![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য পথে জোর কদমে মিথ্যা পায়ে দলে জীবন চালাই প্রভূর দেয়া বিধান মতে চলে।
শাহ্জালাল’র (রহঃ) নিশান উড়ে
ফয়জুল আলম বেলাল
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসারে পীর-আওলিয়াদের অবদান অনস্বীকার্য। খোলাফায়ে রাশেদীনের পরে সত্যিকারের ইসলামী রাজ্য হারিয়ে গেলে ও যুগে যুগে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যে অনেকে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শাহাদাত বরণ করেছেন। ইসলামপন্থীরা বিশ্বাস করেন যে, ইসলামের সোনালী যুগ নিঃশ্বেষ হয়নি। আবার পৃথিবীতে অদূর ভবিষ্যতে ইসলামী নিশান উড়বে। হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) ছিলেন এমনি প্রত্যয়ে প্রত্যয়শীল। তিনি স্বীয় মাতৃভূমি ইয়ামেন ছেড়ে দিল্লী এসেছিলেন। সেখান থেকে সময় সুযোগে ইসলামী শাসন কায়েম করতে সিলেটে আগমন করেন। কেবল আধ্যাতিকতা নিয়েই নয়, তখনকার দিনের সর্ব প্রধান অস্ত্র তলোয়ার ও ঢাল সঙ্গে এনেছিলেন। তাঁর ৩৬০ অনুসারীদের হাতে ও ঢাল-তরবারী ছিল। গৌড় গোবিন্দের সকল প্রচেষ্টা তাঁর সামনে ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি বিনা রক্তপাতে সিলেট জয় করেন।
ছোট বেলায় মক্তবে সহপাঠিদের কাছে প্রথম শুনি শাহ্জালাল’র (রহঃ) মাজারে পুকুরে শুধু গজার মাছ। পানিতে হাত দিলে গজার চলে আসে। ভেবে অবাক হই! কি আশ্চর্য স্থান! সৌভাগ্যক্রমে মক্তবে শুনার কয়েক সপ্তাহ পরে সিলেট শহরে আব্বার সাথে ১৯৮২ যাওয়ার সুযোগ হয়। আমি ও আমার বড় ভাই আব্বার সাথে শাহ্জালালের (রহঃ) দরগা জিয়ারতে যাই। পুকুরের সেই মাছ দেখে শুনা গল্পের সাথে যথেষ্ট সদৃশ্য পাই। তবে পুকুরের চার তৃতীয়াংশ কচুরিপানা এবং এক ভাগে শুধু গজার মাছ। ভক্তরা ছোট ছোট মাছ ক্রয় করে গজার মাছকে খেতে দেয়। আমরাও তাই করি। কেউ কেউ বলেন গজার মাছ সবার খাবার খায়না। যাদের ভাগ্য ভালো তাদের খাবার খায়!
আব্বার সাথে মাজারে উঠার সিঁড়ির কাছে যেতে কর্তব্যরত এক ব্যক্তি বলেন, হাফপ্যান্ট পড়ে উপরে যাওয়া নিষেধ। তিনি আমাদের নিচে রেখে জিয়ারতে চলে যান। আক্ষেপ করি হাফ প্যান্ট না পড়ে যদি লুঙ্গি পড়ে আসতাম তাহলে সুযোগ হাতছাড়া হত না। সোনার মাগুর দেখতে মাজারের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে যাই। মানুষ কুয়ার দেয়ালে (ইদারা) আঘাত করে মাদারি বলে ডাকে। কেউ বলছে ঐ দেখা যা”্ছ।ে আবার কেউ বলে সোনার কই মাগুর কই? সেখানে যেতে পেরেই নিজেকে তৃপ্ত মনে করি। দেখা না দেখার কোন ধারধারিনি! আব্বা দরগার সামনের দোকান থেকে শিরনি ক্রয় করে আনেন। এক প্যাকেট মাজারে অবস্থানকারী ভিক্ষুকদের (আহলে মাজার) বন্টন করার জন্য এক ব্যক্তির হাতে দেন। অন্য প্যাকেট বাড়ি নিয়ে আসেন। মাজারের শিরনি বলে সবাই খেয়ে তৃপ্তবোধ করেন। শাহ্জালাল (রহ সম্পর্কে এসব প্রাথমিক ধারণা। তিনি কোথায় থেকে কেন এসেছেন? কিংবা তাঁর মাজার কেন্দ্রিক প্রতিবছর ওরশ হয়, সে সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না। ১৯৮৭ সালে জুলাই মাসে আমাদের ঘরে প্রথম টি,ভি ক্রয় করে আনা হয়। সন্ধ্যার পরে শহিদ চাচা ও শফিক মিয়া (নানা) টি,ভি নিয়ে আসেন। আমরা ভাই-বোন টি’ভি ঘিরে দাঁড়াই। খানিক পরে অন করা হয়। তখন আটটার সংবাদ ছিল। সংবাদে হযরত শাহ্জালালের (রহঃ) ওরশের উপর প্রতিবেদন দেখানো হয়। হাজার হাজার মানুষের ভীড়, দোকান পাঠের পসরা। বাউল-মাস্তানাদের ছড়ি হাতে গেরুয়া গায়ে গান পরিবেশন দেখি। শফিক মিয়া বলেন শাহ্জালালের (রহঃ) ওরশ। টি’ভি আনা সার্থক ও মূল্য উসুল হয়েছে।
শাহ্জালালের (রহঃ) ওরশ দেখা ও তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ তখন থেকে জন্মে। অডিও ক্যাসেট ও বইয়ের মাধ্যমে জানার সুযোগ পাই। কিন্তু দরগার ওরশ বাস্তবে দেখার সময় ও সাহস কোনটি অনুকুলে আসেনি। ১২মে ১৯৯৩ বুধবারে দুপুরে হঠাৎ বিশ্বনাথ থেকে সিলেট ওরশ দেখার জন্য রওয়ানা হই। সিলেট চৌহাট্টা থেকে মানুষের ঢল দেখি! রাস্তার দু’পাশে রকমারি দোকান-পাঠ সারিসারি। আনন্দ উদ্দীপনায় দরগায় যাওয়ার মূল ফটক অতিক্রম করি। মাঝারের নীচে দক্ষিণ পাশে ব্যাঙের ছাতার মত তাঁবু দেখি। কোন কোন তাঁবুতে তুমুল বাদ্যে সুরে বেসুরে গান চলছে। কোন তাঁবুতে কেউ কেউ গাজা টানছে। আবার কেউ কেউ ঝিমুচ্ছে ঘুমে কিংবা নেশায়। এই দৃশ্য দেখে আমার মনে ভয় এসে যায়। আমার কাছে মনে হয় যে কোন সময় এখানে আল্লাহর গজব আসতে পারে! যত সম্ভব দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে যাই। এতদিনের ওরশ দেখার আনন্দ ক্ষণিকের মধ্যে মলিন হয়ে যায়।
১৯৯৫ সাল থেকে কয়েক বছর দরগার পাশ্ববর্তী রাজারগলি অবস্থান করি। ঐ কয়েক বছরে দরগা সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় জানার সুযোগ হয়। প্রতি বৃহস্পতিবারে সপ্তাহিক ওরশ থাকে। রাতে দরগার উত্তর পাশে গানের আসর বসে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত মানুষ বৃহস্পতি বারে আসে। কেউ কেউ জিয়ারত ও শিরনি বিতরণ করে পাশ্ববর্তী হোটেল সমূহে অবস্থান করেন। আবার কেউ কেউ মাঝার আঙ্গিঁনায় রাত যাপন করেন। ভক্তদের প্রবল ভালোবাসা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত মাগরিব ও এশার নামাজের সময় তাদের সাথে মিশে যেতাম। তাদের কার্যকলাপ উপভোগ করতাম। পুকুর পাড়ে ভক্তরা আলাপ প্রসঙ্গেঁ বলেন, এই পুকুরে কোন তলদেশ নেই। কেউ কোনদিন খুঁজে পাবেনা। ভক্তদের এমন বিশ্বাসের বিপক্ষে কথা বলার সাহস ছিল না। কিন্তু ১৯৯৭ সালে পুকুরটি পুনঃখননের জন্য সেচ করা হয়। পুকুরের পানিতে গজার মাছ মরে যাচ্ছিল। মাছগুলি মুফতি বাড়ির একটি পুকুরে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে ও মাছগুলি ভেসে বেড়াতে দেখেছি। ভক্তদের মনে হয়তো শক্ত আঘাত লেগেছে, যারা এতদিন বলেছেন পুকুরের কোন তলদেশ নেই! সিলেটের মাটি ইসলামের ঘাঁটি থাকবে চিরকাল, এই মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন হজরত শাহ্জালাল (রহঃ)।
শাহ্জালাল (রহঃ) এর পাক কদমের বরকতে বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট ইসলামের বিজয় নিশান উড়েছিল। সাতশত বছর পরেও দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্ত মুরিদান এখানে আসেন। প্রতিদিন তাদের পদচারণায় মুখরিত থাকে সিলেটের বিভিন্ন জনপদ। তারা মাজারে এসে মহান ওলির সাহায্য নিয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে। মাজারের সংরক্ষিত কক্ষে শাহজালাল’র (রহঃ) ব্যবহৃত বস্ত্র, খড়ম, তলোয়ার, সাজানো রয়েছে। এসব ভক্তরা অশ্র“ সজল চোখে দেখেন। মাজার প্রাঙ্গণে পুকুরে বৃহৎ আকৃতির গজার মাছ দেখে। এগুলো হযরত শাহজালাল’র (রহ রেখে যাওয়া মাছের বংশধর। তাই আগত ভক্ত আশেকানরা গজার মাছকে খাবার বিলিয়ে দেয়। এসব মাছ কেউ খায় না বরং মরে গেলে মাটিতে পুতে রাখা হয়। তবে মাছের সংখ্যা ক্রমাগত ভাবে হ্রাস পাচ্ছে। মাজারের পশ্চিম পাশে একটি কূপ (ইদারা) রয়েছে। এর গা ঘেঁষে পানি প্রবেশ করে। ভক্ত মুরিদানরা রোগ মছিবত থেকে রক্ষার জন্য বোতল ভরে পানি নিয়ে যান। অনেকে ইদারায় টাকা-পয়সা, সোনা-দানা ফেলে রাখেন। ইদারার মধ্যে সোনালী বর্ণের কই-মাগুর মাছ রয়েছে। এগুলো দেখার জন্যে ভক্তদের মাঝে যথেষ্ঠ আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ এগুলো দেখাকে সুভাগ্য মনে করেন। মাজারে কাজল বর্ণের অসংখ্য কবুতর আছে। এগুলো সিলেট শহর ও পার্শ¦বর্তী এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে। কবুতরের খাবারের জন্যে ভক্তরা ধান-চাল এনে নির্দিষ্ট স্থানে রাখেন। এসব কবুতর হযরত শাহজালাল (রহ
কে উপহার দেয়া দরবেশ নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার এক জোড়া কবুতরের বংশধর। আমি ৪ এপ্রিল ২০০৪ সালে নিউ দিল্লি তাঁর মাজার জিয়ারতে যাই। দুই দরবেশের অবস্থান ও কবুতর উপহারের কথা মনে পড়ে। এই ভাবনায় ‘একজোড়া কবুতর’ কবিতায় লেখি, আজ থাকলে হয়তো দিতে প্রীতি উপহার/ একজোড়া কাজল কালো কবুতর তোমার/ সাত শত বছর পূর্বে তুমি সুহৃদ হযরত/ শাহজালাল (রহ
কে দিয়েছিলে একবার। তোমার স্মরণীয় দিনগুলো মনে পড়ে এখন/ দুই কিংবদন্তীর ওলি ছিলে একসাথে তখন/ আমিও দাঁড়িয়েছি সেই স্মৃতির আঙ্গিনায়/ কিন্তু তোমরা পরকালের বাসিন্দা দুইজন। সিলেটের নীলাভ আকাশ পানে প্রত্যহ ভোরে/ সেই কবুতর ঝাঁকে ঝাঁকে ডানা মেলে উড়ে/ তোমাদের বন্ধুত্বের বন্ধনের জয়গান গায়/ স্মৃতির ক্যানভাস ভাসে আনন্দে হৃদয় জুড়ে।(সংক্ষেপিত)
কিংবদন্তীর এই সৈনিক ১৩০৩ খ্রীষ্টাব্দে সিলেটে আগমন করেন। তাঁর আগমনে সিলেট সহ বাংলার ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায়। মানুষ নতুন জীবন লাভ করে। শাহ্জালাল’র (রহঃ) নাম, আদি বাসস্থান ও জন্ম তারিখ সম্বন্ধে যথেষ্ট মতভেদ থাকলেও আমরা এসবের উর্ধ্বে থাকব। তাঁর পৈত্রিক বাসস্থান ছিল আরব দেশের ইয়ামেন প্রদেশে। পিতার নাম মুহাম্মদ ও মাতার নাম সৈয়দা হাসিনা ফাতিমা। শাহ্জালাল (রহঃ) বাল্যকালেই পিতা-মাতাকে হারান। মামা সৈয়দ আহমদ কবির তাঁকে পুত্র নির্বিশেষে লালিত-পালিত করেন। মামার কাছে কুরআন-হাদিস শিক্ষার মাধ্যমে তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তির বিকাশ ঘটে। কথিত আছে যে সৈয়দ আহমদ কবিরের কাছে একটি হরিণী বাঘের আক্রমনে দৌড়ে এসে বিচার প্রার্থী হয়। তিনি ভাগ্নে শাহ্জালাল (রহঃ) কে ঘটনা স্থলে প্রেরণ করেন। শাহ্জালাল (রহঃ) সেখানে গিয়ে বাঘটিকে চপেটাঘাত করে তাড়িয়ে দেন। মামার কাছে এসে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। মামা তা শুনে বলেন, তুমি কামালিয়াত লাভ করেছ। আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। তিনি নিজের হুজরা থেকে এক মুঠো মাটি তুলে শাহ্জালাল (রহঃ) এর হাতে দিয়ে ধর্ম প্রচারের জন্য হিন্দুস্থানে পাঠান। তিনি মাটি হাতে দিয়ে বলেন, যেখানে এই বর্ণের ও গন্ধের মাটি পাবে, সেখানেই তোমার ধর্ম প্রচার ও সাধনার স্থায়ী আবাস গড়বে। তিনি মামার নির্দেশানুসারে বারোজন সঙ্গী নিয়ে ভারতবর্ষে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে আরো অনেকে সফর সঙ্গী হন।
তাঁরা দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ভারতবর্ষের দিল্লীতে আসেন। তখন শাসনকর্তা আলা উদ্দিন খিলজী ছিলেন। দিল্লীতে বিখ্যাত দরবেশ নিজাম উদ্দিন আওলিয়ার সাথে কিছুদিন অবস্থানের পর বাংলা অভিমুখে রওয়ানা হন। হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) সিলেট আগমনের পূর্বে গৌড় রাজ্যের রাজা গৌড় গোবিন্দ ছিল। তখনকার গৌড় নগর বর্তমান টুলটিকরে বুরহান উদ্দিন নামে একজন মুসলমান বাস করতেন। তিনি পুত্রের আকিকায় একটি গরু জবাই করেছিলেন। একটি চিল এক টুকরো গোশত নিয়ে যায় এবং তা ফসকে গৌড় গোবিন্দের মন্দিরে পড়ে যায়। রাজা অগ্নিশর্মা হয়ে সৈন্য দ্বারা তল্লাশি করে বোরহান উদ্দিনকে ধরিয়ে আনেন। রাজার আদেশে তাঁর ডান হাত কেটে ফেলা হয় এবং নবজাত পুত্রকে হত্যা করা হল। বুরহান উদ্দিন এই নির্মম অত্যাচারের জন্যে বাংলার সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের নিকট বিচার প্রার্থী হন। সুলতান স্বীয় ভাগ্নে সিকান্দার খানের নেতৃত্বে সিলেটে অভিযান প্রেরণ করেন। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যুদ্ধে সিকান্দার খান পরাজিত হন। বাংলার সুলতান ফিরোজ শাহ্ ব্যর্থতার খবর শুনে মর্মাহত হন। তিনি পুণরায় নাসিরুদ্দিনকে সেনাপতি করে পাঠান। বোরহান উদ্দিন ভগ্ন হৃদয়ে সিলেটে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি বুরহান উদ্দিনের মুখে সিলেটে মুসলিম নির্যাতনের করুণ কাহিনী শুনে সঙ্গীসাথী সহ জিহাদের সিদ্ধান্ত নেন। তখন তিনি সাতগাঁওয়ে ৩৬০ আওলিয়া সহ ইসলাম প্রচারে ছিলেন। সেখানে মুসলিম সেনাপতিদ্বয় তাঁর আধ্যাত্মিক সাহায্য প্রার্থী হলে তিনি তাদের জন্যে দোয়া করেন। তাদের সাথে জিহাদে সিলেটের পথে রওয়ানা হন। শাহ্জালাল’র (রহঃ) আগমনে মুসলিম সৈন্যদের মনোবল বেড়ে যায়।
বর্তমান নবীগঞ্জের চৌকি নামক স্থানে মুসলিম বাহিনী ও গৌড় গোবিন্দের সৈন্যদের যুদ্ধ শুরু হয়। গৌড় গোবিন্দের সকল যাদু বিদ্যা ব্যর্থ হয় এবং যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী বিনা বাঁধায় অগ্রসর হয়ে সিলেট শহরের উপকণ্ঠে সুরমা স্রোতস্বিনীর তীরে পৌঁছেন। সুরমা নদী পারাপারের কোন খেয়া নৌকা ছিলনা। রাজা নদীর সব নৌকা সরিয়ে ফেলে। ফলে নদী অতিক্রম অসম্ভব হয়ে পড়ে। কথিত আছে, সে সময় শাহ্জালাল (রহঃ) তাঁর হরিণের চামড়ার তৈরি জায়নামাজে বসে নদী পাড়ি দিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম সৈন্য ও তাঁর সঙ্গী গণকে এরূপ অলৌকিক ভাবে নদী অতিক্রম করতে সক্ষম হন। গৌড় গৌবিন্দ তখন রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যায়। হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) স্বীয় সঙ্গী শাহনূর (রহঃ) কে আজান দিতে বলেন। তাঁর আজানে গৌড় নগরের (বর্তমান সিলেটের সর্বোচ্চ টিলা) সাত তলা বিশিষ্ঠ প্রশাসনিক ভবন ভেঙ্গে পড়ে। মামার দেয়া মাটি সফর সঙ্গী হযরত চাষণী পীর সিলেটের মাটির সাথে পরীক্ষা করে সাদৃশ্য খুঁজে পান। তাই শাহ্জালাল (রহঃ) সিলেটে ইসলাম প্রচার ও স্থায়ী ভাবে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন। এভাবে তিনি সিলেটের জনপদে মানবতার মুক্তি ও সাম্যের বাণী নিয়ে এলেন। তিনি সঙ্গীদের সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য প্রেরণ করেন। তাঁদের আহবানে চর্তুদিকে সাড়া পড়ে যায়। দীর্ঘ দিনে অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে। এভাবে সিলেটে শান্তির বিজয় নিশান উড্ডিন হয়। তিনি সিলেটের শাসন ব্যবস্থা সঙ্গীদের হাতে ছেড়ে খোদার ইবাদতের ধ্যান মগ্ন হন।
বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্ত ‘আজাইবুল আছফারে’ বলেন, হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) জীবনের শেষ ৪০ বছর অনবরত রোজা রাখতেন এবং প্রতি দশদিন অন্তর নিজের গাভীর সামান্য দুধ পান করতেন। তিনি সমস্ত রাত্রি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন। স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁর নিকটই ইসলাম কবুল করে। তিনি অত্যন্ত কৃশ ও লম্বা ছিলেন। মুখে গোফ দাঁড়ি অল্পই ছিল। ওফাতের আগের দিন তিনি মুরিদের ডেকে বলেন, আল্লাহর হুকুমে কাল তোমাদের ছেড়ে যাব। আল্লাহর উপর ঈমান রেখো, তিনিই তোমাদের রক্ষা করবেন। পরের দিন জোহরের নামাজের শেষ সেজদায় তিনি নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রতি বছর জিলক্বদ মাসের ১৯ তারিখকে ওফাত দিবস ধরে ১৯ ও ২০ তারিখ শাহ্জালার (রহঃ) এর উরস উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে সিলেট শহরে মানুষের ঢল নামে এবং অলি-গলি লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। ওরস উপলক্ষে দরগা কর্তৃপক্ষ খতমে কুরআন, মিলাদ-জিকির ও শিরনী বিতরণের কর্মসূচী হাতে নেন। কিন্তু তাদের চোখের সামনে সংসার বিরাগীদের উদ্ভব আসর বসে। গোরস্থানের পাশ ঘেঁষে ও রাস্তা জুড়ে বসে ফকির মেলা। দরগার চারিপাশে তাঁবুর সারি ঘিরে বসে। এসবরে মধ্যে ঢোল, করতাল, মন্দিরার কানফাটা আওয়াজ ও নারী পুরুষের বেতাল নৃত্যের অভিনব আচার অনুষ্ঠিত হয়। গাজার কড়া গন্ধে মাজার এলাকার আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে যায়। তাদের মাথায় লাল পট্টি বাঁধা, দাড়ি গোফে মুখ ডাকা। কেউ উদোম শরীরে, আবার কেউ অর্ধ উলঙ্গ। কারো হাতে বিচিত্র আকৃতির বল্লম, রড, লাঠি ইত্যাদি লোকের সমাগম ঘটে।
একদিকে মসজিদের মিনার হতে আজান হচ্ছে, যে আজানে গৌড় গোবিন্দের প্রাসাদ ভেঙ্গেছিল। আজো সে আজান সিলেটের পবিত্র ভূমি থেকে ধ্বনিত হচ্ছে। কিন্তু সংসার বিরাগীদের মনে সে আজানের কোন প্রভাব পড়ছেনা। তারা উম্মাদ হয়ে লালে লাল ধ্বনি দিচ্ছে। অপরদিকে মুসল্লিরা আজানের সাথে সাথে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ছে। ওরসে নবাগত যে কেউ হাল-হকিকত দেখে হতভম্ব না হয়ে পারেনা। ওরসের এসব কর্মকান্ডে মনে প্রশ্ন জাগে শাহ্জালাল (রহঃ) সিলেটে এই ফকির মেলার মিশন নিয়ে কি এসেছিলেন? বরং তিনি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ইসলামের প্রগতিশীল জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অথচ আজ সেই কুসংস্কার তাঁর মাজারের পাশেই ঠাঁই নিয়েছে। যার শিকড় অত্যন্ত গভীরে গিয়েছে। হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা শরিয়ত সম্মত ভাবে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতেন। সংসার ত্যাগীদের মতো দাড়ি গোফে মুখ ডাকা, হতাশা গ্রস্থ ও জীবন বিমূখ ছিলেন না। তাদের মতো বিকৃত আচরণ ও কালচারে কখনো জড়িত ছিলেন না। সিলেট তিনশ’ ষাট আওলিয়ার আগমনে সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়েছিল। জনজীবনে সভ্যতার আলো ও উদ্ভাসিত হয়। সংসার বিরাগীদের আচরণ, আওলিয়াদের মিশনের সাথে কোন সাদৃশ্য নেই। মাজারে অনৈসলামিক ও অসামাজিক কার্যকলাপ কোন দৃষ্টিতেই কাম্য হতে পারে না। এসব বন্ধের পদক্ষেপ নিয়ে মাজারের পবিত্রতা রক্ষা করা প্রয়োজন।
শাহ্জালাল (রহঃ) সিলেট আগমনের উদ্দেশ্য ও মিশন আবার প্রমাণ করতে হবে। এখানে কোন অপসংস্কৃতি ও অনৈসলামিক কার্যকলাপের স্থান নেই। এ ব্যাপারে সিলেটের সচেতন নাগরিকবৃন্দ ও প্রশাসনের অগ্রনী ভূমিকা পালন করা উচিত!
©somewhere in net ltd.