![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
'যতদূর মনে পড়ে খুব ছোটবেলা থেকেই আমিই রাতের আকাশ দেখে মজা পেয়েছি এবং রাতের আকাশ আমাকে টেনেছে। মনে হয়, রাতের 'আকাশের প্রতি টান নিয়েই জন্মেছি। তবে ১৩ বছর বয়সে এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে দূরবিন এক রাতের জন্য ধার করে আনার পর আমার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। সে সময়ের প্রতিটি মুহূর্তের কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ছোট ওই দূরবিন দিয়ে এবড়ো থেবড়ো চন্দ্রপৃষ্ঠ বিশদভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার চোখকে তখন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সে রাত আমার জীবনের গতি বদলে দেয়। তার পরপরই আমি রাতের আকাশের ছবি তুলতে শুরু করি।' কথা গুলো কে বলেছেন তা হয়ত অনেকেই অনুমান করতে পারছেন। হ্যাঁ, রাতের আকাশের ছবি তোলা নিয়ে কথা বলতে যেয়ে এ কথা গুলো বলেন বাবাক তাফরেশি। পুরো নাম বাবাক আমিন তাফরেশি।
তেহরানে জন্মগ্রহণকারী বাবাক তাফরেশি এখন আমেরিকার বোস্টনে বসবাস করেন। দ্যা নাইট স্কাই বা সংক্ষেপে টোয়ান নামের সংস্থার পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠাতা আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা পেশাদার আলোকচিত্রী বাবাক।
রাতের আকাশের ছবি তোলা নিয়ে কর্মশিবির করতে তেহরান আসছেন বাবাক। ইনস্টগ্রামের দেয়া পোস্ট থেকে জানতে পারি। গত ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। আয়োজন করছে তেহরানের নাইকন স্কুল। কর্মশিবিরে অংশ গ্রহণের জন্য কোনও টাকাকড়ি নেয়া হবে না। যোগাযোগ করার যে ফোন নম্বর দেয়া ছিল তার একটি ছিল জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে প্রাচীন সাময়িকী 'নজুম'এর।
প্রথম কর্মশিবির হলো তেহরানের আমির কাবির বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গেলাম সেখানে। সেখানকার কর্মশিবিরের প্রধান সমন্বয়কারীর সঙ্গে কথা হলো। ছবি তোলার এবং সাক্ষাৎকার নেয়ার অনুমতি দিলেন। তেহরানে এ সব অনুষ্ঠানে বিনা অনুমতিতে কেউ ছবি তোলার কথা ভাবেন না। তখনও এসে পৌঁছান নি বাবাক তাফরেশি। কর্মশিবিরের অংশগ্রহণকারীরা নাম নিবন্ধন করছেন। আমি এবং আমার ছোট ছেলে রাসতিন ওসবের আর ধার ধারলাম না। ভেতরে ঢুকলাম। নিবন্ধনের কাজে নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী দ্রুত ডেকে পাঠালেন সমন্বয়কারীকে। ইরানি কন্যাটির ভাবগতিক দেখে নিজেই এগিয়ে গেলাম। প্রধান সমন্বয়কারী সাঈদ ততক্ষণে এসে গেছেন। আমাকে দেখে সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। বললেন- না। অসুবিধা নেই। ইরানি কন্যাটি লজ্জা পেলো। ভঙ্গি থেকে ধারণা জন্মালও, 'ধরণী দ্বিধা হও' জাতীয় কিছু হয়ত বলছে মনে মনে। 'বেবাকসিত' (মানে 'মাফ করুন' বলছিলো বারবার। আমি বললাম- তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছ 'দোখতারে গোল'(আক্ষরিক অনুবাদ হবে 'ফুল কন্যা' আর ভাব অনুবাদ করলে দাঁড়াবে 'লক্ষীমেয়ে'
বরং তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কেউ হতো তখন? তোমার কাজ একশ ভাগ ঠিক আছে।
ভেতরে টুকটাক ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ দেখলাম মঞ্চে কি যেন ঠিক করছেন একজন। - বাবাক না? সায় দিল রাসতিন। দু'বছর আগে তেহরানে এসেছিলেন সে সময় রাইয়ান-রাসতিন দু'ভাইই গিয়েছিল। ব্যস্ত থাকায় যাইনি আমি।
ইনস্টগ্রামের ছবিতে নিয়মিত মন্তব্য করি। এ ছাড়া, সাক্ষাৎকার নেবো বলে ইমেইলও করেছি। এগিয়ে যেয়ে নাম বললাম। উষ্ণ ভাবে হাত বাড়িয়ে দিলেন বাবাক। করমর্দন করলাম। -বাবাক তোমার সঙ্গে কোলাকুলি করতে চাই। ওমনি উষ্ণ আলিঙ্গন করলেন তিনি। খুবই 'মাই ডিয়ার' টাইপের মানুষ। কথা বললেই ভাল লেগে যাবে যে কারও।
তখনই সাক্ষাৎকার নেবো কিনা জানতে চাইলেন। বললাম,- 'না। কর্মশিবির শেষ করি তারপর সাক্ষাৎকার নেবো।' বাবাক খুশি মনেই সম্মত হলেন। কর্মশিবির শেষে সাক্ষাৎকারে দিতে প্রস্তুত ছিলেন বাবাক। কিন্তু রাত হয়ে গেছে। এ ছাড়া, খানিকটা ক্লান্তও। তাই আমি আর রাজী হলাম না। অবশ্য পরে সাক্ষাৎকার টেলিফোনে নিয়েছিলাম।
আমির কবির বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশাল হল প্রায় ভরে গেছে। অন্তত ৫০০ ছেলে মেয়ে এসেছে। কর্মশিবিরের মাঝ খানে একবার অল্প সময়ে বিরতি দিলেন। চা-কফি-বিস্কিটসহ হালকা আয়োজন ছিল।
আধা ঘণ্টার বিরতির পর আবার কথা বলা শুরু করলেন বাবাক। খুবই চমৎকার কথক। নিজের তোলা ছবির মতোই সুন্দর তার বাচন ভঙ্গি। রসিকতা করতে জানেন। একই কর্মসূচি ছিল দ্বিতীয় কর্মশিবিরে। এটি হয়েছিল তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে। সেখানেও অংশ নিয়েছেন শ' পাঁচেক আলোকচিত্রে আগ্রহী ব্যক্তি। যাদের বেশির ভাগই তরুণ। সত্যিই এটা উৎসাহ ব্যঞ্জক।
রাতের আকাশের ছবি তুলতে যেয়ে পুলিশে হাতে পড়েছেন। অল্প সময়ের জন্য হাজতবাস হয়েছে। এমন বেগতিক পরিস্থিতির শিকার সব দেশেই হয়েছে। -এটা রাতের আকাশের ছবি তোলার সঙ্গে জড়িত বিপদ। এ বিপদ মেনে নিয়েই ছবি তুলতে হবে। মজার ভঙ্গি সে কথা বলতেই গোটা হল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ল।
রাতের আকাশের ছবি তোলার প্রধান চ্যালেঞ্জের কথা বলতে যেয়ে তিনি জানান, প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, এমন স্থান খুঁজে বের করা যেখানে মানুষের তৈরি আলোর কোনও দূষণ নেই। উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা যায় আমাদের গ্রহটিতে আলোর দূষণ প্রতি বছর ২ শতাংশ হারে ঘটছে। আমাদের গ্রহ ক্রমেই রাতে উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে আর এতে রাতের আকাশ হারিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির এমন সৌন্দর্যময় দিকটি হারিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে জনবহুল দেশে এমনটি ঘটছে, বলেন তিনি। অবশ্য, এখনও পৃথিবীর অনেক দেশে প্রচুর স্থান আছে সেখান থেকে রাতের আকাশ নির্বিবাদে দেখা যায়। এ ছাড়া, অনেক দেশেই এমন স্থানগুলোকে রাতের আকাশ দেখার জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ স্থানগুলোকে 'ডার্ক স্কাই পার্ক' 'রাতের আকাশের পার্ক' বলা হয়। এ ধরণের পার্ক করার চিন্তা মাত্র এক দশক আগে শুরু হয়েছে। এ ধারণার প্রসার ঘটিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই অ্যাসোসিয়েশন। এখন এ ধারণা দেশে দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে।
রাতের আকাশে ছবি তোলার আরেক চ্যালেঞ্জ ক্যামেরা এবং যন্ত্রপাতি। সে কথাও জানালেন। আজকের দিনের যে কোনও ডিএসএলআর বা আধা-পেশাদারি মিররলেস ক্যামেরা দিয়ে রাতের আকাশের ছবি তোলা যাবে। লং এক্সপোজার বা দীর্ঘ মেয়াদি এক্সপোজার করা যাবে কিন্তু এতে 'নয়েজ' নামে পরিচিত কিছু সমস্যা থাকবে না তেমন যে কোনও ক্যামেরা দিয়ে রাতের আকাশের ছবি তোলা যাবে। জানালেন তিনি।
এ জন্য ১০ থেকে ৩০ সেকেন্ড এক্সপোজার দেয়া লাগবে এবং আইএসও থাকবে ৩২০০ থেকে ৬৪০০। এ ছাড়া ওয়াইড অ্যাংগেল লেন্স লাগবে। অল্প সময়ে সঠিক মাত্রার আলো ধারণের জন্য লেন্সকে ফার্স্ট হতে হবে। অর্থাৎ ওপেন অ্যাপারচার ২.৮ বা তার চেয়ে কম হতে হবে। ক্যামেরা যাতে কোনোভাবে নড়াচড়া না করে সেজন্য শক্ত-সমর্থ ট্রাইপড বা তেপায়ার ওপর রাখতে হবে। অন্ধকার রাতকে সঠিকভাবে পাওয়া গেলে ছবি তোলার জন্য দামী ক্যামেরার প্রয়োজন নেই। রাতের আকাশের ছবি মানেই কেবল ছায়াপথের ছবি নয়। জানান তিনি। ছায়াপথের অসংখ্য ছবি তোলা হয়েছে। তাই ছায়াপথের ছবি তোলার বিষয়ে সতর্ক হওয়া দরকার।
এ ছাড়া, সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় রাতের আকাশের ছবি তুলতে যেয়ে হিপোর তাড়া খাওয়ার গল্প আমাদেরকে শুনিয়েছিলেন তিনি। তিনি বলেন, দেখুন আমার তোলা প্রতিটি ছবির একটি নিজস্ব গল্প আছে। আর তাই আমার কাছে হাজার হাজার আলাদা গল্প রয়েছে। রাতে অনেক কিছুই ঘটে। দিনের বেলায় এ সব ঘটনা সচরাচর ঘটে না। দিনের বেলায় মস্তিষ্ক যতোটা তৎপর থাকে রাতের বেলায় তা থাকে না। তাই রাতে আপনি ভুল করেন, কোনও কিছু আপনি পরিষ্কার ভাবে দেখতে পান না। এ ছাড়া দুর্ঘটনাও কখনও কখনও ঘটে। সব মিলিয়ে ছবি তোলাই হয়ত আর হয় না। তবে রাতের আকাশের ছবি তোলার ক্ষেত্রে এ সবই স্বাভাবিক ঘটনা। আর এ সব কারণেই রাতের আলোকচিত্র গ্রহণকে আরও মজার করে তুলেছে। এটি আরও চ্যালেঞ্জিং এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। রাতের আকাশের ছবি তোলার দিকে মানুষকে আকর্ষণ করার অন্যতম কারণ হলো এই যে দিনের আলোতে ছবি তোলার চেয়েও এটি একেবারেই ভিন্ন।
রাতে চোখে আপনি আলো দেখতে পান না কিন্তু ক্যামেরা তা দেখতে পায় এবং ধারণ করে। রাতের বেলায় সবই আপনার কাছে অন্ধকার এবং বর্ণহীন ঠেকে। কিন্তু ক্যামেরা ৩০ সেকেন্ডে এক্সপোজারের মাধ্যমে যে দৃশ্য ধারণ করে তা দেখে আপনি হতবাক হয়ে যাবেন।
আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়াতে ছবি তুলেতে যেয়ে এক দারুণ অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছিলাম। ২০০১ সালে অর্থাৎ ১৭ বছর আগে পূর্ণ সূর্য গ্রহণের ছবি তোলার জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। জাম্বেসি নদীর কাছে রাতে আমি ছায়াপথ এবং মঙ্গল গ্রহণের ছবি তুলছিলাম। সে সময় ছবি তোলার কাজে ফিল্ম ব্যবহার করছিলাম কারণ তখন ছবি তোলার হতো অ্যানালগ পদ্ধতিতে।
পাঁচ ছয় মিটার দূরে একদম নদীর পাড়ে বিশাল পাথর ছিলো। সে সময় আমি সে পাথরকে তাক করে টর্চের আলো ফেলতে থাকি। রাতের আকাশে যে ছবি তুলছি তার ভেতর যেনও নিয়ে আসা যায় সে জন্য এ ভাবে পাথর লক্ষ্য করে আলো ফেলতে থাকি। একে আলোকচিত্রের ভাষায় 'লাইট পেইন্টিং' বলা হয়। কিছুক্ষণ পরে নজরে পড়ে পাথরের নিচে দু'টি জায়গা থেকে আলো প্রতিফলিত হচ্ছে এবং ও দুই এলাকা নড়াচড়া করছে। এরপরই গোটা পাথর নড়ে উঠতে শুরু করে। এটি আমার দিকে ধেয়ে আসতে থাকে।
আর তখনি বুঝতে পারি আমি বিশাল একটি হিপো বা জলহস্তীর কাছেই রয়েছি। সাথে সাথে আমি ক্যামেরাসহ সবকিছু নিয়ে ছুটতে থাকি। রাতে বিরক্ত করেছি তাই আমাকে তাড়া করে আসে ৪ বা ৫ টন ওজনের বিশাল এক জলহস্তী। আফ্রিকার সবচেয়ে বিপদজনক প্রাণী হলো হিপো। এ প্রাণী বেশ আগ্রাসীও!
প্রতি দু'বছর পর তেহরানে আসেন বাবাক তাফরেশি। তার মুখে নতুন কোনও গল্প শুনতে দু'বছর অপেক্ষা করতে হবে।
©somewhere in net ltd.