নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আকাশে দাঁগ কেটে যাই

ঝিনুকের মতো পরান খুলে দিয়েছিলাম যারে.........

শাখাওয়াৎ নয়ন

দু:খ ঘেরা সুখ আমার পদ্ম ঘেরা সর্পে। সুখেরা সব স্বর্গে যাবে কষ্ট রবে দর্পে। বন্ধুত্বে স্বাগতম: [email protected]

শাখাওয়াৎ নয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী: একজন উত্তরাধুনিক চলচ্চিত্রকার

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ ভোর ৪:৪৯

“বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম, সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর” লেখা দিয়ে শুরু হয় বাংলা চলচ্চিত্রের মূলধারার ছবি। প্রথম দৃশ্যে দেখানো হয়: নায়িকা ঘোড়া কিংবা গাড়ী থেকে নামছে(ক্লোজ শর্ট): নায়িকার থামের মতো বিশাল চকচকে দুটি পা আর স্ফিত নিতম্ব। তারপর দেখা যায়-দেখা যায়-দেখা যায় না ধরনের পোশাকে তার বক্ষ। কোনো রকম মান সম্মত কাহিনী ছাড়া, আংশিক সত্য, বাস্তবতা বিবর্জিত, অসুস্থ গাজাখোড়ী কল্পনা নির্ভর ছবি তৈরী হয়, যেখানে ধর্ষণ, অপহরণ, খুনাখুনিই কাহিনীর বিষয়বস্তু। সিনেমার নামে অশ্লীলতা, নায়িকা নামধারী একটা বেঢপ কিছুর নৃত্যের নামে উচ্চাঙ্গ নিন্মাঙ্গের কুরুচীপুর্ণ প্রদর্শন চলে, একটা রক্তমাখা প্লাষ্টিকের কাটা হাত নির্ভর ফাইটিং দৃশ্য। গোটা কয়েক টিনের তলোয়ার আর দু’একটি পুষ্টিহীন ঘোড়ার দৌড়াদৌড়িতে ভরপুর। যা একা কিংবা পরিবারের কাউকে নিয়েই দেখার মতো না। শহরের মোড়ে মোড়ে যাত্রা পথে সিনেমার নাম, পোষ্টার দেখলে বাবা-মায়েরা তাদের কোমলমতি শিশুদের চোখ ঢেকে দিতে বাধ্য হয়। সিনেমা হলগুলো যখন শুধুমাত্র নাম মাত্র কিছু দর্শক এবং ছাড়পোকাতে হাউসফুল। তখন সমাজের প্রকৃত অপরাধীরাই সিনেমার ভিলেন কখনওবা নায়ক চরিত্রের শিরোমনি হয়ে উঠছে। সিনেমার ওই সব ভিলেনরা সমাজের প্রতিনিধি হওয়ার জন্য দুষ্ট রাজনীতির সাথে হাত মেলাচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে চলছে বঙ্গ রজনীর এক তুঘলকি উপাখ্যানের বাস্তব শোডাউন।



এমন পরিস্থিতিতে ভালো ভালো সম্ভাবনাময় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা টেলিভিশন মিডিয়া কিংবা শর্ট ফিল্ম, আর্ট ফিল্মে কাজ করার কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। আর অন্যদিকে আরেক শ্রেনীর সিনেমা পাগল-বোদ্ধারা মেতে উঠেছে স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র (শর্ট ফিল্ম) নির্মানে। এরা মেধাবী শিক্ষিত শ্রেনী। তাদের ধ্যানে-জ্ঞানে-চেতণায় বদ্ধমূল বিশ্বাস “ভালো শর্ট ফিল্মই হতে পারে সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার। মানুষের সচেতনতাই বদলে দেবে সমাজ।”এই সপ্নচারী শর্ট ফিল্ম আন্দোলনকারীরা প্রতিবছরই দু’চারটি শর্ট ফিল্ম নির্মান করছে, তারা বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে তাদের ছবি নিয়ে হাজির হয়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ কোন এক বিবেচনায় নাম সর্বস্ব দু’একটি ধাতব পুরস্কার বগলদাবা করে দেশে ফিরে আসেন। সাড়া দেশ জুড়ে দেখা যায়, পড়া যায়, শোনা যায় এমন মিডিয়াগুলোতে ভূঁয়শী প্রশংসা হয়, দু’চারটি সিনেমা হলে দু’চার সপ্তাহ প্রদর্শিত হয়। দু’এক সপ্তাহ পরেই এই সব সিনেমার শো প্রেমিক যুগলদের প্রেম করার প্রত্যাশিত অন্ধকার জায়গায় পরিনত হয়। কারন ছবির নির্মান, ভাষা, রুচী, বিষয় সাধারণ মানুষের এ্যান্টেনার উপর দিয়ে চলে যায়। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে এই সব শর্ট ফিল্ম গুলোর আবেদন সহজে পৌছায় না। এইসব ছবিতে আবার কিছুটা রাজনৈতিক ফ্লেভার মিশিয়ে দিতে পারলে কিছুদিন সেন্সর বোর্ডে আটকে থাকে তাতেই পাওয়া যায় বিনা পয়সায় প্রচারনা। এইসব ছবির নির্মাতা, প্রযোজক, পরিচালকদের প্রাপ্তি শুধু তথাকথিত সিভিল সোসাইটিতে নাম লেখানো এবং বিভিন্ন মিডিয়াতে ইন্টারভিউ দেয়া। যেহেতু এই সব ছবিতে বিনিয়োগকৃত টাকা ফিরে পেতে নাভিশ্বাস উঠে যায় সেহেতু কয়েক বছর ক্ষ্যান্ত দিয়ে আবার তারা একই ভাবে ছবি তৈরীর কাজে নেমে পড়েন।



বাংলা চলচ্চিত্রের এমনই এক ক্রান্তিকালে হুমায়ুন আহমেদ, গিয়াস উদ্দীন সেলিম এবং মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অধিকতর সংখ্যক দর্শক শ্রেনীর জন্য ছবি বানানোর কাজে হাত দেন। ময়ুরী-ডিপজলরা যখন দেশের সিনেমা হলগুলো ছাপিয়ে মানুষের বিবেককে কাপিয়ে দিচ্ছিল। তখন হুমায়ুন আহমেদের একক প্রয়াস নরকের উনুনে চোখের জল ছাড়া কিছুই ছিল না। কিন্তু গিয়াস উদ্দীন সেলিম এবং মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অব্যহত প্রচেষ্টায় বাংলা সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া দর্শকরা আবার সিনেমা হলে ফিরতে শুরু করেছে। উপরোল্লিখিত তিনজন পরিচালক/ব্যক্তিত্ব সম্পুর্ন তিন ধরনের ছবি বানালেও দর্শকদের কাছে তাদের গ্র্রহনযোগ্যতা ঈর্ষণীয়।



হুমায়ুন আহমেদ যখন শাওন মেঘে ঢেকে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আর্বিভাব। তিনি সম্পুর্ন একটি আলাদা ঘরানার জন্ম দিয়েছেন বলে মিডিয়া জগতে নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। যাদেরকে ‘ফারুকী ভাই ব্রাদার্স’ বলে অন্যরা আলাদা করে। এখানে উল্লেখ্য “ছবিয়াল প্রযোজনার” ব্যানারে তিনি একদল তরুন মেধাবী সাহাবাদের নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। তারা অভিনেতা, গায়ক, গীতিকার, নাট্যকার, লেখক। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তাদের কাছে সিনেমা ধর্মের নতুন পথপ্রদর্শক, অবতার। ইতিমধ্যেই টেলিভিশন মিডিয়ায় তাদের নাটক ও সিনেমা বিষয়ক মতাদর্শ এমন ভাবেই প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, তাদের নাটক, টেলিফিল্ম ছাড়া টিভি চ্যানেল গুলো প্রায় অচল। এই সাহাবাদের মাঝে কেউ কেউ ফারুকী পরবর্তী যুগে খলিফা হিসাবে পরিগনিত হবেন বলে অনেকে মনে করেন, যেমন ইফতেখার আহমেদ ফাহমী, মোস্তফা কামাল রাজ প্রমুখ।



কোন গ্রেটই সমসাময়িকদের কাছ থেকে প্রশংসা পাননি, খুব একটা নন্দিত হননি। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তাদের মতাদর্শ বিরোধীরা সংখ্যায় বেশী হলেও বিষয় বৈচিত্রতা না থাকায় এবং সৃষ্টশীলতায় নপুংশুকতার কারনে ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ছেন। ফলে বিরোধী দ্বিগগজরা যারা কয়েকটি খাট কাঁপানো লম্ফ দিয়ে মনে করতেন দেশ কাপিয়ে ফেলেছেন, তারা একদিকে যেমন শৌর্য বীর্যহীন হয়ে পড়ছেন অন্যদিকে তারা একাকীও হয়ে পড়ছেন। তাদের অনুসারীরা এখন ফারুকী প্রবর্তিত ভিজুয়্যাল মিডিয়ার নতুন ধর্মে নাম লেখাচ্ছেন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বাংলা চলচ্চিত্রের কলংকের কালী ভরা, প্রায় ছিড়ে যাওয়া শাড়ীতে আর রিফু করেননি, নতুন করেই বুনন শুরু করেছেন।



মোস্তফা সরয়ার ফারুকী দেখতে অনেকটা অপদাতিক তালেবান হলেও কর্মে, আচরনে, ব্যক্তিত্বে ভীষন আধুনিক। চমৎকার উচ্চারনে জড়তাহীন ভাষায় কথা বলেন। নিজের স্বপ্ন, লক্ষ্য, উদ্দেশ্যের, সীমাবদ্ধতার কথা অকপটে বলতে দ্বিধা বোধ করেন না। প্রকাশে প্রচেষ্টায় একজন পরিপুর্ন পরিবর্তনমুখী তথা বিপ্লবী চরিত্রের অধিকারী। তিনি মানুষের মুখের কথা সিনেমায়, নাটকে ব্যবহারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশে একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘ভাষা সব সময় পরিবর্তনশীল একটি যোগাযোগ মাধ্যম। মানুষ চলতি/কথ্য ভাষার সাথে অনেক বেশী একাত্মতা অনুভব করে।’ তিনি “কি চমৎকার দেখা গেল, মালকা ভানু আইসা পড়লো” টাইপের এক ঘেয়েমী নাটক, সিনেমা থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন।



মোস্তফা সরয়ার ফারুকী শহুরে আধুনিক সমাজের মানুষের- যাদের বিনোদন ছিল হিন্দি ফিল্ম, ভারতীয় বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সিরিয়্যাল “কাহানী ঘার ঘার কি” “কিউ কি সাস ভি কাভি বহুথি” টাইপ অনুষ্ঠান। তাদেরকে বাংলা টিভি নাটক, সিরিয়্যাল দেখার প্রতি উৎসাহী করেছেন। তিনি ভাঙ্গা দেওয়ালে, শ্রমজীবি মানুষের ঘামে, অসচ্ছল পরিবারের টানা পোড়েনে, মানুষের সম্পর্কের বিভিন্ন মাত্রা ও বহুমুখীনতাকে তার শিল্প কর্মের উপজীব্য করেছেন। ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় অনেক অদেখা, মিথ্যার বস্তায় বেধে রাখা, ধর্মের পর্দায় ঢেকে রাখা সত্যের বিড়াল তিনি ছেড়ে দিয়েছেন, কখনও কখনও সমাজ সংসারের, রাজনীতির বাঘের গলায়ও ঘন্টা বেধেছেন। তিনি উপস্থাপন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিষাদ উপাখ্যান, বিজয়গাঁথার প্রচলিত পথে না হেটে পরাজিত মানুষের দু:খ, কষ্ট, বেদনার প্রতি তিনি সহমর্মী হয়েছেন। প্রতিবন্দীদের চাওয়া-পাওয়া বাস্তবতা, সুখ-সপ্নের সকরুন ভালোবাসার পরিস্ফুটন করেছেন। তিনি শিল্পের দীপ্তি ছড়ান; নি:শব্দে প্লাবন আনেন, শ্যামল উর্বর করে তোলেন শুষ্ক মনোভুমিকে। তিনি কখনও আকাশকে নামিয়ে আনেন মাটিতে আবার কখনও মাটির বলা না বলা আনন্দ বেদনাকে ছড়িয়ে দেন আকাশে। তার চিন্তায়, কর্মে আনন্দলোক, সত্য ও সুন্দরকে এক সূঁতোয় বাধেন। তিনি কবিকে নবতর সৃষ্টির প্রেরনা দেন আর সাধারন দর্শককে করে তোলেন কবি।



তিনি তরুন প্রজন্মের প্রেম, প্রতারনা, হতাশা, দু:খ ভালোবাসা নিয়ে ২০০৩ সালে ব্যাচেলর ছবি বানিয়ে বাংলাদেশের ছাত্র, তরুন সমাজের মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলেন। ২০০৭ সালে “মেইড ইন বাংলাদেশ” ছবিতে বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার এক বিদ্রুপাত্মক চিত্র তুলে ধরে সুধী মহলকে ভাবিয়ে তুলেছিলেন। স¤প্রতি তিনি নারী-পুরুষের উত্তরাধুনিক সম্পর্ক লিভ টুগেদার নিয়ে “থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার” ছবি বানিয়েছেন। এই ছবিতে তিনি মানুষের মনের বহুমুখী দ্বন্দ, চাওয়া, সুখ-দু:খ, অনুভুতি যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি ধর্ম, সমাজ, সম্পর্ক, নীতি-নৈতিকতার বন্ধনে পুরুষশাসিত সমাজে রুদ্ধ, একজন অবরোধবাসিনীর নি:সঙ্গ সংগ্রামী জীবন চলাকে চিত্রিত করেছেন। ছবিটি ইতিমধ্যেই, দক্ষিন কোরিয়ার বিশ্বখ্যাত পুশান এবং মধ্যপ্রাচ্য চলচিত্র উৎসবে ভুঁয়শী সুনাম অর্জন করেছে।



মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বৃষ রাশির জাতক, জন্মেছেন ১৯৭৩ সালের ২ মে ঢাকায়। বিপ্লবী, দার্শনিক কার্ল মার্কস, কবি রবীন্দ্রনাথ এবং চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ও বৃষ রাশির জাতক ছিলেন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী একজন উত্তরাধুনিক চলচ্চিত্রকার। তিনি বাংলা ছবির ডুবন্ত জাহাজকে উদ্ধারকারী জাহাজ বৃদ্ধ রুস্তমের দ্বারা উদ্ধারের চেষ্টা করেননি। তিনি সম্পুর্ন একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছেন। সচেতন মহল মনে করেন, সমালোচনার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে তার অবদান, মেধা এক কথায় ভালোত্ব টুকু কখনই পড়ে যাবে না। এই উত্তরাধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছে মানুষের প্রত্যাশার পর্বত হিমালয়ের চেয়েও উচু, মহাসাগরীয় বায়ুর মতো বেগবান। তিনি কি ব্রতী হবেন পদ্মা মেঘনা যমুনায় বহমান বাঙালীর সুখ-দু:খের ছবি বানাতে? এক বুক আশা নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে সমগ্র বাংলাদেশ ।



লেখক: গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসল, অষ্ট্রেলিয়া ।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.