![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
I like to explain the international affiars.
গত কয়েক দশক থেকে প্রতিবেশী বন্ধু প্রতিম দেশ ভারতের সাথে বাংলাদেশের অমীমাংশিত ইস্যু অনেকগুলো। যার মধ্যে রয়েছে তিস্তার পানি বন্টন সংক্রান্ত একটি চুক্তি, যে চুক্তিটি ভারত সরকার আজ অবধি বাস্তবায়ন করার মানসিকতা দেখায়নি । কিন্তু বর্তমানে দেশে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের কারণে ভারতের সাথে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কেন্দ্রিক এসব চুক্তি অনেকটাই ছায়ার অন্তরালে পড়ে গেছে। পত্র-পত্রিকা কিংবা বুদ্ধিজীবীদের কলমেও তেমন দেখা যাচ্ছে না। ফলে এই বিষয়ে আপডেট জানতে পারছে না জনগণ এবং কোন প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারছে না। আর তাছাড়াও দেশের যে সহিংস পরিস্থিতি তাতে ভারতের সাথে আমাদের তিস্তা চুক্তি কতদুর তাই বা জানার সময় কোথায়? নিজের ঘর সামাল দিতেই আমরা ব্যস্ত। এক্ষেত্রে তিস্তা চুক্তি থেকে ভারত কে নিস্কৃতি দিতে অবশ্য সরকারকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মতো বুদ্ধি খাটাতে হয়নি (যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি থেকে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে জনগণের দৃষ্টি অপসারনের জন্য শত্রু রাষ্ট্র সোভিয়েতের সাথে সল্ট-২ চুক্তি স্বাক্ষর) বরং বিরোধী দলগুলো কাজটি করে দিয়েছে। অথচ এই তিস্তা চুক্তি বাংলাদেশের জন্য কত বেশি গুরত্বপূর্ণ তা দেশপ্রেমিক নাগরিক মাত্রই অবগত। তারপরও গুরত্বটুকু আলোচনা করার প্রয়াস রাখছি।
কৃষি প্রধান বাংলাদেশে চাষাবাদের ক্ষেত্রে সেচের ভুমিকা অপরিসীম আর বাংলাদেশ নদী ভিত্তিক সেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যেখানে দেশের গড় সেচ আবাদি জমির শতকরা হার ৪২ শতাংশ সেখানে তিস্তা অববাহিকার শতকরা ৬৩ ভাগ আবাদি জমির সেচের আওতাধীন যা মূলত তিস্তা ব্যারেজকে কেন্দ্র করেই। (তিস্তা নদীর পানি প্রধানত সেচকাজেই ব্যবহারের জন্য ১৯৮৩ সালে ভারত জলপাইগুড়িতে গজডোবায় এবং বাংলাদেশ লালমনিরহাটে দোয়ানিতে তিস্তা ব্যারেজ নির্মান করে) কিন্তু তিস্তায় পানি প্রবাহ ধীরে ধীরে হ্রাস পাওয়ায় এই প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের উত্তরবঙ্গের মানুষ। এর কারণ ভারত উজানের দেশ হওয়ায় আগেই ব্যারেজ ও সেচখালের মাধ্যমে পানি সরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশর ব্যারেজটি শুস্ক মৌসুমে অকার্যকর ও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আবার বর্ষা মৌসুমে এই পানি ভারত পুরোপুরি ছেড়ে দেয়ায় বাংলাদেশে বন্যা ও নদীভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। আর এ কারণেই উত্তরাঞ্চের মানুষের দারিদ্রদশা ঘোচানোর জন্য একটি বড় শর্ত হচ্ছে তিস্তার ন্যায্য পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
১৯৭২ সালে আন্তঃসীমান্ত নদী সমূহের উন্নয়নের দিককে সামনে রেখে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে তিস্তা বিষয়ে আলোচনা হয়ে আসছে। এই সময়ের সাফল্য ছিল, ১৯৮৩ সালে যৌথ নদী কমিশনের ২৫ তম বৈঠকে তিস্তার পানি বন্টনের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত একটি এডহক চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল তিস্তার প্রবাহের জন্য ২৫ শতাংশ পানি রেখে বাকি ৭৫ শতাংশ পানি ভারত ও বাংলাদেশে মধ্যে (৩৯ঃ৩৬) অনুপাতে ভাগ করা হবে। কিন্তু এই পানি কোথায় এবং কোন পদ্ধতিতে বন্টন হবে সে বিষয়ে সমঝোতা না হওয়ায় চুক্তিটি বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তিস্তা বিষয়ে অনেক কয়েকটি বৈঠক হয়েছে কিন্তু ভারত বাংলাদেশ তিস্তার বিষয়ে একমত হতে পারে নি।
তবে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে বরাবরের মতই ভারতের সাথে সম্পর্ক উষ্ণ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালের জানুয়ারীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করলে তিস্তার পানি নিয়ে নতুস করে আলোচনা শুরু হয় এবং বলা হয় এই সফরে উভয় দেশ তিস্তা চুক্তির বিষয়ে অনেক দুর এগিয়েছে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জানালেন যে আলোচনার অগ্রগতি হলেও প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে চুক্তি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
এরপর ২০১১ সালের সেপ্টেমবরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সিং বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে তখন তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের সব রকমের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও খুব আশাবাদী ছিলেন যে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হবে। কিন্তু মমতার জোরালো বিরোধিতার কারণে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে তিস্তা চুক্তি আটকে যায়। মমতা প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশ সফরে আসেনি। আর তিনি ছাড়া এই চুক্তি করাও সম্ভব নয়। মমতার অভিযোগ ছিল, ভারত সরকার চুক্তির জন্য যে খসড়া তৈরি করেছিল তা তাকে দেখানো হয়নি। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার যে ফর্মুলা তৈরী করেছে তাতে তার রাজ্যের স্বার্থ হানি হচ্ছে। পরে অবশ্য ভারতের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া (মমতার মতে) হলো যে তিস্তার যে পানি থাকবে তার ৭৫ শতাংশ ভারত নেবে ২৫ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে। সফরে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের গণমাধ্যমেও ব্যাপক সমালোচনা হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু তাতে লাভ কি আবারো পরের সফরের উপর ভরসা।
কিছুদিন পরের গল্প চলতি বছরের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন এবং বিভিন্ন মহল থেকে বলা হলো তার সফরটি বিভিন্ন কারণে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। অবশ্য সালমান খুরসিদের সফরের কয়েকদিন আগেই ভারতের পরারাষ্ট্র সচীব রঞ্জন মাথাই বাংলাদেশে এসে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তিস্তার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সালমান খুরসিদ অনেক বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং যাওয়ার সময়ে তিস্তা নদীর পানির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে সম্ভাব্য চুক্তির বিষয়ে তিনি ‘আশ্বাসই’ দিয়ে গিয়েছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ তখনও বলা হলো যে ভারতের পশ্চিমবাংলা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সম্মতি ছাড়া এই চুক্তিতে উপনীত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। অবশ্য তিনি আরো একটি বিষয়ে বাংলাদেশকে আশান্বিত করে গেছেন যে, ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিটি শিগগির ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদন দেবে বলে আশা করছে ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার। এ ব্যাপারে ভারতের মন্ত্রিসভা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে পার্লামেন্টে এই চুক্তির অনুমোদনের জন্য বিরোধীদলগুলোর সমর্থন প্রয়োজন হবে। বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দলের সমর্থন অপরিহার্য।
এরপর চলতি বছরের ২-৩ মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের বাঙ্গালী প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি। তখনও ধারণা করা হয়েছিল যে, প্রণব মুখার্জির এই ঢাকা সফরে বাংলাদেশের সরকার ভারতের সাথে বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ ইস্যু ও অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করবে। বিশেষ করে তিস্তার পানি বন্টন সংক্রান্ত চুক্তি নিয়ে। কেননা এই চুক্তি দীর্ঘদিন থেকে ঝুলে রয়েছে। অবশেষে তিনিও প্রতিশ্রুতিটিই দিয়ে গেলেন যে খুব দ্রুত তিস্তা চুক্তি হবে। বাস্তবতা হলো শুধু উচ্চ পর্যায়ের অনেকগুলো সফরেই হলো কিন্তু তিস্তা চুক্তি হলো না কারণ এই চুক্তির মাঝে বড় ফ্যাক্টর মমতা ব্যানার্জি।
এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকার কোন জোড় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আর তাছাড়াও বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়েছে তাই সামাল দিতেই সরকার ব্যস্ত। এছাড়াও ভারতকে কূটনেতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেও রাজি করানোর মতো আমাদের দক্ষতা নেই। এছাড়াও এ পর্যন্ত যারা তিস্তা চুক্তির বিষয়ে পানি সম্পদ বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিলেন তাদেরও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এদিকে ভারতের সাথে বন্ধুত্বের এতো ঢাকঢোল পেটানোর পর জানানো হলো বাংলাদেশ ২৫ শতাংশ পানি পাবে। যা কোন ভাবেই বাংলাদেশের পক্ষে রাজি হওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে ভারতের এই চুক্তি না করলেও কোন সমস্যা নেই। কারণ ভারত উজানের দেশ তিস্তার পানি ব্যবহারের জন্য ভাটির দেশের (বাংলাদেশ) সাথে কোন চুক্তির অপেক্ষা করতে হয় না।
তবে এরই মাঝে ভারত আবারো আশান্বিত করেছে বাংলাদেশকে তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে। ১৮ এপ্রিল দৈনিক সমকালের সংখ্যায় ‘তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের নতুন উদ্যোগ’ শিরোনামে একটি খবর ছাপা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এ লক্ষ্যে মনমোহন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ ও রঞ্জন মাথাইয়ের সাথে বৈঠক করেছেন। খুব শিগগিরই সালমান খুরসিদ পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মমতার সাথে আলোচনা করবেন। কেননা কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এছাড়া ভারতের চলতি বাজেট অধিবেশনে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করার জন্য সংবিধান সংশোধনী বিল পেশ করবে। আর বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ সরকার এটা বাংলাদেশকে জানাবেন।
কিন্তু এটা শুনে আবারো তৃপ্তির ঢোক গেলার কিছু নেই। কারণ এ পর্যন্ত অনেক উচ্চ পর্যায়ের সফরে এর চেয়ে কয়েকগুনে বেশি প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। বলা হয় ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু রাষ্ট্র। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে বহুদিনের পুরনো সীমান্ত চুক্তি এখনও কার্যকর করছে না ভারত, বলা হচ্ছে যে চলতি অধিবেশনে এটা পেশ করা হবে। অথচ সেখ হাসিনার সফরের পর থেকে এই কথা বলা হচ্ছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যে রয়েছে বিশাল ঘাটতি, অশুল্ক বাধার শেষ নেই। শুল্ক ছাড় দেয়া বাংলাদেশি পণ্য ঢুকতে পারছে না অনেক ক্ষেত্রেই। যে ঋণ দেয়া হচ্ছে তাও অনেক উচ্চ সুদে। ট্রানশিপমেন্ট নেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ ভারত বাংলাদেশকে যতটুকু সুবিধা দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি সুবিধা আদায় করছে। আবার বলা হচ্ছে যে, তিস্তা চুক্তি এ বছর হলেও পানি বন্টনের বিষয়টি উহ্য থাকবে। প্রকাশ করা হবে না। যদি বাংলাদেশ এতে রাজি হয় তবে বাংলাদেশের জন্য এটি হবে চরম ভুল। এর উপর চলতি বছরেই শেখ হাসিনার ভারত সফরের কথা রয়েছে। কিন্তু তিস্তার বিষয়ে একটি কার্যকরী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত তার সফর করা কতটুকু যৌক্তিক সেটাই দেখার বিষয়।
যদি তিনি আবারো ভারত সফরে যান আর তিস্তা চুক্তি না হয় তবে বাংলাদেশকে বুঝতে হবে যে, তিস্তা চুক্তি নির্ভর করছে ভারতের ইচ্ছার উপর। অর্থাৎ আমাদের নির্ভর করতে হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের দয়ার উপর। ফলে বিষয়টি এরকম হয়ে দাড়াবে যে, রাজনৈতিক কাটাতারের ফাদেঁ পড়ে সীমান্তের ঐপারে গজলডোবায় কৃষানীর ঘর ধানে ভরে যাবে আর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাকবলিত মানুষ নিজের যেটুকু আছে তা চাষাবাদ করতে না পেরে এক মুঠো ভাতের আশায় ঘুরবে দুয়ারে দুয়ারে ।
রাশিদুল ইসলাম নাহিদ
শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাবি
©somewhere in net ltd.