নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শেরপা

দেখতে চাই ধরনী

মুনতাসির

আমি পাহাড়ে চড়ি,সাগরে ডুবি, পৃথিবী আমার প্রেম

মুনতাসির › বিস্তারিত পোস্টঃ

অন্যের নির্বাচনে নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখা: জোহরান মামদানি ও বাংলাদেশের শিক্ষা

০৬ ই নভেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫৮

‘আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর নেওয়ার কী দরকার?’ প্রবাদটি আমরা সবাই জানি। বেশিরভাগ সময় সত্যিই দরকার পড়ে না। কিন্তু আমরা যেন অভ্যাসবশতই অন্যের ব্যাপারে নাক গলাই। তবে, নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের ফলাফল আমাদের শেখায়, কখনো কখনো এই ‘অযৌক্তিক’ কৌতূহলই সবচেয়ে যৌক্তিক হয়ে ওঠে। কারণ, ওখান থেকে আমরা নিজেদের জন্য বড় শিক্ষা নিয়ে আসতে পারি।

যার সঙ্গে আমাদের কোনো প্রত্যক্ষ স্বার্থ নেই, তার বিষয়ে মাথা ঘামানো অবশ্য সবসময় অনাবশ্যক নয়। কারণ, বিশ্ব রাজনীতির ঘটনাবলির সঙ্গে আজ প্রতিটি দেশ, এমনকি প্রতিটি দেশের প্রতিটি নাগরিক, কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে। নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনের ফলাফলও তার একটি দৃষ্টান্ত। বাইরে থেকে তা হয়তো ‘অন্যের ব্যাপার’ বলেই মনে হতে পারে, কিন্তু এর ভেতর লুকিয়ে আছে গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ ও নৈতিক নেতৃত্বের এমন কিছু শিক্ষা, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও প্রাসঙ্গিক।

এ বছরের জুন মাসে নিউ ইয়র্কের ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে ৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানি জিতেছেন—যা কেবল একজন তরুণ প্রার্থী বা কোনো অভিবাসী আমেরিকানের বিজয় নয়, বরং নাগরিক অংশগ্রহণের এক নতুন দর্শনের জয়। তার এই সাফল্য প্রমাণ করেছে, রাজনীতি সব সময় অর্থ ও প্রভাবের খেলা নয়; বরং মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম, জীবনের মৌলিক চাহিদা, আর ন্যায্যতার প্রশ্নগুলোই শেষ পর্যন্ত জনগণের হৃদয় ছুঁয়ে যায়

মামদানির প্রচারণায় ছিল না কোনো কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা, পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য, কিংবা আড়ম্বরপূর্ণ মিডিয়া কৌশল। তিনি সরাসরি কথা বলেছেন সেই সব নিউ ইয়র্কবাসীর হয়ে—যারা প্রতিদিন ভাড়া দিতে হিমশিম খায়, বাজারের দাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে এবং গণপরিবহনের খরচে বিপর্যস্ত। তার বার্তা ছিল সরল অথচ গভীর। প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার আছে এমন এক শহরে বসবাস করার, যেখানে বেঁচে থাকা শুধু অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রশ্ন নয়, মানবিক মর্যাদারও নিশ্চয়তা।

এই সরল বার্তাই নিউ ইয়র্কের নানান শ্রেণি ও পেশার মানুষের মনে ধরেছে। এখানেই বাংলাদেশের জন্য আছে বড় শিক্ষা, বিশেষত যখন সামনের ফেব্রুয়ারিতে আমাদের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে কথা চলছে।

মামদানির জয় এসেছে এমনসব ভোট ব্যাংক থেকে, যা খুব কম বিশ্লেষকই অনুমান করতে পেরেছিলেন।

প্রথমত, তরুণ ও প্রথমবারের ভোটাররা। কুইনিপিয়াক পোল অনুযায়ী, ১৮–৩৪ বছরের ৬৪ শতাংশ ভোটার মামদানিকে সমর্থন দিয়েছে, যেখানে ৫৫–৬৪ বয়সীরা মাত্র ৩২ শতাংশ। তরুণরা রাজনীতির পুরোনো ভাষায় ক্লান্ত; মামদানি তাদের বাস্তব জীবনের ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। এতে রাজনীতির প্রতি তাদের আস্থা ফিরেছে। এই ঘটনার কিয়দংশও যদি বাংলাদেশে ঘটে, তবে সমীকরণ বদলাতে বাধ্য। কে জোর দিয়ে বলতে পারে যে নতুন ভোটাররা ভোট দিতে আসবে না?

মামদানিকে যতই কোণঠাসা করা হয়েছে, তার প্রতি সমর্থন আরও বেশি জোরালো হয়েছে। এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় চব্বিশের জুলাইয়ের কথা।

দ্বিতীয়ত, এশীয় ও দক্ষিণ এশীয় ভোটাররা। বিশেষ করে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর নেপালি বংশোদ্ভূত মানুষ। তার প্রচারণা ছিল বহুভাষিক, এমনকি বাংলাতেও। নিউ ইয়র্কের মুসলিম ও অভিবাসী সম্প্রদায় তাকে দেখেছে নিজেদের প্রতিফলন হিসেবে, যিনি তাদের জীবনের সংগ্রাম আর পরিচয়কে সত্যিই বোঝেন।

তৃতীয়ত, বহুজাতিক ঐক্য। মামদানি শুধু প্রগতিশীল এলাকায় নয়, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো, এশীয় ও তরুণ শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকাতেও এগিয়ে ছিলেন। জাতিগত গণ্ডি পেরিয়ে তিনি তৈরি করেছেন বহু-বয়সী, বহু-জাতিক ভোট ব্যাংক।

আর সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো, যারা সাধারণত ভোট দিতে আসেন না, তাদেরকেও তিনি টেনে এনেছেন। বাড়তি ভাড়া, খাবারের দাম বা গণপরিবহনের খরচের মতো বাস্তব সমস্যা নিয়ে কথা বলে তিনি রাজনীতিকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা, রাজনীতি যদি মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে যায়, মানুষ আবার রাজনীতিতে ফিরে আসে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ছবিটা অবশ্যই ভিন্ন, কিন্তু মামদানির এই গল্প থেকে আমরা কিছু গভীর শিক্ষা নিতে পারি। আমাদের তরুণ ভোটাররা ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে। বাংলাদেশে অর্ধেকেরও বেশি ভোটার ৩৫ বছরের নিচে, কিন্তু তারা প্রায়ই শুধু মিছিলে বা স্লোগানে ব্যবহৃত হন, প্রকৃত রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পান না। মামদানি দেখিয়েছেন, যখন তরুণরা রাজনীতিতে নিজেদের সমস্যা খুঁজে পান, তারা শুধু ভোট দেন না, পুরো খেলাটাই বদলে দেন। আমাদের দেশে যদি দলগুলো তরুণদের কথা শোনে, তাহলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অন্যরকম হতে পারে।

অবশ্য গণআন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বেশ কয়েকজন তরুণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারেও থেকেছেন, আছেনও এখন। এই তরুণরা কি সুযোগটা কাজে লাগাতে পেরেছেন ঠিকমতো? এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দেবে। আগামী নির্বাচনে তারা যদি তরুণদের ম্যান্ডেট নিয়ে জয়ী হয়ে আসতে পারেন, তাহলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে ব্যতিক্রম কিছুটা হলেও হতে পারে। ওই মূল্যায়নও সময়ের হাতে ছেড়ে দিলাম।

আরেকটি বিষয় হলো, স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতিতে পৌঁছানোই প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব। মামদানি নিউ ইয়র্কের মানুষের কাছে গিয়েছেন তাদের ভাষায়—মসজিদে, দোকানে, পার্কে, স্টেশনে। বাংলাদেশে এটা আরও জরুরি। প্রতিটি স্থানিক ও জাতিগত গোষ্ঠীকে তাদের নিজস্ব ভাষা ও জীবনযাত্রাকে প্রাধান্য দিয়ে বোঝাতে হবে। এতে মানুষ অনুভব করবে, রাজনীতি তাদের জন্যই।

দলীয় বিভাজন ভেঙে সাধারণ মানুষের ইস্যুতে ঐক্য গড়া সম্ভব, সেটাও দেখিয়েছেন মামদানি। তিনি দেখিয়েছেন, রাজনীতি যদি দৈনন্দিন বাস্তবতায় ফিরে আসে, তাহলে দলীয় লাইনগুলো অনেকটা মিলে যায়। বাংলাদেশে এটি আশার আলো দেখাতে পারে। দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে যদি কোনো প্রার্থী বা দল সাহস করে মানুষের দৈনন্দিন উদ্বেগ (যেমন মূল্য বৃদ্ধি, চাকরির অভাব) নির্বাচনি ইশতেহারে তুলে ধরে, তাহলে ভোটের মানচিত্র বদলে যেতে পারে।

বাংলাদেশে অনেক শহুরে ও গ্রামীণ ভোটার হতাশা, ভয় বা অবিশ্বাসে ভোট থেকে দূরে সরে গেছেন। মামদানির প্রচারণা শেখায়, এই ‘নিষ্ক্রিয়’ মানুষদের সক্রিয় করা সম্ভব, যদি রাজনীতি আবার তাদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়। উন্নয়নের বড় বড় গল্পের পরিবর্তে, যদি কথা হয় ‘বাঁচার খরচ’ নিয়ে, তাহলে মানুষ ফিরে আসবে।

বাংলাদেশে এখন রাজনীতি ও মানুষের মধ্যে এক গভীর দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মেগা প্রকল্পের গল্প শুনে যে নাগরিক প্রতিদিন বাজারে ১০ টাকা বাড়তি দাম দেয়, সে আস্থা হারাচ্ছে। মামদানি এই দূরত্ব কমিয়েছেন, তার ফোকাস ছিল মানুষের জীবনযাত্রায়, বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে নয়। তিনি শহরকে ফিরিয়ে দিয়েছেন মানুষের হাতে। এটাই আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় চাহিদা, মানবিক নৈকট্য।

প্রতিনিধিত্ব মানে প্রতীক নয়, বিশ্বাস। মামদানি তার অভিবাসী পরিচয়কে বিভাজনের অস্ত্র বানাননি, বরং তা ব্যবহার করেছেন বোঝাপড়ার সেতু হিসেবে। বাংলাদেশে নারী, তরুণ বা সংখ্যালঘুরা প্রায়ই রাজনীতিতে ‘সাজসজ্জা’ হিসেবে থাকেন। কিন্তু প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব তখনই হয়, যখন নেতারা সত্যিই মানুষের জীবন অনুভব করেন।

তিনি দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, কিন্তু প্রতিপক্ষকে দানব বানাননি। এতে দেখা যায়, দৃঢ়তা আর সৌজন্য একসঙ্গে চলতে পারে। বাংলাদেশে যেখানে সমালোচনাকে ‘রাষ্ট্রবিরোধিতা’ বলা হয়, সেখানে এটা গণতন্ত্রের পরিপক্বতার শিক্ষা।

তার প্রচারণা ছিল একেবারে মানুষের সঙ্গে মিশে—বহুভাষায় লিফলেট, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কথা বলা। বাংলাদেশে প্রচার মানে এখনো মাইকের চিৎকার, মঞ্চের শক্তি, গাড়ির বহর। কিন্তু ভোট জেতে যারা শোনে, না যারা চিৎকার করে। রাজনীতিকে আবার মাঠে নামার সময় এসেছে।

নিউ ইয়র্কের এই তরুণ মেয়রের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, কিন্তু তার জয় প্রমাণ করে মানুষ এখনো রাজনীতিতে বিশ্বাস করতে চায়, যদি রাজনীতি তাদের বিশ্বাস করে। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য শুধু রাজনৈতিক নয়, নৈতিক পরীক্ষাও। আমাদের গণতন্ত্রের মূল সমস্যা এখন দমন নয়, শ্রবণের অভাব। মামদানির গল্প এক অভিবাসীর সন্তান থেকে শহরের নেতৃত্বে ওঠার কাহিনী, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—রাজনীতি তখনই বাঁচে, যখন তা মানুষকে গুরুত্ব দেয়।


প্রকাশিত : Click This Link

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর ঝরঝরে লেখা।
পড়ে আরাম পেয়েছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.