নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছোট থাকতে পছনদো করি

নাঈম ফয়সাল নয়ন

সত্য কে সত্য আর মিথ্যা কে মিথ্যা বলার চেষ্টা করি

নাঈম ফয়সাল নয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোস্বা ঘর (হরর)

১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:১৩

আমার একবার অনেক পুরোনো এক জমিদার বাড়িতে কয়েকদিন থাকবার সুযোগ হয়েছিল। ঝিনাইদহ জেলার মুল শহর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে মুরারীদহ নামক গ্রামে অবস্থিত ভাঙাচোরা জরাজীর্ণ এই প্রাচীন জমিদার বাড়িটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল বঙ্গাব্দ ১২২৯ সালে, এবং সমাপ্ত হয় ১২৩৬ সালে (ইংঃ১৮২৯)। অর্থাৎ প্রায় ৭ বছর লেগেছিল বাড়িটি নির্মাণ করতে! বাড়িটি স্থানীয় নবগঙ্গা নদীর উত্তর দিকে অবস্থিত। বর্তমানে বাড়িটি ভগ্নপ্রায়। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী বাড়িটির প্রধান ফটকে নির্মাণ সময়ের কিছু কথা কাব্যিক ভাবে খোদাই করা আছে। তাতে লেখা-
"শ্রী শ্রী রাম, মুরারীদহ গ্রাম ধাম, বিবি আশরাফুন্নেসা নাম, কি কহিব হুরির বাখান। ইন্দ্রের অমরাপুর নবগঙ্গার উত্তর ধার, ৭৫,০০০ টাকায় করিলাম নির্মাণ। এদেশে কাহার সাধ্য বাধিয়া জলমাঝে কমল সমান। কলিকাতার রাজ চন্দ্র রাজ, ১২২৯ সালে শুরু করি কাজ, ১২৩৬ সালে সমাপ্ত দালান।"
যত দূর জানা যায়, যে জমিদার এই দালানটি নির্মাণ করেন তার বংশের লোক ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় ভবনটি বিক্রি করে দেন সেলিম চৌধুরী নামের এক ব্যক্তির কাছে। তাই ভবনটিকে স্থানীয় ভাবে কেউ কেউ সেলিম চৌধুরীর বাড়িও বলে থাকে। বলা হয়ে থাকে বাড়িটি থেকে নবগঙ্গা নদীর নিচ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ ছিল। সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখ এখনো চিহ্নিত করা যায়। নদীতে যে ভাবে বাঁধ দিয়ে ইমারতটি নির্মাণ করা হয়েছিল সেভাবে তৈরি আর কোন পুরানো ইমারত ঝিনাইদহ শহরে দেখা যায় না।
বাড়িটির স্থানীয় ভাবে ব্যাপক পরিচিতির আর একটি বড় কারণ বাড়িতে থাকা একটি বিশেষ খেজুর গাছ, যে গাছটিতে ৭ টি মাথা ছিল এবং প্রতিটি মাথা থেকেই রস আহরণ করা যেতো। আমি নিজেও দেখেছি সেই মরা গাছটি আজো ঠাই দাড়িয়ে আছে।
বাড়িটি সম্পর্কে ব্যাপক কৌতুহল বশতই যেকোন উপায়ে সেখানে কয়েকটি রাত অতিবাহিত করবো বলে ঠিক করলাম। যদিও ভাঙা ঘর গুলো স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের অযোগ্য। তবুও আমি স্থির সিদ্ধান্ত নিলাম ওখানে থাকার, তাও আবার সম্পূর্ণ একা!!
লোক মুখে বাড়িটি সম্পর্কে বহু ভৌতিক ঘটনার মুখরোচক গল্প প্রচলিত থাকলেও আজ অব্দি এমন কাউকে পেলাম না যিনি কিনা স্বয়ং নিজে ভুতের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। তবে হ্যাঁ, একজন ব্যক্তি আছে যে কিনা ওই বাড়িতে বসবাস রত ভুতের সাক্ষাৎ পেয়েছে!! সেই ব্যাক্তিটি আর কেউ নয় ... স্বয়ং আমি নিজে!!!
---
তখন ছিলো পৌষ মাসের শুরু, প্রচন্ড কনকনে শীত কে মাথায় রেখেই শীতের কাপড়, মাফলার, হাত মোজা, পা মোজা সহ যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়েই উঠলাম বাড়িটির দোতালার ঠিক কোনার দিকের ঘরটাতে। যেন জানালা খুললেই নবগঙ্গা নদী ও তার আশপাশের মোনোরম দৃশ্য চোখে মেখে চায়ের কাপে চুমুক দিতে পারি। তাছাড়া সকালে উঠেই জানালা খোলা মাত্র মিষ্টি রোদ এসে শরীরের সমস্ত লোমকুপ কে করবে আন্দোলিত, ভেবেই ঠিক জানালার পাশে একটা চৌকি এনে সেখানে বিছানা বানালাম। বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই, তাই একটা নতুন হারিকেন আর ১ লিটার কেরোসিন তেল সঙ্গে করেই এনেছি।
বাড়ির মূল সীমানা থেকে ৩০ থেকে ৪০ কদম দূরে হরিশংকর এর বাড়ি। সে দীর্ঘ ১৯ বছর এই বাড়ির দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত। আমার তিন বেলা খাবার আর দেখাশোনার দ্বায়িত্বও তার উপর অর্পিত হল। সে আগে ভাগেই আমার ঘরটা ঘষে মেজে পরিষ্কার করে বসবাসের উপযোগী করে রেখেছে। এতো দিনের পুরোনো জংজাল পরিষ্কার করতে গিয়ে তার যে বেশ কষ্ট হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। এজন্য প্রথম দিনেই আমি তার হাতে পঞ্চাশটা টাকা গুঁজে দিলাম। সেও প্রচন্দ আহ্লাদে আমাকে খোশামদ করে আমার প্রতি তার দ্বায়িত্ব আরো দ্বিগুণ করে ফেললো।
১ম দিন -
দুপুর নাগাদ জমিদার বাড়ি পৌছনোর পর একটা চাদর মুরি দিয়ে পুরো বাড়িটা দেখতে লাগলাম ঘুরে ঘুরে। বাড়ির প্রতিটি পরতে পরতে কি দারুণ কারুকার্য! কি নিপুণ হাতের শৈল্পিক নিদর্শন! দেখলে যে কারো চোখ জুড়িয়ে যেতে বাধ্য। সত্যিই দূ্র্লভ শিল্পকর্ম। কিন্তু এসবই আজ যত্ন ও প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নিঃশেষ প্রায়। অদ্ভুত এই বাড়িটিও আস্তে আস্তে অনেকটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। আমি প্রতিটা ঘর অত্যন্ত ধর্য্যের সাথে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলাম এবং কল্পনায় বিভোর হয়ে গেলাম। যেন চোখের সামনে পুরো বাড়িটা সাদাকালো থেকে রঙিন হয়ে উঠলো, সব কিছু জীবন্ত হয়ে গেল, যেন সময় টা অনেক পিছিয়ে গেছে! আমি দাড়িয়ে আছি জমিদার বাড়ির ঠিক ১৮২৯ সালের মূহুর্থটাতে!! দেখতে পেলাম জমিদার বাবুর স্ত্রীগন বাড়ির ভিতরে পায়চারী করছে আর সমস্ত কাজের লোক গুলো প্রচন্দ ব্যস্ততা নিয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। শুনেছি জমিদারের ৩ জন স্ত্রী ছিল এবং তারা এক সাথেই বসবাস করত...
-"বাবু, আপনের চা আর সিগেরেট"
হরিশংকরের ডাকে ঘোর কাটলো, এবং মূহুর্থেই আমি ফিরে এলাম ২০১৭ সালে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম -
-"হ্যাঁ দাও দেখি, শরীরটা কেমন ম্যাজ ম্যাজ করছে, চা খেয়ে যদি একটু ছাড়ে"
বলে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে অন্যান্য ঘরের দিকে এগোতে থাকলাম, হরিশংকরও আমার পিছে পিছে আসলো। আমি চা টা শেষ করে সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বললাম -
-"আচ্ছা হরিশংকর, এই দীর্ঘ সময়ে এই বাড়িতে কখোনো কোন ভুত প্রেতের দেখা পেয়েছ কি?"
-"আজ্ঞে বাবু তেমন কিছু তো দেখিনি, তবে গোস্বা ঘরের দিকে কেউ যায়না, ওদিকে যাওয়া বাড়ন, রাইত হইলেই কে নাকি কান্দা কাটি করে আর কাছে ডাকে ... তই মুই কুনুদিন দেহি নাই বাবু !"
গোস্বা শব্দের অর্থ হলো 'রাগ' তথা গোস্বা ঘর অর্থ 'রাগ ঘর'। অর্থাৎ আগেকার রাজা বাদশাদের স্ত্রীগন রাগ বা অভিমান করলে গোস্বা ঘরে গিয়ে বসে থাকতো। এবং রাজারা ওই গোস্বা ঘরে গিয়ে তাদের স্ত্রীগনের রাগ ভাঙিয়ে বের করে নিয়ে আসতেন। এতে করে রানী তার প্রাপ্য সম্মান ফিরে পেয়েছে এমন আনন্দ নিয়েই বের হয়ে আসতেন গোস্বা ঘর থেকে!!
আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম -
-"কোন দিকে সেই গোস্বা ঘর?"
-"ওই যে প্রাচীরের কোনার দিকে যে ঘরটা দেখতাছেন ওইটাই"
আমি সেদিকে হাটা শুরু করলাম। কাছে গিয়ে দেখলাম একটা ইয়া মস্ত তালা ঝুলছে!! তৎক্ষণাৎ হরিশংকর কে বললাম -
-"এ তো দেখি তালা মারা! চাবি কই?"
-"আজ্ঞে বাবু তাতো জানিনে !!"
আমি তালাটা নেড়েচেড়ে দেখলাম, কি দারুণ কারুকার্যখচিত পুরো তালা জুড়ে। হাত বুলিয়ে ওই অদ্ভুত শিল্পকর্ম অনুভব করার চেষ্টা করলাম। যদিও বয়সের ভারে আর জং ধরে সেগুলোও ঝাপসা প্রায়। মনে মনে বললাম - যে ভাবেই হোক, এই তালা আমাকে ভাংতেই হবে ...!! গোস্বা ঘরের রহস্য আমাকে উৎঘাটন করতেই হবে যেকোন মূল্যে ...!! না হলে যে আমার এই অস্থায়ী বাস সম্পূর্ণ বিফলে যাবে ..!! আমার কাছে তালা ভাঙার সব রকম সরঞ্জাম বর্তমান ...!! বড়সর হলেও মরিচা পরায় ওটাকে ভাঙতে আমার খুব বেশি বেগ পেতে হবে বলে মনে হয় না। এখন শুধু রাতের জন্য অপেক্ষা ... হরিশংকর আমাকে রাতের খাবার দিয়ে যখন বিদায় হবে তখনই হল মোক্ষম সময় ... পুরো জমিদার বাড়ি আমি একা ...!! মনে মনে অনাজা ও অদেখা শত বছরের পুরোনো কোন রহস্য উৎঘাটন করতে পারবো এমনটা ভাবতেই আমার লোভাতুর চোখ দুটো ঝিলিক মেরে উঠলো এক অনাবিল আনন্দে ..!!!
আমি ঘুরে দাড়িয়ে হরিশংকর কে বললাম -
-"কি মশাই দুপুরের খাবার আয়োজন কি কি?"
-"আজ্ঞে বাবু, ইলিশ মাছের দোপেঁয়াজা, টাকি মাছের ভর্তা, পালংশাক আর মুসুরির ডাল"
-"বেশ বেশ"
বলে আমার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

*******************************************

একটা বালিশ বোগলের নিচে দিয়ে পা দুটো টান টান করে কাত হয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রেখে সন্ধ্যার মায়াবী দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। সিগারেটে ছোট ছোট টান দিয়ে ধুঁয়া গুলো গোল বলের মত করে জানালার দুই শিকের মাঝখান দিয়ে বাইরে পরিচালনা করার এক সুক্ষ প্রচেষ্টা চলছিল। চারিদিকে সুনসান নিরবিচ্ছিন্ন নিরবতার দরুন নদীর পানির কুলকুল বয়ে যাওয়া শব্দটা খুব স্পষ্ট। সেই সাথে চাপা আনন্দ আর রমাঞ্চ বয়ে চলেছে আমার মস্তিষ্কের ভিতর দিয়ে। দুপুরে ভাত খেতে খেতে হরিশংকরের কাছ থেকে গোস্বা ঘর সম্পর্কে নতুন গল্প শোনার পর থেকে আমার কৌতুহলের মাত্রাটা আরো কয়েক গুন বেড়ে গেল। গল্পের সারমর্ম অনেকটা এরকম -
""সে সময় জমিদারের তিন বউয়ের ভিতরে ছোট বউ ছিল প্রচন্ড সুন্দরী ও হিংসুটে। তিন বউয়ের উপরে জমিদারের সমান ভালবাসা কে মেনে নিতে পারতো না সে। তার কথা হল - সে সবার থেকে সুন্দরী ও কম বয়সী হওয়া সত্বেও একটা বুড়ো ভাম কে বিয়ে করেছে সবার সাথে সমান ভালোবাসা ভাগাভাগি করার জন্য নয়!! সবার থেকে সে একটু বেশি প্রাধান্য পাবে, বেশি সম্মান পাবে, এমনকি সহায় সম্পত্তিরও বেশি ভাগিদার হওয়ার পিছনে যুক্তিসংগত ও ন্যায্য দাবি আছে বলে মনে করত সে। কিন্তু জমিদার তার নিরপেক্ষতায় ছিল অটল। সে কখনোই কোন বউ কে সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি। ফলে দিন দিন ছোট বউয়ের অযথা রাগ আর মানসিক নির্যাতন ক্রমেই জমিদার কে অতিষ্ঠ করে তুলল। যেমন ছোট্ট একটা উদাহরণে বিষয় টা একটু খোলাসা হবে - জমিদার একবার পুজোর সময় তার তিন বউয়ের জন্য অনেক দামী শাড়ি উপহার দিলেন। প্রত্যেক বউকে ৫ টা করে শাড়ি দিলেন। এতে ছোট বউ স্বভাবদোষেই ক্ষেপে উঠলো! এবং পাঁচটা শাড়িতেই আগুন লাগিয়ে দিল!! জমিদার এসে জানতে পারলো শাড়ি গুলোতে নাকি দুর্ঘটনাবশত আগুন লেগে গেছে!! ফলে জমিদার আবারো নির্দেশ দিয়ে ছোট বউয়ের জন্য আরো ৫ টা শাড়ি আনালেন। আর যথারীতি ছোট বউ এই ভেবে আনন্দিত হল যে - তার জন্য জমিদারের ১০ টা শাড়ির খরচ হলো, ফলে সে অন্য বউদের থেকে নিজেকে একটু আলাদা প্রমান করতে পারলো !! জমিদার যে এই ষড়যন্ত্র একে বারেই বোঝেনি তা কিন্তু নয়!! এছাড়াও ছোট বউয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল বাড়ির সমস্ত ভৃত্য। কারণে অকারণে গায়ে পর্যন্ত হাত তুলতে বাধেনি তার। এসব নিয়ে জমিদার কিছু বলতে গেলেই গোস্বা ঘরে গিয়ে সারাদিন বসে থাকতো সে। দানা পানি কিছুতেই স্পর্শ পর্যন্ত করত না!! এভাবে একদিন জমিদারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো!! ছোট বউ যখন গোস্বা ঘরে রাগ নিয়ে বসেছিল তখন তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওই ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে দিলেন!!! এবং হুংকার দিয়ে বললেন কেউ যেন ওই ঘরের ত্রিসীমানায় না ঘেষে .. ব্যস...... তারপর থেকেই আজ অবধি প্রায় ২০০ বছর যাবৎ ওই ঘরের তালা ওভাবেই বন্ধ!!!""
-"বাবু, হারিকেন টা জ্বালিয়ে দেই?"
হরিশংরের ডাকে পিছনে ফিরলাম, এবং বললাম -
-"হ্যাঁ জ্বালাও, আর তোমার বউকে বলো তার রান্না আমার কাছে চমৎকার লেগেছে, অসাধারণ রান্নার হাত তার"
হরিশংকর একটু লাজুক ভাবে বলল -
-"বাবু, আমি তো ওর রান্দার প্রেমে পইড়াই ওরে শাদি করছিলাম, ওরে দেইখ্যা আমার পছন্দ হয় নাই, কিন্তু ওর রান্দা খাইয়া আমি হাছাই ওর প্রেমে পরছিলাম"
আমি ওর দিকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে বললাম -
-"নাও তোমার বউয়ের এই গুনের জন্য তুমি একটা সিগারেট খাও! আর এখান থেকে যাবার সময় তোমার বউকেও বকসিস দিয়ে যাবো"
রাত তখন ৮ টার মত বাজে। হরিশংকর আমার রাতের খাবার ও পানি দিয়ে চলে গেল। আমার কিন্তু একটুও ক্ষিধে নেই!! হরিশংকরের বউয়ের হাতের সুস্বাদু রান্নার থেকেও গোস্বা ঘরের উত্তেজনা আমাকে বেশি প্রভাবিত করল। যদিও এই মুহূর্তে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করা যাবেনা। অপেক্ষা করতে হবে রাত গভীর হওয়া অব্দি, পাছে তালা ভাঙার শব্দ কারো কানে না পৌছায়। আমি হারিকেন টা বিছানার উপরে নিয়ে একটা বই খুললাম, উদ্দেশ্য সময় পার করা।
হঠাৎ একটা মরা কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল!! তাকিয়ে দেখি হারিকেনের পাশে বইয়ের উপরে মুখ থুবড়ে পরে আছি!! কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিলাম টেরই পাইনি!! দেখি একটা কালো কুচকুচে বেড়াল আমার খাবার গুলো আরাম করে খাচ্ছে! হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি রাত ২ টা!!
আমি সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে উঠে পরলাম। টর্চলাইট টা নিলাম, তালা ভাঙার সরঞ্জাম নিলাম, দিয়াশলাই আর সিগারেটের প্যাকেট টা নিয়ে নিচে নামলাম। ঘরের বাইরে পা রাখতেই তিব্র শীতে শরীর টা কেঁপে উঠলো। আমি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে টর্চলাইটের আলো ফেলে এদিক ওদিক চতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। প্রচন্ড কুয়াশায় দুই হাত দূরে আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। ফলে গোস্বা ঘর টা খুজে বের করতে একটু কষ্ট হল। চারপাশে অসম্ভব নিরবতা, যেন একটা পিঁপড়ে কথা বললেও তা শোনা যাবে। আমি সিগারেটে টান দিতে দিতে ধীর গতিতে এগোতে থাকলাম.. হঠাৎ ......আমাকে পিছন থেকে কেউ একজন জড়িয়ে ধরলো ...!!! আমি হাতের টর্চলাইট টা দিয়ে ধাম করে মারলাম বেটার মাথা বরাবর!! ... কিন্তু কই? কেউ তো নেই ...!! স্পষ্ট টের পেয়েছি আমি ...!!! আর ওটাকে বেটা না বলে বেটি বলা উচিত, কেননা যে আমাকে জাপটে ধরেছে সে কোন পুরুষ হতেই পারেনা, তার হাতের চুরির শব্দটা এখোনো রিনঝিন করে বাজছে আমার কানে ...!!! এটা যে আমার মনের কোন ভুল নয় তার আরো একটা প্রমাণ নিচে পরে থাকা অর্ধেক জলন্ত সিগারেট!! ধাক্কা খেয়ে ওটা আমার হাত থেকে পরে গিয়েছিল ....!! আমি এদিকে সেদিক টর্চের আলো ফেললাম, কেউ নেই ... কিন্তু ঘাবড়ালাম না!! ভাবলাম আমার মত কেউ হয়তো গোস্বা ঘরের রহস্য উৎঘাটন করতে এসে অন্ধকারে আমার সাথে ধাক্কা লেগেছে...। কিন্তু ওর চুরির আওয়াজ? এত রাতে কন মহিলার দায় ঠেকেছে এই তিব্র শীতকে উপেক্ষা করে গোস্বা রহস্য উৎঘাটন করবে? সে যাগ্গে ... অত ভেবে আমার কাজ নেই .. আমি বরং ঘরটার দিকে এগোতে থাকলাম। ঘরের কাছে পৌছে আরেকটা সিগারেট ধরালাম। টর্চলাইট টা কাধেঁ চেপে, সিগারেটটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে তালা ভাঙার কাজে হাত দিলাম। পকেট থেকে হাতুড়ি, ছানি, আর রেঞ্জ বের করলাম। কিন্তু তালায় হাত দিয়ে চমকে উঠলাম ....!!!
তালা আগে থেকেই খোলা!!! কিন্তু কিভাবে? আমার আগেই কি কেউ উদঘাটন করে ফেলেছে গোস্বা ঘরের রহস্য?? কিভাবে কিভাবে কিভাবে সম্ভব?? এ হতেই পারে না ... চাপা ক্রোধ আর হিংসায় জ্বলে ছারখার হয়ে গেলাম আমি ... নিজেকে হিংস্র পশুর মত মনে হল ...!!! রাগে ক্ষোভে সব ভেঙে চুরে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে ...!! কিন্তু কেন?? আমার তো এত রাগ আর হিংসা কোনদিন ছিলনা ..!! কেন আমার ভিতরে এমন অনুভূতি হচ্ছে?? জমিদারের ছোট বউয়ের ভুত কি তবে আমার উপরে ভর করলো? ..... প্রশ্নই ওঠেনা ...!! সরঞ্জাম গুলো পকেটে ঢুকিয়ে, টর্চলাইট টা হাতে নিয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছি আর ভাবছি ঘরে ঢুকব? নাকি ঢুকব না ....!!!
ঢুকলাম বটে ... কিন্তু ঢুকলে যে আমার এমন বেহাল দশা হবে জানলে হয়তো ঢুকতাম না, কেননা যথেষ্ট সাহস আর শক্তির পরিচয় আমি ইতমধ্যেই দিয়েছি .. কিন্তু এই সাহসিকতা আর শক্তি যে যথেষ্ট নয় তা জানতে পারলাম গোস্বা ঘরে ঢোকার পর ..!!!
ক্যাচক্যাচে একটা শব্দ তুলে খুললাম দরজার কপাট টা। টর্চলাইট মারলাম ঘরের ভিতরে। অবাক হয়ে দেখলাম ভিতরের চোখ জুড়ানো শিল্পকর্ম। ছোট ছোট তেলাপোকা আর ইদুরের বাস, আর কেমন একটা উটকো বাশি গন্ধ!! একটা চেয়ার, টেবিল, কলশি, গ্লাস, খাট আরো অনেক আসবাবপত্রে ভরা ঘরটা। কিন্তু সব কিছুর উপরে পরেছে পুরু ধুলোর আস্তরণ!! আমি বিষ্ময় নিয়ে দেখতে দেখতে ভিতরে এগোতে থাকলাম ... ঠিক এমন সময় ......... ঘটাম করে একটা শব্দে লেগে গেল দরজা টা ...!! আটকা পরে গেলাম ভিতরে আমি... হাত থেকে টর্চলাইট টা পরে নিভে গেল ...!! অন্ধকার .....!! ঘুটঘুটে অন্ধকার ..... এই শীতেও দরদর করে ঘামছি আমি ... মেঝেতে বসে হাতরে হাতরে টর্চলাইট টা খুজছি ...!! খুজতে খুজতে পেলাম .... কিন্তু টর্চলাইট নয় ....!! একটা হাত ....!! একটা মেয়ের হাত ....!! হাতে চুরিও আছে ....!!! এই প্রথম আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত মেরুদন্ড বেয়ে হিম শিতল একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল ... আর যেতে যেতে ফিস ফিস করে বলে গেল 'বড্ড ভুল করে ফেলেছিস ...!! বড্ড ভুল' ...
আমি ওর হাত টা ছেড়ে দিলাম ... পকেট হাতরে দিয়াশলাই টা বের করে জ্বালালাম ... তাকে দেখতেও পেলাম ... কিভাবে বর্ননা করলে যথার্থ হবে ভেবে পাচ্ছি না ... তার চোখ দুটো খুলে গালের কাছে ঝুলছে .. মাথায় কোন চুল নেই ... নাক দিয়ে কালো রক্ত পরছে টপটপ করে ... আর জ্বীভ ..... সেটা যে মুখ দিয়ে বের হয়ে গড়িয়ে ঠিক কতদূর গেছে তা দেখার জন্য আমার মস্তিষ্ক আর সক্রিয় থাকলো না ... জ্ঞান হারালাম আমি ....!!!
২য় দিন -
খুব সকালে হরিশংকরের ডাকে সজাগ হলাম, দেখলাম আমি আমার বিছানায় ..!! রাতে যে বইটা পরতে পরতে ঘুমিয়ে গেছিলাম সেটা ও বন্ধ করে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল -
-"কি বাবু, বই পরতে পরতেই ঘুমাইয়া গেছিলেন? রাতের খাবার গুলোও দেখি খান নাই!!"
বলে সে নষ্ট খাবার গুলো ফেলে দেয়ার জন্য বাইরে নিয়ে গেল। তবে কি খাবার গুলো বিড়াল খাইনি? ... কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো মাথাটা ... আমি ঝটপট ছুটে গেলাম গোস্বা ঘরের দিকে ... এবং তাজ্জব বনে গেলাম ... ঘরটা যেমন ছিল তেমনই রয়েছে ... তালাটাও মারা ... আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে ঘরে ফিরে এলাম ... তবে কি সব স্বপ্ন? কিন্তু স্বপ্ন এতটা বাস্তব হয়?? আমার সত্যিই বেশি ভাবার মত কোন অবস্থাই ছিলনা তখন ... তবে গোস্বা ঘরের রহস্য উৎঘাটনের নেশা তখনো আমাকে ছাড়েনি ... ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা কে জোর করেই একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হিসেবে মেনে নিলাম। ...
---
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা ... এবং রাত। আজ আর কোন ভাবেই ঘুমোবো না বলে প্রতিজ্ঞা করলাম। হরিশংকর কে এটা সেটা বলে বিদায় করলাম রাত আসার সাথে সাথেই। পায়চারী করতে লাগলাম ঘরের ভিতরে। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলাম রাত গভীর হওয়ার ...।
রাত ১ টা। প্রস্তুত হলাম যাবার জন্য .. কিন্তু টর্চলাইট টা কোথায়? ... কোথাও খুজেঁ পেলাম না ...!! আশ্চর্য!! তবে কি?? না না ... এটা হতেই পারেনা ... নিশ্চয়ই আছে কোথাও, খুজেঁ পাচ্ছিনা। যাইহোক, হারিকেন তো আছে ...! ওটা নিয়েই রওনা দিলাম ... গোস্বা ঘরের সামনে এসে দাড়ালাম .. কুয়াশা ভেঙে হারিকেন এর আবছা আলোয় দেখলাম তালা আগের মতই লাগানো। যাক বাবা কিছুটা সস্থি পেলাম এটা ভেবে যে গতকালের ঘটনা টা নিছক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয় ...।
আমি তালা ভাঙা শুরু করলাম। প্রায় ১০ মিনিটের এক দুর্দান্ত চেষ্টার পর সফল হলাম!! আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে খুললাম দরজা টা ... সেই একই ক্যাচক্যাচ শব্দে খুলল দরজা... প্রবেশ করলাম ভিতরে ... একি!!! গতকাল যেমনটা দেখেছিলাম হুবহু তেমনই রয়েছে ভিতরটা ... কিভাবে সম্ভব!!! তবে কি ওটা সপ্ন নয় .....!!!
এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম মেঝেতে পরে থাকা আমার টর্চলাইট টার দিকে ....!!! ওটার গায়ে স্পষ্ট লেখা আছে Made in Germany 2016. ওটা যে গত রাতে ফেলে যাওয়া আমার টর্চলাইট তাতে আর কোন সন্দেহ রইলো না, কেননা জমিদার বাবুর ছোট বউ নিশ্চয়ই ২০০ বছর আগে ২০১৬ সালের তৈরি এই অত্যাধুনিক টর্চলাইট টা নিয়ে এই ঘরে ঢোকেননি!! আমি টর্চলাইট টা তুলতে যাব এমন সময় সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ... তবে একটু ভিন্ন ভাবে।
সেই একই ভাবে চরম শব্দে দরজা লেগে গেল, এবং হারিকেনের আলোটা দপ করে নিভে গেল ...!! আর শুরু হল মহাপ্রলয় ... ধুম ধুম শব্দে জানালা গুলো বারি খেতে লাগল, প্রচন্ড বিদ্যুৎ চমকানোর আলো মাঝে মাঝেই আলোকিত করে যাচ্ছে ঘরটা ... মনে হচ্ছে বাইরে প্রচন্দ ঝড় তুফান শুরু হয়েছে ... বাতাসের শো শো শব্দ আর কনকনে শীত শরীরে কাটা দিয়ে যাচ্ছে ... হঠাৎ একটা শক্তিশালী দমকা হাওয়া আমাকে উড়িয়ে নিয়ে ঘরের দেয়ালে আছাড় মারলো ... প্রচন্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম আমি ... এমন সময় শুনতে পেলাম এক ভয়াবহ বিভৎস নারী কন্ঠ ...!! প্রচন্ড ক্ষোভ, আক্রোশ আর ক্রোধ মাখা কন্ঠে চিৎকার করে বলল -
"জানোয়ার!!! এতদিন পর এসেছিস আমার গোস্বা ভাঙাতে? আমার রাগ ভাঙাতে? কোথায় ছিলি এতদিন??? হ্যাঁ?? কোথায় ছিলি?? এতদিন পর কেন এলি আমার রাগ ভাঙাতে?? এতদিন পর কেন এলি??"
বিদ্যুৎ চমকানোর তির্যক আলোয় দেখলাম জমিদার বাবুর ছোট বউ শুন্যে ভাসছে ... কত পুরোনো দূর্লভ কারুকার্যখচিত দামী শাড়ি পরে আছে তা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না ... আর তার রূপের বর্ননা কি বলব ...!! হরিশংকরের কাছে যেমনটা শুনেছিলাম তা যে নেহায়েত গালগল্প নয় তা একবিংশ শতাব্দীর নারীদের সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করলেই বোঝা যায় ...!!!
#পরিশিষ্টঃ খুব ভোরে হরিশংকরের আসার আগেই জ্ঞান ফিরে দেখলাম গোস্বা ঘরের তালা বন্ধ দরজার সামনে পরে আছি। বুঝে নিলাম অন্তত গত রাতের এই ঘটনাকেও যেন স্বপ্ন মনে করে আবার একই ভুল না করি তাই আজ আর তিনি (জমিদার বাবুর ছোট বউ) আমায় কষ্ট করে আমার ঘরে পৌঁছে না দিয়ে এখানে ফেলে রেখেছেন ... যাক তাও যে বাঁচিয়ে রেখেছেন .. এতেই রক্ষে ...। ঘরে এসে ব্যাগপত্র গুছিয়ে ফেললাম ... আর এক মূহুর্থও এখানে নয় ...।
সব ঠিকঠাক ... কিন্তু টর্চলাইট টা পেলাম না কোথাও ...। ওটার আফসোস ছেড়ে দিলাম .. জার্মানিতে মামা কে আরেকটা টর্চলাইট পাঠাতে বললেই হবেক্ষন। তবে .. ভবিষ্যতে যদি কেউ আমার মত এই গোস্বা ঘরের রহস্য উৎঘাটন করতে এসে ওই টর্চলাইট আবিষ্কার করে ভ্যাবাচ্যাকা খায় তবেই জমবে মজা ... আর তার দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখটা কল্পনা করতে এখনই কেমন হাসি পাচ্ছে ...।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৭

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:

ভাইরে, শিউরে উঠলাম। ভূতে বিশ্বাস নেই তবুও ভয় চলেই আসে!

১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:৪৪

নাঈম ফয়সাল নয়ন বলেছেন: হাহাহা, তাহলে তো আমার লেখা সার্থক হয়েছে বলতে হবে। ধন্যবাদ ভাই।

২| ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫১

নাঈম জাহাঙ্গীর নয়ন বলেছেন: ভাই, আপনার গোস্বাঘর কাহিনী আমাকে ভয় পাইয়ে দিল, আর আপনি.....!!

এটা কি গল্প নাকি বাস্তব আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে....

দারুণ লিখেছেন, পরোটা পড়েই ছাড়ছি, মাঝেমধ্যে গল্পের মতো করে কল্পনায় ঘুরেছি
আমার ভয় লাগছে খুব

১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:১১

নাঈম ফয়সাল নয়ন বলেছেন: ধন্য হল এই অধমের লেখা। আর হ্যাঁ, নিছক গল্প, তবে ওই বাড়ি আছে। "মিয়ার দালাম" লিখে গুগ্লিং করলেই হবে।

৩| ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:১৬

শূন্যনীড় বলেছেন: খুব সুন্দর লিখেছেন,

ভালো লাগলো গোস্বাঘর আতংক!

১৪ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩২

নাঈম ফয়সাল নয়ন বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.