![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি তোমাদের মাঝে খুজিয়া ফিরি আমার বিশ্বলোক; নরকে গেলেও হাসিয়া বলিব আমি তোমাদেরই লোক।
কিছু পেশা আছে যেগুলো কেবল জীবিকা নয়, সমাজে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের পথ দেখায়। যেমন শিক্ষক, চিকিৎসক কিংবা ধর্মীয় নেতা। তাদের কাজ শুধু পড়ানো, চিকিৎসা দেওয়া, ধর্মীয় উপদেশ প্রদান নয়—তারা নিজের হয়ে ওঠেন অজান্তেই সমাজের বিবেক ।
তাদের হেঁটে চলা, কথা বলা, এমনকি মুখের ভঙ্গিও মানুষ গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে। কারণ, তারা নিজের পরিচয়ের বাইরেও একটি অবস্থান বহন করেন—যেটি আলাদা, গুরুত্বপূর্ণ এবং সমাজের বাকি অংশের জন্য আদর্শের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।
এইজন্যই যখন তারা কনটেন্ট নির্মাতা হয়ে ওঠেন, ক্যামেরার সামনে আসেন, তখন প্রশ্ন আসে— তারা কি শুধুই নিজের কথা বলছেন, নাকি নিজেদের মর্যাদাকেই বিনিময় করে নিচ্ছেন একরাশ লাইক, শেয়ার আর ভাইরালিটির মোহে?
১
একজন শিক্ষক শুধু পাঠ্যবই পড়ান না—তিনি একজন জীবন্ত পাঠ্যবই হয়ে ওঠেন। শ্রেণিকক্ষে তাঁর উপস্থিতি, ভাষা, পোশাক, মেজাজ—সবকিছু শিক্ষার্থীর চরিত্র নির্মাণে অদৃশ্য ভূমিকা রাখে।
ছাত্ররা যেভাবে বই পড়ে, ঠিক সেভাবেই দেখে স্যারের মুখ, তাঁর আচরণ। একজন শিক্ষক যেমন বলেন—ভালো মানুষ হও, ছাত্রের মনেও ঠিক তেমনই গেঁথে যায়—স্যার নিজেই কি সেই মানুষটি?
এই মানুষটাই যখন রিল বানাতে গিয়ে নাচেন, হাস্যকর সংলাপে অভিনয় করেন, ছাত্রদের নিয়েই ট্রেন্ডি ভিডিও বানান— তখন শ্রেণিকক্ষ হয়ে যায় কনটেন্ট স্টুডিও। আর শিক্ষক হয়ে ওঠেন ভাইরাল হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামা আরেকজন প্রতিযোগী।
ছাত্র-ছাত্রীরা তখন আর তাকে শ্রদ্ধা করতে শেখে না বরং শেখে উপভোগ করতে। এই উপভোগ একধরনের শ্রদ্ধাহীনতা তৈরি করে—যেটা শিক্ষকতা পেশাকে নিঃশব্দে তুচ্ছ করে ফেলে।
তাহলে কি শিক্ষক কনটেন্ট বানাবেন না?
অবশ্যই বানাবেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, বোঝাপড়া—সবকিছু এই সমাজের দরকার। কিন্তু কনটেন্ট যেন হয় তাঁর পেশার শালীনতা ও মর্যাদার আলোয় আলোকিত।
উপস্থাপন হোক শিক্ষামূলক বিষয়ের, পাঠদানের নতুন পদ্ধতির, কিংবা ছাত্রদের অনুপ্রেরণামূলক গল্পের— কিন্তু যেন কোনো অবস্থায় শিক্ষকতা হাসির খোরাকে রূপ না নেয়।
এই দৃষ্টান্তেই দাঁড়িয়ে আছেন মুনজেরীন শহীদ। তিনি আমাদের দেখান—কিভাবে একজন শিক্ষক, আধুনিক মাধ্যম ব্যবহার করেও, নিজের ব্যক্তিত্ব ও পেশার মর্যাদা অটুট রাখতে পারেন। তাঁর কনটেন্ট জ্ঞানভিত্তিক, সৌজন্যময়, এবং এমনভাবে নির্মিত—যা শ্রেণিকক্ষের বাইরেও শিক্ষকের গুরুত্ব ও সৌন্দর্য প্রতিষ্ঠা করে।
২
একজন মানুষ যখন চিকিৎসকের কাছে যান, তখন তাঁর সঙ্গে শুধু অসুস্থ শরীরটা থাকে না; থাকে অজানা আশঙ্কা, ভিতরের একরাশ ভয় আর থাকে একধরনের অব্যক্ত প্রার্থনা—তার কিছু যেন না হয়,থাকে বাঁচার আকুতি।
এই ভয় আর ভরসার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে একজন চিকিৎসক হয়ে ওঠেন রোগীর চোখে একরকম আশার আলো—যাঁর কণ্ঠে আশ্বাস, চোখে মমতা আর হাতে নির্ভরতার স্পর্শ থাকে।
এই সম্পর্কটা এতটাই স্পর্শকাতর, এতটাই আন্তরিক, যেটা ভেঙে ফেলতে খুব বেশি কিছু লাগে না—শুধু একটা ভুল ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল, একটা ভুল উদ্দেশ্যই যথেষ্ট।
কিন্তু আজ আমরা দেখি, কিছু চিকিৎসক হাসপাতালের করিডোরেই রেকর্ড করেন রিল, মুখে মাস্ক ঝুলিয়ে, ক্যামেরায় চোখ রেখে বলেন—“বন্ধুরা, আজকের কনটেন্টে দেখুন…”আর পেছনে হয়তো বসে আছেন একজন রোগী—যাঁর ভয়, যন্ত্রণার কোনো জায়গা নেই ওই ক্যামেরার ফ্রেমে।
এই চিত্রের একেবারে উল্টোপথে হাঁটেন ডা. তাসনিম জারা। তাঁর ভিডিওতে নেই মেকআপে ঢাকা মুখ, নেই বিনোদনের নাটকীয়তা।
তিনি জানেন, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানেই শুধুই নিজেকে উপস্থাপন করা নয়—তা একধরনের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব থেকে তিনি বলেন, বোঝান, শেখান। স্বাস্থ্যের জটিল বিষয়গুলোকে তিনি এমন সহজ ভাষায় তুলে ধরেন, যেন একজন বড় বোন পাশে বসে আদর করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন—এই জিনিসটা ভয় পাওয়ার কিছু না, আমি আছি।তাঁর চোখে মেকি আলো নেই, কিন্তু আছে মানবিক দীপ্তি। তাঁর কণ্ঠে নেই চিৎকার, কিন্তু আছে ভরসার নিঃশব্দ বলিষ্ঠতা। তিনি দেখিয়ে দেন—ক্যামেরার সামনে থেকেও একজন চিকিৎসক তাঁর শপথ ভুলে যান না। ৩
ধর্মের কাজ মানুষকে নিছক ভয় দেখানো নয় বরং মানুষকে ভেতর থেকে জাগানো যাতে মানবিক গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে।
আত্মা যেখানে হাঁপিয়ে ওঠে, মন যেখানে দুর্বল হয়, ধর্ম সেখানে হয় আশ্রয়।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজকাল কিছু ধর্মীয় বক্তা ক্যামেরা দেখলেই উত্তেজিত হন। তাঁদের কণ্ঠে উঠে আসে রাগ, আঘাত, অসহিষ্ণুতা, দলীয় বার্তা, রাজনৈতিক মিশ্রণ।
আয়াত-হাদিসের ছায়ায় জন্ম নেয় গুজব, বিভেদ আর গর্জন। এই ওয়াজের মঞ্চগুলো যেন কখনো কখনো হয়ে ওঠে—শান্তির বদলে হট্টগোলের উৎস, আত্মশুদ্ধির বদলে ভিউ-বাণিজ্যের কেন্দ্র।
এই রাস্তায় না গিয়ে, মুফতি ড. মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ হাঁটেন আলোর পথে। তাঁর কথা ধীর, চিন্তাশীল, গভীর। তাঁর কনটেন্টে নেই অহেতুক নাটকীয়তা, নেই অন্যকে হেয় করে নিজেকে বড় দেখানোর কৌশল।
তিনি জানেন—ধর্ম মানে মানুষের হৃদয় স্পর্শ করা। তাই তাঁর ভিডিওতে ঝড় ওঠে না, তবে মানুষ চুপ করে শোনে।
তিনি ভায়োলেন্স শেখান না, সংযম শেখান। তিনি প্রমাণ করেন— ক্যামেরার সামনে থেকেও একজন মুফতি নিজের ভিতরটাকে অটুট রেখে, মানুষের মধ্যে আলো ছড়িয়ে দিতে পারেন।
এই সময়টা ভাইরাল হওয়ার সময়। সেই ভাইরালিটি কেউ কেউ কিনে নেন হাস্যকর অভিনয় দিয়ে, কেউ কেউ হাঁটছেন নিজের আত্মমর্যাদা বিসর্জনের পথে। কিন্তু তার বিপরীতেই আছেন এমন কিছু মানুষ—যাঁরা ভাইরাল হন, কিন্তু কখনোই নিজের পেশা, নৈতিকতা কিংবা ভেতরের বিশ্বাসকে বিসর্জন দেন না।
মুনজেরীন শহীদ, ডা. তাসনিম জারা, মুফতি সাইফুল্লাহর মত এমন অনেকেই আছেন—তাঁরা দেখান, আপনি জনপ্রিয় হতেই পারেন, তবে সেটা হতে হবে আপনার শুদ্ধতা দিয়ে—আপনার বিচ্যুতি দিয়ে নয়।
এই সময়টা আমাদের জিজ্ঞাসা করে—আপনি কনটেন্ট বানাচ্ছেন তো, কিন্তু আপনি নিজেকে কোথায় হারিয়ে ফেলছেন কালের গহ্বরে?
আমরা চাই, পেশাজীবীরাও ভার্চুয়াল জগতে আলো ছড়ান, তবে সেটি যেন হয় সত্যিকারের আলো, ক্যামেরার নয়—চরিত্রের, দায়িত্বের, মূল্যবোধের আলো।
©somewhere in net ltd.