নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অদৃষ্টরে শুধালেম, চিরদিন পিছে, অমোঘ নিষ্ঠুর বলে কে মোরে ঠেলিছে?সে কহিল, ফিরে দেখো। দেখিলাম থামি, সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।

মুবিন খান

নিজের পরিচয় লেখার মত বিখ্যাত বা বিশেষ কেউ নই। অতি সাধারণের একজন আমি। লিখতে ভাল লাগে। কিন্তু লেখক হয়ে উঠতে পারি নি। তবে এই ব্লগে আসা সে চেষ্টাটা অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্য নয়। মনে হল ভাবনাগুলো একটু সশব্দে ভাবি।

মুবিন খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফ্যান্টাসিঃ একটি বানানো গল্প

১৪ ই নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৪৯



এক

ইমিগ্রেশনের মেয়েটা ভুরু কুঁচকে আনিস সাহেবের দিকে তাকাল। মনে হলো খুবই অল্পবয়সি মেয়ে। তারপর বলল, ‘পাসপোর্ত।’

আনিস সাহেব কোটের বুকপকেট থেকে পাসপোর্ট বের করে বাড়িয়ে দিলেন। হাত বাড়িয়ে পাসপোর্ট নিল মেয়েটা। কোঁচকানো ভুরু আরও একটু কুঁচকে পাসপোর্ট পর্যবেক্ষণ করতে করতে কম্পিউটরের কিবোর্ড টেপাটেপি করতে লাগল। আনিস সাহেব ভীতু মানুষ। ভয় পেয়েছেন কিনা বুঝতে পারছেন না। মনে হলো নার্ভাস বোধ করছেন। শুনেছেন বাংলাদেশ আর মুসলিম দেখলে নাকি এরা খুব হেনস্তা করে। এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে আনিস সাহেব নার্ভাসনেস কাটাতে চাইলেন।

‘লুক হিয়ার।’

কানে যেতেই মেয়েটার দিকে ফিরলেন। অকারণেই হাসলেন। বেচারা এবার ভয় পেয়েছেন। তাঁর বুকের ভেতরটা ঢিবঢিব করছে। মেয়েটা তার পাশের অত্যাধুনিক ক্যামেরার দিকে তর্জনী তাক করে সেদিকে দেখতে বলছে। আনিস সাহেব মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালেন। তাঁর দাঁড়ানোর ভঙ্গীটা গ্রুপ ছবি তুলতে লোকে যেভাবে দাঁড়ায় অনেকটা তেমন। মেয়েটা বলল, ‘রিমুব ইওর গ্লাস।’

কণ্ঠে যেন কিছুটা বিরক্তি মেশানো। আনিস সাহেব চোখের চশমা খুলে নিলেন। দুহাত দুপাশে টানটান করে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ালেন। মেয়েটা এবার ডয়েচ উচ্চারণ আর ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘মেমিংগ্যানে কী কাজে এসেছ?’

‘তিনদিন পর এখানে একটা লেখক সম্মেলন হচ্ছে। আমাকে আয়োজকরা চিঠি লিখে অংশ নিতে ডেকেছে। তুমি কি চিঠিটা দেখতে চাও?’ আনিস সাহেবের কন্ঠে দৃঢ়তা।

মেয়েটা বলল, ‘তুমি লেখক?’

এ কথার উত্তর হয় না। লেখক সম্মেলনের লোকেরা নিশ্চয়ই একজন অলেখককে ডাকবেন না। উত্তর না দিয়ে আনিস সাহেব মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চিঠিটা বুক পকেটেই রয়েছে। দেখতে চাইলে বের করে দেবেন। কয়েক সেকেন্ড পরে মেয়েটা আনিস সাহেবের পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিল, ‘গো।’

যাবেন! সে কথা প্রশ্ন করে জানতেও চাইলেন। মেয়েটা আবারও বলল, ‘ইয়েস, গো।’

এবার যেন মেয়েটার ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা দেখা গেল। যেন আনিস সাহেবের মনের অবস্থা বুঝে ফেলেছে। বুঝে ফেলে মজা পেয়েছে। আনিস সাহেবের ভালো লাগল। নিজের নার্ভাসনেস দিয়েই হোক, মেয়েটাকে হাসাতে তো পেরেছেন!



দুই

যাত্রীদের নিতে আসা লোকেদের ভীড়ে অনেকেই বোর্ড হাতে দাঁড়িয়ে। বোর্ডে যাত্রীর নাম লেখা। আনিস সাহেব আশা না করলেও একটা বোর্ডে খাঁটি বাংলায় লেখা নিজের নাম দেখতে পেলেন। তানিয়া বোর্ডটা উঁচু করে ধরে যাত্রীদের ভীড়ে চোখ বুলাচ্ছেন। একটা অপ্রত্যাশিত আনন্দ বয়ে গেল তাঁর ভেতরে। এ আনন্দ অচেনা অজানা বন্ধু পরিজনহীন একটা দেশে হাজারও মানুষের ভীড়ে একজন স্বজন পাওয়ার আনন্দ। আনিস সাহেবের মুখটা আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি এগিয়ে গেলেন তানিয়ার দিকে।

লেখক সম্মেলনে আনিস সাহেবের যোগ দেওয়ার সকল আয়োজন তানিয়াই করেছেন। আনিস সাহেব লেখক হিসেবে এমন আহা মরি গোছের কেউ নন। তাঁর সেই বিশেষত্বহীন লেখা তানিয়া পড়েছেন। তারপর অনলাইনে পরিচয়। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। একদিন লেখক সন্মেলনের কথা জানিয়ে আনিস সাহেবকে যোগ দিতে বললেন। আনিস সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে। ব্যবস্থা করেন।’

আনিস বুঝতে পারেন নি তানিয়া সত্যিই ব্যবস্থা করে ফেলবেন। দুদিন পরেই চিঠি পেলেন। সঙ্গে প্লেনের টিকেট। সেই চিঠি দেখে অ্যাম্বেসিও ভিসা দিয়ে দিল। সবই এমন দ্রুততায় ঘটে গেল! তারপর তো এই যে এসেই পড়লেন মেমিংগ্যান।

তানিয়া শাড়ি পরে এসেছেন। চারপাশে পশ্চিমা পোশাক পরা নারী পুরুষদের মাঝে শাড়ি বেমানান পোশাক হলেও তানিয়া মানিয়ে গেছেন। সুন্দর লাগছেন। সকলের মাঝে অন্যতম হয়ে আছেন। তানিয়া হাসলেন। তানিয়ার হাসির বিশেষত্ব হলো হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে পুরো মুখটাই হাসতে থাকে। তানিয়া সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘কেমন আছেন?’

‘নার্ভাস হয়ে ছিলাম। এখন ভালো আছি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন?’

‘বেশিক্ষণ না। আসেন যাই।’

পাশের রেলিংয়ে রাখা ওভারকোটটা তুলে নিয়ে তানিয়া ঘুরে হাঁটতে লাগলেন। বাইরে বেরিয়ে মোটা সোয়েটার পরা আনিস সাহেব ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে তানিয়ার পেছন পেছন গাড়িতে এসে পৌঁছলেন।



তিন

মিনিট দশেকের মধ্যেই আনিস সাহেবকে নিয়ে তানিয়া বাড়ি পৌঁছে গেলেন। ছোট্ট দোতলা একটা বাড়ি। ডুপ্লেক্স। আধুনিক আর যত্নে সাজানো। দোতলার কোণার একটা ঘর আনিস সাহেবকে দিয়েছেন তানিয়া। পুরো বাড়ির মতো ওই ঘরটাও চমৎকার আর যত্ন দিয়ে সাজানো। যাকে বলে বিলাসবহুল। ঘরটা নিয়ে আনিস সাহেবের উসখুস আছে। বেরুতে হলে বলতে গেলে পুরো বাড়ি হেঁটে বেরুতে হবে। নিচতলার একটা ঘর পেলে ভালো হতো। যখন তখন বেরুনো যেত। কিন্তু যে ঠান্ডা। বের হয়ে যাবেনই বা কোথায়। এ বাড়িতে কি সিগারেট খাওয়া যায়? কোথাও তো কোনও অ্যাশ ট্রে দেখলেন না। সিগারেট খেতে হলে তো বাইরে যেতেই হবে।

ভাবতে ভাবতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেলেন আনিস সাহেব। একসময় ঘুমিয়েও গেলেন।



চার

সন্ধ্যা সাতটার কিছু আগেই তানিয়া এসে আনিস সাহেবকে ডেকে তুললেন। তিনি হাতমুখ ধুয়ে এলে ডিনার টেবিলে ডেকে নিলেন। তানিয়ারা সন্ধ্যা সাতটাতেই ডিনার সেরে ফেলেন। শুনে আনিস সাহেবের চোখমুখ শুকিয়ে গেল। বলে কি! এখন রাতের খাবার খেয়ে নিলে রাত বারোটা একটার দিকে তো আবার খিদে পাবে। এরা তো থাকবে ঘুমিয়ে। যদি জেগেও থাকে, আনিস সাহেব তো খাবার চাইতে পারবেন না! ভাবনাটা চকিতে সরে যেতেই আনিস সাহেব লজ্জা পেলেন। তিনি খাবার নিয়ে ভাবছেন! লজ্জা একটু পাওয়ারই কথা।

খাবার টেবিলে বসে আনিস সাহেব মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সবই দেশি রান্না। ভর্তা, ভাজি, সবজি এসবে টেবিল ঠাসা। খেতে বসে আলোচনা চলতে লাগল। তানিয়ার কথা। তানিয়ার স্বামীর কথা। তাদের তিনকন্যার কথা। স্বামী এখন জার্মানের বাইরে। কাজে গেছেন। তিনকন্যারা আছে। এরা কথা বলে বাংলা আর ডয়েচ ভাষায়। আনিস সাহেব তাদের সবকথা না বুঝলেও শুনে মজা পাচ্ছেন। তিনকন্যা সারাক্ষণই পাখির মতো কিচির মিচির করছে। তানিয়াকে বারবার ওদেরকে ধমক দিয়ে থামাতে হচ্ছে। ধমক খেয়ে এরা খিলখিল করে হেসে উঠছে। হাসি সংক্রামক। এদের হাসি দেখে আনিস সাহেবও কিছু না বুঝেও হেসে উঠছেন।

তানিয়া বললেন, ‘লেখক সমাবেশ হতে তো এখনও দুদিন বাকি। কাল আমাদের একটা আড্ডা আছে। চলেন ঘুরে আসবেন। আশা করছি আপনার ভালো লাগবে।’

‘আড্ডা! কিরকম বলেন তো!’ আনিস সাহেবের কন্ঠে কৌতুহল।

‘এখানকার মুসলিম পরিবারগুলো একসঙ্গে হই। শুরুতে শুধু বাঙালিরা আসত। এখন ভারতীয়, পাকিস্তানি, টার্কিশরাও আসে। স্থানীয় জার্মান মুসলিমও আসে। সবাই বন্ধু।’ বললেন তানিয়া।

‘কী হয় আপনাদের ওই আড্ডায়? শুধু মুসলিম পরিবারগুলো একসঙ্গে হয় বললেন তো তাই জিজ্ঞেস করছি।’ কৌতুহলী কন্ঠে বললেন আনিস সাহেব।

তানিয়া বললেন, ‘আড্ডাই হয়। মুসলিম পরিবারের বৈঠক শুনে ভাববেন না ধর্মীয় কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। পারিবারিক বন্ধুরা মাসে একবার দুবার একসঙ্গে হই আর কি।’

আনিস সাহেব কিছু বললেন না। তানিয়ার ব্যাখ্যা শেষ হয় নি। তিনি সেটা শুনতে চাইছেন। তানিয়া বলতে থাকেন,

‘বাংলাদেশের এক ভদ্রলোক আছেন। ফেরদৌস হাসান। বয়স্ক মানুষ। মিউনিখ থাকেন। তিনি মাসে একবার আসেন। খুব ভালো এবং উদার একজন মানুষ। ধর্ম নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেন। সবার প্রশ্নের উত্তর দেন। কাল তিনিও আসবেন। কথা বললে আপনার ভালো লাগবে। আলাপী মানুষ।’

আনিস কি বলবেন ভেবে পেলেন না। ধর্ম বিষয়ক আলোচনায় তার আগ্রহ কম। এই ধরনের বৈঠক তিনি এড়িয়ে চলেন। ধর্মবিষয়ক প্রশ্নগুলোর উত্তর তিনি বইপত্র থেকেই সংগ্রহ করতে আগ্রহী। কিন্তু তানিয়ার আগ্রহ দেখে তাকে বলতে পারলেন না এসব কথা। তানিয়া যেন আনিস সাহেবের ভাবনা পড়ে ফেললেন। বললেন, ‘আহা চলেনই না। এখানকার বাঙালিদের সঙ্গে পরিচিত হবেন। তারা কেমন আছে জানবেন। সবকিছুই আপনার কাজের হতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই।’

বলে তানিয়া হাসতে লাগলেন।তানিয়ার হাসি খুব সুন্দর। যখন হাসেন, হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তখন পুরো মুখটা হাসতে থাকে। তার চোখও হাসতে থাকে। আনিস সাহেব মুগ্ধ হয়ে ছড়িয়ে পড়া হাসি দেখতে থাকেন।



পাঁচ

জার্মানির ব্যাভারিয়া রাজ্যর ছোট্ট একটা শহর মেমিংগ্যান। মাত্র বিয়াল্লিশ হাজার লোক বাস করে এ শহরে। সয়াবিয়া এলাকার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হলো মেমিংগ্যান। ফলে শিক্ষাকেন্দ্রগুলোও এ শহরেই গড়ে উঠেছে। প্রচুর খালি জায়গা। এই শহরের ঐতিহাসিক পরিচিতি রয়েছে। মেমিংগ্যান রোমান সম্রাজ্যর অংশ ছিল। অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপত্য এখনও বর্তমান। রয়েছে অনেক দূর্গ। এখনকার বাড়িগুলো সবদিক থেকে আধুনিক হলেও ওইসব স্থাপত্যর সঙ্গে মিলিয়ে নকশা করা। যদিও ধীরে ধীরে মেমিংগ্যানের লোকেরা এ থেকে বেরিয়ে আসছে। এখন লোকেরা আধুনিক আর্কিটেক্টে বাড়ি তুলছে।

গাড়ি চালাতে চালাতে তানিয়া তুষার ঢাকা শহরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। যদিও তানিয়া মেমিংগ্যানকে শহর নয়, গ্রাম বলেই উল্লেখ করছিলেন। কথা বলতে বলতে তারা পৌঁছে গেলেন গন্তব্যে। একটা বাড়ির সামনে থামল গাড়ি। বাড়িটা শহরের এক প্রান্তে। গাড়ি থেকে নেমে সামনের রাস্তাটার দিকে ইশারা করে তানিয়া বললেন, ‘এই যে রাস্তাটা দেখছেন, এ রাস্তা ধরে মিনিট বিশেক গাড়ি চালালে অস্ট্রিয়া পৌঁছে যাবেন। আর যদি ডানদিকে মোড় নিয়ে যেতে থাকেন তবে তিরিশ মিনিটে পৌঁছে যাবেন সুইটজারল্যান্ড।’ শুনে আনিস সাহেব চমৎকৃত হলেন।

কথা বলতে বলতে বাড়ির সদর দরজায় এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল। স্থুল আকৃতির এক ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে হাসতে হাসতে তানিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন। ওটা যে আনন্দর চিৎকার ছিল সেটা আনিস সাহেব শুরুতে বুঝতে পারেন নি। তানিয়াও হাসছিলেন হয়ত তবে তাঁর মনে হলো তানিয়া হাঁসফাঁস করছেন। ইচ্ছে হলো ছুটে গিয়ে ভদ্রমহিলার হাতের বাঁধন আলগা করে দেন। কিন্তু ভাবনাটাই সার। সাহস পেলেন না।



ছয়

এ বাড়িটাও তানিয়ার বাড়ির মতোই ডুপ্লেক্স। তবে বসার ঘরটা বেশ বড়। প্রায় চারপাশের দেয়ালই সোফা দিয়ে ঘেরা। তেরো চোদ্দজন মানুষ বসে আছেন। তারপরও ঘরটা অনেকটাই ফাঁকা। ঠিক মাঝের দেয়ালে একটা একলা সোফায় একজন লোক বসে। পরনে সাদা স্যুট। গলায় বো টাইটাও সাদা। সুট্যের সঙ্গে মিলিয়ে চুলও সাদা। কিন্তু দুয়েকটা চুল তখনও বিদ্রোহ করে কালোই রয়ে গেছে। তানিয়া আর আনিস সাহেব ঘরে ঢুকতেই ঘরের সবাই তাকালেন। তানিয়া এগিয়ে গেলেন। পেছন পেছন আনিস সাহেব। তানিয়া সালাম দিয়ে বললেন, ‘হাসান চাচা, নতুন অতিথি নিয়ে এসেছি।’

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। আনিস সাহেবের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম। আমি ফেরদৌস হাসান। কেমন আছেন আনিস সাহেব?’

আনিস সাহেব চমকে উঠলেন।ভদ্রলোক বললেন, ‘অবাক হবেন না। এখানের সবাই জানে বাংলাদেশ থেকে একজন লেখক আসছেন। তাই আপনি কাউকে চিনতে না পারলেও সবাই আপনাকে দেখেই চিনেছে।’

আনিস সাহেব সে জন্যে চমকান নি। এই ভদ্রলোককে তাঁর খুব চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু চিনতে পারছেন না। চিনতে পারার আশায় ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভদ্রলোক নিজের সোফায় ফিরে গেলেন। আনিস সাহেবও বসলেন। কিন্তু ভদ্রলোকের মুখ থেকে দৃষ্টি সরাতে পারলেন না।

ভদ্রলোক তখন বলে চলেছেন, ‘এক লোক গেছে হুজুরে পাক (সাঃ) এর কাছে। গিয়ে বলছে, হুজুর আমি এত এত পূণ্য কাজ করতে পারব না। কিন্তু আমি বেহেশতে যেতে চাই। আপনি আমাকে বেহেশতে যাওয়ার পথ বলে দেন।

হুজুরে পাক (সাঃ) বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে বেশি কিছু করতে হবে না। তোমাকে সারাজীবনে শুধু দুটা কাজ করতে হবে, তাহলেই তুমি বেহেশতে যাবে। আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি।

লোকটা বলল, কি কাজ হুজুর?

তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বললেন, এখন থেকে তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে এবং কখনও মিথ্যা কথা বলবে না। তাহলেই তুমি বেহেশতে যেতে পারবে।…’

উপস্থিত লোকেরা মন্ত্রমুগ্ধর মতো ফেরদৌস হাসানের কথা শুনছে। লোকটির কথা বলার ভঙ্গীটা বেশ সুন্দর। অনুচ্চ কন্ঠে প্রত্যেকটা শব্দর স্পষ্ট উচ্চারণ। বাচনও চমৎকার। ছাঁটা সাদা দাড়ি চেহারাকে একটা সূফি সূফি ভাব এনে দিয়েছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আনিস সাহেবের মুখ হা হয়ে গেল। হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। হৃদপিন্ড কয়েকটা স্পন্দন হারাল। আনিস সাহেব ভয় পেলেন। ভয়ে তার হাত পা জমে শক্ত হয়ে গেল। তিনি নড়তে পারলেন না। আনিস সাহেব লোকটাকে চিনতে পেরেছেন।



সাত

ঘরের সবাই মুগ্ধ বিস্ময়ে লোকটার কথা শুনছে। আনিস সাহেব স্থবির হয়ে বসে আছেন। কারও কোনও কথা তাঁর কানে ঢুকছে না। হঠাৎ তার গায়ে কে যেন ধাক্কা দিল। চমকে ঘুরে তাকিয়ে দেখেন তানিয়া।

‘এত চমকে উঠলেন কেন!’

‘কিছু না। এমনি।’

‘আসেন, আপনার সঙ্গে হাসান চাচা কথা বলতে চান।’

‘হাসান চাচা কে!’ হতবিহ্বল কন্ঠে বললেন আনিস সাহেব।

‘দেখবেন নে কে, আসেন।’ কন্ঠে তরল রহস্য ঢালেন তানিয়া।

তাঁরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেলেন। কোণার একটা ঘরে ঢুকলেন তানিয়া। ঘরটার পুরো দেয়াল জুড়ে বুকশেল্ফ। মাঝখানে একটা টেবিল। দুপাশে দুটা চেয়ার। একটা চেয়ারে ফেরদৌস হাসান নামের লোকটা বসে। টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম। আনিস সাহেবকে সামনের খালি চেয়ারটায় বসতে ঈঙ্গিত করে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘চায়ে ক চামচ চিনি খান? দু চামচ?’

আনিস সাহেব কিছু বললেন না। শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সামনের চেয়ারটাতে বসলেন। ভদ্রলোক চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘কেমন আছেন আনিস সাহেব?’

‘ভালো আছি?’ শুকনো কন্ঠে বললেন আনিস সাহেব।

‘তাহলে ভয় পেয়েছেন কেন?’ মিটিমিটি আর পবিত্র হাসি মুখে ছড়িয়ে বললেন হাসান।

কথা সত্য। ভীতু আনিস সাহেব ভয় পেয়েছেন। খুব বেশি ভয় পেয়েছেন। ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। হাসান ফেরদৌস নামের এই লোকটার নাম নাদের মোল্লা। মুক্তিযুদ্ধের সময় একে সবাই কসাই নাদের বলে জানত। ‘৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে ‘৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই লোক কত শত মানুষ মেরেছে তার সঠিক কোনও হিসেব নেই। একবার একটা গ্রামে ঢুকে একসঙ্গে প্রায় সাড়ে তিনশ’ মানুষ মেরে ফেলেছিল। বুলেটের খরচ বাঁচাতে সে ধরে আনা মুক্তিযুদ্ধর পক্ষের মানুষদের জবাই করতে পছন্দ করত। একবার একজন কবিকে জবাই করে টুকরো টুকরো করে তার মাথা দিয়ে খোলা মাঠে বিহারিদের নিয়ে ফুটবল খেলেছিল। আরেকবার একটা গ্রামে ঢুকে নিরীহ নিরস্ত্র একশ’রও বেশি মানুষ মেরে ফেলেছিল।

‘আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন আনিস সাহেব?’

‘হ্যাঁ।’

এই প্রথম কথা বললেন আনিস সাহেব। ফেরদৌস হাসান আবারও হাসলেন। যেন অনেক আনন্দ পেয়েছেন।

‘আপনার পর্যবেক্ষণ শক্তি খুব ভালো আনিস সাহেব। এখানে এতদিন আছি, কেউ কখনও যা কল্পনাও করতে পারে নি, আপনি দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাস্তবতায় ঢুকে গেছেন।’

আনিস সাহেব এতক্ষণে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছেন। বললেন, ‘আমরা তো জানি আপনার ফাঁসি হয়েছে। আপনার নাম তো মৃত মানুষের তালিকায়। আপনি বেঁচে রইলেন কী করে!’

ফেরদৌস হাসান হাহা করে হেসে উঠলেন। সেই পবিত্র হাসি নয়, গায়ে কাঁটা দেওয়া হাসি। হাসি শুনে আনিস সাহেবের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। হাসি থামলে ফেরদৌস হাসান বললেন, ‘সারাজীবন শুধু শুধু রাজনীতির মানুষ হয়ে রইলেন আনিস সাহেব, রাজনীতি করলেনও না, বুঝলেনও না। আমার ফাঁসির জন্য আপনারা হৈচৈ করতে করতে দেশ অচল করে দিচ্ছিলেন। আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হচ্ছিল। তাই ফাঁসির আদেশটা দরকার হয়ে পড়েছিল।’

‘কিন্তু লাশ! কবর!’ আনিস সাহেবের কন্ঠে বিস্ময়।

‘লাশের মুখ বাইরের লোকে দেখেছে নাকি? পত্রিকায় লাশের ছবি ছাপা হয়েছে? ষোল কোটি মানুষের দেশ আনিস সাহেব। আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে তো লাশের অভাব নেই। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে আমার সঙ্গে শেষ দেখা করে ফেরার সময় আমার স্ত্রী আঙুল দিয়ে ভি চিহ্ন দেখিয়েছিলেন।’

হ্যাঁ, আনিস সাহেবের মনে আছে সে কথা। পত্রিকায় এর স্ত্রীর ছবিও ছাপা হয়েছিল। সবাই তখন খুব ধাঁধায় পড়েছিল। ভদ্রমহিলার স্বামীর ফাঁসি হতে যাচ্ছে! এখানে তার বিজয়টা কোথায়! আজ জানা গেল বিজয়টা। ফেরদৌস হাসান বললেন, ‘এসব কথা বাদ দেন আনিস সাহেব। আসেন কাজের কথা বলি।’

আপনার সঙ্গে তো আমার কোনও কাজের কথা নেই। দৃঢ় এবং কঠিন স্বরে বললেন আনিস সাহেব। ফেরদৌস হাসান শীতল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আনিস সাহেবের দিকে। তারপর বললেন, ‘আছে। বলছি শোনেন, ‘৭১-য়ে যখন গন্ডগোল শুরু হলো…’

‘গন্ডগোল নয়, মুক্তিযুদ্ধ।’ আনিস সাহেব শুধরে দিলেন।

‘আচ্ছা, মুক্তিযুদ্ধ। ‘৭১-য়ে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো, আমরা বললাম, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে ভাগ করে আলাদা করলে এটি ইসলামের বিরুদ্ধে যাবে। এটা রাজনীতির কথা না। আমরা বিশ্বাস থেকেই বলেছিলাম। কাফের ইন্ডিয়া না থাকলে বাংলাদেশ বলে কিছু হতো না। পাকিস্তানই থাকত। আর বাংলাদেশ হয়েই বা কি হলো! ‘৭৫ থেকে আমরা রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে আছি। তারা নিজেদের স্বার্থেই আমাদের সঙ্গে রেখেছে।’

আনিস সাহেব কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। এই লোক ভুমিকা করছে না কাজের কথা বলছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করছেন।

ফেরদৌস হাসান বলতে থাকেন, ‘আমরা যদি ভুল হতাম তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ইসলামিক সংগঠন আমাদের দলটা হতো না। হতে পারত না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনরা আমাদের সঙ্গে রাখত না, জাতীয় সংসদে আমি দু দুবার নির্বাচিত হয়ে বসতে পারতাম না। এবং আজ আপনার সামনে বসে কথাও বলতে পারতাম না।

আনিস সাহেব কিছু বললেন না। হাসান ফেরদৌসের কাজের কথার প্রতীক্ষা করছেন।

‘এখন কাজের কথা বলি, আপনি আমাকে চেনেন না, কোনদিন দেখেন নি, আমার কথা শোনেনও নি। এখানে তো নয়ই, দেশে ফিরেও কাউকে কিছু বলবেন না। কোথাও কখনও লিখবেন না। বুঝতে পেরেছেন আনিস সাহেব?’

‘আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?’ আনিস সাহেবের কন্ঠে কৌতুক।

‘আমি ভয় পাই না। আমি আপনার কথা ভেবেই বলেছি। কাল ভোরে ঢাকার একটা ফ্লাইট আছে। ওটাতে আপনার নামে টিকেট বুকিং করা হয়েছে। ঢাকা ফিরে যাচ্ছেন তো তাই বললাম কাউকে কিছু না বলতে।’

আনিস সাহেব অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন ফেরদৌস হাসানের দিকে। তারপর একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘আমি লেখক সন্মেলনে যোগ দিতে এসেছি। লেখক সন্মেলনের এখনও দুদিন বাকি। আপনার কেন মনে হলো কাল আমি ঢাকায় ফিরব!’

‘আপনার মামা শ্বশুর মারা গেছেন। এই মুহূর্তে আপনার স্ত্রী গাড়িতে মামাবাড়ির পথে রয়েছেন। আপনার এখন আপনার শোকগ্রস্ত স্ত্রীর সঙ্গে থাকা দরকার।’

আনিস সাহেবের মুখটা ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল। এই লোক এসব কি বলছে! তিনি ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই সোফায় বসা তানিয়া উঠে এগিয়ে এলেন।

‘আড্ডা শেষ হল? আপনার জন্যেই বসে আছি। চলুন যাই। মেয়েদের বাবা ফিরেছে। তিনিও আপনার জন্যে বসে আছেন।’

আনিস সাহেব একটু সরে এসে দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে স্ত্রীকে ফোন করলেন, ‘কেমন আছ? এখন কোথায় তুমি?’

-‘এই শোন, আজ সকালে বড় মামা মারা গেছেন। এখন মামার বাড়িতে যাচ্ছি। গাড়িতে রয়েছি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাব। তুমি কি বাসায় এসেছ?’

এই অবস্থার মধ্যেও আনিস সাহেব হেসে ফেললেন। ঢাকা থেকে কাল রওনা হয়ে তিনি জার্মান এসেছেন। এখুনি বাসায় পৌঁছে যেতে পারা শুধু তার স্ত্রীর ভাবনাতেই সম্ভব। স্ত্রীকে বললেন, ‘পৌঁছে যাব। তুমি মামার বাড়িতেই থাক আজ।’

‘আচ্ছা।‘

আনিস সাহেব ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন।



আট

ভোর।

মেমিংগ্যান এয়ারপোর্ট।

আনিস সাহেব ঢাকা ফিরবেন। তানিয়া আজ কাজে যান নি। সঙ্গে এসেছেন আনিস সাহেবকে এগিয়ে দিতে। আনিস সাহেবের চলে যাওয়াটা তানিয়া মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছেন না। তানিয়া হাসলেন। তানিয়ার হাসিটা অনেক সুন্দর। হাসলে হাসিটা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে। তখন পুরো মুখটা হাসতে থাকে। আনিস সাহেব মুগ্ধ হয়ে তানিয়ার হাসি দেখেন। দুজনের কেউ তেমন কথা বলেন না। এক সময় আনিস সাহেবের যাওয়ার সময় হয়ে যায়। তানিয়াও বিদায় নেন।

চলে যেতে থাকা তানিয়ার দিকে তাকিয়ে আনিস সাহেব বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, ‘আমি একজন ভীতু মানুষ তানিয়া। মেরুদন্ড বাঁকা একজন মানুষ। আজকের চলে যাওয়ার কারণটা তাই আপনাকে বলতে পারি নি। আমার রাষ্ট্র আমাকে সাহসী হতে দেয় না। আমার রাষ্ট্র আমাকে, আমার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয় নি। আমার পরিবারের নিরাপত্তা আমাকেই নিশ্চিত করতে হবে। সেটা করতে হলে আমার ভীতু হয়ে থাকাই উত্তম।’

আনিস সাহেব ইমিগ্রেশনের দিকে হাঁটতে থাকেন। কালকের সেই মেয়েটা কি এখন আছে? থাকলে মেয়েটাকে গুডবাই বলতে হবে। ভীতু লোকেদের ওপর কেউ বিরক্ত হয়ে থাকবে এটা ভীতু লোকেরা পছন্দ করে না।


[সম্পূর্ণ কল্পনাশ্রয়ী বানানো একটা গল্প। কারও সঙ্গে কোনও সমিল নেই- লেখক]

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১২:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: পুরোটাই কি বানানো??

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:৫৭

মুবিন খান বলেছেন: জ্বি ভাই, পুরোটাই শতভাগ বানানো।

২| ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ১:৩৯

অপু তানভীর বলেছেন: খুবই চমৎকার গল্প ! পড়ে ভাল লাগলো !

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:৫৮

মুবিন খান বলেছেন: আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগছে। লেখা সার্থক হলো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.