নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মাতাল গদ্য মাতাল পদ্য

মাতাল গদ্য মাতাল পদ্য › বিস্তারিত পোস্টঃ

মধ্য বয়সের সঙ্কট, বিড়ম্বনা ও জীবনের অপরিহার্য বাস্তবতা তথা ‘MIDDLE AGE CRISIS’

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৪৬

মধ্য বয়সের সঙ্কট, বিড়ম্বনা ও জীবনের অপরিহার্য বাস্তবতা তথা ‘MIDDLE AGE CRISIS’ (দ্বিতীয় পর্ব সহ)
মানুষের জীবনে ৪৫-৬৫ বছর বয়সে নানা রকম সঙ্কট দেখা দিতে পারে। আর এই সঙ্কটকেই বলে মধ্যবয়সের সঙ্কট তথা Middle age crisis বা Middle-life crisis বলেই একটা বিষয় হিসেবে সারা পৃথিবীতে আলোচিত বিষয়।
মানুষের জীবনে জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তি আর নানা বিষয়ে যে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এগিয়ে যাচ্ছে তাতে সবাই হয়তো তার ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা ধ্যান-ধারণা বা নিজস্ব শিক্ষা-সংস্কৃতি বা নিজস্ব পরিবেশ প্রতিবেশে গড়ে ওঠা মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তণ করে হালনাগাদ করতে বা চলতি শ্রোতে ভাসতে পারেনা। তখন একজন ব্যক্তির পক্ষে সবসময় সকল পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং নিতে পারেনা। এমন কি তার নিজস্ব পরিবারে স্ত্রী সন্তানের সাথেও তার একটা দুরত্ব তৈরি হয়ে যায়। আর এই দুরত্বকেই বলা হয় ‘Generation Gap’ বা প্রজন্ম ব্যবধান। বা প্রজন্মের দুরত্ব।

একজন মধ্যবয়সী মানুষের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠতে পারে তিনটি কারণে। এক, তার স্বচ্ছলতার অভাব। মানে, প্রয়োজনের তূলনায় তার আয় বা সম্পদ কম থাকা। দ্বিতীয়ত, এই সম্পদ না থাকার কারণে এবং নিত্যদিনের সাংসারিক অস্বচ্ছলতা কেন্দ্রিক ঝগড়া-ঝাটি কিম্বা স্বচ্ছলতার পরেও তার ঝগড়াটে বা সন্দেহপ্রবণ কিম্বা অবিশ্বস্ত স্ত্রী এবং সর্বশেষ তার অবাধ্য অযোগ্য অশিক্ষিত কুশিক্ষিত সন্তান।
একজন মানুষের জীবনে তার নিজের আর পরিবারের অন্যান্য সকলের সুস্থতার থেকে আর বড় কোনো সম্পদ নেই বা হতে পারেনা। এরপরেই তার কাছে বড় সম্পদ হচ্ছে তার বিশ্বস্ত আর বিনয়ী জীবনসঙ্গী আর তৃতীয় এবং মূল্যবাণ সম্পদ হচ্ছে তার সুশিক্ষিত আলোকিত সুসন্তান যারা মা বাবা ছাড়াও যেকোনো মানুষের কাছে সর্ব অবস্থায় একজন মানবিক মানুষ। লেখাপড়া শিখে উচ্চতর কোনো পেশাজীবী হলেই যে একজন মানুষ মানুষ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একজন মানুষ উচ্চ ডিগ্রিধারী নাও হতে পারে তার বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী না থাকলেও ক্ষতি নেই সে যদি স্বশিক্ষিতও হয় এবং আলোকপ্রাপ্ত মানবিক মানুষ হয় সে-ই হতে পারে যথার্থ মানুষ বা যথার্থ সুসন্তান।

অর্থ-বিত্ত প্রাচুর্য সকলক্ষেত্রে একজন মানুষের জীবনে সফলতার নির্দেশক বা নিয়ামক নয়। অর্থ-বিত্ত একজন মানুষের কাছে তার স্বচ্ছন্দভাবে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন অবশ্যই তবে তা সর্বক্ষেত্রে তা তার জন্য সম্পদ নাও হতে পারে।
ধরুন একজনের অনেক টাকা বা অনেক সম্পদ আছে কিন্তু সেই টাকা বা সম্পদের সংরক্ষণের জন্য তার যে পরিমান টেনশণ বা এ্যাটেনশনে উদ্বিগ্নতায় থাকতে হয় তাতে একসময় দেখা দেয় তার হাইপারটেনশন বা উচ্চরক্তচাপ ডায়বেটিস হৃদরোগ কিম্বা কিডনি জটিলতার মতো নানা প্রাণঘাতী অসুখ বিসুখ। আর তখন তার জীবনে অর্থ-বিত্ত থাকলেও সুখ-শান্তি দুরে চলে যায়। মানুষের জীবনে শত শত বা হাজার কোটি টাকা থাকলেও বা কি লাভ যদি তা মানুষের কল্যাণে না লাগে বা আপনি যদি রসগোল্লা রসমালাই বা সন্দেশ রাজভোগই খেতে না পারেন তাহলে সেই অঢেল বিত্ত নিয়ে রাজা হয়ে থাকার কোনো মানে আছে?
মধ্যবয়সী মানুষের জীবনে যে সকল সমস্যা সাধারণত দেখা দেয় তা হতে পারে নানা কারণে। এবং সে সকল সমস্যা হতে পারে নারী পুরুষ নির্বিশেষে। যে কোনো মধ্যবয়সীর জন্যই সেটা হতে পারে শারিরীক মানসিক অর্থনৈতিক এবং অবশ্যই তার যৌনজীবনের অতৃপ্ত কামনা বাসনার থেকেও। এই অবস্থা একজন ব্যক্তি সে নারী বা পুরুষ যে ই হোকনা কেন, তার স্বাভাবিক জীবনে অস্বাভাবিক ছন্দপতন ঘটাতে পারে। তার ব্যক্তিজীবনের চালচলনে আচার আচরণে অনেকটাই অস্বাভাবিকতা তৈরি করতে পারে। এমনকি এই সমস্যায় আক্রান্ত মানুষ সবার সাথে স্বাভাবিকভাবে মিশতেও পারেনা। সে কোথাও যায়না বা যেতে চায়না। আনন্দ বিনোদন উৎসবে যোগ দেয়না। এমনকি আত্নীয় বান্ধবের বিয়ে বা এধরণের সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও সে যায়না এবং তার মধ্যে যে বিষন্নতাবোধ তৈরি হয় আর সেই বিষন্নতাবোধ আর জীবনের পরন্তবেলায় এসে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নানা রকমের অপ্রাপ্তির অতৃপ্তি আর ভবিষ্যতের কঠিন জীবনের ভাবনা তাকে অধিকাংশ সময় মানসিকভাবে উদ্বিগ্ন উৎকন্ঠিত করে রাখে। যে কারণে তার মধ্যে একধরণের অস্থিরতা কাজ করে, হটাৎকরে বদমেজাজী হওয়া, বা কিছু ভাঙচুর করা, কখনো কখনো চিৎকার চেচামেচি করা সহ নানানভাবে অসহনশীলতার পরিচয় দিতে পারে। এবং অস্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারে। সে তার জীবন যাপনের পূর্বপরিচিত রুপ সম্পূর্ণই বদলে ফেলতে পারে। এরকম মানুষ কিছুটা স্বেচ্ছানির্বসনের মতো সামাজিক জীবনযাপন থেকে একঘরে হয়ে একাকিত্বের জীবন বেছে নিতে পারে। এটা হতে পারে নারী পুরুষ উভয়ের বেলাতেই। এমনকি এই মধ্য বয়সের সঙ্কটে পড়া মানুষ পরকীয়া বা অনৈতিক সম্পর্কের দিকেও জড়িয়ে পড়া অস্বাভাবিক নয়।

একজন ব্যক্তি মানুষের জীবনে এই সমস্যা তথা মধ্যবয়সের সঙ্কট দেখা দিতে পারে তার যেকোনো অবস্থান থেকে। সেটা হতে পারে ঘরেবাইরের যে কোনো যায়গাতেই। এটা শুরু হতে পারে তার নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে তার বা নিজের ঘরেও। এখানে একজন ব্যক্তির কাজ, তার কাজের ক্ষেত্র, কাজের যায়গার সুস্থস্বাভাবিক পরিবেশ, তার আয় উপার্জনের বিষয়, তার যোগ্যতা অনুযায়ী পদ-পদবী-পদোন্নতি, তার উপরে চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক কাজের বোঝা এবং তার বিপরীতে তাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন না করা, বা যথাযথ যোগ্যত অভিজ্ঞতায় শ্রেষ্ঠত্ব থাকার পরেও শুধুমাত্র তেল তোষন স্তুতি স্তাবকতা না করতে পারবার কারণে তার পদোন্নতি বিবেচনা না করা। একজন মানুষের শিক্ষা দীক্ষা তার বয়স অভিজ্ঞতা তার সততা তার নিয়মানুবর্তিতাকে মূল্যায়ণ না করা এবং ক্ষেত্রবিশেষ অবমূল্যায়ণ করার দ্বারাও একজন মধ্যবয়সী মানুষের ক্ষোভ হতাশা এবং উদ্বিগ্নতা তৈরি হয় হতে পারে। একজন ব্যক্তির জীবনে এই ধরনের সঙ্কটের জন্য তার ঘরের বাইরে তার কর্মস্থলের পরিবেশ পরিস্থিতিও তাকে এ ধরণের সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
একজন নারী যখন তার ঘরে, পরিবারে তার স্বামী সন্তানের কাছে যথাযথভাবে মূল্যায়িত না হয় এবং যথেষ্ঠ যোগ্যতা থাকার পরেও সে যদি কেবল শুধুমাত্র একজন নারী বা উর্ধতনদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক না থাকার কারণে তার কর্মস্থলে অবমূল্যায়িত হয় বা তার দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার স্বাভাবিক দেহ-মনের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলেও একজন নারীর মধ্যজীবনে এ রকম সঙ্কট সমস্যা দেখা দিতে পারে।

আমাদের মনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেক মানুষই সে নারী হোক কিম্বা পুরুষ, সে একজন স্বতন্ত্র সত্ত্বা। প্রত্যেকটি মানুষের চিন্তা-ভাবনার জগৎ তার রুচি-প্রকৃতি আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে প্রত্যেকটি মানুষের স্বতন্ত্র সত্বাকে যেন আমরা আলাদাভাবে বুঝতে চেষ্টা করি। দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রেও স্বামী-স্ত্রীও দুজন ব্যক্তি, দুজন আলাদা মানুষ, দুটি আলাদা ব্যক্তিসত্ত্বা। মানুষের দাম্পত্য জীবনেও দুজন মানুষ তাদের সংসারের সবকিছুতে সকল বিষয়ে একমত হবার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে তাদের দুজনার পরিবার, তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা-অবস্থান, শিক্ষা-দীক্ষা, তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ প্রতিবেশ, তাদের সংস্কার কুসংস্কার, তাদের পঠন-পাঠন থেকে গড়ে ওঠা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তাদের আজন্ম লালিত মূল্যবোধ এবং তার ভিন্নতা বিচ্ছিন্নতা একসময় সম্পর্কের টানাপোড়নে তা নতুনভাবে সামনে চলে আসতে পারে নানা কারণেই। আর সে সকল বিষয় থেকেও এ ধরনের মধ্যবয়সী সঙ্কটের উদ্ভব হতে পারে। তবে একজন ব্যাক্তির জীবনে তা নারীপুরুষ ভেদাভেদে তার আর্থিক স্বচ্ছলতা স্বচ্ছন্দ তার মোহনীয় মার্জিত ব্যক্তিত্ব এবং তার নিজস্ব বসবাসরত সমাজে তার আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থানও তার মধ্যবয়সের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

লেবাননের বিখ্যাত আরবি কবি যিনি ‘প্রফেট’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ লিখে পৃথিবী খ্যাত হয়েছেন। তার নাম কাহলিল জিবরান। সেই কবি কাহলিল জিবরান তার LOVE বা ভালোবাসা কবিতায় বলেছেন,

‘সর্বদাই তুমি একসঙ্গে থাকতেপারো। এমনকি সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে নীরব ভাবনাতেও। তবুও এই এক সঙ্গে থাকার মধ্যেও কিছুটা দূরত্বরেখো এবং স্বর্গের বাতাসকে নিজের মধ্যে বইতে দিও। একে অপরকে ভালোবাস কিন্তু ভালোবাসার কোনো বন্ধন তৈরি করো না; বরং এটাকে তোমার হৃদয়ের তীরের মাঝে বহমান সমুদ্রের মতো থাকতে দিও। একে অপরের কাপ পূর্ণ করো কিন্তু একই কাপ থেকে পান করো না। একে অপরকে রুটি দাও কিন্তু একই রুটিতে উভয়েই কামড় দিও না’
তিনি আবার বলেছেন,
‘একসঙ্গে নেচে-গেয়ে আনন্দ করো, কিন্তু একে অপরকে একটু একা থাকতে দিও। যেমন লিউটসের তারের মতো নিঃসঙ্গ তবুও তাদের কম্পন একই সুর দেয়। তোমার হৃদয় দাও কিন্তু একে অপরের হৃদয় ধরে রেখো না। শুধু ঈশ্বরের হাতই তোমার হৃদয়কে ধারণ করতে পারবে। এবং এক সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ো কিন্তু খুব কাছাকাছি নয়: মন্দিরের পিলারগুলোও আলাদা থাকে এবং ওক ও সাইপ্রাস গাছ একে অপরের ছায়ায় বেড়ে ওঠে না’

মানুষের স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্বাকে কোনো নিয়মের বা লক্ষণের গন্ডিতে বেঁধোনা। ঘরে যেমন দরোজা জানালা থাকে এবং তা দিয়ে আলো হাওয়া আসে, তেমনি মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এবং যেকোনো সম্পর্কের জন্য ব্যক্তির স্বকীয়তা আর তার ইচ্ছে ভালোবাসা অনুযায়ী কিছু জানালা অবশ্যই খোলা রাখা প্রয়োজন। তা নাহলে মানুষে মানুষে সম্পর্কের জটিলতা তথা ব্যক্তিত্বের সংঘাত তৈরি হবেই। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে, পারস্পরিক যেকোনো সম্পর্কের বেলায় সততা স্বচ্ছতা আস্থা আর বিশ্বাসটা হচ্ছে সব থেকে গোড়ার কথা। আর মানুষে মানুষে ভালোবাসার ভিত্তিটাই হচ্ছে কোনো রকমের সন্দেহহীন পারস্পরিক বিশ্বাস। পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে সবকিছু। সম্পর্ক, সংসার সন্তান জীবনের সকল সুন্দর। আমরা যেন আমাদের বিশ্বাস আস্থা ত্যাগ সাধনা আর ভালোবাসা দিয়ে সত্য আর সুন্দরের জয়গান গাই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.