের পর এই প্রথম সন্না সোমান্দ্র কথা বলাই শুদ্র খুশি হয়, সোমান্দ্রকে বলে, ‘লিলু, আমি আর এমন কাজ করবো না। আসলে কাল রাতে কিভাবে আমি বাইরে গেলাম নিজেই বলতে পারবো না।’
সোমান্দ্র বলে, ‘ওটা তোমার ভাগ্যে ছিল। এবিষয়ে আর কথা নয়।’
এভাবে আরো তিনদিন চলার পর তারা পর্বতের চূড়ায় পৌছালো। তারা পর্বতের চুড়ায় লুকিয়ে থাকল। তারপর যখন রাত নামলো সাদা ভাল্লুক ফিরে আসলো। শুদ্র ভাল্লুকের বিশালাকার শুভ্র চেহারা দেখে বলে উঠলো, ‘মনোরম! তুলার মত!’ ভাল্লুক তার গুহা উন্মুক্ত করলো। গুহা উন্মুক্ত করার সাথে সাথে গুহা থেকে ঠিকরে আলো বের হলো। সাথে সাথে জেগে উঠলো শ্বেতরাজ্য। বরফ মানব এবং প্রাণীরা বরফের চ্যাঁই থেকে বের হয়ে আসতে লাগলো। সিদু বলে উঠলো, ‘এ দৃশ্য জীবনে একবারই দেখা যায়।’
সন্না সোমান্দ্র শুদ্রকে বলে, ‘লুলু, তুমি এই গুহায় প্রবেশ করবে। মনে রাখবে তোমাকে ভয় পেলে হবে না। আমার আশীর্বাদ তোমার সাথে আছে। তুমি গুহাতে নিঃশব্দে ঢুকে দেখবে ভাল্লুক ঘুমিয়ে আছে। আর তার মাথার সামনে সেই শক্তিদন্ড। সাবধান! ভাল্লুক কিন্তু আসলে ঘুমায় না, ঘুমের ভান করে থাকে। তুমি ভাল্লুকের মাথার কাছে যাবে, আর এই যে দেখছো বোতল এই বোতলের তরল ভাল্লুকের নাকের সামনে রাখবে। তাহলে ভাল্লুক অজ্ঞান হয়ে পড়বে। কয়েক মূহুর্ত অজ্ঞান থাকবে ভাল্লুক। এর মাঝে তুমি শক্তিদন্ড স্পর্শ করে আসবে।’
শুদ্র বলে, ‘ঠিক আছে লিলু।’
সিদু বলে, ‘আর শোন! কোন বিপত্তি হলে চিৎকার করে আমাদের ডাকবে।’
শুদ্র চলে গেলে সোমান্দ্র বলে, ‘এটা বিপদজনক। আর আমার পক্ষেও গুহাতে ঢোকা সম্ভব নয়। সিদু, বিপত্তি হলে কি করতে হবে মনে আছে তো?’
সিদু বলে, ‘সব মনে আছে। আমার জীবন চলে গেলেও আমি শুদ্রের ক্ষতি হতে দেবো না। তবে আমি যদি সেটা করি তাহলে আমরা বিপদেও পড়তে পারি। আপনি জানেন, সাদা ভাল্লুক কতটা শক্তিশালী।’
সোমান্দ্র বলে, ‘সেটা অবশ্য ঠিক। তুমি যেভাবেই হোক শুদ্রকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসবে।’
শুদ্র ভিতরে যাবার পর অনেক সময় হয়ে আসলো তবু শুদ্রের ফেরার নাম নেই। সোমান্দ্র আর সিদু অস্থির হয়ে পড়লো। শেষে সিদ্ধান্ত হলো, সিদু ভিতরে যাবে আর সোমান্দ্র গুহার মুখে অপেক্ষা করবে।
তবে তারা গুহার মুখে যেতে না যেতেই ভাল্লুক ডেকে উঠলো বিকটভাবে। সাথে সাথে পুরো শ্বেত রাজ্য দ্বিগুণ গতিময় হয় গেলো। চারপাশ থেকে বরফ মানব আর প্রাণীরা গুহার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। সোমান্দ্র ভয় পেয়ে গেলো। কি ঘটতে চলেছে বোঝার আগেই দেখে শ্বেত রাজ্যের রাজা তার বিরাট থাবা ফেলে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সোমান্দ্র আর সিদু কিছুটা দূরে চলে যায়।
সোমান্দ্র হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে, ‘সিদু, এটা অসম্ভব।’ তারপর হাত উঁচিয়ে দেখায়, শুদ্র ভাল্লুকের পিঠে উঠে আছে। সোমান্দ্র ভালো করেই জানে শ্বেতরাজ্যে রক্ত মাংসের মানুষদের ঢোকার কোন অনুমতি দেয় না শ্বেতরাজা। সেই শ্বেতরাজা শুদ্রকে পিঠে নিয়ে। শ্বেতরাজা তাদের দিকে এগিয়ে আসতেই শুদ্র বলে ওঠে, ‘ওদের কিছু করো না। ওরা আমার বন্ধু। ওরাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।’
শ্বেতরাজা তাদের ভাষায় কথা বলছে আর শুদ্রও বলছে, তার মানে শুদ্র শক্তিদন্ডের স্পর্শ পেয়েছে। সোমান্দ্র এটা বুঝতে পেরে খুশি হয়। কিছু সময়ের মধ্যেই শ্বেতরাজ্যের সব বরফ মানব-প্রাণীরা গুহার চারিদিকে ভিড় করতে থাকে।
সোমান্দ্র আর সিদু শ্বেতরাজার নির্দেশে তার পাশে যায়। সোমান্দ্র বলে, ‘মহারাজা! এটা অন্ততঃ আমি আশা করি নি। এটা অসম্ভব। আমার জানা মতে লাল রক্তের মানুষদের এ রাজ্যে আশা নিষেধ।’
শ্বেতরাজা সোমান্দ্রের সাথে মশকরা করে বলে, ‘তুমি বড্ড চালাক। ৩০ বছর আগে তুমি এসেছিলে শক্তিদন্ড ছুঁতে। তোমার গায়ে ছিল লাল রঙের পোশাক। তোমার কাধে ছিল সাদা পানির পাত্র। দুপাশে দুটো রৌপ্য খচিত তলোয়ারও ছিল। তোমরা কি মনে করো সামান্য ঐ তরলেই আমি কুপোকাত হয়ে যাবো।’ হুংকার ছেড়ে বলে প্রজাদের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শ্বেতরাজ্যের রাজা অতটা দুর্বল নয়। সোমান্দ্র, তোমাদের আসতে দিয়েছি আজকের জন্য। আমরা এই আজকের অপেক্ষায় ছিলাম। এই সন্তানের চোখের জল শ্বেতরাজ্যে পড়েছে। এই সন্তান একদিন হয়ে উঠবে শ্বেতরাজ্যের রক্ষাকর্তা।’
শুদ্র ভাল্লুকের পিঠে বসে অবাক চোখে শুধু বরফ মানবদের দেখতে থাকে মুখে হাসি নিয়ে। শ্বেতরাজা বলে ওঠে, ‘আমরা আমাদের রাজ্যে রক্ত মাংসের মানুষদের নিরাপত্তা দিতে পারি না। শক্তিদন্ডের সেই ক্ষমতা নেই, সেজন্য লাল রক্তের মানুষদের আসতে মানা এ রাজ্যে। লাল রক্তের মানুষদের সাথে আমাদের শত্রুতা নেই, তবে ভয় আছে। তবে এই সন্তান আমাদের মুক্তি দেবে একদিন।’
সন্না সোমান্দ্র শুদ্রের শ্বেতরাজ্যে শুদ্রের এ প্রাপ্তিতে খুশি হয়। শ্বেতরাজা প্রজাদের নির্দেশ দেয়, তাদেরকে যেন জাহাজে নিরাপদে পৌঁছানোর সব ব্যবস্থা করা হয়। সোমান্দ্র শ্বেতরাজাকে বলে, ‘মহারাজা! শুদ্রকে যাবার অনুমতি দিন।’
শ্বেতরাজা সোমান্দ্রকে বলে, ‘তোমরা যাও। আমি নিজে শুদ্রকে সকালে পৌঁছে দেবো।’
সোমান্দ্র আর সিদুকে নিয়ে যেতে একটা বরফের ঘোড়ার গাড়ি এসে হাজির হয়। সিদু তাবুটা গাড়ির আসনে পেতে দু’জন উঠে পড়ে। শুদ্র হাত নেড়ে তাদের বিদায় জানায়। সোমান্দ্র আর সিদুও হাত নেড়ে বিদায় জানায় সবাইকে। সকালের আগেই তারা জাহাজের কাছে পৌঁছে যায়। ঠিক তখনই দেখে শ্বেতরাজা শুদ্রকে পিঠে নিয়ে আসছে। শ্বেতরাজা শুদ্রকে সোমান্দ্রের কাছে দিয়ে সবাইকে বিদায় জানাই। শুদ্র কান্না থামিয়ে রাখতে পারে না, শ্বেতরাজার চোখেও জল।
কেন এ জল, সোমান্দ্র বুঝে উঠতে পারে না। কি হয়েছিল গুহার ভিতর তাও জানা নেই, শ্বেতরাজা সারা রাত শুদ্রকে নিয়ে কোথায় ছিল তাও তার জানা নেই। জাহাজ পাল তুলে আবার চলতে শুরু করলে, ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করলো সোমান্দ্র একবার। শুদ্র বলে, ‘লিলু, ওকথা আমি বলতে পারবো না।’
সোমান্দ্র সিদুকে নির্দেশ দিয়ে বলে, ‘এ ঘটনা যেন আর কেউ না জানে।’
******************************************
©somewhere in net ltd.
১|
২৫ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১০:৩৬
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: চলুক । আগের পর্বটি পড়া হয় নি ভ্রাতা
ভালো থাকবেন