![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘BACKDATED’
আমরা যারা পুরানো ধ্যান ধারণার এদেশীয় মানুষ এবং আমাদের বাঙালির সমাজ-সংস্কৃতি আর এদেশীয় মানুষের চিরন্তন মূল্যবোধ আকড়ে আছি, তাদের জন্য বর্তমান এই সমাজের বা হাল আমলের এদেশীয় মানুষের চাল-চলন, জীবন-যাপন, বিয়ে-বিচ্ছেদ আর পরকীয়ার বিষয়টা বেশ বিব্রতকর হলেও বর্তমান কালের পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণার তথাকথিত আধুনিক মানুষের জন্য কোনো ঘটনাই নয়। এরা, একালের মানুষেরা, আমাদের চিরন্তন মূল্যবোধ আর বাঙালি সংস্কৃতিকে আঁকড়ে থাকা মানুষদেরকে বলে, ‘Backdated’। এরা জীবনের সব কিছুতেই নিত্য নতুনের প্রত্যাশী। তা ঘরের টিভি থেকে বিবি আর শাড়ী থেকে স্বামী বা গাড়ি থেকে বাড়ি। আর আমরা যারা এখনও একটা পুরানো দিনের প্রায় অচল মোবাইল, একটা পুরানো দিনের টিভি আর স্থূলকায় প্রায় অচল বিবি নিয়ে, একটা মানবজীবন সন্তষ্টির সাথে পার করছি, তখন এরা ধার করে বা কনজিউমার ঋণ নিয়ে হলেও সব কিছুতেই নিত্য নতুন চায় এবং সংগ্রহ করে; ভোগ করার প্রয়াসে তারা জীবনকে বাঁজি রাখে। এর নামই বোধ হয় ভোগবাদী সমাজ আর ভোগবাদী সংস্কৃতি।
আমরা প্রয়োজনে হয়তো হাতের পুরানো মোবাইল বা ঘরের টিভিটাকে বড়জোড় বদলাতে পারি। কিন্তু বিবিটাকে ‘নৈব নৈব চ’ মানে, কখনোই নয়। সেটা চলুক বা না চলুক। একবার কারো সাথে গাঁটছাড়া বাঁধলেন তো আজীবনের জন্য ফাঁসলেন। সে আপনার যোগ্য হোক, অযোগ্য হোক, আপনার পায়ে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে পারুক, চাই না পারুক, মন-মননে-মানসিকতায়, সাংস্কৃতিক সমতায় তার সাথে আপনার মিল হোক বা না হোক, এদেশের বিত্তহীন মধ্যবিত্তের জীবন একবার কারো সাথে বাঁধা পড়লে তার আর নিস্তার নেই। এদেশে মধ্যবিত্তের জন্য বিবাহবিচ্ছেদ এক মহাযন্ত্রনা আর আইনী ঝামেলার বিষয়। এদেশে নারীর পক্ষে আইনী গ্যাড়াকলতো আছেই। এদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের জন্য জামিন অযোগ্য আইন আছে, কিন্তু ঘরে ঘরে যে পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তার প্রতিকারে কোনো আইন নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষরা তাদের উপর এসব নির্যাতনের, তা শারিরীক বা মানসিক যেকোনো নির্যাতনই হোকনা কেন, লজ্জা আর অপমানের ভয়ে তা প্রকাশ করেনা। তাই এদেশীয় সমাজব্যবস্থায় মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে পুরুষেরা নির্যাতিত হলেও তারা এসব নির্যাতন প্রতিনিয়ত সয়ে সয়ে টেনশন-এ্যাটেনশন শেষে হাইপারটেনশনের রোগী হয়ে, তারপর ডায়বেটিস-হৃদরোগ এবং যাবতীয় জটিলতা নিয়ে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের অপেক্ষা করতেই হয়।
এদেশে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া-ঝাটি মারামারি করলেও বিবাহ বিচ্ছেদ বা ছাড়াছাড়ির সুযোগ নেই বললেই চলে। এমনকি, মানসিকভাবে নির্যাতিত পুরুষটির পরিবারের লোকজনও বিয়ে বিচ্ছেদ বা ছাড়াছাড়ির পক্ষে খুব বেশি মত দেননা। ছাড়াছাড়ির ব্যপারে ভুক্তভোগীর পরিবারের মানুষেরও এক্ষেত্রে সমর্থন থাকেনা। বিয়ে বিচ্ছেদের ব্যপারে এদেশের বিত্তহীন মধ্যবিত্তেরই যত ঝামেলা। এদেশের উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্তের এই বিষয়ে কোনো ঝামলা নেই বললেই চল। তারা শাড়ি বদলানোর মতই স্বামী বা গাড়ি বাড়ি বদলানোর মতই স্ত্রী বা স্বামী বা সঙ্গী বদলাতে পারেন; তাতে তাদের কোনো সমস্যাই নেই। নিম্নবিত্তের বেলায় তো আরো বেশি সুবিধা। বিয়ে করে দু’একটা বাচ্চাসহ ফেলে গেলেও তাদের কোনো সমস্যা হয়না বা তাতে কারো কিছু যায় আসেনা। এদের বেলায় বিয়ে বিচ্ছেদ বা বহুবিবাহ করায় সামাজিক নিন্দা সমালোচনার কোনো বিষয় নেই। এদের সামাজিক দায়বদ্ধতায়ও যেমন নেই, দায় বা জবাবদিহিতারও কোনো বিষয় নেই। এসব বিষয়ে যত ঝামেল সব মধ্যবিত্তের। তা মেয়ে হোক বা ছেলে হোক, ঝামেলার বিষয়ে মেয়ে পুরষ নির্বিশেষে তেমন কোনো হেরফের নেই।
একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক সময়ে এসেও, আমাদের দেশের এই ধর্মীয় মৌলবাদী সমাজে, নারী পুরুষের প্রেম ভালোবাসা এখনও স্বীকৃত নয়, যেখানে, সেখানে পরিচয় প্রেম পরিণয় এখনও অনেক দুরের এক বিষয়। কেউ কেউ প্রেম ভালোবাসার পরে যে পরিণয়ে আবদ্ধ হচ্ছেনা তা অবশ্য নয়। তবে, তার অনুপাত বা সংখ্যা কত? বিহাহপূর্ব মেলামেশা এখনও সমাজ স্বীকৃত ব্যবস্থা নয়। যে কারণে, বিবাহযোগ্য ছেলে মেয়েদের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও সহজে তারা জুটিবদ্ধ হয়ে সংসারী হতে পারছেনা। কারো কারো অবশ্য দেরি করে হলেও সম্বন্ধ করেই আজো এদেশে বিয়ে শাদী হয় বা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দু’জন নারীপুরুষ তাদের পরস্পরকে জানা শোনা বা ভাবের আদান প্রদান বা পরস্পরের মন-মানসিকতা, সাংস্কৃতিক সমতার বিষয়ে জানুক বা না জানুক, মিল থাকুক চাই না থাকুক, একমাত্র ‘চাঁদমুখ’ দর্শন বিচারেই সম্পর্ক স্থাপনের বিষয় পাঁকা হয়ে যায়। একটা বিয়ে শুধুমাত্র দু’টো নারীপুরুষেরই সম্পর্ক নয়, দু’টো পরিবারের একটা স্থায়ী সম্পর্কের বিষয়। সেক্ষেত্রে দুই পরিবারের রাজনৈতিক মতামতের পার্থক্যও বিশাল ফরাক তৈরি করতে পারে বৈকি! একজন শিক্ষিত স্বজ্জন ও সংবেদনশীল মেয়ে বা পুরুষ তার সঙ্গী বা সঙিনীকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে, সেই সম্পর্কের স্থায়ীত্ব বেশিদুরে আর বেশিদিন সামনে নিয়ে যাওয়া না। সংসার মানে হচ্ছে ‘সমঝোতার শিল্প’ এই সমঝোতার শিল্পে পারস্পরিক সমঝোতাই যদি না থাকে তাহলে এ ধরণের দাম্পত্য সম্পর্ক আর জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরীর উপর বসে থাকা প্রায় একই বিষয়। আর এর প্রতিকার আমাদের এদেশীয় মধ্যবিত্ত সমজে প্রায় নেই বললেই চলে। তারপরে ঐ দম্পতির যদি কোনো সন্তান থাকে তাহলেতো আর কথাই নেই। সেক্ষেত্রে যত রকমের বাড়াবাড়িই হোক, ছাড়াছাড়ি বা বিচ্ছেদ একেবারেই অসম্ভব। তবে কোনো দম্পতির যদি সন্তান থাকে আর স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়, সেক্ষেত্রে ঐ সন্তানরা একটা মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যায় এবং বাবা মায়ের বিচ্ছেদ ঐ সন্তানদের জীবনে নানা রকম হতাশা আর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমনকি কারো কারো জীবন বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। সে বিষয়টাও যারা বিচ্ছেদ চায় তাদের একান্তভাবেই ভাবা উচিত। তবে আজকালকার শিক্ষিত সচেতন কর্মজীবী নারী এবং পুরুষের উচিত ভুল মানুষের সাথে ভুল পথে না চলা। কারো সাথে যদি মতের মিল না হয় বা ব্যক্তিত্বের সংঘাত লেগেই থাকে, তবে রবীন্দ্রনাথের কথা মত, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে…….’ তার একলা চলাই বোধ করি শ্রেয়তর পন্থা। আমাদের সমাজে বহু দম্পতি আছেন যারা দীর্ঘদিন একসাথে, এক ছাঁদের নিচে থাকছেন, খাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন, সংসার করছেন, সন্তান জন্ম দিচ্ছেন, কিন্তু কেউ কাউকে আদৌ চিনতে পারছেন না। চিনবার চেষ্টাও করছেন না। সংসার বড় জটিল যায়গা, এখানে স্বার্থ ছাড়া কিছুই চলেনা। ঘর সংসার সন্তান টাকা পয়সা বিষয় সম্পত্তি এবং আরো বহু বিষয় তুচ্ছ হয়ে যেতে পারে প্রেম ভালোবাসার কাছে; তা যদি পরকীয়াও হয়!
স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ যদিও খুব ভাল বিষয় নয়, তবুও প্রত্যকটি মানুষের ব্যক্তিসত্ত্বার স্বাতন্ত্রবোধ আর ব্যক্তি স্বাধীনতা, পারস্পরিক রুচি প্রকৃতির মিল অমিলকে আমরা কেন গুরুত্ব দেবনা?
আমাদের মানুষ্য জীবন একবাবের জন্যই। জীবনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও মানুষের ভুল-ত্রুটি হতেই পারে, তাই বলে মানুষ কি সেই ভুল ত্রুটি সংশোধন করার সুযোগ পাবেনা? সারা জীবনভর সে ভুলের মাশুল দিয়েই তবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে?
আমার নিজের কবিতার লাইন এখানে মনে পড়ছে, ‘যদি শুধরে নিতে পারতাম জীবনের যত মধুর ভুলগুলো! ফিরে যেতে পারতাম সময়ের উল্টোরথে চড়ে! তাহলে আমি ফিরে যেতে চাইতাম শৈশবে আবার’।
©somewhere in net ltd.