নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

\"দুইশো চার\"

নাভিদ ফারাবী

বাংলা ভাষার অক্ষরগুলোকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে ফিরেয়ে ভাষাটার সাথে বেয়াদবী করি। বেয়াদবীগুলোর মধ্যে নকশা খুঁজতে গেলে গোলকধাঁধায় পড়বেন বলে দিচ্ছি।

নাভিদ ফারাবী › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুখী মামা

১২ ই এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৫:০০


১৪ই ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার।
ঘড়ির কাঁটায় ১০ টা বাজতে ৫ মিনিট।
স্কুলের ছেলেপেলের সাথে আকাম কুকাম সেরে বাসায় ফিরব বলে ঈদগাহ মাঠে রিকশা ধরতে এসেছি। বেশ কতগুলো রিকশা দাঁড়িয়ে। পয়ত্রিশের ওপারে বসা এক মামার পাঞ্জাবীর সাদার ভিতরের বেগুনী রঙটা ডাকল বলে এগিয়ে গেলাম তার দিকেই।
-"মামা, যাবেন নাকি চাইনিজ?"
মুখে শব্দের বদলে একটা হালকা হাসি ঝুলিয়ে ইঙ্গিত করলেন উঠতে।
-"ভাড়া কিন্তু ৩০।"
আবারও তার হাসিমাখা ইঙ্গিত।
অনেকদিন পর বাইন মাছের মত পিছলাপিছলি ছাড়াই ১০ টাকা কম বলি দেয়া যাচ্ছে ভেবে খুশিই লাগল।
উঠে পড়লাম।
কিছুদূর এগোতেই বাম পাশের মেকানিক শপগুলোর সামনে রাখা একটা গাড়ির নিচে ছোট্ট একটা ফুলকি উঠে বেশ আওয়াজ করে কিছু একটা বার্স্ট করল। মামা তড়িঘড়ি করে গতি বাড়িয়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলেন।
ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুটা আতঙ্কমাখা একটা হাসি দিয়ে বললেন,
-"কি না কি ফুটছে খোদাই জানে কন। পরে না গাড়িডা ফাইট্টা মইরা টইরা যাই আমরা, তাই জোরত আগায় যাওন ভাল।"
মানুষটার পোড় খাওয়া চেহারায় অনেকদিনের ঢাকাই অনাদর দেখতে পেলেও তার আচার আচরণে তা মনে হচ্ছিল না।
-"হক কথা। ভাল করেছেন এগিয়ে। তো ঢাকায় কয়দিন মামা আপনার?"
-"এই তো প্রায় বছর আষ্টেক হইব।"
বেশ অবাক হলাম। আট বছর ঢাকায় রিকশা চালানোর পরেও কারো মনে এত আনন্দ টিকে থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না।
-"বাসা কই আপনার?"
-"বাড়ি জামালপুর৷ এইখানে বাসা ঈদগা মাঠের ভিতরের দিকে।"
-"আজকে তো ভালবাসা দিবস। মামীকে কিছু দেন নি আজকে?"
-"বিকালে ৭০ টাকা দিয়া একটা কিলিপ আর ফুল কিন্না দিছি। বড় মাইয়াডায় কয়, এত টাকা নষ্ট করছো ক্যান?"
-"আপনি বলেন নি যে আমার বউ আমি দিয়েছি তাতে তোর কি?"
-"ফুলটা ছোট মাইয়াডার পছন্দ হইছিল বইলা অগোর মায়ে ছোট মাইয়াডারেই দিয়া দিছে। কারে তহন আর কিল্লিগা ঝাড়ি দেই?"
মিরপুরের ধূলার বায়বীয় কার্পেট চিরে রিকশা এগিয়ে যাচ্ছে আর কথাবার্তা চলছে মামার সাথে। তেরো আর এগারো বছরের স্কুলপড়ুয়া মেয়েদুটোকে সাথে রাখলেও সাত বছরের ছোট ছেলেটাকে দিয়েছেন আশুলিয়ার এক মাদ্রাসায়। বড় হুজুর তার কাছে কিভাবে ছেলের "মজগের" প্রশংসা করেছিল সেটা বলতে গিয়ে গর্বে মামার গলার আওয়াজটা পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা পিকআপের হর্ণটাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছিল।


পাঁচ মিনিটের পথ জ্যাম ঠেলে পৌছলাম পনেরো মিনিটে।
বাসার সামনেই চায়ের দোকান। আমন্ত্রণ জানালাম এক কাপ চায়ের। রাজি হলেন। রিকশাটা সাইড করে দুজনে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। ওনার জন্য দুধ চা আর আমার জন্য রঙ চা বলতেই হাত নেড়ে দুটোই রঙ চা বললেন।
-"দুধ চায়ে সমস্যা কি, মামা?"
-"বাড়িতে থাকনের সময় আপনের মামী গাইয়ের দুধ দিয়া চা বানাইত। ওই চা ছাড়া অন্য দুধ চায়ে জুত পাই না।"
ঠোঁটে দাগ দেখে সিগারেট খান বলে মনে হওয়ায় অফার করলাম। ফিরিয়ে দিলেন।
-"বয়সকালে অনেক খাইতাম। আপনের মামী কিরা কাটানের পরেত্থে আর খাই না।"
-"মামীকে অনেক মানেন বুঝি?"
উত্তরের বদলে এক পশলা লাজুক হাসি।
-"বিয়ে করেছিলেন কত বছর বয়সে?"
-"আমার তহন ১৮/১৯ হইব।"
-"মামীর?"
-"হ্যার তখন হইল গিয়া..এহ.. এহ..৩০।"
উত্তরটা শুনে হোঁচট খাওয়ার কথা থাকলেও খেলাম না ওনার বলার ধরণ আর লাজুক হাসিটাকে অপ্রস্তুত হাসিতে রূপ নিতে দেখে। উত্তর ত্রিশ তো নয়ই বরং ১৮/১৯ এরও অনেক অনেক নিচে সেটা নিশ্চিত। লজ্জা পাচ্ছেন বলতে, তাই তালগোল পাকিয়ে আনকোরা একটা বেখেয়াল মিথ্যে আমার সামনে বলে ফেলেছেন। দৃশ্যমান লজ্জার সাথে আর লুকোচুরি খেলতে গেলাম না।


শীতকালটা যাই যাই করছে বলেই হয়ত শুধু হাফপ্যান্ট পরা একটা বছর ছয়েকের ছেলে দুকাপ রঙচা দিয়ে গেল। টি ব্যাগ। আমার এলাকাটা যেন টি ব্যাগে ছেয়ে গেছে। লিকারের সাথে একটু আদা লেবু মিশিয়ে চা দিলে মনে হয় কেউ এদের বাপের জমি কেড়ে নেবে। এক চুমুক দিয়ে মামা মুখ খুললেন।
-"আমার রিকশায় যেই উডে মামা সেইই কয় "আপনেরে দেইখা মন ভালা হয়া যায়"। এ কি বিপদ কন দেহি? আমি কই আমি এমনই। সবসুমত খুশি খুশি লাগে। মনে আনন্দ আছে, প্যাডে ভাত আছে, উপরে আল্লাহ আছে, খুশি না থাইকা কেমনে পারি কন?"
-"তিনটা বাচ্চা, সংসার, থাকা খাওয়ার খরচ, হয় রিকশা চালিয়ে?"
-"হয় মামা হয়, আল্লায় রাখলে হইব না কেন? দুই মাইয়া আর পোলা মিলায়া মাসে আড়াই হাজার খরচা, ঘর ভাড়া সাড়ে তিন, তার উপরে খাওয়াদাওয়া তো আছেই। আমি তো আর খাওয়াই না, আল্লায়ই খাওয়ায়।
আপনেরে একটা কাহিনী কই হুনেন।
আমার সম্মন্ধি থাকে কমলাপুরের দিকে। ডেঙ্গু লাগছিল কয়া দেখতে যামু। আপনের মামী কইল কি নিবা? আমি রুগীর লেইগা সকালবেলাতেই আঙুর ফল কিন্না ঘরে রাখছিলাম নিয়া যামু বইলা। আপনের মামী সেইটা দেখে নাই। হেয় কইল যে আমার সম্মন্ধী দই খাইতে চাইছিল। পরে আবার দইও কিনছিলাম। আঙুর ফল আর দই দুইটাই কিনছি দেইখা আপনের মামী কইল "এতগুলা টাকা নষ্ট করলা?"
নষ্ট করলাম কই? নষ্ট করলে দই আর আঙ্গুর ফল কিননের পরেও আমার হাতে টাকা থাকে কেমনে?
খোদার ভাণ্ডারের শেষ নাই, আমার ভাণ্ডারের শেষ থাকব কেন? আমি খোদার লোক না? আমি খোদার কাছে কই "আমারে তুমি দেইখা রাইখো", খোদায় আমারে দেইখা রাখে। আমি চামু একটা জিনিস কিনতে আর আমার খোদায় আমারে ফিরায়া দিব তাই হয় নাকি?"

চা তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলার একটা বদঅভ্যাস আমার আছে। আমার খালি কাপ সামনে রেখে দেখি মামার অর্ধেকও শেষ হয়নি এখনো। বেশ আরাম করে চুমুক দিচ্ছেন।
-"বুঝছেন মামা আল্লাহর কাছে দোয়া করি সবের জন্য।
আমারে যেমনে তুমি আজীবন ভরায়া রাখছো এমনে সবায়রে ভরায়া রাখো। মাইনষের লেইগা দোয়া করলে কোনদিন কার কি কমছে কন দেহি আমারে?"

পরীক্ষার জন্য, বৃষ্টির দিনে হাঁটুপানি পার করার সময় গাড্ডায় না পড়ার জন্য, এর ওর ভালমন্দ, কত না কিছুর জন্য দোয়া করি আমরা। কার দোয়া কবুল হয় আর কার দোয়া হয় না সেটা এক আল্লাহ মাবুদ ছাড়া আর কেউ জানেন বলে মনে হয় না। কিন্তু কিছু মানুষ থাকে যাদের দেখলে বোঝা যায় যে এদের দোয়ার আবেদননামায় খোদাতায়ালা "হ্যাঁ" সিল দিতে দিতে নিজের হাত ব্যথা করে ফেলেন। এই মামা সেইসব মানুষদের একজন। এরকম মানুষ এক জীবনে দেখতে পাওয়া খুব বেশি রকমের ভাগ্যের বিষয়।

-"কয়দিন আগে তাবলীগে গেছিলাম, ওইখান থেইকা একটা বই আইনা দিয়া বড় মাইয়াটারে কই তুই পড়, পইড়া পইড়া হুনা। বড় মাইয়াডা পড়ালিখায় ভাল না অতডা। কিন্তু গলার আওয়াজ মাশাল্লাহ। অয় দিনে অর মায়েরে পইড়া হুনায়, রাইতে আমারে। কি যে সুন্দর সুন্দর কথা।
জুমাবারের নামাজ বিসমিল্লাহ গার্মেন্টস এর সামনের মসজিদটায় পড়ার চেষ্টা করি। ওইখানের খতিবের কথাডিও এত্ত ভাল্লাগে। আইজকা জুমার নামাজও অইখানেই পড়ছি। হুজুরের সুরাডি হুনলেই বুকটা বইসা যায়। বাসায় আইয়া কই হুজুরে এই এই কইছে। আপনের মামী হুনে।"
-"রাত তো ভালই বাজে। বাসায় যাবেন কখন?"
-"একটু দেরী কইরা যাইতে হইব আইজ। মাগরিবের একটু আগেত্থে এশা তামাইত ঘরেই ছিলাম আইজ। আপনের মামীর লগে একটু গল্প টল্প করলাম আরকি। এশার পরে ভাত খাইয়া গোসল কইরা রিকশাটা লইয়া বাইর হইছি। আইজ রাইতে আর বেশি দূর যামু না। মিরপুরের ভিতরেই থাকমু। মানুষজন আইজ বেশি।"
-"মামা আপনার কি একটা ছবি তুলব?"
-"তুলেন। কিন্তু মামা হইল গিয়া দাঁড়ির কারনে বয়স বেশি দেখায়, বুঝছেন নি? বয়সকালে কামাইতাম বেশি, এর লেইগা মনে হয় সাদা হয়া গেছে। বয়স আমার বেশি না।"
লাজুক হাসিটা উঁকিঝুঁকি দিল আবার একটু।
-"নায়ক মার্কা চেহারা নিয়া লাখ টাকার হাসিও দিতে জানেন মিয়া, আবার এত কথা বলেন কেন?"

ছবি টবি তোলা শেষ। দরদ দিয়ে মামা বাকি চা টুকুতে চুমুক দিচ্ছেন। সেই ১০ টা থেকে পৌনে ১১ টা পর্যন্ত এক টানা ৪৫ মিনিট একটা মানুষের মুখে এত হালকা দিলখোলা হাসি ঝুলে থাকতে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ল না। সত্যিকারের সুখী মানুষের আশেপাশে কিছুক্ষন থাকলে মনে হয় নিজের অন্তরটা শীতের সকালের শিশিরে ভিজে দুহাতে কুয়াশা সরিয়ে বেরিয়ে আসা তরতাজা সূর্যের মোলায়েম রোদ বেশ আয়েশ করে গায়ে মাখাচ্ছে। দুনিয়ার যা কিছু অসুন্দর আর অসুখী সেসবের সমাধান হিসেবেই বোধহয় এসব মানুষকে আল্লাহ তায়ালা এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন।

ওনার কাপটা শেষ হলেই বেরিয়ে রিকশা পর্যন্ত গেলাম দুজনে। ভাড়া হিসেবে একশো টাকা গুঁজে দিলাম ওনার হাতে।
-"এইটা কি দেন মামা?"
-"আরে রাখেন। আপনাকে দিচ্ছি নাকি? ভালবাসা দিবস উপলক্ষে মামীর জন্য আমার উপহার এটা।"
ভুবনভোলানো আরও এক চিলতে হাসির সাথে বিদায় দিলেন আমাকে।
বাসার দিকে এগোতে এগোতে ভাবছি আমার ৩০ টাকা ভাড়ার ৩০ টাকাই আমি দিয়েছি। একটা টাকা বেশিও না, কমও না। বাকি ৭০ টাকার হিসাব আমার ডান কাঁধের ফেরেশতার কাজের আওতায়ও পড়ে না।
ওটা সরাসরি খোদাতায়ালার পক্ষ থেকে এই মানুষটার উপহার। আমি এখানে একজন ক্যাশিয়ার মাত্র। এই মানুষের টাকার অভাব হবে কি করে?
ভাগ্যিস এটা সেই অসুখী রাজার গল্পের রাজ্য না যেখানে রাজাকে খুশি করানোর জন্য পাইক পেয়াদারা একজন সুখী মানুষের জামা খুঁজতে থাকে। ওরকম হলে বোধহয় এই মানুষটাকে ঐ শীতের রাতে খালি গায়ে মুখে শুধু একটা হাসি চড়িয়েই রিকশা চালাতে হত।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.