নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মন যোগাতে নয় মন জাগাতে

নকিব হাসান আবিদ

কষ্ট পাওয়া খুব সহজ বরং সুখে থাকাটাই অনেক কঠিন

নকিব হাসান আবিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মোনা লিসা

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:১৩

প্রচন্ড বাতাসের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে সিগারেট ধরানো সহজ কাজ না, বাতাসের মধ্যেও দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর মধ্যে একটা আর্ট আছে, কৌশলটা রপ্ত করতে হয়। আমি নিজেও একটা সময় পর্যন্ত বাতাসে কাঠি জ্বালাতে পারতাম না, রিকশায় বসা অবস্থায় সামান্য বাতাসে আনাড়ি হাতে একের পর এক কাঠি নষ্ট করতাম, এরপর একদিন বন্ধু রাজন সেই আর্ট শিখিয়ে দিলো। আর কখনও ভুল হয় নি এককাঠিতে সিগারেট ধরানোয়, এই যেমন এখন চট করে সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম লঞ্চের সামনের দিকে ডেকে দাঁড়িয়ে। আয়েশ করে সিগারেট টান দিতে হবে, অনেকক্ষণ সিগারেট খাইও নি। কারণ লঞ্চে যাত্রী অনেক বেশি, যেখানে বসা ছিলাম সেখান থেকে একবার উঠে গেলে সেখানে গিয়ে পরে আবার জায়গা পাওয়া যাবে না। সিগারেটে টান দিয়ে বাতাসের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেই অন্যরকম অনুভূতি ভর করল আমার মাঝে। শেষ কবে লঞ্চে উঠেছিলাম? বছর আটেক আগে, বরিশাল যাওয়ার পথে। এই লঞ্চটাও বরিশাল যাবে তবে আমি বরিশাল যাচ্ছি না, চাঁদপুরে যাচ্ছি, লঞ্চটা চাঁদপুরেও থামবে। সদরঘাটে চাঁদপুরের লঞ্চ বলতে শুধু এই একটাই ছিল, বাদবাকী সবকয়টা বরিশালের। স্বাভাবিকভাবেই লঞ্চে যাত্রী বেশি, আজ যেন একটু বেশিই অন্যদিনের তুলনায় কিংবা এখন হয়ত অনেক লোকই লঞ্চে উঠে। এখন খুব ইচ্ছে করছে লঞ্চের নিচতলায় একেবারে সামনে পানির কাছাকাছি কোন একটা জায়গায় ঘুমাতে, ঐ জায়গায় সাধারণত লোক থাকে না। প্রথমবার যখন বরিশালে যাই তখন ঠিক ঐ জায়গায় পত্রিকা বিছিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম, ঠান্ডা বাতাসে কিছুক্ষণ পরই শীত ধরে গিয়েছিলো, তবুও উঠিনি, গুটলি পাকিয়ে শুয়ে ছিলাম বাতাস ভালো লাগছিল বলে।













হাতের সিগারেট জোরে টোকা মেরে পানিতে ফেলে পরবর্তী সিগারেট যখন ধরাতে যাব তখন খেয়াল করলাম আমার পাশে একজন লোক এসে দাঁড়িয়েছে। বয়স কত আর হবে? ত্রিশের আশেপাশে, আমার চেয়ে বছর চারেকের ছোট হতে পারে। সুন্দর চেহারা, ফর্সা, লম্বা এবং কাপড়চোপড়ে দেখলে মনে হয় বড়লোক ঘরের ছেলে কিংবা বিশাল অংকের টাকা রোজগার করা কোন কর্পোরেট অফিসার যে কিনা ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে। আমি তার দিকে তাকাতেই লোকটি বলল,'অনেকক্ষণ ধরে দূরে দাঁড়িয়ে থেকে আপনাকে দেখছিলাম, খুব তৃপ্তি সহকার সিগারেট ফুঁকছিলেন। একটা মানুষ এতটা তৃপ্তি সহকারে সিগারেট টানতে পারে ভেবে অবাক হচ্ছিলাম।'









আমি বিনিময়ে একটা হাসি ফিরিয়ে দিলাম, সে বলতেই আছে, 'আমাকে একটা সিগারেট দিবেন, আমি অবশ্য সিগারেট খাই না, একসময় খেতাম যখন খুব পড়াশুনার চাপ ছিল তারপর ছেড়ে দিয়েছি।'









আমি প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দিয়ে তাকে বললাম, 'সিগারেট ছাড়তে কে বলেছিলো! জীবনে অনেক ভালো একটা সঙ্গীকে ছেড়ে এসেছেন।'









'আসলে সিগারেট খাওয়াটা লিসা মানে আমার স্ত্রী পছন্দ করে না, তার সাথে বিয়ের আগে থেকেই পরিচয় ছিল তাই বাদ দিয়ে দিয়েছি তাকে খুশি রাখার জন্যে। সিগারেট টেনে কিইবা হবে যদি সে পাশে থাকে।'









আমি কিঞ্চিত হাসলাম, 'হুম' বলে অন্যদিকে তাকিয়ে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিলাম, ফুসফুসে আটকে রাখার চেষ্টা বিষাক্ত ধোঁয়াকে। মনে পড়ল কিছু পুরোনো কথা, মোনার সাথে পরিচয়ের পরই সে আমাকে সিগারেট ছাড়তে বলেছিল। আমি তখন বলেছিলাম, 'যদি কেউ আমার প্রতিটা সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছার মূহুর্তে একটা করে চুমু খায় বিনিময়ে তবে আমি সিগারেট ছেড়ে দিব।'









সে বলেছিল, 'আমি খাব।'









আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'ক্ষুধা লেগেছে? কী খাবে?'









'উহু চুমু খাব।'









আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেন? কেন খাবে?'









'একজন বন্ধুর জীবনকে সুন্দর করার জন্যে, তাকে ভালো করার জন্যে।'









'কোন বান্ধবী কি তার বন্ধুর ঠোঁটে এমনিই চুমু খায়?'









সে চুপ হয়ে গিয়েছিল, তখন আর বলার মতো কোন কথা খুঁজে পায় নি। আমি আর মোনা বন্ধু ছিলাম, মুঠোফোনের ভুল নম্বর থেকে পরিচয়, সে আমার বয়সে চারপাঁচ বছরের ছোট ছিল, এমনিতে ভাইয়া ভাইয়া ডাকত কিন্তু একটা সময় পর খেয়াল করে দেখতে পেলাম সে আমাকে আর ভাইয়া ডাকছে না।













হঠাত্‍ সমবিত্‍ ফিরল সেই লোকটার কথায়, 'কী ব্যাপার ভাই? মাইন্ড করলেন নাকি? অচেনা একটা লোক হয়ে সেধে সিগারেট চেয়েছি বলে?'









'আরে না, না। এমনি অন্য একটা কথা মনে পড়ল হঠাত্‍ তাইই ভাবছিলাম।'









'ওহ, বিরক্ত করে থাকলে দুঃখিত।'









'আরে না, বলুন কথা, এমনিতে একা একা বিরক্তি বোধ করছিলাম।'









'আপনি কোথায় যাচ্ছেন? বরিশাল?'









'নাহ, চাঁদপুরে, আপনি?'









'আমি? বরিশালে, স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুড়বাড়িতে।'





















আমি একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, বরিশাল আমারও শ্বশুড়বাড়ি হতে পারত, মোনাদের বাড়ি ছিল বরিশালে। হলো না, কপালে ছিল না, আসলেই কি কপালের দোষ ছিল? না অন্যকিছুর দোষ? আমারও দোষ ছিল, প্রচণ্ড বদরাগী ছিলাম এক সময়, একজন নিম্ন আয়ের মানুষ বলে অভাবের সাথে যুদ্ধ করতে করতে মেজাজ খিচড়ে থাকত। মোনারা অনেক বড়লোক ছিল আমাদের চেয়ে, বরিশাল শহরে তখনই একটা দোতলা বাড়ি ছিল। তার এক চাচা আমেরিকা থাকতেন, বেশ অবস্থাসম্পন্ন তার পরিবার। আর আমরা? আমিই একমাত্র উপার্জনকারী বৃদ্ধ বাবা মায়ের সংসারে। নিজেকে দোষ দেওয়াটা হলো আমার সান্তনা খোঁজা, অপরাধী মনে হয় নিজেকে, তাকে তো অপরাধী বানানো যায় না। তবে একটা সময় তাকেই আমি অপরাধী ভাবতাম, সেদিন কার্জন হলের সামনের সেই ঘাসটায়, সে বলেছিল, 'দেখো শফিক, বাসায় তোমার কথা বলেছি কিন্তু তারা মেনে নিচ্ছে না। আমি আমার সব চেষ্টা করেছি।'









আমি বলেছি, 'মোনা, তুমি না যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমার সাথে থাকতে চাও?'









'আমি তোমাকে অনেক আগেই বলেছি, আমি কখনও আমার বাবা মায়ের কথা ফেলতে পারব না, বাবা মাকে তোমার কথা বলব যদি তারা রাজি না হয় তবে আমার কিছুই করার নেই। এত বছর ধরে যে বাবা মা আমাকে লালন পালন করে বড় করেছে তাদেরকে কোন দোষে পেটে লাত্থি মেরে আমি তোমার সাথে পালিয়ে যাব?'









'মোনা, আমি কী দোষ করেছি যে এখন তুমি আমার পেটে লাত্থি মেরে চলে যাচ্ছো? তোমাকে ভালবাসা আমার দোষ ছিল? অপরাধ ছিল? তুমি তো আমার সবকিছু জেনেই তো এসেছিলে, তখন তো বলেছিলে কোন সমস্যা হবে না। আমি তো বলিনি, আসো মোনা, প্রেম করি! নিজের ইচ্ছেয় এসেছো এখন নিজেই পেটে লাত্থি দিয়ে চলে যাচ্ছো!'









মোনা উচুগলায় বলেছিল, 'শফিক সবকিছুর আগে বাবা মা। আর তোমার মতো বদরাগীর সাথে সারাজীবন থাকা যায় না, আমি পারবো না সারাজীবন তোমার গালি খেয়ে থাকতে।'









'হ্যাঁ হ্যাঁ সবকিছুর আগেই বাবা মা, তোমার পড়ালেখা, ক্যারিয়ার, চাকরি সবকিছুই আগে শুধু আমিই সবকিছুর পিছনে। আমি কোন গুরুত্বই পেলাম না।'







'তোমাকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছি আমি, তোমার কথা মতো নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করেছি, আমি আগে রান্নাবান্না করতাম না, কোনদিন করবো যে তাও ভাবি নাই আর এখন আমি প্রায়ই নিজে রাঁধি বাসায়।'







'সামান্য এই পরিবর্তন তোমার নিজের জন্যেই, তুমি আমি ছাড়া যে কাউকেই বিয়ে করো না কেন নিজের সংসার নিজেরই চালাতে হবে।'



কথায় কথায় অনেক ঝগড়া হয়েছিলো সেদিন, মোনা সেদিন রেগে চলে গিয়েছিলো, আমি তার চলার পথে দৃষ্টি রেখে অতীতের ভুল অনুধাবন করতে পেরেছিলাম।













''আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি, ভুল করেছি





নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে পাঁচ দুপুরের নির্জনতা





খুন করেছি, কী আসে যায়?









এক জীবনে কতোটা আর নষ্ট হবে





এক মানবী কতোটা আর কষ্ট দেবে''





(হেলাল হাফিজ)

















লোকটি একটু জোরেই ডাক দিলো, 'এই যে ভাই' আমি ফিরে তাকালাম তার দিকে। আরেকটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, হাতের সিগারেট প্রায় নিভে যাচ্ছে, ছাই অনেক লম্বা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ টান না দেওয়ায়।









'কী হয়েছে ভাই? শরীর খারাপ?'









'নাহ ঠিক আছি, অনেকদিন পর লঞ্চে উঠলাম তো তাই একটু খারাপ লাগছে। আপনার কথা বলেন, শুনছি।'









'আমার কথা কিইবা বলব, সিগারেট শেষ, আরেকটা দেন' মুচকি হেসে বলল।









আরেকটা সিগারেট বের করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কী করেন আপনি?' সৌজন্যতা মূলক প্রশ্ন।









'ইঞ্জিনিয়ার, চট্টগ্রামে শিপ ইয়ার্ডে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, বাড়ি চট্টগ্রাম, থাকিও, সার্সন রোডে বাসা। আপনি?'









'থাকি ঢাকায়, বাড়ি নেত্রকোণার কেন্দুয়ায়, একটা প্রাইভেট কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার। বুয়েটে পড়ালেখা?'









'হুম। তিন বছর আগে এমএসসি করে তারপর বিয়ে করলাম।'









'প্রেমের বিয়ে?'









স্বলাজ হেসে উত্তর দিলো, 'হুম, লিসার সাথে বুয়েটেই পরিচয়, সেখানকার ছাত্রী ছিল, আমার ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র। প্রেম বলতেও আসলে কিছু ছিল না, আবার প্রেমও বলতে পারেন।'









'কী রকম?'









'আমি তাকে প্রথম দেখা থেকেই ভালবেসে ফেলি, অনেক খোঁজখবর নিয়ে তার সাথে পরিচয় হই, একসময় ঘনিষ্ঠতা বাড়ে কিন্তু তাকে কখনও বলি নি যদি সুন্দর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়। ও প্রায়ই আসত আমার কাছে পড়াশুনার দরকারে, একসাথে অনেক ঘুরাঘুরি হত। পাস করার পর বিয়ে করার জন্যে উঠেপড়ে লাগি, তার পরিবারে প্রস্তাব পাঠাই, তারা রাজি হয়ে যায়।'









'বাহ ভালো তো। সবার কপালে কিন্তু প্রেমের বিয়ে লেখা থাকে না, প্রেম হতে পারে কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না কারন দিল্লী বহুত দূর।'









একটু দম নিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে তাকে দিতে চাইলাম, সে না করল, 'নাহ লিসা এমনিতে টের পেয়ে যাবে, পরে রাগ করবে।'









মুচকী হেসে জিজ্ঞেস করলাম, 'অনেক ভালোবাসেন তাকে?'









'হুম, তা আর বলতে হয়!' বলে হেসে দিলো। লোকটা মনে ব্যস্ততার চাপে কারো সাথে তেমন মন খুলে কথা বলতে পারে না, তাই আজ আচমকা সুযোগ পেয়ে অপরিচিত একজনের সাথে অনেক কথাই বলে ফেলছে।





















আমি খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেলাম আবার, বুয়েট! বুয়েটটাই হয়ত অনেক ঝামেলার মূলে ছিলো, বুয়েটের কারনেই তার আর আমার মাঝে ব্যবধান বাড়তে থাকে। ঢাকা এসে বুয়েটে চান্স পেয়ে ভর্তি হওয়ার পরই মোনার সাথে ঝগড়ার পরিমান আমার বাড়তে থাকে। আমি পছন্দ করতাম না তার অনেক ছেলেদের সাথে আড্ডা, আমি রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে, তার পাশাপাশি যে কেউ বেশি থাকলেই আমার খুব হিংসা হত, কষ্ট পেতাম। সে অধিক সুন্দরী, বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দরী তাই তার আশেপাশে গুণগ্রাহী চাটুকারের অভাব হত না। আমি তাকে আমার মতো করে চলার জন্যে বলতাম, আমাকে যেন জিজ্ঞেস করে কোন কিছু করতে বলতাম যেহেতু সে বয়সে অনেক ছোট এবং ঢাকা শহরে নতুন, সে আমার কথামতো তেমন একটা চলত না। তার সাথে এসব নিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়া হত, তার কথা, 'শফিক তুমি আমার স্বাধীনতায় হাত দিচ্ছো, আমার বন্ধুবান্ধবে তোমার সমস্যা, আমার পোষাকে আষাকে তোমার সমস্যা, আমার ইচ্ছের কি দাম নেই?'









আমি তাকে বলতাম, 'মোনা, আমার ইচ্ছের কি দাম নেই? আমি নিশ্চয়ই আমার হবু বউকে আর চৌদ্দটা ছেলের সাথে অবাধে ঘুরোঘুরি মেনে নিতে পারি না, আমার পরিবারের বউকে অবশ্যই শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরতে হবে। আমার কথা শুনতে হবে। আমার ইচ্ছার দাম কই?'













ঝগড়া বাঁধতই, তার আর আমার পছন্দ-অপছন্দ, স্বভাব এমন কি রোমান্টিকতাও পুরোপুরি উল্টো ছিল। সে অনেকটা যান্ত্রিক রোবোটিক রকমের মেয়ে ছিল, আবেগ প্রকাশ করত না, কিন্তু আমি আবেগ প্রকাশ না করে পারতাম না। একটা সময় সে বলত, আমি তার কোন কথাই শুনি না, সিগারেট ছাড়তে বলেছিল তাও ছাড়ি নি, সিগারেটকে নাকি বেশি ভালবাসি, সম্পর্কের নাকি গুরুত্ব আমার কাছে নেই, আমি বেকার ঘুরোঘুরি করি, একটা চাকরি নেই না, চাকরি না করে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে তার বাবা মায়ের সামনে আমাকে নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তার এসব কথার পর অনেক চেষ্টার পর আমি চাকরি নিলাম, একটা ছোট্ট কোম্পানির ফিল্ড মার্কেটিং অফিসার হিসেবে। তীব্র রোদে গরমের মাঝে হন্য হয়ে ঘুরোঘুরি করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দোকানে দোকানে পণ্য বিক্রি ও মার্কেটিং করতাম। অল্প বেতন, যা দিয়ে আমারই চলত, পড়ালেখা বেশিদূর করতে পারি নি অভাবের কারনে, তাই ভালো চাকরি আর পাওয়া গেল না। আমি তার কথামতো অনেক কিছু করার পরও যখন তাকে বলতাম, 'কই? আমি তো তোমার কথা শুনলাম, আমার কথা কই শুনো?'









সে রাগ দেখাত, 'তোমার কথায় কি আমার উঠতে বসতে হবে? তোমাকে আর ঐ চাকরি করতে হবে না যেটার জন্যে আমার প্রায়ই খোঁটা শুনতে হয়!'









আমার কথায় উঠা বসার কথা তাকে কখনও বলি নি, শুধু ইচ্ছের দাম দিতে এবং আমাকে গুরুত্ব দিতে বলেছিলাম। তার কাছে স্বামীর কথামতো চলার চেয়ে মরে যাওয়া উত্তম!!









আমার খুব কষ্ট লাগত তার ব্যবহারে, রাগারাগি করতাম অনেক, রাগলে আমার মাথায় রক্ত এখনও চড়ে যায়, মাঝেমাঝে গালাগালি করতাম, সে কাঁদত, 'সারাজীবন আমাকে তোমার গালি খেয়েই যেতে হবে, তাই না?'

















আমি খুব ছোট্ট বেলা থেকে যেমন মেয়ে আশা করতাম তার মধ্যে এর ছিঁটেফোঁটাও ছিল না, তবুও কেন জানি না তাকে অনেক ভালোবেসে ফেলি, অনেক। তার দেয়া কষ্ট, তাকে দেয়া কষ্টের পর আমি নিজে কষ্ট পেতাম, কষ্ট সহ্য করতে নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়লাম আস্তে আস্তে, তাকে জানালামও কিন্তু তার তেমন কোন বিকার দেখলাম না, আমার আরও খারাপ লাগতে শুরু করল, নেশার মাত্রা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি করে দিলাম। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় একটা কবিতা প্রায়ই আওড়াতাম,









''আমি সুনীলের নীরার মতো কেউ একজনকে চেয়েছিলাম,





হায় আফসোস! নীরারা উপন্যাসের পাতা থেকে





উঠে আসে না, কবিতার সাথে ছন্দের মতো লেপ্টে থাকে।





আমারও আর পাওয়া হয় না সুনীলের নীরার মতো





একজন চিরপ্রেমিকা, দুর্ভাগ্য আসলে এখানেও পিছু ছাড়ে না।





নীরার অপেক্ষায় থেকে থেকে কত বেলা অযথাই কেটে গেছে,





কত রূপসীর চোখের দিকে তাকিয়ে নীরাকে খুঁজেছি,





নাহ! নীরা কোথাও নেই, সুনীলের তরে বিলীন হয়ে গেছে।





আমার জন্যে কোন নীরা নেই,





তবুও নীরার পদধ্বনি শোনার অপেক্ষায় দরজায়





দাঁড়িয়ে থাকি রোজ বিকেলে।''





(আকিব আরিয়ান)



















বুয়েট পাসকৃত একটা মেয়ের সাথে যোগ্যতায় কখনও একটা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাসকৃত ছেলে এক হতে পারে না, আমিও তার সাথে যোগ্যতায় এক হতে পারলাম না। সে চাকরি পেয়ে চলে গেলে আরও ধরাছোঁয়ার বাইরে। মোনা চলে যাওয়ার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম, তীব্র জ্বরের ঘোরে তাকে ডাকতাম, 'মোনা, মোনা, কী করো সোনা?' জ্বরের কাঁপুনিতে কবিতার মতো প্রলাপ বকতাম,









''আমি তোমার জন্যে পথপ্রান্তে অশ্বত্থের মতো





দাঁড়িয়ে থাকবো-





ঐ বৃক্ষ অনন্তকাল ধ’রে যোগ্য পথিকের





জন্যে প্রতীক্ষমান,





আমাকে তুমি প্রতীক্ষা করতে বোলো





আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবো অনড় বিশ্বাসে,





দাঁড়িয়ে থাকতে-থাকতে





আমার পায়ে শিকড় গজাবে...









আমার প্রতীক্ষা তবু ফুরোবে না...''



(রফিক আজাদ)











একটা সময় সে আমাকে অনেক ভালবাসত, আমি নিজেও বুঝতাম। প্রথম দিকে একদিন প্রচন্ড হতাশা থেকে তাকে বলেছিলাম, 'মোনা, আমাকে ক্ষমা করে দিও, আমাকে ভুলে যাও, আমি কখনওই কিছু করতে পারব না, তোমাকে আমার করে নিতে পারব না, ভবিষ্যতে বেশি কষ্ট পাওয়ার চেয়ে এখন সরে গেলে কম কষ্ট পাওয়া যাবে।'









মোনা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, 'কী চাই তোমার? বলো? কত টাকা লাগে, যা লাগে আমি দেব। প্লীজ আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো না।'









আমি তখন মৃদু হেসেছিলাম তার টাকা দিয়ে ভালবাসা কেনার ইচ্ছে শুনে। মনে হয়েছিল টাকা দিয়ে ভালবাসা কেনা যায় না কিন্তু নাহ, এখন জানি ঐদিন আমার যদি অনেক টাকা থাকত তবে হয় আমার ভালবাসাকে ঠিকই কাছে পেতাম।









মানিব্যাগে রাখা তার দেয়া চিঠি বারবার পড়তাম, চিঠিতে কয়েকটা লাইন এরকম ছিল,









'তোমাকে আমি অনেক বেশি বেশি ভালবাসি। আমি জানি আমি তোমাকে বুঝাতে পারি না। তুমি হয়তো আরো ভালবাসা চাও; যেটা সবসময় আমি তোমাকে দিতে পারি না। তার জন্যে আমি দুঃখিত।









আমি চাই, কিন্তু কেনো জানি পারি না। আমি সত্যি তোমাকে খুব ভালবাসি সোনা।'













তারপর একদিন সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তাকে একটা চিরকুটে লিখে পাঠালাম,









''যদি কোনদিন মনে হয় আমাকে ভালবাসা তোর খুব উচিত ছিল তবে সেদিন একদম কাঁদিস না। তুই কাঁদলে যে আমি ভালো থাকি না।''



(কৃষ্ণ কুমার গুপ্ত)











চোখ বেয়ে কখন যে টুপটুপ করে পানি পড়ছে টেরই পেলাম না, হাত দিয়ে মুছতে গিয়ে দেখি পাশের সেই লোকটি দূরে গিয়ে মুঠোফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। আমি দ্রুত আত্নসংবরণ করে নিলাম, এবং গলা খাঁকারি দিয়ে তার দৃষ্টি আর্কষণের চেষ্টা করলাম, তাকিয়ে ছোট্ট একটা ইশারা দিলো; যার মানে, 'আসছি।'









কাছে আসার পর সেই কথা বলা শুরু করল, 'নাহ আমার স্ত্রী ফোন দিয়েছিলো, অনেকক্ষণ ধরে আমি লাপাত্তা তো তাই, আমি বলে দিয়েছি এখানে চলে আসতে। কেবিনে আমি ছাড়া একা বসে থেকে থেকে বিরক্ত হচ্ছে নাকি।'









'ও আচ্ছা।'









'আপনার কী হয়েছিল? আবার চুপ হয়ে গিয়েছিলেন যে?'









'নাহ কিছু না, আজকে এত ভীড়ের মধ্যে কেবিন পেলেন কিভাবে?'









'আরে মস্ত হাঙ্গামা করে কেবিন জোগাড় করেছি, সরাসরি বরিশালের লঞ্চে এসি কেবিন সব বুকড তাই বাধ্য হয়ে এটাতে উঠেছি।'









আমার মুখ দিয়ে অস্ফুট একটা 'ওহ' স্বর বের হলো। আজ বড্ড অন্যমনস্ক আমি, লঞ্চে হয়ত আর কোনদিন চড়া হত না শেষবার মোনার সাথে দেখা করে বরিশাল থেকে ফেরার পর। মোনাকে সেদিন হাত ধরে একটা কথা বলেছিলাম,'আমাকে কোনদিন ছেড়ে যাবে না তো? কথা দাও।'









'আমি কি বলেছি ছেড়ে যাব? যাব না তো।'









আমার চোখে পানি দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, 'আরে কাঁদার কি হয়েছে!'









'আবার কবে দেখা হবে তা ভেবেই খারাপ লাগছে।'









ঐ ছিল শেষ বরিশালে গিয়ে তার সাথে দেখা করা, ঢাকায় অবশ্য অনেক বারই দেখা হয়েছে আর শেষ দেখা বছর ছয়েক আগে কার্জন হলের ঘাসে।





















সিগারেট আবার ধরাতে গিয়ে আমি কানের কাছাকাছি এলাকায় একটা ডাক শুনলাম, "তমাল"; আমার পাশের সেই লোককে কেউ ডাকছে হয়তো; আমি সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে সিগারেটের আগুনে ছ্যাঁক খেলাম, ভূত দেখলেও হয়ত এতটা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকতাম না, হতবাক হতাম না। আজ ক'বছর? ছ'বছর মোনাকে দেখি না, বছর আটেক আগে প্রথম দেখা রূপাতলীতে, ভিড়ের মধ্যে রিকশার পাশে দাঁড়ানো চশমায় ঢাকা দুটো চোখ আমাকে এদিক ওদিক খুঁজে বেরুচ্ছে। প্রথম দেখেই আমি আবারও তার প্রেমে পড়লাম, নিজেকে বেশ বেমানান মনে হলো তার কাছে, এত সুন্দরী একটা মেয়ে আমাকে ভালবাসে! বেশ অবাক লাগছিল সেদিন। দুজনে রিকশায় চেপে কীর্তনখোলার তীরে গিয়ে বসি দপদপিয়ায়। ঘাস কচুপাতায় ঘেরা জায়গায় বৃষ্টির পানিতে ভরা, সে খালি পায়ে পানিতে হাঁটছে আর আমার সাথে কথা বলছে, আমি তাকিয়ে শুধু তাকে দেখছি, কথাগুলো কানকে স্পর্শ করতে পারছিল না মুগ্ধতায়।









লোকটি আমার দৃষ্টি আর্কষণ করে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো, 'আমার স্ত্রী মোনালিসা, আমি লিসা ডাকি ছোট্ট করে, মোনা ডাকতে চেয়েছিলাম তার নাকি ঐ নাম পছন্দ না সবাই ডাকত বলে।'









আমি আবার হারিয়ে গেলাম গহীনে, কোথাও, অজানায়, যেখানে কলকল করে পানির আওয়াজ হচ্ছে আর আমি চোখ বন্ধ করে হিমশীতল হাওয়া খাচ্ছি গুটলি পাকিয়ে, প্রথম দেখা করতে যাওয়ার সময়ের মতো। আমি তার মোনালিসা নামটা ছোট্ট করে আদুরে গলায় মোনা ডাকতাম, আমার ডাকটা তার নাকি ভালো লাগত অনেক, এখন বোধহয় লাগে না।









ছয় বছরে সে বদলে গেছে অনেক, আগের কালো ফ্রেমের চশমার জায়গা সে হাল ফ্যাশনের ফ্রেমের চশমা লাগানো, বেশ কেতাদুরস্ত কাপড় চোপড়, শর্ট ফতুয়া আর জিন্স, একেবারেই আধুনিক; একেবারে বদলে গেছে সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে আমার দিকে, হয়ত স্বপ্নেও ভাবে নি আমার সাথে তার এমনি করে দেখা হয়ে যাবে কোন একজায়গায়। আমিও ভাবি নি, তাকে বলেছিলাম পথের বাঁকে হয়ত দেখা হবে কিন্তু এমনি করে দেখা হবে জানা ছিল না।









''তোর কাছ থেকে মুঠোভরা ভালোবাসা নিয়ে

দৌড়ে এসে দরজা বন্ধ করে

মুঠি খুলে দেখি ভালোবাসা নাই

আঙ্গুলের ফাঁক গলে মিলিয়ে গেছে সব;

ফাল্গুনের রোদে শুকাতে দেয়া ভালোবাসারাও

উবে যায় কর্পূরের মত,

বেঁয়ে পরে দু’হাতে

ভালোবাসা ধরা যায় না, ভালোবাসা ধরা যায় না।''



(রিক ভাইয়ের কবিতা)











লোকটা এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিত রাগত স্বরে বলল, 'কী ব্যাপার ভাই? আপনি মানুষটা বড্ড অন্যমনষ্ক!'

'দুঃখিত ভাই, আমার শরীরটা হঠাত্‍ করে খারাপ লাগছে খুব।'

'ব্যাপার না।'













আমি ঘুরে গিয়ে ডেকের রেলিংয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পানি দেখতে লাগলাম, সিগারেট আগেই নিভে গেছে। বুকের ভিতর এক রকম জ্বালা করছে, মনে হচ্ছে কেউ আমার বুক কেটে কলিজা ফুসফুস হৃদপিন্ডে মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে। আমাকে দেয়া কথা মোনা রাখে নি, আজ সে মোনা নয় লিসা হয়ে গেছে। কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখে নি।









এক জীবনের সব হাহাকার বুকে নিয়ে অভিশাপ

তোমাকে দিলাম,

তুমি সুখী হবে, ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে, দেখে নিও, খুব

সুখী হবে।





(হেলাল হাফিজ)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.