![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্লান ছিলো সাত সকালেই বেরোবো। তা আর হয়ে উঠলো না। রাতে বিছানায় গা এলিয়েছি দশটার আগেই। সামনে দীর্ঘ জার্নি। কিন্তু ঘুম কি আসে। এতোবড়ো একটা রোমন্থন! বহু আকাঙ্খিত ঢাকা-বরিশাল সাইকেল রাইড। যাই হোক যখন সাইকেল নিয়ে বুড়িগঙ্গায় সদরঘাটের এলোমেলো লঞ্চের নোঙরের বহর দেখতে দেখতে বাবুবাজার ব্রীজ পার হচ্ছি তখন সকাল দশটা। এখনকার হিসেবে অতি সাধারণ একটি সাইকেলে চেপে একাই এই দুঃসাহসটি করে বসেছি। চিনবেন সবাই, হিরোর রেঞ্জার ম্যাক্স সাইকেল। আবহাওয়া পক্ষেই ছিলো। যতদুর মনে আছে গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। ব্রীজের খাড়া ঢাল দিয়ে সিএনজির সঙ্গে সমান তালেই ছুটছিলাম। কদমতলীর জ্যাম বাধ সাধলো। বুঝলাম ঢাকা এখনো ছাড়াইনি। অতি সন্তর্পনে কখনো রাস্তার মাঝ দিয়ে কখনো আবার আউট অফ রোড দিয়ে, ময়লা আবর্জনা ঠেলে ঢাকা মাওয়া হাইওয়েতে পৌছলাম। আহ যেন প্রচ্ছন্ন শান্তি। সামনে ব্রেকলেস দুর্দান্ত প্যাডেলিংয়ের হাতছানি। প্রো রাইডারদের পরামর্শ (Slow but steady, When journey is lengthy) থোরাই কেয়ার করে পঁচিশ কিলো গতিতে ছোটালাম আমার পংখিরাজ। পনের কি বিশ মিনিট হবে, গুরুজনদের বাসি কথা মিষ্টি হতে লাগলো। টোটাল এনার্জি হ্যাজ গন। তাহলে কি ফিরে যেতে হবে? না ফিরবো না। ডিটারমাইন্ড আমি।উপায় হাতড়ালাম। একটা বাজার দেখে থামলাম। বাজারের নাম মনে নেই। অবশ্য খুব সহজে কোন নামই মনে থাকেনা আমার। এই দূর্বলতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থি। গরীবের এনার্জি টোটকা কলার শরনাপন্ন হলাম। বড়সরো একটা সাগর কলা পেটে চালান করে দিলাম। যথারীতি ইনস্ট্যান্ট এনার্জির কাজ হলো। ফার্মেসী থেকে একটা মাস্কও নিলাম। হাইওয়েতে এর আগেও রাইড করেছি। যেমন ঢাকা -চট্টগ্রাম, ঢাকা-আরিচা। তবে এবার একটু বাড়তি সুবিধা পেলাম। মাওয়া পর্যন্ত দুপাশে পথচারীদের জন্য যে বাড়তি দুই ফুট করে জায়গা রাখা আছে তা আমার জন্য আশির্বাদই ছিলো। না হলে গাড়িগুলো ছিলো বেশ বেপরোয়া। ওভারটেকের খপ্পরে যখন পড়েছি তখন প্রতিবারেই রাস্তার বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছি। কোথাও ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে কোথাও আবার খানাখন্দের মধ্য দিয়ে। ড্রাইভারদের স্বেচ্ছাচারীতা দেখে মনে হচ্ছিল এই রাস্তায় সাইকেলিং করা অনেকটা নিষিদ্ধ। যাই হোক ধলেশ্বরীর জোড়া ব্রীজ পার হওয়াটা ছিল সত্যিই একইসাথে রোমাঞ্চকর এবং ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। ব্রীজ দুটো এতটাই ন্যারো যে দুটি বাস ক্রোস করলে পাশে একফুট জায়গা থাকে। মানে এক ইঞ্চি এদিক সেদিক হলে দুর্ঘটনার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তার সঙ্গে মরার ওপর খরার ঘা এর মতো দুপাশেই পুরু বালুস্তর জমেছিলো। যাই হোক আল্লাহর নাম জপতে জপতে এ যাত্রায় রক্ষা হলো। ব্রীজ দুটো যথেষ্ট উঁচু। তবে প্রথমটার খাঁড়াই বেয়ে উঠতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলেও দ্বিতীয় ব্রীজটায় উঠতে কোনো কষ্টই হয়নি। প্রথম ব্রিজটির ঢাল অর্ধেক শেষ হতে না হতেই দ্বিতীয় ব্রীজটার ঢাল শুরু হয়ে যায়। এতে ঢাল থেকে নামের গতি আর স্বাভাবিক প্যাডেলিং দ্বিতীয় ব্রীজের ওপরে পৌঁছে দেয়। এবার বিক্রমপুরের প্রকৃতি দর্শনের পালা। প্রকৃতি দর্শন বলতে হাইওয়ের দুইপাশে যতদূর দেখা যায় এই। কিছু বড়বড় বিলের মতো জলাভূমি রয়েছে। জলাভূমির মাঝে মাঝে দ্বীপ সদৃশ দু একটা বাড়ি দেখলাম। এছাড়া বিস্তীর্ণ ক্ষেতও ছিল। বারোটা আঠারোয় মাওয়া পুরনো ঘাট পৌছে গেলাম। পথিমধ্যে কোন ব্রেক নেইনি। পেট চো চো করতে লাগলো। একটা বড় পরাটা ডিম আর ভাজি দিয়ে গলধকরন করলাম। পানি যে এত সুস্বাদু হয় আগে জানতাম না। চাপ কল ছিল দোকানের পেছনেই। কল চেপে ন্যাচারাল ঠান্ডা পানি। আহ! তাড়াতাড়ি এবং সস্তা উপায় হিসেবে লঞ্চের দোতলায়, সুকানির পরামর্শে পেছনের খালি জায়গায় সাইকেল রাখলাম। লঞ্চ ছাড়ি ছাড়ি করছিলো। কানায় কানায় যাত্রী। তাই পেছনে নামাজের জন্য সংরক্ষিত জায়গায় অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে বসলাম। প্রচন্ড রোদ। থাই হেলমেটটি আর খুলিনি। এটাই সবার দৃষ্টিগোচর হলো। নানা জন, নানারকম প্রশ্ন করলো। হাসিমুখে উত্তর দিলাম। যদিও বিগত শারীরিক পরিশ্রম আর লাভা ছড়ানো রোদে মেজাজ ছিল তিরিক্ষি। যখন পুরনো মাওয়া ঘাটে বসে খাচ্ছিলাম তখোনো দুএকজন খুটিনাটি প্রশ্ন করেছিল। একজন তো রীতিমতো গল্প জুড়ে দিলেন। বয়স কালে তিনি মাওয়া হতে হাটা পথে ঢাকা গেছেন। তখন এমন রাস্তা ছিলনা। ছিল দুর্গম পথ। লোকটার বয়স অনুর্ধ্ব চল্লিশ। আমি কথা বাড়াইনি। চুপচাপ শুনে গেলাম। লঞ্চ যখন পদ্মা পার হয়ে পল্টন ছুলো তখন বেলা দুটো বিশ এরকম হবে। আমার সঙ্গে সাইকেল। অগত্যা সবার শেষেই নামলাম। আমাদের জাতিগত যে কটা বদঅভ্যাস আছে তার মধ্যে গাড়ি, লঞ্চ থেকে নামার তুমুল প্রতিযোগিতা। আমি কখনো বায়ুপথে ভ্রমণ করিনি। জানিনা আকাশযান থেকে নামার সময়েও আমাদের দেশে এরকম হয় কিনা। যাই হোক। ঢাকা থেকে পঞ্চাশ কিলোর্ধ অতিক্রান্ত হয়েছে। পুনরায় সেই ব্রেকলেস প্যাডেলিং শুরু। একটানা দুই ঘন্টা যাত্রা। পথিমধ্যে চম্পা কলা কিনেছিলাম এক খুনখুনে বুড়োচাচার দোকান থেকে। উনি অনেকাংশে আমার এই কষ্টকর জার্নি ইজি করে দিয়েছেন। ঐ মুরব্বীর দোকানটা ভাঙ্গা আর কাওরাকান্দি ঘাটের মাঝামাঝি একটা বাজারে। মুরব্বীর দোকানটা রাস্তা থেকে অনেকটা নীচে। তো আমি চম্পা কলা দেখে দোকানে গিয়ে দেখি দোকানদার নেই। চাচা রাস্তার ওপারে ছিলেন। বয়সের ভারে ধনুকের মতো বেকে গেছেন। ওনার রাস্তা পার হয়ে দোকানে আসতে দুই মিনিটেরও বেশি লাগলো। বয়স জিজ্ঞাসা করতে বললেন সঠিক হিসেব জানেন না। তবে নব্বইয়ের আশে-পাশে হবে। আমার ধারনও এরকমই ছিলো। যাই হোক চাচাকে দেখে খুব ইনস্পায়ারড হলাম। এরপর ছাগলছিড়া বাজার পর্যন্ত একটানা পথ চললাম। যখন মাদারীপুর ডাল গবেষণা ইনস্টিটিউটে পৌছলাম তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। পথিমধ্যে ফরিদপুরের বিস্তৃত চাষের জমি বেশ উপভোগ্য ছিল। এইপথে ইতিপূর্বে কতবার গিয়েছি, কই কখনো এতোটা ভালো লাগেনি তো। সত্যিই সাইকেলিং এক রোমান্সের নাম।
ঐ সব ক্ষেতে যেন রং বেরংয়ের মাদুর বিছানো। অমন অনিন্দ্যসুন্দর ক্ষেতে যখন শীতের স্লোথ বাতাসের ঢেউ খেলেছে, উফ বড্ড লেগেছে। শুরুতেই বলেছি গন্তব্য বরিশাল। যদিও প্রথমটায় অন্তত একজন সঙ্গি থাকবে আশা ছিলো। কিন্তু সময়ের স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে সে আশা ক্ষীন হয়ে যায়। পথেই রাত অথবা ক্লান্তি ভর করার সমূহ সম্ভাবনা ছিলো, তাই আশ্রয়স্থল হিসেবে মাদারীপুরের ডাল গবেষণাকেন্দ্র আব্বুকে বলে দূরসম্পর্কের চাচার সাবেক কর্মস্থল হবার সুবাদে যাত্রা বিরতী স্থল হিসাবে ঠিক করেছিলাম। প্লানটা খুব কাজে দিলো। অতটা ক্লান্তি কোনদিনই ভর করেনি আমায়। আর অমন গভীর প্রশান্তির ঘুম ছোটবেলায় সারাদিন ছুটোছুটির পরেও ঘুমিয়েছি কিনা মনে পড়ে না। সন্ধে সাড়েসাতটা থেকে সাড়ে পাচটা অব্দি টানা দশ ঘন্টার ঘুম বেশ কাজে দিলো। সকালে উঠে যা দেখলাম তাতে চোখ ছানাবড়া। অনেক ভ্রমণকাহিনী বা বইয়ে যেসব চমৎকার বাংলোর কথা পড়েছি, ডাল গবেষণা কেন্দ্রটি যেন ওগুলোরই একটি। যাই হোক কতক্ষণে ঢাকা থেকে সাইকেলে চেপে নিজের জন্মস্থান বরিশাল পৌঁছতে পারি এই চিন্তা মাথায় ভর করে ছিলো। তাই সূর্য উকি দেয়ার আগেই বেরিয়ে পড়লাম পথে। বাকি ছিলো আরো চল্লিশ কিলো। অর্ধেক আবার অফরোড। তাই একটানা চার ঘন্টা প্যাডেলিং (নাস্তার পনের মিনিট বাদে) এর পর পৌঁছে গেলাম আমার চিরচেনা গাঁয়ে।
অবশ্য এই যাত্রা শেষে বাহবার বদলে বোকা, গাধা, পাঠা সহ নানান সব শক্তিশালী ও কর্মঠ প্রানীজাত উপাধি জুটেছিল আমার। আশান্বিত হইনি কিংবা অাহতও হইনি। বরং নিজের সূদূরপ্রসারী চিন্তার বাস্তব প্রতিফলন দেখে গর্ববোধ করেছি। বাংঙাল না আমরা ?
০৫ ই এপ্রিল, ২০১৭ ভোর ৬:৫০
মুহাম্মদ মুশফিকুর রহমান বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য। দেখুন আমি অনেককেই দেখেছে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বসে থাকতে। আসলে কোন কিছু করার অদম্য ইচ্ছাই যে কাউকে সফল করে। কারোরই সকল বাহন থাকেনা।
©somewhere in net ltd.
১|
০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৫:১৩
ভবঘুরের ঠিকানা বলেছেন: ভালো লাগলো লেখা পড়ে। ছবিগুলোও চমৎকার। তবে আরও কয়েকটি ছবি দিলে ভাল হত। আমি একটি ইলেকট্রিক বাই সাইকেলের কথা ভাবছি, যা সোলার প্যানেলের সাহায্যে সূর্য থেকে শক্তি সংগ্রহ করবে। এ রকম সাইকেল পেলে পুরো বাংলাদেশ ভ্রমনে বের হয়ে পড়বো।